প্রান্তস্বর/ ব্রাত্য ভাবনা : ক্ষমতা-কাঠামোর অ-পূর্ব ব্যাখান

সমাজের খোলনলচের মধ্যকার আন্তর সম্পর্ক বোঝার বড়ো উপায় সম্ভবত সমাজে জারি থাকা ক্ষমতা-কাঠামোর হদিস নেওয়া । কারণ সে-নকশাই আদতে বাতলে দেবে মনোযোগ্য সমাজ কিভাবে তার খোলনলচেসমেত ক্রিয়াশীল থাকে। বাংলাদেশের সমাজের এমন পাঠ-তৈরিতে তাই জরুরি সেই ক্ষমতার গড়ন কীভাবে নির্মিত, তা জানা । নিশ্চিত যে এ-হদিসে, এই পাঠ-তৈরিতে সর্বত্রই দৃশ্যমান হয় (হবে) প্রবল-প্রান্তিকের বাইনারি সাজ — কেন্দ্র-প্রান্তের বিষম উপস্থিতি। এই দুইয়ের ক্ষমতা-সম্পর্কই বুঝিয়ে দেয় কোন স্বরটি প্রবল হয়ে প্রান্তে ঠেলে দেয় আর-আর স্বরকে — তৈরি হতে থাকে এভাবেই প্রান্তস্বর ।

 

এই প্রান্তস্বর নিয়ে স-তর্ক আলাপের বই হিমেল বরকতের প্রান্তস্বর ব্রাত্য ভাবনা, যার পহেলা প্রবন্ধের নাম ‘চিরদুখী বাংলাভাষা ও প্রতারক ভাষাপ্রেম’ – নামেই আঁচ মেলে শুরুর আলাপ বাংলাভাষা নিয়ে । জন্মলগ্ন থেকেই প্রবলের অহংকারে এ-ভাষা ছিল উপেক্ষিত, প্রান্তিক। ‘সংস্কৃত পণ্ডিতদের কাছে বাংলা জানাটা ছিল দূষণীয়, অকৌলিন্যের’। সংস্কৃত ভাষার উপনিবেশ কাটাতে-না-কাটাতেই আরও একদফা বিকৃতি ঘটে গেল মুসলিম শাসনামলে, রাজভাষা ফারসির প্রতাপে । আরবি-ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশে ‘বাংলা ভাষার চেহারা সেখানে অবিকৃত থাকেনি’। আশরাফ শ্রেণির ‘পারস্যীয় আভিজাত্যে’ বাংলাভাষা হয়ে ওঠে ‘আতরাফ’, প্রান্তিক । এ-অবস্থার কোনো হেরফের বিট্রিশ ঔপনিবেশিক আমলেও ঘটে নি।

 

আপাতদৃষ্টিতে ভাষার যে-দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তনগুলো দেখা যায় আদতে সে-সব ঔপনিবেশিকতাকে টিকিয়ে রাখার রাজনৈতিক অভিসন্ধি থেকে জাত মাত্র। পাকিস্তান পর্বে আরও একদফা বিকৃতি ঘটে বাংলা ভাষার। স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে এমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায না, যেখানে বাংলাভাষার প্রান্তিক দশা থেকে ‍মুক্তি ঘটতে পারে। হিমেল বরকত তাঁর ‘চিরদুখী বাংলাভাষা ও প্রতারক ভাষাপ্রেম’-এ অনেকটা সবিস্তারেই ইতিহাসের নানান অভিক্ষেপ হাজির করে দেখিয়েছেন কী করে আজও বাংলাভাষা অপাঙক্তেয়ই রয়ে গেছে। হিমেল বলছেন, এই স্বাধীনতা-উত্তর কালেও বাংলাভাষার প্রান্তিক অবস্থান অপরিবর্তনীয় থাকার মূলে রয়ে গেছে আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণির ‘প্রতারক ভাষাপ্রেম’।

 

হিমেল বরকতের এ বইয়ের দোসরা প্রবন্ধ হলো ‘‘তোতাকাহিনী’র রবীন্দ্রনাথ’। সেখানে দেখানো হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মূলধারার একজন শ্রেষ্ঠ মনীষার শিক্ষা-ভাবনাও কেন্দ্রজনের মনোযাগ থেকে কতোটা দূর-অবস্থান, এবং উপেক্ষিত । কেন রবীন্দ্রনাথের আর সব চিন্তার জোর ‘প্রচার’ চললেও শিক্ষা-ভাবনা নিয়ে রা করেন না এ-কালের শিক্ষা-চিন্তকেরা?- তারই সুলুকসন্ধানে নেমেছেন লেখক । তোতাকাহিনী একটি শিশুতোষ রচনা রবীন্দ্রনাথের, তবু এর আখ্যানের মধ্যেই রয়ে গেছে ‘ঔপনিবেশিক শিক্ষা-কাঠামোর নানা অসারতার সূত্র’। রবীন্দ্রনাথ তো মূলত দেশীয় রুচি-আদর্শ-মানুষের সঙ্গে পরিচয়, সর্বোপরি প্রকৃতি থেকে শিক্ষা লাভকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। লেখকের ঝোঁক এরূপ শিক্ষা-ব্যবস্থার দিকে, কেননা এ-শিক্ষাভাবনাতেই রয়েছে ঔপনিবেশিকতাকে লঙ্ঘন করার তুমুল ডিসকোর্স, এবং বিঔপনিবেশায়নের (decolonization) বিপুল অংশভাক । তাই এ-ভাবনার দিকে হিমেলের এতোটা পক্ষপাত ।

 

এই ঔপনিবেশায়নের একচ্ছত্র চিন্তার বদৌলতে প্রভু-ভৃত্যের দ্বি-বিধ ক্ষমতাসম্পর্কটা আমাদের সমাজে পাকাপাকি শিকড় গেড়েছে । যার দরুন ঔপনিবেশিক প্রভুরা বিলাত পাড়ি জমিয়েছেন বটে, অথচ আমরা এ বাইনারির ঘর ছাড়তে না পেরে স্বতই বিভিন্ন অনুষঙ্গে পূরণ করে যাচ্ছি । ঠিক প্রভু-ভৃত্যের ক্রম মেনেই পুরুষ-নারী, পুরুষ কেন্দ্র – নারী ক্রমমাফিক অপর হয়ে প্রান্ত। আর তাই চন্দ্রাবতীর মূল্যায়ন এখনও পুরুষ-প্রবলের নির্বিচারিতায় প্রান্তঘেঁষা । লেখকের অভিযোগ, চন্দ্রাবতীকে শুধু ‘মধ্যযুগের একজন নারী কবি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে । তাতে কবি হিসেবে চন্দ্রাবতীর যে শক্তিমত্তা, তা রয়ে গেছে অনালোকিত। কবি চন্দ্রাবতীর কাব্যকৃতির নানান নজির টেনে ছোট্টো পরিসরে লেখক দেখিয়েছেন চন্দ্রাবতীকে কেন বিপুল আয়তনে আলোচনা জরুরি।

 

এ-প্রবন্ধের জোড় হিসেবে পড়া যেতে পারে ‘পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন ও সমাজ-মনস্তত্ত্ব’ প্রবন্ধটি। এ-প্রবন্ধে লেখক কাজ করেছেন সংবাদপত্রে প্রকাশিত পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন নিয়ে – নারী সেখানে নিতান্তই পুরুষের ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিজ্ঞাপিত, পুরুষ সেখানে কেন্দ্রের ক্ষমতাবলে তার লিঙ্গসত্তা নিয়ে হাজির; আর এ হাজিরার সাপেক্ষ এতোটা সজোর যে নারী সে-বিজ্ঞাপনে পুরুষের নির্মাণের বাইরে আর কোনও মানবীয় সত্তা হিসেবে গণ্যই হয় না। নারী নিয়ে পুরুষের এই নির্মাণকে হিমেল ঠিক সমাজতাত্ত্বিকের গবেষণার তরিকায় তথ্য-তত্ত্বসমেত দেখিয়েছেন তাঁর ‘পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন ও সমাজ-মনস্তত্ত্ব’-এ ।এ-প্রবন্ধের ভঙ্গি এবং নির্যাস একজন সমাজতাত্ত্বিকের। যেখানে বিভিন্ন তথ্যকে নানান ছকভুক্ত করে হিমেল দেখিয়েছেন নারী কী করে হয়ে ওঠে ‘অপর’, প্রান্তিক, পুরুষের এক-অন্ত নির্মাণ।

 

‘তৃতীয় লিঙ্গ’, মানে লোকমুখে যাকে ডাকা হয় হিজড়া ।প্রবল তার প্রান্তিক দল হিসেবে ঘোষণা করেছে নারীকে । আর দলবল ছাড়ি একা, বড়ো ‘অপর’ হলো এই ‘তৃতীয় লিঙ্গ’। এই তৃতীয় লিঙ্গ নিয়ে তিনটি উপন্যাসের একটা সরল পাঠ তৈরি করেছেন হিমেল তাঁর ‘‘তৃতীয় লিঙ্গ : তিনটি উপন্যাস’ প্রবন্ধে । সেখানে ঐ তিনটি উপন্যাস উছিলা, হিমেলের লক্ষ্য দেখানো, যাকে বলা হচ্ছে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’, সমাজের কেন্দ্রীয় বল কী করে রীতি-প্রথার প্রাবল্যে ঐ লিঙ্গের মানুষজনকে অপর/অধস্তন হিসেবে নির্মাণ করে ।এই নির্মাণের একটা সমাজতাত্ত্বিক পাঠ তৈরি করা হয়েছে তিন আখ্যানকে উপলক্ষ্য করে । ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ নামকরণ নিয়ে হিমেল ভীষণ হুঁশিয়ার, উদ্দীপিত মন্তব্যও করেছেন, ‘তৃতীয় বিশ্বের মতো ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ শব্দবন্ধের গায়েও লেগে আছে প্রান্তিকতার ধুলো, অধস্তনতার চিহ্ন।’

 

কবিতা নিয়ে, তার ব্যবহার-উপযোগিতা নিয়ে বিস্তর কথা হয়েছে, হচ্ছে ।কবিতাকে কেউ কেউ নন্দনতত্ত্বের বাইরে সমাজ-প্রসারিত করতে চাননি, কেউ কবিতাকে তার সংগ্রামের হাতিয়ার করতে চেয়েছেন। কেউ নন্দনতত্ত্বের জোরে পরিচিত আয়তনকে এক অপরিচিতকরণের মধ্য দিয়ে পাঠের আনন্দ খুঁজে নিতে চেয়েছেন। হিমেল এসব ‘বুর্জোয়া নন্দনতত্ত্ব’কে আমলে না এনে, বরং তাদের প্রবল সমাচারে যা পাতযোগ্য মনে করা হয় নি, সেই ‘পথকবিতা’কে পড়তে চেয়েছেন আরও সরব উচ্চারণে। তাই এই পথকবিতা নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন ‘‘পথকবিতা’ : সমাজ-ধর্ম-রাজনীতি’। সুপ্রচুর কবিতার চরণ তুলে এনে লেখক দেখিয়েছেন, বুর্জোয়া মুখে যা রোচে না, তা আদতে আমাদের গোটা সমাজের প্রতিভূ হিসেবে কতোটা প্রমূর্ত।এই চিন্তার আদল দিয়ে একেবারে পড়ে ফেলা যাবে ‘আদিবাসী কবিতায় স্বাধীকার ও সংগ্রাম’ ও আখেরি প্রবন্ধ ‘কাব্যে ও গানে সুন্দরবন’ প্রবন্ধটি। এই তিন প্রবন্ধ তো আসলে সহচরী। একই চিন্তার উৎসমূল দিয়ে গ্রন্থিত।

 

জাতীয়তাবাদ তার প্রবলতাপ্রবণ রূপ থেকেই আর সব জাতিসত্তাকে করে তোলে দূর-প্রান্তিক, উন্মূল, অনিকেত । তাই বাংলাদেশের কবিতা সংকলনে ঠাঁই হয় না একই ভূখণ্ডের নাগরিক আদিবাসী কবিতাগুচ্ছের। লেখক তীব্র সশ্লেষে বলছেন  ‘বাংলাদেশের কবিতা : আধিপত্যের রাজনীতি’-তে, এ-সব সংকলক বা গবেষক তাদের সংকলনের/গবেষণার নাম দিতে পারে ‘বাংলাদেশের বাঙালি নাগরিক কবিদের কবিতা’। এ-শ্লেষের মোদ্দাকথাই হলো সে-সব সংকলনও রাজনৈতিক দ্বি-বিধ কেন্দ্র-প্রান্তের বাইনারিমুক্ত নয় ।

 

‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ প্রবন্ধে হিমেল বরকত কথা বলেছেন মাহবুব উল আলমে কবিতায় বিবৃত রাজনৈতিক ইতিহাসের স্বরগুচ্ছ নিয়ে ।

 

প্রান্তস্বর ব্রাত্য ভাবনায় হিমেল বরকত বস্তুত প্রান্তস্বরগুলোকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন, উন্মূল করে নয়, বরং সে-স্বরের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতাসহ। তাই ক্ষমতা-কাঠামোর অসম বিন্যাসে যেখানে কর্তাঅংশ প্রবল হয় ওঠে, সেখানেই কথা বলে উঠেছেন হিমেল বরকত । দেখিয়েছেন প্রান্তের যাপন কতোটা লিপ্ত হয়ে আছে কেন্দ্রকে তুমুল অস্বীকৃতি ঘোষণার মধ্য দিয়ে । আর এ-সব ঘোণষার/বেদনার/বিক্ষোভের অ-পূর্ব ব্যাখ্যান-ঋদ্ধ হিমেল বরকতের প্রান্তস্বর ব্রাত্য ভাবনা গ্রন্থটি ।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here