নগুগি ওয়া থিওঙ্গো সাহিত্য ও রাজনীতির দুনিয়ায় চেনা একটি নাম। তাঁর বিখ্যাত বই Decolonising the Mind: The Politics of Language in African Literature (1986)। ঔপনিবেশিক রাজনীতি, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি বোঝার দারুণ প্রতিনিধি-পুস্তক এই বই। বইটি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করবেন শিবলী নোমান।
আফ্রিকান কল্পকাহিনির ভাষা
এক
আমার একটি বইয়ের শিরোনাম হলো ডিটেইনড, আর এর উপশিরোনাম হলো আ রাইটার’স প্রিজন ডায়েরি। কেন একজন লেখকের জেলখানার ডায়েরি? কারণ এর মূল আলোচ্য ছিল জেলখানার পরিবেশে থেকে উপন্যাস লেখার পদ্ধতি নিয়ে। কাইতানি মুথারাবাইনি১ উপন্যাসটি ১৯৮০ সালে প্রকাশ করেছিল হাইনেম্যান। আর গিকুয়ু ভাষায় এটিই ছিল এ ধরনের পরিসর ও আকারে প্রথম উপন্যাস।
আফ্রিকান কল্পকাহিনির ভাষা সম্পর্কিত আলোচনায় কাইতানি মুথারাবাইনি লেখার অভিজ্ঞতায় আমি বারবার ফিরে যাবো। আর আমি আশা করি যে, এক্ষেত্রে আফ্রিকান উপন্যাসের বিদ্যমানতা, উদ্ভব, বিকাশ ও উন্নয়নের বিভিন্ন বিচার্য বিষয় ও সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হবে। ১৯৭৭ সালের ৩১ ডিসেম্বরে আমাকে যখন আমার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তখন আমি কামিরিথু কমিউনিটি এডুকেশন অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারের কার্যক্রমের সক্রিয় অংশগ্রহণকারীর পাশাপাশি ইউনিভার্সিটি অব নাইরোবির সাহিত্য বিভাগের সভাপতি ও সহযোগী অধ্যাপক ছিলাম। আমি শ্রেণিকক্ষে আমার শেষ বক্তব্যটি মনে করতে পারি। এটি ছিল আমার তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থিদের উদ্দেশ্যে। আমি বলেছিলাম, ‘‘আগামী বছর আমি চিনুয়া আচেবের থিংস ফল অ্যাপার্ট থেকে গার্লস অ্যাট ওয়ার পর্যন্ত লেখাগুলোর একটি শ্রেণি বিশ্লেষণের চেষ্টা করতে চাই।’’ আমি বিশেষভাবে চাচ্ছিলাম থিংস ফল অ্যাপার্ট ও অ্যারো অব গড-এ দেখানো উপনিবেশের প্রকৃত বার্তাবাহক, কেরানি, সৈনিক, পুলিশ, ক্যাটেচিস্ট২ এবং রাস্তার শ্রমিকদের থেকে বার্তাবাহক শ্রেণির উদ্ভব ও ক্রমোন্নয়ন থেকে নো লঙ্গার অ্যাট ইজ-এ দেখানো বাইরে থেকে শিক্ষিত হয়ে ফিরে আসা; আ ম্যান অব দ্য পিপল-এ দেখানো ক্ষমতা বিষয়ে তাদের ধারণা ও চর্চা; গার্লস অ্যাট ওয়ার-এ জাতিকে অন্তঃশ্রেণিগত গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে ফেলা পর্যন্ত বিষয়গুলো অনুসন্ধান করতে। আর এসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা শুরুর আগে আমি সবাইকে আহ্বান করবো দুইটি বই আগে পড়ে নিতে যেগুলো তথ্য দেয় আফ্রিকান রচনা বিশেষত আফ্রিকানদের লেখা উপন্যাসগুলো সম্পর্কে আর সেগুলো পড়া না থাকলে বিষয়গুলো বুঝতে পারা অসম্ভব। এর প্রথমটি হলো ফ্রানজ ফানোর দ্য রেচড অব দ্য আর্থ, মূলত এর ‘দ্য পিটফলস অব ন্যাশনাল কনশাসনেস’ শীর্ষক অধ্যায় এবং দ্বিতীয়টি হলো ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের ইম্পেরিয়ালিজম, দ্য হাইয়েস্ট স্টেজ অব ক্যাপিটালিজম।
