রবীন্দ্রনাথ কি সৌমিত্রের অনুঘটক?

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় গত হলেন পরিণত বয়সেই। তাঁর আদি নিবাস এখনকার বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে হলেও সৌমিত্রের মানসগঠন করেছিল কলকাতা, কলকাতার সেই সময়ের বিপ্লবী আবহ। তাই কল্লোলিনী কলকাতাতেই তাঁর প্রথম লাল পতাকা স্পর্শ করা, কবিতা লেখা, অভিনয়, আবৃত্তি, রাজনীতি—সবকিছু।

 

তবে ভিনদেশি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা ব্যথিত হলাম কেন? মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো কেন হয়ে উঠল সৌমিত্রময়?

 

এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর হলো, আমরা সৌমিত্রকে—বলা ভালো, সৌমিত্রদের দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। আমাদের দেশের বেশ কয়েক প্রজন্ম আদতে কলকাতাকেই বাংলার শিল্পসাহিত্য ও চলচ্চিত্রের স্ট্যান্ডার্ডের সর্বচূড়া ভেবেছে। বাংলা অঞ্চলের শিল্পসাহিত্য-সংস্কৃতিতে কলকাতার ঐতিহ্যিক প্রভাব ও প্রতিপত্তি অস্বীকার তো করা যাবে না; এবং তা সংগতও হবে না।

 

ফলে চাই কি না চাই, সৌমিত্র এবং সৌমিত্রেরা ছিলেন আমাদের কাছে ‘স্ট্যান্ডার্ড’—মাপকাঠি। তাই আমাদের মনের কোনে বারবার তাঁরাই উদিত হয়েছেন। সমাজতত্ত্বিক বিবেচনার আলোকে একে আমাদের মানসিক উপনিবেশের ফল হিসেবে যদি কেউ চিহ্নিত করতে চান, নির্দ্বিধায় করতে পারবেন। সত্যি বলতে, স্বাধীন বাংলাদেশে জান্তে-অজান্তে কিছুটা মানসিক উপনিবেশ আমাদের ছিলও বটে। যে কারণে সিনেমা দেখতে দেখতে আমরা অনেকেই আনমনে সৌমিত্রের মতো হতে চেয়েছি। অনেকে উত্তমকুমারের মতো হতে চেয়েছেন। এই বাস্তবতা অস্বীকারের জো নেই। যদিও সেই বাস্তবতা ধীরে ধীরে এখন বদলাতে শুরু করেছে। তাই তো একজন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে আমাদেরও মন পোড়ে।

 

তবে দুই বাংলার চলচ্চিত্রে এবং আমাদের মনস্তত্ত্বের গভীরে অনেক দিন থেকেই সৌমিত্রের যে পাকা আসনটি তৈরি হয়েছে, এর পেছনে তাঁর সুঅভিনয়ের বৈশিষ্ট্য তো আছেই, সঙ্গে আরও আছে জনসংস্কৃতির দু–একটি অনুঘটক।

 

একটি হলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্র–নান্দনিকতার স্পর্শে গঠিত হওয়া সৌমিত্রের মন আমাদের মনের সঙ্গে মিলতে একফোঁটাও সময় নেয়নি। রবীন্দ্রনাথে কীভাবে জারিত হয়েছেন সৌমিত্র, সেটি বোঝা যাবে ‘প্রতিদিন তব গাথা’ নামে তাঁর লেখা একটি গীতি আলেখ্যে, যেখানে রবীন্দ্র–গান ও কবিতার সঙ্গে মিলিয়ে নিজের যাপনের অনুভূতি তিনি তুলে ধরেছেন:

আমি সেই একাকী রবীন্দ্রনাথকে চিনতে পারি, যাকে “রবি” বলে ডাকবার মানুষ অবিশষ্ট ছিল না। গানে যে একবার বলেছিলেন, “কে আছে নাম ধ’রে মোর ডাকতে পারে”, আমি ভাবি তা এক ব্যক্তিগত আক্ষেপ। এমন কথা যে আমারও কথা।…আমার পিতৃপিতামহের মধ্য দিয়ে আমার দেশের যতটুকু শিক্ষা, যতটুকু সংস্কