প্রায় এক দশক আগের কথা মুজীবুল আনাম এই গবেষণাটি সম্পন্ন করেছিলেন। সে সময় তিনি নিয়মিত মাঠকর্মে গিয়েছেন, তারই অভিজ্ঞতার আলোকে লিখেছিলেন মজমা, পুরুষের যৌনস্বাস্থ্য ও যৌনতা বিষয়ক এই গবেষণাটি। জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে গবেষণাটির বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০১১ সালের বইমেলায় বটতলার পুঁথি নামক একটি এক-ফর্মা সিরিজের অন্তর্ভুক্ত পুস্তিকা আকারে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও জনস্বাস্থ্যগত গুরুত্বের জায়গা থেকে প্রবন্ধটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো।
১. মজমা বিষয়ক গবেষণার প্রেক্ষাপট
বলব বাবা ফলটার নাম? যে ফলটা পুরুষের জন্য খাওয়া মানা?
একটা সব্জি বাবা পুরুষের খাওয়া ঠিক না। বলব বাবা সব্জিটার নাম?
মজমা নিয়ে আমি যখন মাঠকর্ম শুরু করি, প্রথম যে মজমাতে উপস্থিত ছিলাম সেই মজমাতে পরামর্শগুলো দিয়ে যাচ্ছিলেন পঞ্চাশ-উর্ধ্ব একজন মজমাওয়ালা। পাঠক নিশ্চয় অবগত আছেন, বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে, বাজারে প্রচলিত এসব মজমা নিয়ে। যারা অবগত নন, তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি মজমা হচ্ছে মজমাওয়ালা, হকার, ঔষধ বিক্রেতা, ক্যানভাসারের লোক সমাগমের একটা ক্ষেত্র। যে ক্ষেত্র থেকে ঐ ব্যক্তি তার প্রচার কাজ, বেচাকেনার কাজগুলো করে থাকে। লোক সমাগম নিশ্চিত করার জন্য অনেকক্ষেত্রেই সাপের খেলা থেকে শুরু করে, গান বাজনা, অভিনয় প্রভৃতির আশ্রয় নেয়া হয়। লোক সম্মুখে নানা ধরনের আকর্ষনীয় বিষয় হাজির করা এবং এর মধ্য দিয়ে মনোযোগের কেন্দ্রে চলে যাওয়া মজমাওয়ালার প্রধান প্রচেষ্টা থাকে।
এক্ষেত্রে একজন মজমাওয়ালা একাধারে বিক্রেতা, চিকিৎসক, ভালো বক্তা, অভিনেতা, গায়ক, ম্যাজিশিয়ান প্রভৃতি বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত। এই মজমা এবং মজমাওয়ালাদের নিয়ে আমার আগ্রহ তৈরি হয়েছিলো স্কুল বয়স থেকেই। আমার মনে পড়ে, কোন এক মজমায় আমি প্রথম এইডস রোগটির কথা শুনেছিলাম। মজমাওয়ালা এইডস নিয়ে বলছিলেন এবং এ রোগের সম্ভাব্য ভয়াবহতা নিয়ে একটা ফিরিস্তিও দিচ্ছিলেন। শৈশবের সেই মজমাকে নতুন করে আবিস্কার করতে শুরু করলাম হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ-তে অধ্যয়ন করতে গিয়ে।
লোকজ চিকিৎসার একটা বিশেষ ধরন হিসেবে মজমাগুলোর গুরুত্ব আমার কাছে নতুন করে ভাবনার খোরাক যোগাতে লাগল। আমি ঠিক করলাম মজমা নিয়ে গবেষণা করার। মাঠকর্ম শেষে মজমা নিয়ে লিখলাম এম এ থিসিস, Masculinity in Majma: An Ethnography of Street Healing in Bangladesh.আমার এই লেখা মজমা: পৌরুষের সংকট এমএ থিসিসেরই অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। আমার গবেষণার দু’টি প্রধান দিক ছিল; প্রথমত: মজমার প্রকৃতি সম্পর্কে বিশ্লেষণ এবং দ্বিতীয়ত: আমাদের জনস্বাস্থ্যের (Public Health) সাথে এই মজমাগুলোর সম্পর্কের ধরন আলোচনা। এই সংক্ষিপ্ত লেখায় আমি আলোচনা করার চেষ্টা করব যৌনতা বিষয়ক মজমার কথোপকথোন, যা আমাদের ধারণা দেবে মজমার কল্পিত পুরুষ সম্পর্কে।
২. আমাদের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা ও যৌনতা প্রসঙ্গ
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখছি যৌনরোগ, বিশেষত সংক্রামক যৌনরোগগুলো, জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত গবেষণা ও প্রকল্পগুলোতে প্রধান জায়গা দখল করে আছে। বিশ্বব্যাপী এটি একটি সাধারণ চিত্র, যেখানে যৌনরোগের সংক্রমণ প্রতিহত করার নানান চেষ্টা লক্ষ্যণীয়। কিন্তু যৌনরোগ নয় — এমন যৌন সমস্যাগুলো জনস্বাস্থ্য বিষয়ক এসব গবেষণা ও প্রকল্পে খুব একটা উচ্চারিত হয় না। বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কার্যক্রমও এই ধারার বাইরে নয়। এমনকি দাতারাও এবিষয়ে খুব বেশি আগ্রহী নন।