পাঁচদিন পর, অথবা বলা যেতে পারে এনিগাহিকা এনদিনদা নিষিদ্ধ হওয়ার ঠিক ছয় সপ্তাহ পর আমি ছিলাম কামিতি সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কারাগারের সেল ১৬ তে একজন রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে আর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলাম নিতান্ত এক সংখ্যা কে৬,৭৭-কে। ভার্জিনিয়া উলফ যাকে বলেছিলেন ‘‘একজনের একান্ত নিজের একটি কক্ষ’’ এবং তিনি একে বলেছিলেন একজন লেখকের জন্যে অবশ্য প্রয়োজনীয়, সেল ১৬ আমার জন্যে তাতেই পরিণত হয়েছিল। আর এটি সরবরাহ করেছিল খোদ কেনিয়ার সরকার।
দুই
তো আমার নিজের সেই কক্ষের চার দেয়ালের মাঝে বন্দি থেকে আমি সাহিত্য বিভাগে আমার অনেকগুলো কাজ নিয়ে খুব ভেবেছিলাম। আমার শিক্ষার্থীরা কি উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে ফ্রানজ ফানো ও লেনিনের লেখা পড়েছে? এবং অবশ্যই ভেবেছিলাম কামিরিথু কমিউনিটি এডুকেশন অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে আমার অংশগ্রহণ বিষয়ে। সেখানে অংশগ্রহণকারীরা কি বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছে? এছাড়া ভেবেছিলাম একজন বন্দি লেখক হিসেবে আমার সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে। শাস্তি দেয়ার সাথে সাথে একটি নব্য-ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর একজন লেখককে বন্দি রাখার আরেকটি কারণ হলো সাধারণ মানুষের থেকে তাকে দূরে রাখা, তার সাথে সাধারণ মানুষের যে কোন ও প্রতিটি সংযোগ ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। আমার ক্ষেত্রে শাসকরা চাচ্ছিলো বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রাম থেকে আমাকে দূরে রাখতে ও সম্ভব হলে আমার মনোবল ভেঙে দিতে। আমাকে আমার মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে হতো আর এর সবচেয়ে ভালো উপায় ছিল ঐ একাকিত্ব ভাঙতে কারাগারের বাস্তবতাগুলোকেই ব্যবহার করা এবং শীতল দেয়াল ও তালাবদ্ধ দরজার ভেতর থাকা সত্ত্বেও একটি সংযোগ পুনঃস্থাপিত করা। আমার সংকল্প আরও দৃঢ় হয়েছিল যখন কারাগারের এক রুঢ় সুপারিন্টেনডেন্ট আমাকে কবিতা লেখার যে কোন চেষ্টার ব্যাপারে বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছিল। সে আসলে উপন্যাসের সাথে কবিতা গুলিয়ে ফেলেছিল।
কিন্তু কেন একটি উপন্যাস? আর কেনই বা তা গিকুয়ু ভাষায়?
তিন
খুব বেশিদিন আগে নয়, ঈশ্বরের মতো উপন্যাসকেও মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল। অন্তত এর উনিশ ও বিশ শতকের ধরনগুলোকে। যদিও আমি জানি না নতুন ঈশ্বরের খোঁজে বা সে ধরনের কোন আন্দোলন হয়েছিল কিনা, তবে nouveau roman৩-এর খোঁজে একটি আন্দোলন হলেও আমি নিশ্চিত নই তার কোন ফলাফল ছিল কিনা। যা স্পষ্ট ছিল তা হলো আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে ‘উপন্যাস’ বলতে যা বুঝানো হতো তাতে জীবনের উল্লেখযোগ্য চিহ্ন ছিল। তাই উপন্যাসের মৃত্যু আমার জন্যে কোন সমস্যা ছিল না।
