বীজ ।। কিস্তি : ৮

বীজ উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে এক তরুণীর তীব্র সংবেদনা; পর্যবেক্ষণশীল চোখ দিয়ে সে দেখেছে নিজের ভেতর ও বাহির। মনিরুল ইসলামের লেখা এই উপন্যাস আপনাকে নিয়ে যাবে সমকালীন জীবনের অন্দরমহলে।

১০

এই মাসটা কেটে গেল দ্রুত। ঘটনাবহুল। ঘটনা বলতে একদম নতুন চোখমুখঅলা মানুষগুলোকে এখন আর নতুন মনে হয় না। সবাইকে নিয়েই সবার মোটামুটি একটা বোঝাপড়া হয়ে গেছে। মাজহার ভাই বিয়ে করেছেন। ছুটি নিয়েছিলেন তিনদিন। সিস্টেমে পাঁচদিন আরকি। উনি আমার সঙ্গে ফেসবুকে নেই। রিকোয়েস্ট পাঠাননি। আমার পাঠানোর প্রশ্নই আসে না। ইমরানের সঙ্গে আছেন। সেখানেই ছবি দেখেছি ভাবির। শুধু বিয়ের ছবিই নয়। বিয়ের পরের ছবিও দেখেছি কয়েকটা। সুন্দর মিষ্টি চেহারা। সবাইকেই অবশ্য আমার কাছে সুন্দর লাগে। অসুন্দর বলতে আমি বুঝি রোগা-হাড়গিলা-অসুস্থ। নয়তো সবাই সবার মত। তাই কে সুন্দর তা টের পেলেও, জোর গলায় কাউকে অসুন্দর আমি বলতে পারি না। গড়পড়তা চোখে শান্তা আপুকে সুন্দও বলা যায় না। জেসমিন দি’র মত তার ফেস কাটিং অসাধারণ নয়। কিন্তু শান্তা আপু মোটেই অসুন্দর নন। মাথা নষ্ট করা লুক তার। একদম নায়িকাদের মত শরীর। সেই তুলনায় দেবীর মত সৌন্দর্য নিয়েও নায়িকাদের মত নন জেসমিন দি।

 

মাজহার ভাইয়ের মধ্যে আসলেই একটা কেবলাকান্ত-মার্কা ভাব আছে। তিনি বিয়ে করাতে ভালই হয়েছে। ভেতরে ভেতরে আগের চেয়ে একটু বদলেছেন হয়তো? না বদলালেও, মনে হবে বদলেছেন। আমাদের সবাইকেই দাওয়াত দিয়েছিলেন বিয়েতে। ঢাকায় হলে একটা কথা ছিলো। ময়মনসিংহে কে যায়! ময়মনসিংহে আমি কখনো যাইনি। যাইনি বলার চেয়ে বলা উচিত বাস থেকে নামিনি। ওখানে আমাদের কোনো আত্মীয় নেই। অথচ ময়মনসিংহের ওপর দিয়েই সবসময় আমরা শেরপুর যাই। কেবল ইমরান গিয়েছিলো বিয়েতে।

 

বিয়ের ছবি দিয়েছিলো ইমরান। মাজহার ভাইদের বাড়িঘরের অবস্থা বেশ ভালো। ছবিগুলোতে ইমরানকেও ভালো দেখাচ্ছিলো। সে যদি জানতো ওকে নিয়ে আমি ভাবি, তাহলে কী করতো ও! জানার ইচ্ছা হয়। ইমরানের একটা বিষয় চমৎকার। কোনো প্রকার ছ্যাবলামি নেই। ও যে আমাকে পছন্দ করে, মোজাম্মেল না-বললে, আমি বুঝতেও পারতাম না। তার হাবভাব মোটেই আজেবাজে ছেলেদের মত নয়। ইমরান কি আমাকে কখনো বলবে না, তার পছন্দের কথা? বললে কীভাবে বলবে! ও যদি জানে, আমি একটা বাজে মেয়ে। তাহলে ও কি আমাকে পছন্দ করবে? ও যদি জানে শোভন নামের একটা ছেলের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিলো আমার। বহুবার আমাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে। তাহলে কি ও আমাকে ভালবাসবে?