খান (২০০৮) দেখান যে, যৌনরোগ নয় — এমন যৌনস্বাস্থ্য সমস্যাগুলোতে দাতারা খুব একটা গুরুত্ব দেন না। অথচ স্কেনসুল (২০০৬) দাবি করেছেন যে, পুরুষের যৌনস্বাস্থ্য বিষয়ক উদ্বিগ্নতায় যৌনরোগের তুলনায় বেশি প্রাধান্য পায় যৌনকর্মের সক্ষমতার প্রসঙ্গ। খান ও স্কেনসুলের আলোচনার ধারাবাহিকতায় আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হলো যৌনরোগ (যেমন, এইচ আই ভি — এইডস) অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু যৌনস্বাস্থ্যে তা একমাত্র বিষয় নয়। পুরুষের যৌনকর্মের সক্ষমতা বিষয়ক উদ্বিগ্নতা তার যৌনস্বাস্থ্য বিষয়ক ভাবনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে থাকে। অথচ আমাদের জনস্বাস্থ্য নীতিনির্ধারকগণ কিংবা চর্চাকারীগণ যৌনতা বিষয়ক আলোচনা কেবল যৌনরোগে সীমাবদ্ধ করেছেন। এর একটি কারণ খুব সম্ভবত যৌনতা বিষয়ক আলোচনা আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ বিরোধী (কবির, ২০০৫:৬৮)।
আমাদের সার্বক্ষণিক চেষ্টাই থাকে কীভাবে যৌনতা প্রসঙ্গটিকে লুকিয়ে রাখা যায়। আমাদের জনস্বাস্থ্যেও এর কোন ব্যতিক্রম হয়নি। যৌনরোগ নিয়ে আমাদের আলোচনাগুলো সম্ভবপর। কারণ আমরা রোগ খুঁজেছি এবং ফলাফলে দেখা যাচ্ছে রোগ নয় মনে করে পুরুষের যৌনকর্মের সক্ষমতা বিষয়ক উদ্বিগ্নতা অনুচ্চারিত বিষয় হিসেবে থেকে যাচ্ছে। অথচ রাস্তার ধারের মজমাগুলো যৌনকর্মের সক্ষমতার প্রসঙ্গকে কেন্দ্রীয় আলোচনা ধরে পুরুষের যৌনতা বিষয়ক উদ্বিগ্নতাকে আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়। আর মজমার কেনাবেচা পুরুষের ‘সক্ষমতা’ বিষয়ক উদ্বিগ্নতাকেই প্রমাণ করে। মজমা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে পৌরুষের সংকট নিয়ে প্রাথমিক কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলা জরুরি মনে করছি।
৩. পুরুষত্ব ও যৌনতা
পুরুষ কী? বা পুরুষ কে? এই প্রশ্নের একটা উত্তর হতে পারে যার পুরুষত্ব আছে সেই পুরুষ। কিন্তু এই পুরুষত্বের পরিমাপক কী? কী দিয়ে আমরা পুরুষত্ব পরিমাপ করব? সম্ভাব্য একটা সমাধান হতে পারে নারীত্বের বিপরীতে যে বৈশিষ্টগুলো আছে তাই পুরুষত্বের পরিমাপক। তাহলে আমরা কী পুরুষত্ব কিংবা নারীত্ব এই দুই ক্যাটাগরির বাইরে অন্য কোন ক্যাটাগরির স্বীকৃতি দিচ্ছি না? পুরুষত্ব কিংবা নারীত্ব সম্পর্কিত বৈশিষ্ট্যগুলোর সার্বজনীন কোন চেহারা কি আমরা দাঁড়া করাতে পারি? বয়স, সমাজ ও সংস্কৃতি ভেদে কি পুরুষত্ব কিংবা নারীত্বের চেহারা পাল্টায় না?
গুটম্যান (১৯৯৭) পুরুষত্বকে পরিমাপ করার চেষ্টা করেছেন। তিনি চার ভাবে বিষয়টিকে আমাদের সামনে নিয়ে আসেন: প্রথমত, পুরুষত্ব হচ্ছে এমন একটি বিষয় যা কেবল পুরুষ চিন্তা করে এবং সে অনুযায়ী কাজ করে থাকে; দ্বিতীয়ত, পুরুষত্ব এমন একটা কিছু যা পুরুষ নিজেকে পুরুষ প্রমাণ করার জন্য চিন্তা করে এবং সে অনুযায়ী কাজ করে; তৃত্বীয়ত, কিছু পুরুষ অন্য পুরুষের তুলনায় নিজেকে আরও বেশি পৌরুষের অধিকারী মনে করে এবং চতুর্থত, পুরুষের সাধারণ ও কেন্দ্রীয় বোঝাপড়া হচ্ছে নারী-পুরুষের সম্পর্ক দিয়ে পুরুষত্বকে বোঝা যেখানে পুরুষত্ব হচ্ছে সেই বৈশিষ্ট্য যা নারীর নেই। গুটম্যান আমাদেরকে ধারণা দিচ্ছেন যে, কত ভাবে পুরুষ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। গুটম্যান থেকে আমি পুরুষত্বের সংজ্ঞায়নের চেষ্টা করছি না এবং এটা করার উদ্দেশ্যও আমার নয়। আমি বরং দেখার চেষ্টা করছি পুরুষত্ব আদৌ কোন সংগঠিত ধারণাকে প্রকাশ করে কিনা। এর অর্থ এই নয় যে, আমি সমাজের বিদ্যমান লিঙ্গীয় অসমতাকে ভুলতে বসেছি। বরং আমি সেই লিঙ্গীয় অসমতাকে কেবল নারী- পুরুষ এই দুই ক্যাটাগরির উর্ধ্বে থেকে দেখতে চাইছি।
আমি দেখছি পুরুষত্বের ধারণায়ণ কেবল নারীত্বের বিপরীতে প্রতিষ্ঠিত নয় বরং পুরুষের মধ্যকার শ্রেণীবিভাজনও পুরুষত্ব বিষয়ক আলোচনার মধ্য দিয়ে হয়ে থাকে। মাইক ডোনাল্সনের (১৯৯৩) হেজিমেনিক মাসকুলানিটি ধারণাটি এক্ষেত্রে সহায়ক। এই ধারণার মাধ্যমে ডোনাল্সন বলেছেন পুরুষত্বকে কেবল নারীত্বের বিপরীতে নির্ধারিত ক্যাটাগরি হিসেবে দেখলে চলবে না বরং হেজেমনিক পুরুষত্বের ভাবনায় পুরুষের মধ্যকার শ্রেণি বিভাজন রচিত হতে থাকে। পুরুষত্ব ধারণার বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে ডোনাল্সন দেখাচ্ছেন কী করে একটি নির্দিষ্ট ক্যাটাগরি হিসেবে ‘পুরুষ’ ক্ষমতা ও সম্পদ দখল ও নিয়ন্ত্রণ করে এবং নারীর উপর আধিপত্য ফলায়। পুরুষত্বের মধ্য দিয়ে যেভাবে ক্ষমতা ও সম্পদ কুক্ষিগতকরণের চেষ্টা চলে তারই সর্ব্বোচ্চ রূপ হচ্ছে ডোনাল্সনের হেজিমেনিক মাসকুলানিটির ধারণা; যেখানে পুরুষ আধিপত্যশীলতা কেবল নারীর উপর নিয়ন্ত্রণ নয় বরং এক পুরুষের উপর অন্য পুরুষের আধিপত্যশীলতাকে বিশ্লেষণ করে। এই সূত্র ধরে ‘সবল পুরুষত্ব’-‘দুর্বল পুরুষত্ব’র ব্যখ্যা আমরা দিতে পারি।
