সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে প্রচ্ছদ-রচনা প্রকাশ করেছিল সহজিয়া। কবি আলতাফ শাহনেওয়াজ লিখেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মনন ও চিন্তনে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা প্রসঙ্গে। এ লেখাটি নিয়ে ছোট একটি সারগর্ভপূর্ণ প্রতিক্রিয়া লিখেছেন কবি, নাট্যকার ও অনুবাদক বদরুজ্জামান আলমগীর। প্রতিক্রিয়াটি অনায়াসে একটি স্বতন্ত্র লেখার মর্যাদা পেতে পারে। প্রতিক্রিয়াটি প্রকাশ করা হলো।
কেউকেউ মনে করেন রবীন্দ্রদীক্ষা-ই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হয়ে ওঠার মূলমন্ত্র। তাঁদের বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথ একটি ইউনিট, চিরায়ত এক চৈতন্যের আধার। আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ কখনও অবিচল এক রবীন্দ্রনাথ নন। ধরুন, পশ্চিম বাঙলার যে রবীন্দ্রনাথ, পূর্ব বাঙলার রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ঠিক এক রবীন্দ্রনাথ নন। সত্যজিৎ রায় অবশ্য অনড় ফ্রেমের কাঠামোয় চূড়ান্ত বলে সুনির্দিষ্টভাবে তাঁকে তুলাদণ্ডে শনাক্ত ও মূল্যায়ন করা যায়। এটিই হয়তো চলচ্চিত্রকারের সৌভাগ্য যে, তিনি বোঝের বাইরে কিছুই থাকেন না — সবটুকু জ্ঞেয়, আবার চ্যালেঞ্জটুকুও হয়তো এখানেই — তার বেবাকটুকুই জাহিরি, বাতেনি বলে কিছু নেই।
আরেকটি দিক আছে, যেখানে আমি সৌমিত্রকে সম্পূর্ণ রবীন্দ্র-ছাউনির ভিতর আটকে রাখি না। রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমকে গ্রহণ করতে সদা প্রস্তুত ছিলেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এ-জায়গায় একেবারে অন্যরকম। তিনিই বাঙলায় একমাত্র অভিনেতা যিনি অভিনয়ের মনস্তত্ত্ব এবং ভঙ্গিমায় ইউরোপীয়, বা হলিউডি কায়দাটা একেবারেই নেন নি। এখনকার চলচ্চিত্র অভিনেতাদের মধ্যে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, যিশু সেনগুপ্ত, আবীর চট্টোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্যকে কখনও কখনও তাঁদের রিয়ালিস্টিক মেথড এক্টিঙের কারণে সৌমিত্র ঘরানা মনে হলেও তাঁরা তা নন।
তারপরও মনে হয়, আমরা পূর্বাঞ্চলে যে রবীন্দ্রনাথকে পথেপথে কুড়িয়েছি, একাত্তরে যুদ্ধের ময়দানে আশা ও সংকল্পে একীভূত করেছি — তিনি রবীন্দ্রনাথের অধিক রবীন্দ্রনাথ, সৌমিত্রের রবি ঠাকুর থেকে বেশি কবিগুরু। উত্তমকুমার বাঙলার উঠতি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মেয়েদের কাছে যতোটা জনপ্রিয় ছিলেন তার থেকে বেশ খানিকটা কমের দিকে ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আবার মেয়েদের মধ্যে যাঁরা স্বাধীন কর্মজীবী ব্যক্তিমানুষ হিসাবে নিজেদের গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তাঁদের প্রথম পছন্দ সৌমিত্র; ছেলেদের মধ্যে যারা পশ্চিমা আধুনিকতা গঠন গ্রহণ করতে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন — তাদেরও পছন্দ অপুকেই। তা সত্ত্বেও আমার মনে হয়, খোদ অভিনেতা হিসাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অনেকটাই ওভাররেটেড। এক্ষেত্রে একটি তুলনামূলক উদাহরণ দিয়ে বলি।
বড় অভিনেতার মধ্যে দেশলাই কাঠির স্বভাবে জ্বলে ওঠার যে বিরল তাৎক্ষণিকতা থাকে তা সৌমিত্রের ছিল না।
আমার কাছে ডেনিয়েল ডে লুইস খুব বড় অভিনেতা — একটি চরিত্রকে ডিসেক্ট করা, এবং চরিত্রের অন্দরমহলটি দানায় দানায় গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ডেনিয়েলের জুড়ি মেলা ভার। আমাদের হুমায়ূন ফরিদীকে সম্পূর্ণ তুলে আনবার মতো কোন সত্যজিৎ রায়, বা ঋত্বিক ঘটক পেলে হয়তো তাঁর কাছ থেকেও আমরা অবিস্মরণীয় অভিনয় পেতে পারতাম।
বড় অভিনেতার মধ্যে দেশলাই কাঠির স্বভাবে জ্বলে ওঠার যে বিরল তাৎক্ষণিকতা থাকে তা সৌমিত্রের ছিল না। অভিনয়ের থেকেও তাঁর কাছে হয়তো বড় কমিটমেন্ট ছিল সামগ্রিক বাঙালি ব্যক্তিত্বের শিথিল মাধুর্যটুকু ধরে রাখা। মঞ্চাভিনেতা হিসাবেও তার মৌলিক কোন রকমফের হয়নি। ওই কথাটির সঙ্গে আমি শতভাগ একমত — সৌমিত্রকে আমাদের এতো আপন, এমন নিজের কাঙ্ক্ষিত রূপ মনে হয়, কেননা সৌমিত্র কেবল অভিনেতা নন — তার বেশি কিছু: সৌমিত্র কবি, সৌমিত্র এক্ষণের সম্পাদক, একটি শিক্ষিত রুচি, একটি প্রতিষ্ঠান; এতো বড় স্টার হবার পরও তিনি কুষ্টিয়া শিলাইদহের কয়া গ্রামে, কী নদীয়ার কৃষ্ণনগরে যে চিরায়ত জবুথবু বাবা, জেঠা, চাচা বা ঠাকুদ্দাদের রেখে এসেছিলেন তাঁদের আদল ও দাঁড়ানোর ভঙ্গি, সংশয়ী হাসিগুচ্ছ তার অভিনয়ের পরতে পরতে তুলে রেখেছেন — এখানেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অনন্য।