তথাপি আমাদের কাছে অর্থাৎ আফ্রিকায় উপন্যাসের যে ধরন এসেছিল তার উদ্ভব ঘটেছিল বুর্জোয়াদের থেকে। এটি জেগে উঠেছিল বাণিজ্য ও শিল্পক্ষেত্রের মাধ্যমে ইউরোপীয় বুর্জোয়াদের ঐতিহাসিক কর্তৃত্ববাদের মাধ্যমে। যার পেছনে ছিল ছাপাখানার নতুন প্রাযুক্তিক উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক প্রকাশনা শিল্প এবং সর্বোপরি মানুষের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বিশ্বকে জানা সম্ভব– এহেন চিন্তার পরিসর তৈরি হওয়া। টলেমির বিশ্ব প্রতিস্থাপিত হয়েছিল কোপার্নিকাস ও গ্যালিলিওর বিশ্ব দ্বারা; আলকেমি কেমিস্ট্রি দ্বারা; আর যাদু ও স্বর্গীয় ইচ্ছাসমূহ প্রকৃতি ও মনুষ্যসংক্রান্ত অভিজ্ঞতা দ্বারা। নতুন বিশ্বের এডমুন্ডদের দ্বারা পুরনো দিনের রাজাদের সকল নিয়ম প্রশ্নের মুখে পড়ছিল। প্রকৃতি ও ঈশ্বরের আধ্যাত্মিক বিষয়াদির প্রতিফলনের মাধ্যমে চালিত বিশ্ব যা ছিল অভিজাত ও সাধারণের সামন্তবাদী বিন্যাসের সকল বৈশিষ্ট্যের ধারক, প্রতিস্থাপিত হচ্ছিলো বুর্জোয়া মানুষ ও লাভ-ক্ষতিতে দৃশ্যমান তার ঈশ্বরের কর্তৃত্বের মাধ্যমে। এখন গাওয়া হয় শ্রমিকদের লাগাম টেনে ধরতে দাও; আর তখন গাওয়া হতো বুর্জোয়াদের লাগাম টেনে ধরতে দাও।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে যে ইউরোপ আফ্রিকায় এসেছিল তা ছিল বিজয়ী বুর্জোয়াদের ইউরোপ। মুক্ত বাজার ব্যবস্থার শিল্প ক্ষেত্রের অধিনায়ক থেকে তা তখন রূপান্তরিত হয়েছিল বড় বড় শিল্প ও বাণিজ্যিক একচেটেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা বিশাল অর্থনৈতিক বিষয়াদির সেনাপতিতে, আর সে তখন খুঁজছিল জয় ও শাসন করার জন্যে নতুন বাজার।
অন্যদিকে, বিভিন্ন অঞ্চল ও মানুষের ভেতর বিভিন্ন পর্যায়ের সামাজিক উন্নয়ন হওয়া উপনিবেশ-পূর্ব আফ্রিকাকে পরিচিত করানো হতো উৎপাদিকা শক্তিতে নিম্নোন্নত অঞ্চল হিসেবে। উপরন্তু এই অঞ্চল ছিল অবোধগম্য ও অদৃশ্যমান ভবিষ্যতে পূর্ণ কিংবা পূর্ণ এমন এক ধরনের প্রকৃতিতে যাকে বুঝতে পারা যায় শুধুমাত্র প্রথা, যাদু ও অতিপ্রাকৃতিক উপায়ে। এই অজানা ও বিপদসঙ্কুল প্রকৃতির মুখোমুখি হতে হয় সামষ্টিকভাবে ও সমাজের আসঞ্জিত বিন্যাসের মাধ্যমে। এর কোন কোন চর্চা রুঢ় হতে পারে কিন্তু এর সদস্যদের ভেতর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও পারস্পরিক দায়বদ্ধতা বিষয়ে সচেতনতার ক্ষেত্রে এটি খুবই মানবিক। এই বিশ্বটি প্রতিফলিত হয় এর থেকে উৎপাদিত সাহিত্যে যেখানে প্রাণি চরিত্রগুলোর এক ধরনের মিশ্রণ দেখা যায়। দেখা যায় অর্ধমানব-অর্ধপশু এবং মানুষ যারা পরস্পরের ভেতর পারস্পরিক সন্দেহ, প্রতিকূলতা এবং ধূর্ততার সাথে মেলামেশা ও মিথষ্ক্রিয়া করে, যদিও সেখানে কখনো কখনো পারস্পরিক সহায়তার দৃশ্যও দেখা যায়। সামাজিক সংগ্রামগুলো আরেক ধরনের সাহিত্যেও প্রতিফলিত হতো। এগুলো ছিল মহাকাব্যিক আখ্যান যেখানে যুদ্ধ ও বিপর্যয়ের সময় যেসব রাজা ও ব্যতিক্রমী চরিত্রসমূহ সম্প্রদায়ের জন্যে কাজ করেছে তাদের নায়কোচিত ও উৎসবমুখর বিবরণ থাকতো। এসব সমাজের অন্তর্গত ও বহিঃস্থ সংগ্রাম এবং তাদের উৎপাদিকা শক্তির উন্নয়ন ও প্রকৃতির উপর প্রগতিশীল কর্তৃত্ব বাধাগ্রস্ত হয়েছিল ইউরোপীয় দাসপ্রথার মাধ্যমে। এসব অঞ্চলের প্রতিষ্ঠিত কৃষিব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল গণঅভিবাসন ও অবস্থান পরিবর্তনের ফলে।৪ কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে তাদের প্রাকৃতিক উন্নয়ন আরো বেশি নাটকীয়ভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। এটি সত্য যে অতি উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর বণিজ্য ও শিল্প পুঁজির অধীনে লাখো মানুষের শ্রমের পুনর্গঠনের মাধ্যমে উৎপাদিকা শক্তির পুঞ্জীভবনের ফলে সাম্রাজ্যবাদ আফ্রিকার জন্যে প্রাকৃতিক বিশ্বকে জানা ও তার উপর কর্তৃত্ব করার সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। কিন্তু একই সময় এটি পরাজিত জাতিসত্তা ও মানুষের বিশ্বকে জানা ও কর্তৃত্ব করার উপায়গুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। এছাড়া তাদের ভূমি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল, তাদের মানুষদের হত্যা করছিল এমন এক সভ্যতা যারা এর আগে আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার জনগণ ও সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে। এভাবে তাদের নিজেদের জীবনধারণের সাধারণ কিন্তু প্রগতিশীল উপায় ও ভিত্তিগুলোকে তাদের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রকৃতি ও একে অপরের সাথে সামঞ্জস্যবিধানের জন্যে বিস্তৃত ব্যবস্থাগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল। আর মানুষকে ছুড়ে দেয়া হয়েছিল প্রকৃতির বিশৃঙ্খলা, অযৌক্তিকতা ও সাংঘর্ষিকতার চেয়ে একটি অধিক রুঢ় ও অধিক অবোধগম্য সামাজিক বিন্যাসের ভেতর।
প্রাথমিকভাবে পুঁজিবাদী কৃষি ও শিল্পব্যবস্থার অধীনে শ্রমের পুনর্গঠনের অর্থ হলো পূর্বের সামন্তবাদী ও সম্প্রদায়গত ব্যবস্থার চেয়ে অজানা মাত্রায় সম্পদ উৎপাদন ও বৃদ্ধির সম্ভাবনা। কিন্তু দমনমূলক বর্ণবাদী আদর্শের ঔপনবেশিক ব্যবস্থা সেসব সম্পদকে কতিপয়ের হাতে–যারা মূলত সাদা-আত্মসাতের নিশ্চয়তা বিধান করেছিল। এভাবে সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্টি করেছিল গণদারিদ্রতা ও অঞ্চলব্যাপী অনুন্নয়ন। পুঁজিবাদ সূচনা করেছিল ক্ষুধার উপর বিজয়ের প্রাচুর্য ও সম্ভাবনা, পুঁজিবাদ নিশ্চিত করেছিল আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি দারিদ্রতা ও খাদ্যাভাব। পুঁজিবাদ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে প্রকৃতিকে জয় করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদের অনিয়ন্ত্রিত ও স্বেচ্ছাচারী ব্যবহারের ফলে পুঁজিবাদ খরা ও মরুকরণের মতো বিপর্যয়ের মাধ্যমে মানুষের উপর কার্যত প্রকৃতির কর্তৃত্ব নিশ্চিত করেছিল। রোগসমূহকে জয় করার জন্যে পুঁজিবাদ আবিষ্কার করেছিল নতুন চিকিৎসা বিজ্ঞান। পুঁজিবাদ নির্ধারিত চিকিৎসা সেবার কারণে অন্তত উপনিবেশগুলোতে একটি রোগে পূর্ণ জনসাধারণ তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল, যারা এখন আর ভেষজ ও মনঃচিকিৎসকদের সাহায্য নেয় না, কারণ এদেরকে চিহ্নিত করা হয়েছে শয়তানি হিসেবে।
সেখানে আরও সাংঘর্ষিকতা ছিল। নিজেদের মতাদর্শের মিশনারিদের দ্বারা সাম্রাজ্যবাদ অনেক আফ্রিকান ভাষায় লেখালেখি শুরু করেছিল। বাইবেলে বর্ণিত দাসভাবাপন্নতা, শ্রম ও কর এবং শৃঙ্খলাভঙ্গকারীদের হত্যার জন্যে সামরিক বাহিনী ও পুলিশকে প্রশাসনিক নির্দেশ প্রদান কিংবা স্থানীয় বার্তাবাহকদের কাছে সরাসরি পৌঁছানোর জন্যে এটি প্রয়োজনীয় ছিল। সাম্রাজ্যবাদী প্রতিপক্ষসমূহের এবং জনগণকে বিভক্ত করে শাসন করার ঔপনিবেশিক চর্চার ফলে একই ভাষার ধ্বনিসমূহের সাংঘর্ষিক উপস্থাপন দেখা গিয়েছিল, একই ঔপনবেশিক সীমানায় প্রায়ই একই ধরনের আফ্রিকান ভাষাগুলোর