‘সবল পুরুষত্ব’ আমরা একটা কাঙিক্ষত ক্যাটাগরি হিসেবে দেখি যেখানে একজন পুরুষ সকল দিকে তার সক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সেই সক্ষমতায় কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে থাকে পুরুষটির আধিপত্যশীলতা, যে আধিপত্যশীলতায় পুরুষটির যৌন সক্ষমতা থেকে শুরু করে তার দৈনিন্দন আচরণের প্রতিটি পদক্ষেপে ‘পুরুষ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে, ‘দুর্বল পুরুষত্বে’র ধারণায়নে দেখা যায় সেই আধিপত্যশীলতায় ঘাটতি এবং অক্ষমতা। পুরুষত্বের শ্রেণিবিভাজন থেকে যে বিষয়টি আমাদের সামনে পরিষ্কার হয় তা হল পুরুষত্বের একটি কাঙ্ক্ষিত চেহরা আছে। এই কাঙ্ক্ষিত চেহরা প্রতিটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিসরের আলোকে তৈরি হয় বলে গিলমোর (১৯৯০) দাবি করছেন। তাঁর বক্তব্য থেকে আমরা দেখি সাংস্কৃতিক নানা প্রপঞ্চে সেই ‘কাঙ্ক্ষিত’ পুরুষের প্রতিকৃতি ছড়িয়ে থাকে। সামাজিক নেতৃত্ব থেকে শুরু করে আচার-প্রথা প্রতিটি বিষয়ের সাথে কাঙ্ক্ষিত সেই পুরুষ সম্পর্কিত। একারণে কেবল যৌনতা দিয়ে পুরুষত্বকে বোঝা সম্ভব নয়।
গুটম্যান, ডোনাল্ডসন কিংবা গিলমোর পুরুষত্বের ভাবনাকে যেভাবে আমাদের সামনে নিয়ে আসছেন তাতে করে পুরুষত্বকে কেবল একটা ধারণ হিসেবে দেখা সম্ভব, যার সাথে যৌন পরিচয় আবশ্যিক এমনটা বলা সম্ভব হচ্ছে না। তার অর্থ হচ্ছে, বিশেষ লিঙ্গের অধিকারী হলেই পুরুষত্বের অধিকারী হবে এমনটি মন্তব্য করা যাচ্ছে না। বরং পুরুষত্ব সাংস্কৃতিকভাবে ছড়িয়ে থাকা নানা ইমেজের আত্তীকরণ ও চর্চার সাথে সম্পর্কিত হয়ে পড়ছে। একারণে পৌরুষের সংকট ছড়িয়ে থাকা সেই ইমেজের আত্তীকরণ ও চর্চার ঘাটতির সাথে সম্পর্কিত। আমাদের আলোচিত মজমা হচ্ছে এমনই এক পরিসর যেখানে পৌরুষের সংকট নানাভাবে উচ্চারিত। তবে যৌনতার সাথে সংশ্লিষ্ট সংকটগুলো এক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রাধান্য পায়। পৌরুষের সংকট সর্ম্পকিত প্রাথমিক আলোচনার পর এবার দেখা যেতে পারে মজমায় এই বিষয়টি নিয়ে কী ধরনের কথপোকথন লক্ষ্য করা যায়।
৪.১ ‘হিজড়ার’ কোন শ্বশুর বাড়ি নাই
মজমায় ‘হিজড়া’ তথা তৃতীয় লিঙ্গ অনেক বেশি আলোচিত। এরকমই একটি আলোচনায় একজন মজমাওয়ালা বলছিলেন ‘হিজড়ার’ কোন শ্বশুর বাড়ি নাই। এই শ্বশুর বাড়ি না থাকার যে ব্যাখ্যা তিনি তার ভাষায় দেন তা হল :
আমাদের বাচ্চা পয়দা করতে হয়। একজন হিজড়া তা পারে ভাই? পারে না। হিজড়া যৌন মিলন করতে পারে না। তার যৌন মিলনের জিনিসই নাই। ম্যাশিন নাই ভাই। তার অনেক টাকা থাকতে পারে, কিন্তু সমাজে, ধর্মে কি তার কোন স্থান আছে বলেন? কোন স্থান নাই। এটা খোদার একটা নমুনা। আমাদের চিন্তা করা দরকার খোদা কেন এমনটা করল। আমাদের পুরুষ লিঙ্গের যত্ন নেয়া দরকার। শুধু পিস্তল থাকলেই চলবে না। এটা দিয়ে গুলি বের হতে হবে। নাহলে ঐ হিজড়ার দশা হবে। শ্বশুর বাড়ি জুটবে না।
মজমাওয়ালা তার বয়ানে ‘হিজড়া’ সম্পর্কিত একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন। যে ধারণায়নে আমরা দেখি পুরুষের যৌনতার সংকটকে ‘হিজড়াতুল্য’ হিসাবে দেখা হয়েছে। ‘হিজড়ার’ যৌনতাকে নিষ্ক্রিয়, অনুৎপাদনশীল অর্থে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তথা যৌনতাবিহীন বস্তু হিসেবে দেখানো হয়েছে। পক্ষান্তরে পুরুষকে সেক্ষেত্রে অনেক বেশি সক্রিয় এবং উৎপাদনশীল হিসাবে দেখানো হয়েছে। সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে গুরুত্ব দেয়া না দেয়ার বিষয়টিও বিবেচিত হচ্ছে সেই যৌনতার মানদণ্ডে। এ থেকে বলা যায়, একজন মজমাওয়ালা ‘হিজড়ার’ যৌনতার যে সংকট চিত্রায়িত করছেন তার বৈধতা কিন্তু কেবল যৌনতার পরিসর দিয়ে ব্যাখ্যা করছেন এমন নয়, বরং সেটিকে সম্পর্কিত করছেন বৃহত্তর সামাজিক ও ধর্মীয় পরিসরের সাথে।
মজমাওয়ালার ‘হিজড়া’ সম্পর্কিত বয়ানের যোগসূত্রতা মিলে গিলমোর (১৯৯০) ‘সত্যিকারের পুরুষ’ ধারণার সাথে। গিলমোর বলতে চাইবেন একটা সাংস্কৃতিক পরিসরে ‘সত্যিকারের পুরুষের’ সন্ধানের নমুনা মজমাওয়ালার এই বয়ান। যা থেকে বলা যায় ‘সত্যিকারের পুরুষ’ কেবল নারীর উপর নিয়ন্ত্রণশীল নয় বরং ‘সত্যিকারের পুরুষ’ অন্য পুরুষের সাপেক্ষে নিজেকে অনেক বেশি সংকটহীন হিসাবে তুলে ধরতে সক্ষম। এই সংকটহীন পুরুষের দায়িত্বশীলতাও মজমার একটা আলোচনার বিষয়, যেখানে মূলত প্রাধান্য পায় নারী-পুরুষের যৌনতার পূর্ণতা বিষয়ক আলোচনা।