 

শেষ পর্যন্ত বিভাস দা’র সঙ্গে এড়িয়ে চলার নীতি আমাকে গ্রহণ করতে হয়নি। তিনি আছেন তার মত। সবকিছু যেমন চলে তেমনই চলছে। বেশ স্বাভাবিক। মনেই হয় না, কিছু হয়েছে। ঐ দিন যেন তার আর আমার মধ্যে কোনো কথাই হয়নি। আমি আর তাদের আলাপে গিয়ে বসি না। বিষয়টা হালকা করার জন্য কখনো আবার গিয়ে বসিও। তারা স্বাভাবিক আচরণ করেন। একদিন আমারই মনে হলো, তারা হয়তো ঠিকই আছে তাদের মত। আমিই বরং বেশি বুঝে ভেতরে ভেতরে একটা ভিন্ন পরিবেশ তৈরি করে আছি।

 

শান্তা আপু একদিন ঠিকই ডাল দিয়ে মুরগির মাংস রান্না করে নিয়ে এলো। চিৎকার করে ঘোষণা করলো, আজকের রান্না দিয়ার সৌজন্যে। খুব ভালো লাগছিলো আমার। তাকে নিয়ে বিভিন্ন সময় কত উল্টাপাল্টা ভাবি। খারাপই লাগলো তখন। খেতে গিয়ে সেদিন চোখে পড়লো চুলে কলপ দেন না বিভাস দা। অনেকগুলো চুল পেকে গেছে। কেমন বয়স্ক দেখাচ্ছিলো। ঠিক বয়স্কও না। আমারই মনে হচ্ছিলো বয়স্ক। যদিও ড্যাশিং ভাবটা ছিলোই। জেসমিন দি আগের মতই। উনার হাজবেন্ডকে একদিন দেখলাম। বাস্তবে নয়। ফেসবুকে। মাজহার ভাই টাইপের চেহারা। শিক্ষক মানুষ। দেখে মনে হলো, উনার ব্যাংকার হওয়া উচিত ছিলো। অফিসার-ইন-ক্যাশ। চোখেমুখে কেমন বিল্ট-ইন বিরক্তি।

 

এরইমধ্যে কারণ ছাড়াই একদিন বিভাস দাকে ডেকে পাঠালেন পাটোয়ারী। বিভাস দা সবসময়ই স্বাভাবিক। উনাকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। অথচ সবার চোখ-মুখ দেখে উনি ঠিকই কেমন বুঝে ফেলেন সব। শান্তা আপু খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। আমারও কেমন একটু লাগতেছিলো। পনের-বিশ মিনিট কী কথা হলো, তারাই জানে। বিভাস দা বেরিয়েও এলেন খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই। জেসমিন দি জানতে চাইলেন, ঘটনা কী? উনার উত্তর ছিলো, এই এমনিতেই খোশগল্প। মানে কী! পাটোয়ারী তাকে খোশগল্প করার জন্য ডাকবে!

 

বিভাস দা’র জন্য আমার মায়া হলো খুব। মনে হলো, তাকে আমার সরি বলা উচিত। ঐদিনের রূঢ় আচরণের  জন্য। কত অযথা সরি বলেছি একসময়। আর এখন কিনা কাজের সময় মুখ দিয়ে সরি আসে না। মোজাম্মেলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঐদিনই আমি নীলক্ষেত গেলাম। বিভাস দা’র সঙ্গে দেখা করতে। অফিস শেষ হলে তিনি নীলক্ষেতের দিকেই থাকেন। পুরোনো বই-কেনাটা তার নেশার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

 

গিয়ে তাকে পেলাম না। তিনি নেই। না-পেয়ে আমার জেদ চেপে গেলো। কেন থাকবেন না! তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। কোথাও নেই। তাকে আমার খুব আপনজন মনে হচ্ছিলো তখন। এতোটা একাগ্রতা নিয়ে আমি হয়ত শোভনকেও খুঁজিনি কোনোদিন। শোভনকে খুঁজতে হতো না। ও হাজিরই থাকতো। প্রয়োজনে আমাকেই খুঁজে নিতো সে। খুঁজতে শিখিনি বলেই হয়তো, একবার হারানোর পর, তাকে আর খুঁজে পেলাম না। শোভন কি এ-সমস্ত কিছু প্ল্যান করেই করেছিলো! আমার তো কোনো প্ল্যান ছিলো না! তাই বুঝতেও পারতাম না যে, আর কারও প্ল্যান থাকতে পারে। নিজেকে যতই আমি স্বাভাবিক প্রমাণ করতে চাই না কেন, ভেতরে ভেতরে আমি পুড়ছি ঠিকই। নির্মমভাবে পুড়ছি। কখনো কাউকে অভিশাপ দিইনি। কিন্তু মন থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটি প্রশ্ন ধ্বনিত হল আমার। হে খোদা, কাউকে এভাবে ঠকিয়ে, নির্মম কষ্টে রেখে কেউ কি সুখী হতে পারে?