ক্ষেত্রে কী হয়েছিল তা না হয় বাদই দেয়া হলো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গিকুয়ু ভাষার দুইটি বিবাদমান বানান পদ্ধতি প্রণীত হয়েছিল প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক মিশনারিদের দ্বারা। এই বিষয়টি সংশোধন হওয়ার আগে পর্যন্ত দুইটি গিকুয়ুভাষী শিশুর পক্ষে একে অপরের অক্ষর কিংবা রচনা পড়া সম্ভব ছিল না। সাম্রাজ্যবাদ সাক্ষরতা কর্মসূচি শুরু করেছিল, কিন্তু তা আবদ্ধ ছিল কেরানি, সৈনিক, পুলিশ এবং পেটি পৌর-কর্মচারিদের ভেতর; গড়ে উঠছিল এমন বার্তাবাহক শ্রেণি যাদের ব্যাপারে আমি শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলতে যাচ্ছিলাম। এসবের ফলে স্বাধীনতা পাওয়ার মুহূর্তেও আফ্রিকান মানুষের বড় অংশটি পড়তে বা লিখতে জানতো না।
সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো ক্রমবর্ধমান অডিয়েন্সের জন্যে ছাপাখানা ও প্রকাশনার সম্ভাবনাগুলো নিয়ে কাজ করছিল। যেমন, পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকার ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অঞ্চলগুলোতে ইংরেজি ও আফ্রিকান ভাষাসমূহে প্রকাশনার প্রশংসনীয় ও আলোকায়িত নীতি নিয়ে অনেকগুলো লিটারেচার ব্যুরো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ চেষ্টা করেছিল ঐসব ভাষার আধেয়গুলোকে ঢেকে দিতে। সরকারের লাইসেন্স দেয়ার আইনের মাধ্যমে সরাসরি কিংবা সরকারি ও মিশনারি দ্বারা পরিচালিত ছাপাখানাগুলোর সম্পাদকীয় চর্চার মাধ্যমে ঘুরপথে বিভিন্ন প্রকাশনা সেন্সর করা হতো। আফ্রিকান ভাষাগুলোকে বাইবেলের বার্তা বহনের একটি উপায় হিসেবেই দেখা হতো মাত্র। এমনকি ওরাটিউর থেকে নেয়া প্রাণিবিষয়ক যেসব গল্প এই ছাপাখানাগুলো পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করতো, সেগুলো খুব সচেতনভাবে নির্বাচিত হতো যেন এগুলোর মাধ্যমে মানুষ সংক্রান্ত বিষয়াদিতে একজন সাদা ঈশ্বরের নির্ভুলতার নৈতিক বার্তা ও উপলক্ষ্য প্রচার করা যায়।
আফ্রিকানদেরকে কুসংস্কার, অজ্ঞতা ও প্রকৃতির কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত করার এসব সাম্রাজ্যবাদী ভণ্ডামির ফলাফল ছিল সেসব অজ্ঞতার আরও গভীর হওয়া, কুসংস্কার বৃদ্ধি এবং চাবুক ও বন্দুকধারী প্রভুর কর্তৃত্ববৃদ্ধি। একজন আফ্রিকান, যিনি ঔপনিবেশিক বিদ্যালয়ে গিয়েছেন, খুবই স্বাচ্ছন্দে বিশ্বজগতের উদ্ভবের সাথে বাইবেলের উদ্ভট বর্ণনা, এর পুনরাগমনের ‘স্বর্গীয়’ গুপ্ততথ্য, নরকের ভয়াবহ চিত্র এবং সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যাওয়া পাপীদের প্রতি অভিসম্পাতকে যুক্ত করতে পারেন। কিন্তু পারেন না উপন্যাসের চরিত্রসমূহ ও কাজের উদেশ্যসমূহের সযত্ন ব্যাখ্যা কিংবা উপন্যাসের সেই সাধারণ অনুমানের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে যেখানে বলা হয় মানুষের আচরণের নকশা বা ছাঁচ অথবা মানুষ বা দলের ভেতরের সম্পর্কগুলোর নকশা বা ছাঁচের পরিবর্তনগুলো পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই আমাদের পৃথিবীকে বোঝা বা ব্যাখ্যা করা যায়।
গণ নিরক্ষরতা, একই ভাষার ধ্বনিবিদ্যাসমূহের ভেতর সংঘর্ষ, বাইবেল ও চার্চের নতুন নতুন কুসংস্কারের ভেতর থেকে কিভাবে আমরা আফ্রিকান উপন্যাসের ব্যাপারে অর্থপূর্ণভাবে কথা বলতে পারি? কিভাবে আমি উপন্যাসকে ফেলে আসা মানুষের সাথে পুনঃসংযোগের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে পারি? কামিরিথুর দ্বারা উপস্থাপিত দুইটি শ্রেণির মানুষেরাই ছিল আমার উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠী। আমি কিভাবে এমন একটি ধরন গ্রহণ করতে পারি— যার উৎস, মালিকানা ও ভোগ একেবারেই বুর্জোয়া-সেই লোকসাধারণের জন্যে যারা উপরোল্লিখিত সমস্যাসমূহে জর্জরিত?
কোন গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন বা আবিষ্কারের উৎসের সামাজিক বা জাতীয় ভিত্তি কখনোই এর উত্তরাধিকারীদের তা ব্যবহার করা বা না করার প্রয়োজনীয় নির্ধারক নয়। ইতিহাস বিপরীত বিষয়াদির উদাহরণে পূর্ণ। বারুদ আবিষ্কৃত হয়েছিল চায়নাতে। আর পৃথিবীর প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে পড়তে একে ব্যবহার করেছিল ইউরোপের বুর্জোয়ারা। আরবের মানুষরা আবিষ্কার করেছিল গণিতশাস্ত্র কিন্তু সারা পৃথিবী এই বিদ্যার সদ্ব্যবহার করেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পুরো ইতিহাসে আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলেশিয়ার সকল জাতির অবদান রয়েছে। গান, নাচ, স্থাপত্যশিল্প, চিত্রাঙ্কন ও সাহিত্যের মতো কলাসমূহের ইতিহাসের ক্ষেত্রেও এটিই সত্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে বিংশ শতাব্দীর ইউরোপ ও আমেরিকা দ্বারাই আফ্রিকান গান ও কলার যথাযথ ব্যবহার হয়েছে। একটি উদ্ভাবনের জাতীয় ও নৃতাত্ত্বিক উৎসের ক্ষেত্রে যা সত্য, তা আরও তীক্ষ্ণভাবে সত্য উদ্ভাবনগুলোর শ্রেণিভিত্তিক উৎসের ক্ষেত্রে। স্পিনিং জেনি৫, তাঁত ও বাষ্পীয় ইঞ্জিনের মতো উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন ও প্রাযুক্তিক উৎকর্ষগুলো সবই ছিল শ্রমিক শ্রেণির জন্য উৎপন্ন। এর আগের গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনসমূহ যেমন সেচের হুইল, উইন্ডমিল কিংবা ওয়াটার মিল, সবই ছিল কৃষকদের উদ্ভাবন। বিভিন্ন কলার ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও বেশি সত্য। গান, নাচ এবং সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ সফলতাগুলো কৃষক শ্রেণির থেকেই ধার করা। ফুটবল ও অ্যাথলেটিক্সের মতো খেলাগুলোও এসেছে সাধারণ মানুষের থেকেই। আর উপরতলার মানুষের সাথে যুক্ত খেলাগুলোও সাধারণের উদ্ভাবিত বিষয়ের পরিমার্জিত রূপ। ভাষার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট। কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির মাধ্যমেই সবসময় ভাষার উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গির পরিবর্তন কিংবা নতুন শব্দ, নতুন শব্দবন্ধ কিংবা নতুন প্রকাশভঙ্গির চর্চা শুরু হয়। কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির কারণেই ভাষা সবসময় পরিবর্তিতি হতে থাকে, কখনোই স্থির থাকে না। সমাজতন্ত্রের জয়যাত্রা শুরু হওয়ার আগের পৃথিবীর সামাজিক ইতিহাস হলো অলস শ্রেণির দ্বারা লাখ লাখ শ্রমিকের মেধা ও উদ্ভাবনের ফলভোগের ইতিহাস। তাহলে কেন আফ্রিকান কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণি উপন্যাসের যথাযথ ব্যবহার করবে না?