৪.২ যে পুরুষ স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে পারে না হাসরের ময়দানে তার কপালে দায়ুস চিহ্ন থাকবে
‘হিজড়া’ সম্পর্কিত বয়ানের ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায় দায়ুস বিষয়ক আলোচনায়। একজন মজমাওয়ালা দর্শকদের উদ্দেশ্যে একদিন পুরুষের কর্তব্য বিষয়ক প্রশ্ন তুললেন। তার ভাষায় :
ভাইয়েরা, আপনারা হয়ত ভাববেন আপনার স্ত্রীকে দু’বেলা খাবার দেয়াই আপনার কাজ। আমার অনেক টাকা আছে, আমার বাড়িতে অনেক খাবার আছে। খাবারই যদি বিষয় হত, তাহলে আমি আমার বোনকে অন্যের বাড়িতে বিয়ে দিয়ে পাঠাতাম না। আমি তাকে পাঠিয়েছি কারণ তার আরো অন্য কিছু দরকার। তার যৌনসুখ দরকার। আপনি যদি কারো বোনকে বিয়ে করেন তাহলে আপনার দায়িত্ব কেবল দু’বেলা খাবার দেয়া নয় বরং তাকে খাবারের সাথে সাথে যৌনসুখও দেয়া। আপনি যদি তাকে যৌনসুখ দিতে না পারেন তাহলে কেয়ামতের দিন আল্লাহ আপনাকে যখন এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করবে, আপনি তখন কি উত্তর দেবেন? আপনার কপালে লেখা থাকবে দায়ুস। যার অর্থ পাপী।
মজমাওয়ালার দায়ুস সম্পর্কিত ধারণার হয়ত অন্য ব্যাখ্যা দাঁড় করানো সম্ভব। কিন্তু এক্ষেত্রে যা লক্ষ্যণীয় তা হচ্ছে একজন পুরুষের দায়িত্বশীলতা বিষয়ক মজমাওয়ালার ব্যাখ্যা। স্ত্রীকে যৌনসুখ দেয়া একজন সত্যিকারের পুরুষের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে এবং সেক্ষেত্রে অক্ষম একজন পুরুষ পাপী হিসেবে প্রতীয়মাণ। এক্ষেত্রে অক্ষমতা একই সাথে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। যার ধর্মীয় একটি যোগাযোগ দেখানোর চেষ্টা করেছেন মজমাওয়ালা। ঐ মজমা শেষে আমি যখন মজমাওয়ালার সাথে কথা বলছিলাম তখন অন্য অনেক বিষয়ের সাথে এই দায়ুস প্রসঙ্গটি নিয়ে আলোচনা করি।
প্রবন্ধকার : দায়ুস কী?
মজমাওয়ালা : এটা একটা আররি শব্দ। যার অর্থ যে আল্লাহর হুকুম পালনে ব্যর্থ।
প্রবন্ধকার : আপনি কীভাবে জানলেন দায়ুস সম্পর্কে?
মজমাওয়ালা : জুম্মার খোদবায় ইমাম সাহেব বলছিলেন। তিনি বলেছেন কোন পুরুষ যদি তার স্ত্রীর যৌন ক্ষুধা মেটাতে না পারে তাহলে রোজ হাসরের ময়দানে ঐ পুরুষের কপালে দায়ুস চিহ্ন দেয়া হবে।
প্রবন্ধকার : আপনি কোন ধর্মীয় গ্রন্থে বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন?
মজমাওয়ালা : কোন ধর্মের বই দেখিনি, কিন্তু ইমাম সাহেব তো মিথ্যা কথা বলবেন না। তাই না?
মজমাওয়ালার উৎসের সত্যতা নিশ্চিত করতে আমি পারিনি। সেটা আমার সীমাবদ্ধতা, কিন্তু যে দিকটি তিনি আমাদের সামনে নিয়ে আসেন তা হল মজমায় উচ্চারিত ধারণাগুলোর সাথে আমাদের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ। মজমায় যৌনতাকে কেন্দ্র করে পুরুষের দায়িত্বকে চিহ্নিত করা কেবল যৌনভাবে সক্ষম কিংবা অক্ষম এই সীমানায় থাকছে না, বরং তা যুক্ত হচ্ছে ধর্মীয় অনুশাসনের সাথে। দায়ুস চিহ্নিত ‘অক্ষম পুরুষ’ তাই কেবল যৌনতার বিচারে নয়, বরং এটির একটি ধর্মীয় মোড়কও মজমাওয়ালা দেয়ার চেষ্টা করেন। পুরুষের এই অক্ষমতার ধর্মীয় বিচার করেই কিন্তু মজমাওয়ালা থেমে থাকেন না, তিনি এই সংকটের সম্ভাব্য আরো ভয়াবহতাকে সামনে নিয়ে আসেন :
বাবারা পুরোনো দিনের কথা ভুলে যান। এখন আমার বোনেরা কিন্তু কেবল বাসা-বাড়িতে কাজ করে না। তারা গার্মেন্টসে কাজ, অফিসে কাজ করে। অনেক মেয়েরা আছে পুরুষের চেয়ে বেশি আয় করে। তারা আপনার ভাতের জন্য বসে নাই। নিজের ভাত নিজে জোগাড় করে। আপনি যদি ভাবেন কেবল ভাত দিবেন আর সে আপনার মর্জিমত চলবে তাহলে আপনি ভুল করবেন। সে আপনার বশে থাকবে তখনই যখন আপনি তাকে পুরোপুরি সুখ দিতে পারবেন। আর আপনি যদি অক্ষম হন, তাকে সুখ দিতে না পারেন; সে তাহলে অন্য পুরুষের কাছে যাবে। গার্মেন্টসে আরো অনেক পুরুষ আছে, যারা সবাই আপনার মত অক্ষম না। সে আপনাকে ছেড়ে চলেও যেতে পারে। আপনার স্ত্রী অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্ক করলে এর জন্য কিন্তু আপনি দায়ী থাকবেন। আপনি সুখ দিতে পারেন নাই বলে সে অন্য পুরুষের কাছে গেছে। আপনার মান-সম্মান একবার চিন্তা করেন। আপনার ধর্ম-সমাজ দুটাই শেষ।