 

ফিরে যাওয়ার সময় বিভাস দা’র সঙ্গে দেখা হল। ‘কী অবস্থা দিয়া, কাজ ছিলো এদিকে?’ তিনিই আমাকে অ্যাড্রেস করলেন। তাকে অপরিচিতের মতই লাগছিলো। মুখে একটা হাসি রেখে আমি দাঁড়ালাম। হয়তো ঘাবড়েও গেলাম কিছুটা। যদিও তাকেই আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম এতক্ষণ। আর যখন বিশ্বাস করে ফেলেছি, না দেখা হচ্ছে না। হঠাৎ তখনই দেখা হওয়াটা মুশকিলে ফেলে দিলো আমাকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বলে ফেললাম, ‘এদিকেই একটু কাজ ছিলো, বিভাস দা, আপনি নিশ্চয়ই বই কিনতে এসেছেন?’ হেসেছিলেন বিভাস দা’। জানি, এটাই তার উত্তর ছিলো। আমি আসলে চাচ্ছিলাম না, এটা তিনি জানেন, যে উনার সঙ্গে দেখা করতেই আমি এখানে এসেছি। ‘ঠিক আছে বিভাস দা আমি তাহলে যাই? কাল দেখা হবে।’ এতো জলদিই শেষ বাক্যটি বলতে আমার নিজেরও খারাপ লাগছিলো। কেন জানি আমার মুখ দিয়ে এই কথাগুলোই বেরিয়ে এলো। বিভাস দা’ কোনো কথাই বললেন না। চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন সোজা। এই সুন্দর চোখ দু’টোকে উপেক্ষা করার জন্যই কিনা জানি না, বাসে উঠে আরও খারাপ লাগছিলো আমার। পুরোটা রাস্তা চোখ বন্ধ করে কেবল তার কথাই ভাবছিলাম। মনে পড়ছিলো টুকটাক সামান্য কথাবার্তাগুলোও। এটা কী ধরনের অনুভূতি আমি জানি না। এটা তো প্রেম না। এটা কি অপরাধবোধ? কীসের অপরাধবোধ? বাসায় ফিরেও তার কথাই কেবল মনে পড়ছিলো আমার। আমার ভেতরে তখন কী চলছিলো তিনি নিশ্চয়ই টের পেয়েছেন সবই। কীভাবে যেন উনি ঠিকই টের পেয়ে  যান। কিন্তু এইসব নিয়ে কখনও কিছু বলেন না।

 

এই ঘটনার পরের দিনটা আমার জন্য ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই দিনের ঘটনাটাই বিভাস দা’র সঙ্গে আমার সম্পর্কের গতিমুখটা একদম বদলে দিয়েছে। অথচ তেমন কিছুই না। খুবই সামান্য ও প্রতিদিনকার মত স্বাভাবিক বিষয় ছিলো সেটা। বিভাস দা, জেসমিন দি আর ইমরান। কথা বলছিলেন জেসমিন দি। যথারীতি বিভাস দা খুব স্বাভাবিক। গতকাল যেন দেখাই হয়নি উনার সঙ্গে। অথচ আমি কিনা পুরোটা সময় শুধু উনাকে নিয়েই ভেবে কাটিয়েছি। সেই বিষয়ে একটি কথাও বললেন না। যেন খুবই তুচ্ছ একটা ঘটনা ছিলো সেটা। কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতে করতে আমিও যোগ দিলাম তাদের সঙ্গে। সেই মুহূর্তেই গতকালকের ঘটনা সম্পর্কে আমার সমস্ত অনুমানকে তিনি সত্য প্রমাণ করলেন। বললেন, ‘দিয়াকে দেখলেই এই কথাগুলো আমার মনে পড়ে।’

Why do you stay in prison

When the door is so wide open?

দুইবার আওড়ালেন তিনি। এরপর জেসমিন দি’র চোখের দিকে তাকালেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জেসমিন বলতে পারবে, কার কথা?’ এরপর ইমরানের দিকে। হাসলেন। যেন উনার হাসিটাই প্রশ্ন। এরপর আমার দিকে তাকালেন বিভাস দা’। কী আশ্চর্য! কোনো লুকোচুরি নেই কথার মধ্যে। সরাসরি আমার নাম ধরে বললেন। যদিও উনার মুখে শুনে পুরো অর্থ আমি তখনও বুঝতে পারিনি। কিন্তু আমার মনে হলো, এরমধ্যে নিশ্চয়ই গূঢ়ার্থ লুকিয়ে আছে। এবং তার সঙ্গে আমি সম্পর্কিত। আর সম্পর্কিত আমার অতীত। আমি হাসলাম। খুশি হওয়ার ভঙ্গিতে বললাম, ‘ইন্টারেস্টিং তো! আমাকে দেখলেই আপনার এই কথা মনে হয়!’ কিন্তু যে প্রশ্নটা আমার মনে দানা বেঁধেছিলো তা উত্থাপন করার সাহস আমি পেলাম না। যেন আমি জানি, কেন মনে হয় উনার। আর এ-ও জানি, কেন মনে হয়? এটা কোনো প্রশ্নই নয় তার কাছে। এর জবাব তিনি দেবেন না। তিনি হাসবেন। সেই হাসিটাই হবে তার জবাব। অর্থাৎ তিনি সবকিছু জানেন।

 

জেসমিন দি বললেন, ‘বাহ্! দারুণ তো! কার কথা এটা?’ — না থেমে কথা চালিয়ে গেলেন — ‘আর দিয়াকে দেখেই তোমার কেন একথা মনে হয়?’ হাসলেন বিভাস দা। তার ধীর-স্থির প্রশান্ত হাসি। ইমরান বললো, ‘আমি অবশ্য পুরোপুরি বুঝিনি। ইংরেজিটা বুঝেছি। কিন্তু কথাটা বুঝিনি।’ বিভাস দা’র চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠলো কিছুটা। বললো, ‘ডোন্ট ওরি! বাক্যটির কাছে পৌঁছতে আমারও বেশ সময় লেগেছে, ইমরান। এখনো পুরোটা বুঝি কিনা। নিশ্চিৎ না।’ একটু থেমে কি জানি কি ভেবে বললেন, ‘আসলে দিয়াকে দেখে মনে হলেও কবিতাটি আমাদের সবার জন্যই।’ এটি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির একটি কবিতা। রুমির কবিতা থেকে দুটি চরণ মাত্র।

 

কবিতাটা বুঝি আর না বুঝি। এটুকু বুঝতে আমার বাকি ছিল না, বিভাস দা লুকোচুরি খেলার মানুষ না। সুতরাং তার সঙ্গেও লুকোচুরি খেলার কিছু নেই। আমার জন্য তার দরজা সবসময় খোলা। শুধু আমার জন্য নয়, সবার জন্যই খোলা তার দরজা। কথাগুলো যেন তিনি আমাকে নিঃশব্দে বললেন।

 

এরপর আবারও একদিন তাকে আমি বইয়ের দোকানে খুঁজতে যাই। সেদিন সরাসরি গিয়ে তার সঙ্গেদেখা হয়।  আমাকে দেখেই তিনি বলে ওঠেন, ‘হোয়াই ডু ইউ স্টেই্ ইন প্রিজন/ হোয়েন দ্য ডোর ইজ সো ওয়াইড ওপেন?’

 

সেদিন ইমরান ছিল তার সঙ্গে। উনি যেন জানতেন আমি আসব। আমার জন্য তাই থরে থরে সাজিয়ে রেখেছিলেন কথার অফুরন্ত ভার। আর শুধুই অপেক্ষা করছিলেন আমার জন্য। অনেক কথা বললেন তিনি। উনার একেকটা কথা আমার হৃদয়ে যাদুমন্ত্রের মত কাজ করছিলো। অনেক কথা বললেন বিভাস দা। শব্দ কত শক্তিশালী হতে পারে, আমি জানলাম সেদিন। এভাবেই তাহলে ব্রেইনওয়াশ করে! আমার ভেতরটা গলে একদম জল হয়ে গিয়েছিলো। অনেকদিন পর। মনে হলো জীবনে হয়তো এই প্রথম এতোটা নির্ভার বোধ করছিলাম আমি। সবকথা মনেও নেই। অনেক কথাই আমি বুঝিনি। কিন্তু কথাগুলোর নরম পরশ ঠিকই হৃদয়ে গিয়ে লাগছিলো। এই কথাগুলোই হয়তো আরও আগেই তিনি আমাকে বলতে চেয়েছিলেন। বেছে বেছে এমন কথাগুলোই তিনি আমাকে বললেন যেন আমার জন্যেই কোনো কবি, কোনো দার্শনিক, কোনো ধর্মপ্রচারক, কোনো সমাজবিজ্ঞানী যত্ন করে কথাগুলো লিখে রেখে গেছেন। ঠিক সময়ে ঠিক শব্দচয়নে ঠিক ভঙ্গিতে কথা বলছিলেন তিনি। কথায় কথায় রচিত হয়ে গিয়েছিল অনবদ্য এক অর্কেস্ট্রা।

 

