নগুগি ওয়া থিওঙ্গো সাহিত্য ও রাজনীতির দুনিয়ায় চেনা একটি নাম। তাঁর বিখ্যাত বই Decolonising the Mind: The Politics of Language in African Literature (1986)। ঔপনিবেশিক রাজনীতি, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি বোঝার দারুণ প্রতিনিধি-পুস্তক এই বই। বইটি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করবেন শিবলী নোমান।
আফ্রিকান কল্পকাহিনির ভাষা
চার
এই (বিংশ) শতাব্দীর প্রথম দিকে শুরু হওয়া আফ্রিকান উপন্যাস ও এর উন্নয়ন প্রভাবিত হয়েছে দুইটি বিপরীতমুখী বিষয় দ্বারা।
উপন্যাসের জন্মের সাথে যুক্ত ছাপাখানা, প্রকাশনা সংস্থা ও শিক্ষামূলক প্রেক্ষাপটগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতো মিশনারি ও ঔপনিবেশিক প্রশাসন। আফ্রিকান উপন্যাসের প্রথমদিকের চর্চাকারীরা–বিশেষত দক্ষিণ আফ্রিকায়–ছিল মিশনারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া যারা তলস্তয়, বালজাক কিংবা ডিকেন্সের চেয়ে বানিয়ানের পিলগ্রিম’স প্রগ্রেস ও কিং জেমস কিংবা বাইবেলের প্রামাণ্য সংস্করণের সাথে বেশি পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে যখন বিদ্যালয়ের পাঠাগারগুলোতে উপন্যাস রাখা হয়েছিল তখন উপন্যাসগুলো নির্বাচন করা হয়েছিল খুব সাবধানে যেন উপন্যাসের বিপজ্জনক, অনাকাঙ্ক্ষিত ও অগ্রহণযোগ্য বিষয়গুলো কচি বয়সের ছেলে-মেয়েদের প্রভাবিত করতে না পারে। আমার মনে আছে এক সকালের সমাবেশে অ্যালায়েন্স হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক অ্যালান প্যাটনের উপন্যাস ক্রাই দ্য বিলাভড কান্ট্রি-র সৌন্দর্য ও মর্যাদা নিয়ে বক্তৃতা করছিলেন যে উপন্যাসের নায়ক হলো আঙ্কেল টম নামের এক অহিংস দাসভাবাপন্ন খৃস্টান আফ্রিকান। আর তার কিছুক্ষণ পরেই প্রধান শিক্ষক অ্যালান পাটনের সমালোচনা করেছিলেন টু লেইট দ্য ফ্যালারোপ উপন্যাসে দক্ষিণ আফ্রিকায় সাদা ও কালো মানুষের ভেতর যৌনসঙ্গমের সিকোয়েন্স রেখে বিপথগামী হওয়ার জন্যে। প্রথম দিকের আফ্রিকান উপন্যাসগুলো এমন পরিস্থিতিতে রচিত হয়েছিল। এগুলো মূলত বাইবেল থেকে এর ভাবধারা ও নৈতিক চিন্তা গ্রহণ করতো বা তাকে আশ্রয় করতো। কিন্তু এ ধরনের উপন্যাস আসলে ছিল সরকার ও মিশনারি নিয়ন্ত্রিত ছাপাখানাগুলোর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নীতিমালা থেকে উৎপাদিত। রোডেশিয়ার লিটারেচার ব্যুরো সেসব আফ্রিকান উপন্যাসই প্রকাশ করতো যেগুলো হয় ছিল ধর্মীয় বিষয় নিয়ে অথবা রাজনৈতিক বিষয়াদি মুক্ত সমাজতাত্ত্বিক বিষয়কে কেন্দ্র করে। পুরানো পৌরাণিক কাহিনী ও গল্প প্রকাশ করা যেত। উপনিবেশ পূর্ব জাদু এবং প্রথাগত চর্চার পুনর্নির্মাণ করা যেত। কথা বলা যেত উপনিবেশ পূর্ব সময়ের অন্ধকার থেকে বর্তমান খ্রিস্টানত্বের আলোয় উদ্ভাসিত চরিত্র নিয়ে। কিন্তু ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে অসন্তোষ নিয়ে কোন আলোচনা বা সে ধরনের কোন আভাস এসব উপন্যাসে কোনভাবেই দেয়া যেত না।
