বায়োগ্রাফিক্যাল ফিকশন বা আত্মজৈবনিক কথাসাহিত্য — যখন ফুটিল কমল। লেখার পরিণতি কী দাঁড়াবে লেখক নিজেই তা ভালো বলতে পারবেন। জাহিদুর রহিম চমৎকার গদ্যে উপহার দিয়েছেন জীবন ও দর্শনের মৌলিক প্রশ্ন ও উত্তর।
জীবন সংকটপূর্ণ হয়ে গেছে তার মানে এই নয় যে এটি ভালোবাসা নয়। জীবন সংকটপূর্ণ ও কঠিন হয়ে পড়ে মূলত তোমাকে এটা দেখাবার জন্য যে ভালোবাসা কত দৃঢ় ও মজবুত, ঠিক ডায়মন্ডের মত। — লিও গুরা
হতাশা এমন সাংঘাতিক হতে পারে আগে জানা ছিল না। আমার বুকের ভেতরটা কেমন ধুকপুক করছে। অদ্ভুত চাঞ্চল্য জাগছে আমার শরীরে। আমার হৃদয় রক্তাক্ত, ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে সব। মন কারো সান্নিধ্য চাইছে না, সঙ্গ চাইছে না, চাইছে না কাউকে দেখাতে মনের জখম, নিষ্পাপ অশ্রু। মনে হচ্ছে কোথাও যেন ভয়াল এক নদীতে চলছে দারুণ এক ঘূর্ণি। সেই ঘূর্ণিতে ক্রমে ভেঙে পড়ছে পাড়।
আমি আমাকে কিছু একটা বলতে চাই, অনুকম্পার, সান্ত্বনার, দয়ার কথা কোন কথা, কিন্তু সাহস হচ্ছে না। কী ভেঙে দিচ্ছে আমাকে, কীসের অনটন আমার? আমার মুখ আর চোখে জ্বালা করছে। মনে হচ্ছে চোখ থেকে বের হবে আগুনের হল্কা। মনে হচ্ছে মাথার ভেতরে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণে সব কিছু উড়ে যাবে। মনে হচ্ছে দূরে কোথাও বরফ ঢাকা পাহাড়ের গুহায় আমার চোখ দুটোকে লুকিয়ে রেখে আসি, অনন্ত কালের জন্য।
আমি এখন যেন কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না। সবই যেন মৃত্যুর রক্তদীপময় অন্ধকারে আচ্ছন্ন। দাড়ি কাটাতে গেলেও ভয় পাই, ভাবি যদি ক্ষৌরকার গলায় শাণিত ক্ষুর বসিয়ে দেয়। রাস্তায় হাঁটতে ভয় পাই, যেন এখনই কেউ চাপা দিয়ে দেবে। বাঁচার জন্য শ্বাসবায়ুর অনুসন্ধান করে চলেছি আমি নৈঃশব্দের নির্জনতায়। শব্দহীন পৃথিবীর সঙ্গলাভের লিপ্সায় মানুষের সংস্পর্শ ত্যাগ করতেও আমি আজ কুণ্ঠাহীন। আমার বন্ধু নেই, মা নেই, স্ত্রী নেই, পরিবার পরিজন নেই — আছে শুধু বিষণ্ণতা। যেন ‘নো ম্যানস্ ল্যাণ্ড’-এর চিরবিষাদসিন্ধুর তটভূমিতে নক্ষত্রহীন অমানিশার মধ্যে আমি অনুভব করতে চেয়েছি জীবনের শুদ্ধতম রূপকল্পকে। আমি যেন চির বিষণ্ণতার দার্শনিক।
আমার এই হতাশার জন্য তো আমি দায়ী নই। অবশ্যই আমি একটা নিষ্কলুষ মন আর নিষ্কলুষ শরীরে জগতে এসেছিলাম। আমার বেড়ে ওঠার সব পর্যায় আমাকে হতাশ আর ভণ্ডে পরিণত করেছে। এই সমাজে বেড়ে ওঠার অর্থ হল, ‘এক একটি ভণ্ডে পরিণত হওয়া এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মতো মিথ্যাচার করা’।
এই মিথ্যাচার কি কেবল ব্যক্তি করে? ব্যক্তি তো রাষ্ট্রের ছায়া। রাষ্ট্রের প্রতিটি পর্যায়ে যেই লক্ষণ থাকে ব্যক্তির জীবনে তাই থাকে। কনফুসিয়াস বলেছিলেন , ‘রাজা যদি মহৎ হন জনগণও মহৎ হবে, যদি রাজা চোর হন, তাহলে জনগণও চোর হবে, রাজা যদি হত্যার মধ্যে দিয়ে শাসন টিকিয়ে রাখে, তাহলে রাজ্যে হত্যাকাণ্ড ছড়িয়ে পড়বে। যদি রাজা অনিরাপদ হন, তাহলে রাজ্যে ধর্ষণ, দুর্নীতি, লুটপাট বেড়ে যাবে। রাজার চরিত্র হচ্ছে হাওয়া আর জনগণের চরিত্র হচ্ছে ঘাস। ঘাসের উপর দিয়ে যখন বাতাস বয়ে যায়, তখন সব ঘাসেই সে হাওয়া এসে লাগে।’ এই বাজে হাওয়া আমার জীবনে এসে লেগেছে। সব এলোমেলো হয়ে গেছে। আমি আমাকেই ভুলে আছি এই জীবনে। কেবল কীসের যেন এক অপেক্ষা, কীসের অপেক্ষা তাও নিশ্চিত জানি না।
মুখ চোখে পানি দিতে ওয়াস রুমে ঢুকলাম। আয়নায় যে মুখ দেখলাম সেদিকে তাকানো যাচ্ছে না, হতাশার বেদনায় বিকৃত হয়ে গেছে। প্রায় মূর্ছিতের মতো আমার দিকে তাকিয়ে আমি হাসলাম, অপ্রকৃতস্থ কান্নাভেজা হাসি। খুব দুর্বল লাগছে নিজেকে। মনে হচ্ছে আমি দীর্ঘ এক পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি, বরফে ভেজা, ঠান্ডা হাওয়ার পথ। বিধ্বস্ত ক্লান্ত পরিত্যক্ত মনে হচ্ছে নিজেকে।
মনে হচ্ছে জীবনের এক সত্যকে খুঁজে পেয়েছি আমি। এক নির্মম, জঘণ্য, বিষণ্ণ সত্য। এমন কোন সত্য যা খুঁজে পেলে মানুষ একা হয়ে যায়, এমন সত্য যা খুঁজে পেতে গেলেও একা হয়ে যেতে হয়। আমি জানি, ‘প্রত্যেক মানুষের দুঃখই তার আপন স্বভাবের মত স্বতন্ত্র ; কেউ একাকিত্বকে ঘৃণা করে, আর কেউ আমৃত্যু একাকিত্ব খুঁজে বেড়ায়।‘ (মির্জা গালিব)
লেভ তলস্তয়কে তাঁর এক দাদা শৈশবে বলেছিলেন বাড়ির কাছের জঙ্গলের মধ্যে একটা সবুজ লাঠি লুকোনো আছে। সেটা খুঁজে পেলে পৃথিবীতে কোনো দুঃখকষ্ট থাকবে না। দাদাটি অকালেই মারা যান। শিশু তলস্তয় জঙ্গলে খুঁজতেন সেই লাঠিটা। পাননি। পরে নিজের অগাধ লেখালেখির জঙ্গলেই তিনি শুধু সেই লাঠিটাই খুঁজেছেন। আনা কারেনিনা সেই সবুজ লাঠির সন্ধান পায়নি, নেখলিউদভ পায়নি, নাতাশা পায়নি, রস্তভ পায়নি, প্রিন্স আন্দ্রুও পায়নি। বৃদ্ধ তলস্তয়, কামবাসনা থেকে পালিয়ে বেড়ানো তলস্তয়, চার্চ থেকে নির্বাসিত তলস্তয়, স্ত্রীর সঙ্গে কলহ করে পালিয়ে আসা তলস্তয় একটা অনামা স্টেশনে অসহায় মারা গেলেন। পরে সেই স্টেশনের নাম ‘তলস্তয়’ রাখা হয়েছিল। নামটা সেই সবুজ লাঠিও হতে পারত তাতে মানে একই থাকতো।
অন্যদিকে দেখুন, তাঁর সমসাময়িক এবং আরেক অবিনশ্বর সাহিত্যিক ফিওদর দাস্তয়েভস্কিকে কেউ সেই সবুজ লাঠির কথা তাঁর শৈশবে বলেনি। অথচ, তাঁর প্রত্যেক কালজয়ী উপন্যাসের প্রকৃত গন্তব্য সেই আশ্চর্য অরণ্য, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে সেই সবুজ লাঠি। প্রিন্স মিশকিন, তার সন্ধান কি পায়? কিংবা, সে নিজেই হয়ে ওঠে সেই সবুজ লাঠি, সেই যিশুতুল্য মানুষ, সমাজ যাকে পায়, কিন্তু শুধু হারিয়ে ফেলার জন্যই পায়।
আমি ভেবে দেখলাম জীবনের সুখ আর আনন্দের উপকরণ খুঁজে খুঁজে এক অন্তহীন শূন্যতা ছাড়া আমি কিছুই পাইনি। বরং সারাটা জীবন আমি কেবল হারিয়ে এসেছি। শুধু হারিয়েছি। আমি হারিয়েছি সময়, হারিয়েছি বন্ধু-স্বজন, হারিয়েছি টাকা আর স্বাস্থ্য। তাহলে কেনই বা খুঁজেছি। মনে হচ্ছে সারাজীবন আমি একটা খেলা খেলেছি। এক অবুঝ খেলা। ভুল খেলা। সুখের খেলা। আমি এক ফাঁদে পড়ে গেছি। জীবনের ফাঁদ। এক স্বপ্নের ফাঁদ। এই জীবন আর স্বপ্ন আমাকে শিখিয়েছে সারাক্ষণ সুখ খুঁজতে। শুনিয়েছে সুখের জন্য হাহাকারের বিরামহীন একঘেয়ে এক যন্ত্রণাদায়ক দাম্ভিক সঙ্গীত। কিন্তু আমিও তো অ্যালব্যের কামুর মতো এ কথা মনে করি ‘যদি তুমি সারাক্ষণ সুখের উপকরণ খুঁজতে থাকো তবে কখনোই সুখি হতে পারবে না। যদি তুমি সারাক্ষণ জীবনের মানে খুঁজতে থাকো তবে জীবনকেও বুঝবে না।’
এ পর্যন্ত বেঁচে থেকে আমি বুঝেছি, কোন কিছু ছাড়া শুধুই বেঁচে থাকাও নেহাত মন্দ নয়। এই যে আমি আছি , চারপাশের অসংখ্য দৃশ্যের মাঝে — কী অসাধারণ এই থাকা! এই বাতাস, এর মাঝে কত হাজার বছরের মানুষের আনন্দ-বেদনার নিঃশ্বাস। মনে হয় আমি দুঃখ-সুখ ভোগী স্বল্পায়ু জীব নই। নিযুত বর্ষার সিক্ত বাতাসের ঘ্রাণে আমি আছি , অনন্ত বসন্তের বাগানে আমিও আছি। মনে হয় শুধু জীবনটা উপচানো আয়ুর দ্রবণ। অসংখ্য জীবনের যোগসূত্র এই জীবনের সব চাওয়া গুলোকে তুচ্ছ করে দেয়।
আজ আমার এই জমাট হতাশার অন্যতম কারণ আমার সম্পর্কে আমার ধারণা সম্পূর্ণ বিপরীতে পাল্টে যাচ্ছে। নিজের সম্পর্কে তো আমার উঁচু ধারণাই ছিল। ভাবতাম আমি এক উঁচুমানের মানুষ। ভাবতাম সবকিছু আমাকে ব্যাখ্যা করে বুঝাতে হয় না। আমি অল্পতেই বুঝে যাই। আর আজ আমার বিমর্ষ, অস্থির আর অবিশ্বাসে ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে জ্বল জ্বলে এক জোড়া জীবন্ত চোখ আমাকে মনে করিয়ে আরেক অভিমান। বলে দিচ্ছে জীবনে শোনা যে সব কথার জাল আমাকে স্বপ্নের ফাঁদে ফেলেছে তাকে আমি ঘৃণা করি।
আমি হয়ত খুঁজেছি সারাজীবন একটু শান্তি। আমার শান্তির বিনিময়ে দুনিয়া জাহান্নামে গেলেও আমার কিছু যায় আসে না। আমার একটুকরো শান্তির জন্য দুনিয়া বিক্রি করে দিতেও আমার আপত্তি নাই। ঠিক যেভাবে দুনিয়া তার ভোগ, বিত্ত ও অনায্য সাম্রাজ্য বাড়ানোর জন্য আমার জীবনকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে, একটু একটু করে। সন্দেহ নেই আমি ইতর, নীচ ও অহং-সর্বস্ব মানুষ কিন্তু আমার জীবনের প্রতি সমাজের তৈরি যে মিথ্যা ফাঁদ , এই অপমান আর ভেঙ্গে ফেলার ফাঁদ এসবকে আমি ক্ষমা করতে পারিনা। বিস্তর বই পুস্তক পড়ে যেসব বিদ্যা আমি আমার মধ্যে ধারণ করেছিলাম সেসব হঠাৎ মিথ্যা মনে হচ্ছে। অপমান ও বিধ্বস্ত মন জুড়ে অধিকার করে আছে ঈর্ষা ও প্রতিহিংসার আগুন। ডুবন্ত মানুষ যেভাবে খড় কুটোর সাহায্যে বেঁচে থাকতে চায়, আমিও, ইঁদুরের গর্ত হতে বেড়িয়ে আকাশ ছুতে চাই। বিকল্প প্রভুত্ব, বিকল্প শ্রেষ্ঠত্বের একটা মৃদু আলো আমার মনের মধ্যে গোপন আলো ফেলছে। আমি বুঝে ফেলেছি জীবন কি সরল আর বাহুল্যহীন হতে পারে। কত কম কিছুতে আমার জীবনটা চলতে পারতো। অথচ আমি স্বপ্নের মিথ্যা ফাঁদে কত জটিল বানিয়েছি, গড়ে তুলেছি হতাশার প্রাসাদ।
অথচ আমি তো এ কথা শুনেছি, ‘জীবন সাহিত্যের চেয়ে উত্তম, বন্ধুত্ব দর্শনের চেয়ে মিষ্টি আর শিশুদের হাসি যে কোন সুমধুর সংগীতের চেয়ে অনেক বেশি মর্মস্পর্শী! আমাদের চারপাশের এই সব জীবন্ত সুন্দর বিনয়ী ও সুশোভিত জীবনের জন্য যথেষ্ট । কিন্তু মানুষ যেহেতু খোঁজে দুর্বোধ্য বিকল্প , তাই তাঁর প্রয়োজন বই “(দ্যা গ্রেটেস্ট মাইন্ড অফ অল টাইম, উইল ডুরান্ট )। জিবরানের মতো আমিও ভাবি, ‘আকাঙ্ক্ষাহীন জীবন অন্ধকার ,জ্ঞানহীন আকাঙ্ক্ষা অন্ধ, কর্মহীন জ্ঞান বৃথা,ভালোবাসাহীন কর্ম নিস্ফল।’ (দ্যা প্রফেট)
ভাবি আমি, আমার আজকের এই হতাশার কারণ কি তবে আমার জীবন ছিল আকাঙ্ক্ষাহীন? তাহলে যেই আকাঙক্ষা নামে কোন কিছু আমাকে শেখানো হয়েছিল সেই গুলো কী ছিল? আমাকে জীবন যেই রঙিন চশমা পরিয়ে দিয়েছিল সেই চশমার বাইরের জীবনটা যত বিবর্ণ হোক, সেই ছিল আমার জীবন। আমি জীবনের আয়নায় সেই জীবনের প্রকৃত রূপ কখনো দেখিনি। আজকের এই হতাশা যত তিতা হোক, যত অপছন্দের হোক, আমি এই হতাশার কাছে কৃতজ্ঞ।
আপনারা যদি আমাকে এখন পাগল মনে করেন আর এই কথাগুলোকে পাগলের প্রলাপ ভাবেন, তবে আপনাদের আমি শুনাই কী করে আমি পাগল হলাম, ‘অনেক আগে,যেন দুনিয়া তৈরির আগে, দেব-দেবী তৈরির আগে, একদিন আমি গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠি। খুঁজতে থাকি বালিশের পাশে রাখা মুখোশ। পাই না। আমার সব মুখোশ চুরি হয়েছে। সাত জনমের সাতটা মুখোশ । মানুষ ভরা রাস্তায় মুখোশহীন দৌড়তে দৌড়তে চিৎকার করতে লাগলাম আমি ‘চোর সব নিয়ে গেছে, অভিশপ্ত চোর।’
রাস্তার সব মানুষ নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, সবাই হাসতে থাকলো। কিছু লোক আমাকে ভয় পেলো, কেউ কেউ দৌড় দিয়ে নিজেদের ঘরে ঢুকে গেলো। হঠাৎ শুনি একটা ঘরের মাধ্য থেকে এক যুবক চিৎকার করছে আর কাঁদছে, আর বলছে, ‘সে একটা পাগল লোক।’
আমি, তার দিকে তাকালাম, আর দেখতে পেলাম, সূর্য প্রথমবার আমার শরীরে আজ আলো ছুঁয়ে প্রথমবার উলঙ্গ দেহে মায়া দিলো। আর আমার হৃদয় ভালবাসার দ্যুতিতে জ্বলে উঠলো সূর্যের চেয়েও প্রখর হয়ে। আমার মন থেকে আর মুখোশগুলারে পেতে চাইলাম না আমি। ভিতর থেকে একটা কান্নার স্বর আর অদ্ভুত বিলাপ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আমি বলতে লাগলাম, ‘শুকরিয়া সেই চোরের যে চুরি করেছে আমার মুখোশ।’ সম্ভবত এইভাবে আমি পাগল হয়েছিলাম।‘
আসলে জীবনের সব দুর্ভোগ দুর্ভাবনা আর হতাশা এসব আমাদের জীবনের প্রকৃত শরীর দেখিয়ে দেয়। আসলে হয়ত এই জীবন আর পৃথিবী সবটা একটা বড় পরিকল্পনার অংশ। বড় পরিকল্পনা। ‘এই দুনিয়ার ঘটনাবলিতে আছে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার হিসাব। এক ফোটা দরদের, একটা কণা পরিমাণ শয়তানির, উভয় তরফের বদলাবদলি হবেই। অন্যের গোপন পরিকল্পনা, প্রতারণা বা চালাকির ব্যাপারে ভয়-চিন্তা করে লাভ নেই। কেউ একটা ফাঁদ বানালে, অন্য কোথাও তার জন্যে হয়ত কেউ ফাঁদ বানাচ্ছেন। ‘বিশ্বজগতের প্রতিপালক সবচেয়ে বড় পরিকল্পনাকারী।’ একটা পাতা নড়ার খবরও তাঁর কাছে আছে। আর তিনি যা কিছু করেন তা সুন্দর করে করেন (শামস তাবরিজি রহ.)।
আমি হতাশাগ্রস্ততার শেষ সীমায় দাড়িয়ে বুঝেছি, জীবনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে প্রয়োজন সর্বদা আমাকে তাড়া করে — সেটা আরেক প্রয়োজন। এবং সেই প্রয়োজন আমার সব হতাশার জননী। আর এই কথা মনে হতেই এক মরুভূমি তৃষ্ণা আমার সকল চেতনা আচ্ছন্ন নিরে নিলো। ক্লান্ত আমি দূর থেকে শুনতে পাচ্ছি ভীষণ এক অরণ্যের ছায়ায় নেচে বেড়ানো এক ঝর্ণার গান। শ্যামলিমাময় স্নিগ্ধ শান্ত এক হ্রদ আমার অপেক্ষায়। গোধূলি অতিক্রম হয়েছে আগেই। সারা আকাশ ভেসে যাচ্ছে চাঁদের হাসিতে। তৃষ্ণার তাড়নায় সব ভেঙেচুরে আমি যাচ্ছি হ্রদের কাছে। ঘন ঘন পড়ছে আমার নিঃশ্বাস শরীরের সব স্নায়ু সজাগতার শেষ প্রান্তে। আমি হুড়মুড় করে হ্রদের কিনারায় গিয়ে পড়ে গেলাম।
আজলা ভরা পানি নিয়ে পাগলের মতো পান করতে লাগলাম। হঠাৎ হ্রদের পানিতে দেখি চাঁদের প্রতিবম্ব। এক মুহূর্তে আমার জীবনের সব হতাশা যেন দমকা এক বাতাস নিয়ে নিলো। মনে হলো এই বিষাদময় জীবনে আমি একা নই। মনে হলো এমন জীবন আমার আগে কাটিয়েছে আরও কেউ। এই বাতাসে যে ফেলেছে শ্বাস, এই পানিতে যে ভেঙ্গেছে তৃষ্ণা। সেদিনও হয়তো এমন চাঁদ ছিল আকাশে। সৌভাগ্যবান তো সেই যে পানির খোঁজে হ্রদের কাছে এসে দেখতে পায় চাঁদের প্রতিবিম্ব।
(চলবে)
পড়ুন ।। কিস্তি : ৫