একটি কথা উনার নিজের। বললেন, অতিযত্নে বহন করছেন আমার জন্য। আমার বোঝাপড়ার শেষ মেরুদণ্ডটাকেও তা একদম গুড়িয়ে দিয়েছিল। বিভাস দা’ আমাকে বললেন, প্রবল পরাক্রমশালী দুই ভাই দৈত্যের কথা। সুন্দ আর উপসুন্দ। বললেন, জগতের প্রতিটি বস্তুনিচয় থেকে কীভাবে তিল তিল পরিমাণ সর্বোত্তম সৌন্দর্যের নির্যাস নিয়ে বিশ্বকর্মা পরমাসুন্দরী তিলোত্তমাকে সৃষ্টি করেন। একপর্যায়ে থেমে, খুবই নাটকীয় ভঙ্গিতে থেমে, আমার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘দিয়া, আপনাকে কেউ কি তিলোত্তমা বলেছে কখনো?’ আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে চললেন, ‘যদি না বলে থাকে, তাহলে আমার সৌভাগ্য, এই সুন্দর কথাটি প্রথমবারের মত আমিই আপনাকে বলতে পারলাম।’ যথারীতি নাটকীয়ভাবে শেষ করলেন তিনি। আমাদের মধ্যে যে আরেকজন কেউ ছিলো, মনে হলো, সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল ছিলো না। যেন উনারা দুজনে মিলে একজন মানুষই ছিলেন। এত সহজ-স্বাভাবিকভাবে তিনি বলে যাচ্ছিলেন এসব কথা, যেন এরচেয়ে সুন্দর কথা পৃথিবীতে আর নেই। আমার জীবনে এ ছিল আরেকটি ধাক্কা। শোভন যদি আমার জীবনে রচনা করে থাকে একটি দীর্ঘ শীত। বিভাস নিয়ে এল বসন্তের উন্মাদনা। শীত নয়, যে উন্মাদনা অনায়াসে গিলে নেয় ঋতুর সমগ্র আবর্তন। বিভাস এমন এক জন্মের গল্প আমাদের শোনালো যে জন্ম সর্বদাই মৃত্যুর অধিক। যে উন্মাদনা শীতের হৃদয়ে কান পেতে শোনে অনাগত বসন্ত-সঙ্গীত।

 

বিভাস আমাকে স্বাগত জানিয়েছে বসন্তের রাজ্যে। আমি বলেছিলাম, ‘এখন তো বসন্তকাল নয়।’ সে বললো, ‘বসন্ত বাইরে নয়, দিয়া। বসন্ত ভেতরে। বসন্তকে স্থির রাখা যায়।’ এটা তার কথা নয়। হাসতে হাসতে বললো, এটা প্রমথ চৌধুরীর কথা। ‘প্রমথ চৌধুরীকে চেনো? খুব মেজাজী লোক। সাবধান। নিটশের মত তার ক্ষেপা চেহারা। দেখেছো?’ বাচ্চাদের মত করে হাসতে শুরু করলেন তিনি। যেন খুব মজার কিছু ঘটেছে। এত সামান্যতেই এত মজা তার কাছে। ভারি অবাক লাগে। প্রমথ চৌধুরীর লেখা আমি পড়েছি। পাঠ্য ছিলো। এমন কথা তো পড়িনি।

 

বিভাসের বাক্যজাল ভেদ করা সহজ নয়। সব জটিলতার সমাধান তার জানা। আর আমার ভেতরে কেবল প্রশ্ন আর প্রশ্ন। প্রশ্নের কারাগারে আমি আটকে আছি। আমার কি মুক্তি নেই? আমি কি জানি না সেই মুক্তির পথ? এই জন্যই কি সে আওড়ালো মন্ত্রের মত কবিতা? কিন্তু দরজা কোনটা? দরজা কি বিভাস? এজন্যই কি শুধু তার সংস্পর্শেই, তার উপস্থিতিতেই, তার মধ্যে নিমগ্ন হওয়ার ভেতরেই কেবল আমি টের পাই সেই হাওয়া! জীবনের সেই নির্ভার আঘ্রাণ! সে নেই, তো কিছুই নেই। শূন্যে মিলিয়ে যায় সব। ছেয়ে যায় অন্ধকারে। সমস্ত শহর। সেই শহর। পুরোই অচেনা, তার সেই, বসন্তের শহর। আমি কি আটকা পড়ছি? এই বন্দীত্বেও কেমন জানি মুক্তির স্বাদ।

(চলবে)

পড়ুন ।। কিস্তি : ৭

বীজ ।। কিস্তি : ৭

 

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here