মজমাওয়ালা পুরুষের সামাজিক মর্যদার সম্ভাব্য সংকটের একটা কারণ হিসেবে যৌন অক্ষমতা চিহ্নিত করছেন। সত্যিকারের পুরুষের বিপরীতে এক সংকটাপন্ন পুরুষকে চিত্রিত করেছেন। এই সংকট পুরুষের সামাজিক মর্যাদার ক্ষুণ্ণ করে, সন্দেহপ্রবণ করে তোলে স্ত্রীর সম্ভব্য অনৈতিক যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে। পুরুষের যৌন অক্ষমতার বিপরীতে নির্দেশিত হতে থাকে কর্মস্থল তথা বাইরের সক্ষম পুরুষটি। যে পুরুষ কর্মস্থলে স্ত্রীর সহকর্মী এবং সক্ষম। এই শ্রেণীকরণ আমাদের মনে করিয়ে দেয় গিলমোর সত্যিকারের পুরুষের সন্ধান বিষয়ক আলোচনা কিংবা ডোনাল্ডসনের আধিপত্যশীল পৌরুষ।
৪.৩ যৌনতার চর্চায় নৈতিকতা
চারটি কাজ বাবা কখনো করবেন না। বেশ্যালয়ে যাবেন না। হস্তমৈথুন করবেন না। পুরুষ হয়ে পুরুষের সাথে জেনা করবেন না। আর মাসিক অবস্থায় কারো সাথে যৌন মিলন করবেন না।
মজমায় একদিকে পুরুষের সংকটাপন্ন একটা চিত্র আমরা পাই। অন্যদিকে সেই সংকট কেন তৈরি হয় তার ব্যাখ্যাও মজমাওয়ালারা দেয়ার চেষ্টা করেন। যৌনতার চর্চার ক্ষেত্রে কাম্য এবং নৈতিক হিসাবে প্রতীয়মাণ — এমন পরামর্শগুলো দেয়া হয়। বেশ্যালয়ে যাওয়া, হস্তমৈথুন করা, সমকামিতা কিংবা মাসিককালীন যৌন মিলন পুরুষের সক্ষমতাকে সংকটাপন্ন করে বলে মজমায় দাবি করা হয়। এই চারটি পরামর্শ বৃহত্তর সামাজিক- সাংস্কৃতিক পরিসরে প্রচলিত নৈতিকতারই সমর্থন জোগায়। পরামর্শ চারটি যৌক্তিক ব্যাখ্যাও দেয়ার চেষ্টা করেন মজমাওয়ালা :
আপনি আজায়গা-কুজায়গায় যান। তাদের সাথে মিলন করেন তাহলে আপনার যৌন ক্ষমতা কমে যাবে। তাদের এ জায়গায় ব্যাকটেরিয়া থাকে, জীবাণু থাকে। আপনি তাদের সাথে শুলে ঐ ব্যাকটেরিয়া গুলান আপনার শরীরে চলে আসবে। আপনার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে। এ কারণে দোহাই লাগে আপনার যৌবন ঠিক রাখতে চাইলে ঐ দিকে পা দেবেন না। আর যারা সেই ছোটবেলা থেকে হস্তমৈথুন করেন। তাদের উদ্দেশ্যে বলব বাবারা একাজ আর করবেন না। আপনি যখন হস্তমৈথুন করেন তখন আপনার হাতের চাপে লিঙ্গের অনেক নার্ভ ছিড়ে যায়। আপনার লিঙ্গ তেড়াবেকা হয়ে যায়। ঠিকমতো খাড়ায় না এছাড়া ঘন ঘন হস্তমৈথুন আপনার শরীরকে দুর্বল করে। যদি মনে করেন লিঙ্গ ঠিক রাখবেন যৌবন ঠিক রাখবেন তাহলে একাজ করবেন না। তৃতীয় এক শ্রেণীর লোক আছে, যারা নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। পুরুষ হয়ে পুরুষের সাথে জেনা করেন তাদের উদ্দেশ্যে বলি আপনাকে খোদাও মাফ করবে না। আর কোন দিনও যৌবন ঠিক থাকবে না। আর যারা ধৈর্য্য হারিয়ে স্ত্রীলোকের মাসিক কালীন সময় মেলামেশা করেন তাদের লিঙ্গ পুড়ে যাবে। আপনার লিঙ্গ থাকবে কিন্তু এতে কোন বোধশক্তি থাকবে না। আপনার লিঙ্গ কালো হয়ে যাবে, আর কাজ করবে না।
মজমাওয়ালার এই পরামর্শসমূহ এবং এর যে ব্যাখ্যা আমরা পেলাম তার সাথে আমাদের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতকে মেলানোর চেষ্টা করা যাক। আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে বেশ্যালয়ে যাওয়া চূড়ান্ত অনৈতিক কাজ হিসাবে দেখা হয় (কবির: ২০০৫)। একইসাথে মজমাওয়ালা যে ব্যাকটেরিয়ার প্রসঙ্গ টেনে আনছেন তার সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে যৌন রোগের সংক্রমণ বিষয়ক ধারণায়ন। এই দুই ভিত্তি থেকে আমরা দেখি বেশ্যালয় কেন্দ্রিক যে নৈতিকতার পরামর্শ মজমাওয়ালারা দিচ্ছেন তা সমাজে প্রচলিত নৈতিকতারই পুনরুৎপাদন। হস্তমৈথুন সম্পর্কিত পরামর্শের ক্ষেত্রে একই ধরনের অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। জোসেফ অলটার ভারতীয় প্রেক্ষাপটে কুস্তিগিরদের নিয়ে কাজ করেন। অলটার (১৯৯২) দেখান যে কুস্তিগিরের সামর্থ্য নির্ভর করে তার যৌন আচরণের সাথে। ভারতীয় প্রেক্ষাপটের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন এ অঞ্চলে পুরুষের বীর্য (Semen) সকল সামর্থ্য, শক্তি, জ্ঞান ও ক্ষমতার উৎস (অলটার ১৯৯২: ১২৯) হিসেবে দেখা হয়। একারণে একজন ভারতীয় কুস্তিগিরের সেই জীবন আচরণ পালন করা প্রয়োজন যেখানে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং বীর্যের যথেচ্ছা অপচয় হবে না। আমাদের মজমাওয়ালা হস্তমৈথুনকে পুরুষ লিঙ্গের গঠনের সমস্যা হিসাবে দেখছেন যার সাথে তিনি যোগ করছেন শারিরীক দুর্বলতাকে। অলটারের ভারতীয় কুস্তিগির সম্পর্কিত আলোচনার সাথে এর একটা যোগাযোগ ঘটছে।