দ্বিতীয় বিপরীতমুখী বিষয়টি ছিল পঞ্চাশের দশকের শুরুতে আফ্রিকান মাটিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়গুলোর উদ্ভব (বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একই ধরনের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ছিল একটি সমান্তরাল আন্দোলন)। উগান্ডার মাকারেরে ইউনিভার্সিটি কলেজ, নাইজেরিয়ার ইবাদান ইউনিভার্সিটি কলেজ এবং ঘানা ইউনিভার্সিটি কলেজ, সবগুলোই ছিল ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের বৈদেশিক মহাবিদ্যালয়। এসব মহাবিদ্যালয়ে পূর্ণাঙ্গ ইংরেজি বিভাগ ছিল। এর ফলে প্রথমবারের মতো একদল আফ্রিকান শিক্ষার্থী গড়ে উঠলো যারা কিং জেমসের বাইবেল কিংবা বানিয়ানের পিলগ্রিম’স প্রোগ্রেস-এর চেয়ে বেশি কিছু সামনে পেল। তারা রিচার্ডসন থেকে জেমস জয়েসের ইংরেজি উপন্যাস পড়েছিল। তারা আমেরিকান, ফরাসি এবং রুশ উপন্যাসের সাথে পরিচিত হয়েছিল, কিংবা এ ব্যাপারে অন্তত সচেতন ছিল। তারা আরও পড়েছিল জোসেফ কনরাড, জয়েস ক্যারি অথবা অ্যালান প্যাটনের মতো ইউরোপীয় ঔপন্যাসিকদের, যাদের অনেকের রচনার বিষয়বস্তু ছিল আফ্রিকা। এসব ইংরেজি বিভাগের অনেকগুলোতেই সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকা ও ম্যাগাজিন ছিল। যেমন ইবানদানে হর্ন এবং মাকারেরেতে পেনপয়েন্ট। কিন্তু এসব শিক্ষার্থীরা আফ্রিকার সাথে তাদের সাহিত্যিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ইংরেজির দিকে ঘুরে গিয়েছিল। একজন চিনুয়া আচেবে কিংবা একজন ওল সোয়িনকা কিংবা একজন কফি আয়ুনুরের দারুণ চিন্তাজগত আফ্রিকান উপন্যাসকে নবজীবন না দিয়ে আফ্রো-ইউরোপিয়ান উপন্যাস নামে নতুন ঐতিহ্য তৈরি করেছিল। ইংরেজি, ফরাসি ও পর্তুগিজ ভাষার এসব উপন্যাস পরবর্তী উৎসাহ পেয়েছিল বহুজাতিক প্রকাশকদের কাছে কারণ এতে তারা দেখেছিলেন সাহিত্যিক জগতে বিনিয়োগের নতুন ক্ষেত্র। হাইনাম্যানের আফ্রিকান রাইটার্স সিরিজ থেকে আফ্রো-ইউরোপিয়ান উপন্যাসকে আলাদা করা এখন প্রায় অসম্ভব, এ তালিকায় রয়েছে শতাধিক উপন্যাস। তবে লংম্যান কিংবা ইস্ট আফ্রিকান পাবলিশিং হাউজের মতো স্থানীয় প্রকাশনা সংস্থারও এমন চিত্তাকর্ষক তালিকা রয়েছে।
এভাবে আফ্রিকান উপন্যাস তার সম্ভাব্য মুক্তির উপায় থেকে পুনরায় বঞ্চিত হয়েছিল। এটি মূলত ঘটেছিল ইউরোপীয় উপন্যাসের ক্রিটিক্যাল ও সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদী সেক্যুলার ঐতিহ্যের সাথে উদীয়মান লেখকদের সংযোগ স্থাপন এবং ঔপনবেশিক সরকার ও মিশনারি নিয়ন্ত্রনের বাইরে থাকা বাণিজ্যিক প্রকাশকদের দৃশ্যপটে আসার মাধ্যমে।
আমি এই পদ্ধতির নিশ্চিত অংশ ছিলাম অথবা ছিলাম এই পদ্ধতি থেকে উৎপাদিত পণ্য। আমি ১৯৫৯ সালে মাকারেরে ইউনিভার্সিটি কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম আর পড়েছিলাম ইংরেজি। আমার একেবারে প্রথম ছোট গল্প মুগুমো প্রকাশিত হয়েছিল দ্য ফিগ ট্রি শিরোনামে বিভাগের ম্যাগাজিন পেনপয়েন্ট-এ। ১৯৬৯ সালের ভেতর আমার প্রথম উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল, পরে যার নাম হয়েছিল দ্য রিভার বিটউইন। ১৯৬৩ সালে আমার দ্বিতীয় উপন্যাস উইপ নট, চাইল্ড-এর পাণ্ডুলিপি প্রকাশের জন্যে গ্রহণ করেছিল লন্ডনের উইলয়াম হাইনাম্যান। পরে এটি আফ্রিকান রাইটার্স সিরিজের সপ্তম অবস্থানে ছিল। আমার গ্রেপ্তার ও রাজনৈতিক বন্দিত্বের বছর ১৯৭৭ সালে প্রকাশ হয়েছিল আমার চতুর্থ উপন্যাস পেটালস অব ব্লাড।