যে কোন বিচারেই উপন্যাস হলো সোয়াহিলি সাহিত্যে লিয়োঙ্গো৬ কিংবা হোমারের ইলিয়ড ও ওডিসির মতো মৌখিক গল্প ও মহাকাব্যিক আখ্যানগুলোর ঐতিহ্যের প্রশাখা।এগুলো একেবারেই কৃষকশ্রেণির নিজস্ব কলাবিষয়ক রূপ। আফ্রিকান মৌখিক সাহিত্য হলো লিখিত আকারে বিস্তৃত আখ্যান হিসেবে আফ্রিকান উপন্যাসের পূর্বসূরি। গল্প বা কাহিনীই হলো মৌখিক গল্প বা উপন্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যার মূল কথা হলো এরপর কী ঘটলো। গল্প বা কাহিনীকে জারি রাখার নানা উপায়ের ভেতরই শিল্পদক্ষতা উপস্থিত থাকে।
উপন্যাসের নৃতাত্ত্বিক, জাতীয় অথবা শ্রেণিগত উৎস নয়, বরং একে যেখানে স্থাপন করা হচ্ছে তার ব্যবহার ও উন্নয়নই হলো এ বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
সূত্র ও টীকা
১. বাংলায় ক্রুশের উপর শয়তান—অনুবাদক
২. খ্রিস্ট ধর্মের শিক্ষক—অনুবাদক
৩. ১৯৫০ এর দশকে নতুন ধারার ফরাসি উপন্যাস—অনুবাদক
৪. “কোন মানবসৃষ্ট বিপর্যয় নয়, শুধুমাত্র বন্যাকেই (যদি বাইবেলের কিংবদন্তী সত্য হয়ে থাকে) আফ্রিকার সেই আকস্মিক ও প্রচণ্ড পরিবর্তনের ধ্বংসাত্মক মাত্রার সাথে তুলনা করা যায়। আমরা সবাই অন্যস্থানে নিয়ে যাওয়া কালো মানুষদের নিয়ে দাস বাণিজ্য ও এর দুঃখজনক পরিণতির সাথে পরিচিত। কিন্তু খুব কম মানুষই জানেন কী ভয়াবহতা আফ্রিকাকে চেপে ধরেছিল। জনসংখ্যার বড় অংশকে তাদের বাসস্থান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল, পুরো প্রজন্ম হারিয়ে গিয়েছিল। প্লেগের মতো ইউরোপীয় রোগগুলো ধ্বংস করেছিল মানুষ ও গবাদি পশুদের, শহর ও নগরগুলো হয়েছিল পরিত্যাক্ত, পরিবারের সদস্যদের ভেতর যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল; রাজ্যগুলো ভেঙে পড়েছিল, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার যোগসূত্র এমনভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল যে এর পর থেকে দুইটি আফ্রিকা নিয়ে ভাবতে হতো। হলোকাস্টের আগের আফ্রিকা ও তার পরের আফ্রিকা।” ইভান ভ্যান সের্তিমা, নিউ ব্রানসউইক ও লন্ডন, ১৯৮৪, পৃ. ৮ —লেখক
৫. কাটনা—অনুবাদক
৬. ফুমো লিয়োঙ্গো, সোহায়িলি ভাষার লেখক—অনুবাদক
(চলবে)
পড়ুন ।। কিস্তি ৮