সমকামিতাকে বাংলাদেশি মুসলিম সংস্কৃতিতে জেনা হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয় (কবির ২০০৫: ৫৯)। যা কিনা ক্ষমার অতীত একটা অপরাধ হিসাবে স্বীকৃত। সমকামিতাকে যৌনতার একটা অস্বাভাবিক ধরন হিসাবে গণ্য করে এ জাতীয় আচরণ অনুমোদন না করার প্রেক্ষাপট বিশ্বজনীন। যা কিনা একই সাথে অনেক যৌনরোগের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়। যৌনতার এই বিশেষ ধরণটি নিয়ে স্বতন্ত্র আলোচনা হতে পারে। এখানে আমরা যা দেখছি তাতে করে মজমাওয়ালা সামাজিকভাবে তীব্র আপত্তিকর যৌনতার একটা বিশেষ ধরন, সমকামিতাকে, পুরুষের সংকটের কারণ হিসাবে দেখছেন।
মাসিককালীন সহবাসের বিষয়ে মজমাওয়ালার যে আপত্তি আমরা দেখি সেই আপত্তি বাংলাদেশে প্রচলিত অনেক বিশ্বাসের একটি। ক্যাথরিন সেইমুর (২০০৮) বলছেন যে, মাসিকের রক্ত সম্পর্কে বাংলাদেশের একটা গড়পড়তা বিশ্বাস হল ওই রক্ত দূষিত এবং বিপদজনক। এ কারণে এই সময়ে নারীর শরীরকে দুর্বল এবং দূষিত হিসাবে দেখা হয়। মজমাওয়ালা যখন বলছেন মাসিককালীন সহবাস না করতে তখন আমরা ক্যাথরিনের আলোচনার ধারাবাহিকতা সেখানে খুঁজে পাই। মজমাওয়ালা বিশেষ ধরনের যৌনতার চর্চার পরামর্শ দেবার মধ্য দিয়ে সামাজিকভাবে স্বীকৃত নৈতিক যৌন আচরণকে তুলে ধরছেন। মজমাওয়ালার ব্যাখ্যা করা সেই নৈতিক আচরণগুলোর পালন করার মধ্য দিয়ে মনে করা হয় একজন পুরুষ সংকটের মুখোমুখি হবে না। এর ব্যত্যয় ঘটলে পুরুষের সংকট তৈরি হয়। পৌরুষের এই সংকট একই সাথে নারীর যৌনতা বিষয়ক সক্ষমতার আলোকে আলোচিত হয় মজমায়।
মজমায় নারীকে প্রধানত একটা যৌনসত্তা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। নারীর যৌন ক্ষমতায় পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাবান মনে করা হয় এবং সেই ক্ষমতাবান নারীর সাথে প্রতিযোগিতার নানা কৌশল সম্পর্কে আলোচনা হয় মজমায়। পুরুষের সংকট একদিকে তার ‘অনৈতিক’ যৌন আচরণ; আর অন্যদিকে যৌন ক্ষমতায় সে নিজে আপেক্ষিকভাবে কম ক্ষমতার অধিকারী হলেও তার প্রতিযোগী নারী তার চেয়ে অধিক ক্ষমতাবান।
৪.৪ নারীর নয় পাওয়ার ভোল্ট আর পুরুষের ছয়
আপনারা মনে করছেন আপনারা পুরুষ আপনারা অনেক ক্ষমতাবান। আপনি ভাবছেন গায়ে আপনার শক্তি আছে আপনার অনেক সেক্স পাওয়ার। কিন্তু আপনি ভুল জানেন। নারীরা পুরুষের চেয়ে বেশি সেক্স পাওয়ার রাখে। আমাদের পুরুষের সেক্স পাওয়ার হল ছয় ভোল্টের আর নারীর সেক্স ভোল্ট হল নয়। এখন তাহলে বলেন কে বেশি পাওয়ারফুল। নারী না পুরুষ?
যৌনশক্তির এই তুলনামূলক পরিমাপ, পুরুষকে সংকটে ফেলে দেয়। যে ক্ষমতার বদৌলতে পৌরুষের চিত্রায়ণ, তাতে ক্ষমতাবান বরং নারী। মজমার বয়ানে পুরুষকে স্মরণ করানো ক্ষমতার উৎসে রয়েছে তার সংকট। কিন্তু মজমাওয়ালাতো একজন ‘পুরুষ’। সেই পরিচয়ে শ্রোতা ও মজমাওয়ালার এক মিত্রতা দেখা দেয়। পুরুষ মজমাওয়ালা তার শ্রোতাদের সান্ত্বনা দেয় এবং একইসাথে সমাধান এনে দেয় কী করে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন নারীকে মোকাবেলা করতে হবে। মজমাওয়ালার ভাষায় :
নারীর ক্ষমতা বেশি দেখে ভয় পাবেন না। নারীর নয়গুণ হলেও তা ঘুমন্ত। পুরুষের উচিত সেই ঘুমন্তকে ছয়গুণ দিয়ে মোকাবেলা করা। আপনার কৌশল, নিয়ন্ত্রণ করার উপায় দিয়ে আপনি নয়গুণকে নিয়ন্ত্রণ করবেন।
মজমাওয়ালা এরপর একে একে বয়ান করেন কৌশলের রাস্তাসমূহ। কামসূত্রের কেন্দ্রীয় জায়গায় তিনি দেখানোর চেষ্টা করেন কী করে পুরুষ এই খেলায় বিজয়ী। তিনি জোরালোভাবে বলতে থাকেন পুরুষের সকল কিছুই সকল সম্মান নির্ভর করছে এই খেলায় তার আধিপত্যশীলতার উপর। পুরুষকে জিততেই হবে যদি সে পুরুষ থাকতে চায়। পুরুষের হারার ফলাফল ভয়ানক। স্ত্রী-নারীও চায় হারতে, সমর্পণ করতে। কিন্তু পুরুষের অপরিপক্বতা, দ্রুত বীর্যপাত নারীকে ক্ষুদ্ধ করে তোলে। নারী প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে ওঠে। কারণ পুরুষের এই অপরিপক্বতা তার সন্তুষ্টির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই অপূর্ণতা নারীকে প্রশ্ন করার, চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়। মজমাওয়ালার মতে, পূর্ণতা নারীকে তার স্বামীর প্রতি আরো বেশি ‘সেবিকা’ করে তোলে; আর অর্পূণতা নারীকে পুরুষের উপর নিয়ন্ত্রণমুখী করে তোলে। পুরুষের এই সংকটের ভয়াবহতা থাকে মজমা জুড়ে। মজমাওয়ালারা দেখান এর সম্ভব্য পরিণতি :