১৯৭৮ সালে কামিতি সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কারাগারের সেল ১৬ তে থাকার সময় উপন্যাসকে আমার চিন্তা ও মস্তিষ্ককে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বন্দি করে রাখার বিরুদ্ধাচরণের উপায় হিসেবে ভেবে নেওয়াটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। কারাগারের পরিস্থিতিতে উপন্যাসের আরও অন্যান্য সুবিধা ছিল। নিরক্ষরতার বাধা ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার আদর্শ উপায় থিয়েটার অথবা চলচ্চিত্রের জন্য একাধিক মানুষের যুক্ত থাকা প্রয়োজন এবং প্রয়োজন নির্দিষ্ট স্থান অথবা প্রাঙ্গণ। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে আর্থিক বিনিয়োগের বিষয়টা না হয় আলোচনা নাই করলাম। কিন্তু একটি উপন্যাস লেখার জন্যে প্রয়োজন শুধুমাত্র কলম ও কাগজ। তথাপি সর্বাগ্রে আমাকে সমাধান করতে হতো ভাষার প্রশ্নটি, যা ছিল আমি কোন ঐতিহ্যের সাথে নিজেকে পুনর্যুক্ত করতে চাই সেই প্রশ্ন থেকে একেবারেই অবিচ্ছেদ্য। একদিকে ছিল আ গ্রেইন অব হুইট ও পেটালস অব ব্লাড-এর মতো আফ্রো-ইউরোপীয় উপন্যাস আর অন্যদিকে ছিল আফ্রিকান উপন্যাস যার সাথে আমার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। কোন নিরপেক্ষতার সুযোগ নেই, আমাকে পছন্দ করতেই হতো।
কিন্তু একদিক থেকে কামিরিথু ও আমার বন্দিত্বের বাস্তবতার ফলে আমার পছন্দটি নির্ধারিত হয়েই গিয়েছিল। আমি সেই ভাষাতেই উপন্যাস লেখার চেষ্টা করবো যা ছিল আমার কারাবরোধের ভিত্তি। আমি নিজেকে আমার পূর্বের আফ্রো-ইউরোপিয়ান উপন্যাসের চর্চার সাথে নয় বরং আফ্রিকান উপন্যাসের প্রতি আমার নতুন অঙ্গীকারের সাথেই যুক্ত করবো।
পাঁচ
ঐ সিদ্ধান্তের পথটি ছিল দীর্ঘ। গিকুয়ু ভাষায় কথা বলে বেড়ে ওঠার কারণে গল্প ও মৌখিক আখ্যানগুলোর সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল এই ভাষাতেই। নতুন সাহিত্য হিসেবে আমি উৎসাহের সাথে গিকুয়ু ভাষায় বাইবেল, বিশেষত ওল্ড টেস্টামেন্টের গল্পগুলো পড়েছিলাম। সেসময় মিশনারি ও সরকারি ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত পুস্তিকাগুলোর অধিকাংশই আমার পড়া ছিল। যেমন মুহেরো মা তেনে, মুয়েন্দো নি ইরা না ইরিরি, কারিয়ুকি না মুথোনি অথবা মিকারিরে ইয়া আগিকুয়ু ; এগুলো মূলত উপন্যাসিকা বা সৃজনশীল গল্প না হলেও ছিল একটি মুগিকুয়ু শিশুর পুরনো অভ্যাস, ঐতিহ্য ও জীবনের নানা ধাপের ঈষৎ কাল্পনিক বর্ণনা কিংবা সরাসরি বাইবেলের আখ্যান। এগুলো ছিল বাইবেল বা পুরনো ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত নৈতিক শিক্ষায় পূর্ণ। সেসময়ে গিকুয়ু ভাষায় লেখালেখি করা কেনিয়ানদের ভেতর সবচেয়ে সৃজনশীল ছিলেন গাকারা ওয়া ওয়ানজাউ। বই প্রকাশ ও বিতরণের জন্যে তিনি স্থাপন করেছিলেন নিজের গাকারা বুক সার্ভিস।