আপনি যদি পুরুষ হন, আপনার স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে পারেন; তাহলে সে রোজ সকাল বেলা আপনার ঘুম থেকে উঠার আগে উঠে আপনার জন্য নাস্তা তৈরি করবে। আপনি পরাটা পছন্দ করলে পরাটা বানাবে ডিম ভাজবে। আপনার জন্য দুধ গরম করে রাখবে। এরপর আপনার কাছে এসে আস্তে আস্তে আপনার ঘুম ভাঙ্গাবে। আর বলবে, স্বামীগো নাস্তা তৈরি চল খেয়ে নিবা। আর আপনি যদি পুরুষ না হন। আপনার স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে না পারেন তাহলে সে দশটা এগারোটা পর্যন্ত ঘুমাবে। আপনাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করবে। সংসারে শান্তি থাকবে না।
মজমাওয়ালা সংসারের সম্পর্কের মাত্রাগত ভিন্নতার কারণ বিশ্লেষণ করছেন পুরুষের সক্ষম যৌনতার মাত্রা দিয়ে। সংসারের অশান্তি, পুরুষের প্রতি অবাধ্যতা, অন্য পুরুষের প্রতি আসক্তি পুরুষের যৌন অক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত করে দেখা হয়। এর ফলাফল হিসাবে পৌরুষের সংকটের যে রুপ আমাদের সামনে আসে তা মূলত যৌনতা বিষয়ক পুরুষের উদ্বিগ্নতা অথবা সন্তুষ্টিকে চিহ্নিত করে। যৌনরোগ বিষয়ক জনস্বাস্থ্য কার্যক্রমে যার মাত্রা খুবই সীমিত। যৌনরোগ দিয়ে যৌনস্বাস্থ্য বোঝার জনস্বাস্থ্য উদ্বিগ্ন পুরুষকে হয়ত কোন দিনও বোঝার চেষ্টা করবে না। কিন্তু মজমাওয়ালার সকল মনযোগ সেই উদ্বিগ্ন পুরুষকে নিয়ে।
৫. শ্রীপুরের বড়ি ও পৌরুষের সংকট মোচন
মজমাওয়ালার কাছে সংকটাপন্ন এই পুরুষের সমাধান কী? সমাধান অবশ্যই মজমাওয়ালার জীবিকার উৎস। সে সমাধান বেচে এবং নিজে বেঁচে থাকে। পুরুষ মজমাওয়ালার বাঁচার ও অন্যকে বাঁচানোর উপকরণ শ্রীপুরের বড়ি। শ্রীপুরের বড়ি একটি নাম ও ধারণা। হাজারো বড়ি আজ মজমাওয়ালার হাতে, কিউরেক্স, শক্তি, ফুল নাইট ইত্যাদি ইত্যাদি। শুধু বড়িতে নয়, যে মজমাওয়ালা একদিন বোতলে ভরে তার ঔষধ বেচত তার বোতলে পরিবর্তন এসেছে। বোতলের নাম হয়েছে, বোতলের গায়ে কাগজ মোড়ানো থাকে, তাতে ঔষধের নাম, গুণ লেখা থাকে। শ্রীপুরের বড়ির বডিতেও এসেছে নতুনত্ব, রং বদলেছে, খাওয়ার রীতিতেও নতুনত্ব এসেছে। বড়ি ও বোতলের এই যে সংস্কার তার ইতিহাস নিয়ে অন্য কোথাও হয়ত লেখা যাবে। কিন্তু এই যে সংস্কার তার সাথে সংকটাপন্ন পুরুষের সম্পর্ক অতিমাত্রায় আমাদের সামনে ধরা দেয়। মজমাওয়ালার অদলের বিজ্ঞাপন আজ বাস থেকে শুরু করে দেয়াল, ওভার ব্রিজ সব জায়গায় পৌরুষের সংকটকে ইঙ্গিত করে। পুরুষের যৌন ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করা ও পুরুষত্বর প্রমাণ দেয়া ডাক এই বিজ্ঞাপনের ভাষায়।
একদিকে যৌনতা সম্পর্কিত খোলামেলা আলাপ আমাদের সামাজিক নৈতিকতার বিরোধী হিসাবে ধরা হয়ে থাকে আর অন্যদিকে সাহসী এই বিজ্ঞাপন ও মজমা আমাদেরকে একটি সংকটের ইঙ্গিত দেয়। যে সংকট নিয়ে অনেকে হয়ত বলতে পারেন মজমাওয়ালা যে সংকটকে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন তার ভিত্তি নেই। মজমাওয়ালার মনগড়ানো কিছু কথাবার্তা, কিছু চমক দিয়ে সে তার ক্রেতাকে খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করে, বাণিজ্য করার চেষ্টা করে। কিন্তু মজমাওয়ালা যে সংকটকে আমাদের সামনে তুলে ধরছেন তাতে কিন্তু সাড়ার কমতি নেই। আমার গবেষণা-অভিজ্ঞতা বলে, বয়স, পেশা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে যদি মজমাওয়ালার পরামর্শ ও ঔষধ গ্রহণকারীদের দেখা হয় তাহলে দেখা যাবে গ্রহীতার বৈচিত্র্য ও সংখ্যা দুটোই বেড়েছে। একে আর ‘অশিক্ষিত’, ‘অবুঝ’ পুরুষের কারবার হিসেবে দেখা যাচ্ছে না (কোনকালেই মজমা ‘অশিক্ষিত’, ‘অবুঝ’ পুরুষের কারবার ছিল বলে আমার মনে হয় না)। বরং দেখা যাচ্ছে গ্রহীতার বৈচিত্র্য ও সংখ্যা বিবেচনায় এনে মজমাওয়ালা নতুন নতুন পথ্য নিয়ে আসছেন। হ্যাঁ এতে করে বাণিজ্যের পরিমাণ ও প্রসার দুটোই বাড়ছে এবং এই প্রবণতা আমাদেরকে বুঝতে সাহায্য করে ‘পৌরুষের সংকটকে’।
মজমাওয়ালা যে সংকটকে তুলে আনেন এবং তার গ্রহীতা যখন এতে সাড়া দেয় তখন আমাদের দেখা প্রয়োজন কেন তিনি সাড়া দিচ্ছেন। মজমাওয়ালার পুরুষের যৌনতা বিষয়ক বয়ানগুলোতে কাহিনির ধারাবাহিকতায় আদর্শ/সত্যিকারের পুরুষ যেমন থাকে, তেমনি থাকে যৌনতার সংকট এবং এর সমাধান। একজন গ্রহীতা সেই কাহিনির ধারা বর্ণনায় নিজেকে মেলানোর চেষ্টা করেন। মজমার প্রকৃতিই এমন যে একজন গ্রহীতাকে নিজের সমস্যা বলার প্রয়োজন নেই। সে মজমাওয়ালার বয়ানে নিজেকে প্রতিস্থাপিত করে মাত্র। মজমার এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য গ্রহীতাকে উদ্বুদ্ধ করে সমাধানের পথ বেছে নিতে। কারণ তার সংকট মজমাওয়ালা আবিষ্কার করান এবং সেটি মোচনের রাস্তা বাতলায়ে দেন।
রাহুল রায়ের (২০০১) মজমা নিয়ে করা ডকুমেন্টারিতে একজন মজমাওয়ালা বলেছিলেন মজমাওয়ালা তার গ্রহীতার যৌনতার নয়, মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার সমাধান দেয়। আমি সেই মজমাওয়ালার সাথে একমত। মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার সমাধানের চেষ্টাই থাকে মজমাতে। এই যে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা, একে আমি বলার চেষ্টা করছি ‘পুরুষের যৌনতা বিষয়ক উদ্বিগ্নতা’। তার যৌন ক্ষমতা কী মাত্রায় হওয়ার দরকার, তার লিঙ্গের আকার-আকৃতি কী মাত্রায় হওয়া দরকার, তার নারী যৌনসঙ্গীকে কতটা তৃপ্ত করা দরকার প্রভৃতি বিষয়গুলো যোগ হয় সেই উদ্বিগ্নতা উসকাতে। এর সবকিছুর মধ্য দিয়ে পুরুষ সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। সেই সংকটাপন্ন অবস্থায় মজমাওয়ালা তাকে সাহস দেয়, উদ্দীপনা যোগায়। শ্রীপুরের বড়ি সেই সাহস ও উদ্দীপনাকে গ্রহীতার বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যেতে সাহায্য করে। এরপরও যদি এটিকে কেবল মজমার সংকট হিসাবে ধরা হয় গবেষণা কিন্তু তাতে সায় দিচ্ছে না। গবেষণা বলছে যে, মজমাওয়ালা যে সংকটকে পুঁজি করে তা কেবল মজমাতে থাকে এমনটি নয়। ভারমা ও তার সহকর্মীরা (২০০১) ভারতীয় প্রেক্ষাপটে যৌনস্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা থেকে দেখাচ্ছেন পুরুষরা যৌন দুর্বলতা, তাদের ভাষায় ‘কমজোরি’কে, প্রধানতম সমস্যা হিসাবে দেখছেন। খান ও তার সহকর্মীরা (২০০৮) বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে একই ধরনের সমস্যা তুলে ধরছেন। তারা আরো বলছেন যে, তাদের গবেষিত পুরুষরা লিঙ্গীয় আকার- আকৃতির সাথে যৌন সক্ষমতাকে মেলানোর চেষ্টা করে। তাদের মতে ভাল আকার- আকৃতির লিঙ্গের অধিকারী পুরুষ একজন শক্তিশালী পুরুষ। যে কিনা একই সাথে যৌনতায় শক্তিশালী। ভারমা, খান ও তাদের সহকর্মীদের গবেষণা থেকে আমরা যা দেখছি তাতে করে আমরা বলতে পারছি না, মজমাওয়ালা যে সংকটকে কোন এক বটতলার মজমাতে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন তা কেবল বটতলায় মজমা শোনা শ্রোতাদের মধ্যে সীমিত। বরং আমরা দেখছি মজমার এই সংকট পৌরুষের সংকট হিসাবেই আমাদের সামাজিক পরিসরে উপস্থিত।
তথ্যসূত্র
Anam, Mujibul 2010. Masculinity in Majma: An Ethnography of Street Healing in Bangladesh. Heidelberg University online publication, Publication link
Alter, Joseph S. 1992. The Wrestler’s Body. Identity and Ideology in North India. Berkeley: University of California Press.
Donaldson, Mike 1993. What is hegemonic masculinity? Theory and Society. 22(NA): 643-657
Gilmore, David D. 1990. Manhood in the Making. Cultural Concepts of Masculinity. New Haven & London: Yale University Press.
Gutmann, Matthew C. 1997. Trafficking in Men. The Anthropology of Masculinity. Annual Review of Anthropology. 26(NA): 385-409.
Kabir, E. 2005. The Need for Sexuality Education in Bangladesh. Dhaka: News Network.
Khan, S. I., Gourab, G., Sarker, G. F., Ghosh, S., & Khondokar, S. I. 2008. Mapping geographical and service delivery gaps and estimating size of street, hotel and residence based female sex workers in Bangladesh. Dhaka: ICDDR,B & Save the Children USA.
Roy, Rahul. 2001. ‘Majma’ a Documentary film on male performance, duration 54 Min, New Delhi, India.
Seymour, K. 2008. Tackling menstrual hygiene taboos, Sanitation and Hygiene Case Study 10. Unicef http://www.unicef.org/wash/files/10_case_study_BANGLADESH_4web.pdf (last accessed on 10.01.2011)
Verma R. K., Rangaiyan G., Singh R., Sharma S., Pelto P. J. 2001. A study of Male Sexual Health Problems in a Mumbai Slum Population. Culture, Health & Sexuality. 3(3): 339-352.
বন্ধুদের সাথে করা আলোচনা, মুখ থেকে লেখায় চলে এলো। কি সুন্দর মজায় মজায় পড়া গেল।