তাঁর ছিল উপন্যাসিকা, রাজনৈতিক রচনা, গান, কবিতা এবং পুরোদস্তুর আন্দোলিত করার মতো বিষয়ে পূর্ণ এক চমৎকার তালিকা। এগুলোতে ভূমি, মুক্তি এবং তাদের সংস্কৃতি রক্ষার জন্য মানুষকে দৃঢ়সঙ্কল্প নেয়ার আহ্বান জানানো হতো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর সকল বই নিষিদ্ধ করা হয় আর তাঁকে গ্রেপ্তার করে ১৯৫২ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ১০ বছর বন্দি করে রাখা হয়। কিন্তু তাঁর রিয়ুয়া রিতানাথুয়া, ও কিরিমা এনগাগুয়া, মাগেরিয়া নোমো মাহোতা, এনগোয়েন্দা উনজুরাগে এবং মারেবেতা ইকুমি মা ওয়েন্দো-র মতো বইগুলো আমার মস্তিষ্কে সবসময়ই বিদ্যমান ছিল। তারপর আমি সরে গিয়েছিলাম কিশওয়াহিলি ভাষায় বিদ্যমান রচনাগুলোর দিকে। এখানেও খুব বেশি কিছু ছিল না। তবে আমি বারবার পড়েছিলাম হেকায়া যা আবুনুয়াসি, যা ছিল আবুনুয়াসি নামক এক ঠগের রোমাঞ্চকর গল্প।
ইংরেজি ভাষাই আমার সামনে কল্পকাহিনীর এক বিশাল ভাণ্ডারের দরজা খুলে দিয়েছিল। আর এর ফলেই ১৯৫৯ সালে আমি ভর্তি হয়েছিলাম মাকারেরের ইংরেজি বিভাগে। আর ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত পেটাল অব ব্লাড ছিল এসবের ফলাফল হিসেবে আমার লেখালেখির শেষ ধাপ। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমার ইংরেজি ভাষার ব্যাপারে অস্বস্তি বাড়ছিল। আ গ্রেইন অব হুইট লেখার পর আমি একটি সঙ্কটের ভেতর দিয়ে গিয়েছিলাম। আমি জানতাম আমি কাকে নিয়ে লিখছি, কিন্তু আমি কার জন্যে লিখছিলাম? যেসব কৃষকের সংগ্রামের কথা এই উপন্যাসে ছিল তারা কখনোই এটি পড়বে না। ১৯৬৭ সালে লিডস ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের পত্রিকা ইউনিয়ন নিউজ-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আমি বলেছিলাম ‘‘আমি সঙ্কটের কাছে এসে পৌঁছেছি। আমি জানি না ইংরেজিতে আমার লেখালেখি করার আর কোন বিশেষ মূল্য আছে কিনা।” ১৯৬৩ সালের ওবি ওয়ালির প্রশ্নগুলো লিডস ও তারপরেও আমাকে অনুসরণ করছিল। ১৯৬৯ সালে মাকারেরে ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগে সৃজনশীল রচনা বিষয়ের একজন ফেলো থাকাবস্থায় আমি ‘টুওয়ার্ডস আ ন্যাশনাল কালচার’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। এটি মূলত লেখা হয়েছিল সেনাগালের ডাকারে ঐ বছরই অনুষ্ঠিতব্য ‘কালচারাল পলিসি ইন আফ্রিকা’ শীর্ষক ইউনেস্কোর সম্মেলনের ব্যাকগ্রাউন্ড ম্যাটেরিয়ালের অংশ হিসেবে। প্রবন্ধটি পরবর্তীতে আমার বই হোমকামিং-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। আর এতেই আমি আরও বেশি জোরালোভাবে ভাষা প্রশ্নে কথা বলেছিলাম :
আমাদের সাংস্কৃতিক রেনেসাঁর জন্যে আফ্রিকান ভাষাসমূহে শিক্ষাদান ও পড়ালেখা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যে কোন ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা কী করে তা আমরা দেখেছি। তারা তাদের ভাষা উপনিবেশিতের উপর চাপিয়ে দেয় আর স্থানীয় মানুষের ভাষাগুলোকে অবমূল্যায়িত করে। এর দ্বারা তারা তাদের ভাষাকে একটি আভিজাত্যের চিহ্নে পরিণত করে। এই বিদেশি ভাষার শেখার মাধ্যমে এর চিন্তাপদ্ধতি ও মূল্যবোধগুলো গ্রহণ করা ব্যক্তিরা সংখ্যাগুরু কৃষক এবং তাদের বর্বর ভাষাগুলোকে তুচ্ছজ্ঞান করে। তারা তাদের মাতৃভাষা বা গণমানুষের ভাষার মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মানুষদের দ্বারা চলতি মূল্যবোধের বাহক হলো ভাষা। যে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ আফ্রিকান ভাষাসমূহে কথা বলে, সেই দেশের বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়গুলোতে এসব ভাষা শিক্ষা না দেয়ার বিষয়টি আমার কাছে খুবই বিচক্ষণতাহীন মনে হয়। আমাদের একটি জাতীয় ভাষা তৈরির প্রয়োজন আছে, কিন্তু তা কোনভাবেই আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে ভয়াবহভাবে খরচ করে নয়। একটি সমাজতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক ভাষাসমূহের উন্নয়ন কোনভাবেই জাতীয় ঐক্য ও সচেতনতার জন্যে ক্ষতিকর নয়। শুধুমাত্র একটি প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেই বিবাদমান পক্ষগুলোর স্বার্থরক্ষায় কৃষক ও শ্রমিকদের সাধারণ স্বার্থের ক্ষতি করতে নৃতাত্ত্বিক ও স্থানীয় ভাষাগুলোকে ব্যবহার করা হয়। একটি অর্থপূর্ণ আত্মপ্রতিরূপ তৈরির জন্যে আমাদের নিজেদের ভাষায় শিক্ষাদানের গুরুত্ব অনুধাবন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে…
…আফ্রিকান ভাষাসমূহে শিক্ষাদান বৃদ্ধি পেলে অনিবার্যভাবেই নিজেদের মাতৃভাষায় লিখতে চায় এমন আফ্রিকানদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে এবং এর ফলে আমাদের সৃজনশীল চিন্তাভাবনার নতুন নতুন পথ উন্মোচিত হবে।৭
কামিরিথুর সাথে যুক্ত থাকায় ১৯৭৭ সালে কেনিয়াত্তা ইউনিভার্সিটি কলেজে আমি একটি উন্মুক্ত বক্তৃতা করেছিলাম। এই বক্তৃতায় কেনিয়ার সকল লেখককে আমি তাদের নিজস্ব জাতীয়তার ভাষা ও সংস্কৃতির শেকড়ে ফিরে যেতে আহ্বান জানিয়েছিলাম।
প্রশ্নটি নিয়ে ভেতরে ভেতরে তখনও আমার খুঁতখুঁত ছিল। থিয়েটারের ক্ষেত্রে আমি ভাষা বিষয়ক সমস্যার সমাধান করতে পেরেছিলাম। উপন্যাসের ক্ষেত্রে? আমি কি এসব সমস্যার সমাধান করতে পারবো? কামিতি সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কারাগার এই বিষয়টির সমাধান করে দিয়েছিল। ১৯৭৮ সালের ২৩ জুন দ্য ডিটেইনিজ রিভিউ-তে আমাকে বন্দি করে রাখা কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যে আমি বলেছিলাম :
নিজের শেকড়ের কাছে ফেরত যাওয়া ছাড়া কেনিয়ান লেখকদের কাছে আর কোন বিকল্প নেই। কবিতা, নাটক ও উপন্যাসের মাধ্যমে তারা যদি ঐ মহান বিশালতার ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ করতে চান তাহলে তাদেরকে ফেরত যেতে হবে তাদের জীবন ও কথাবার্তার ছন্দের উৎস এবং কেনিয়ার গণমানুষের ভাষার কাছে।
অবদমন এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কারাগার ও বন্দিশালায় প্রেরণ না করে তাদের উচিত এমন সাহিত্য রচনায় উৎসাহ প্রদান করা যা হবে কেনিয়ার জন্যে গর্ব আর সারা পৃথিবীর জন্যে ঈর্ষার কারণ।৮
কিন্তু সেই সময়ে আমি ছিলাম গিকুয়ু ভাষায় লেখা আমার প্রথম উপন্যাসের মাঝামাঝিতে। অথবা বলা যেতে পারে যে, কারাগারে, সেল ১৬ তে আমি ছিলাম কাইতানি মুথারাবাইনি লেখা নিয়ে গভীর সমস্যায়।
সূত্র ও টীকা
৭. নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো, হোমকামিং, লন্ডন, ১৯৭২, পৃ. ১৬-১৭ — লেখক
৮. নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো, ডিটেইনড: আ রাইটার’স প্রিজন ডায়েরি, লন্ডন, ১৯৮১, পৃ. ১৯৬ — লেখক
(চলবে)
পড়ুন ।। কিস্তি ৯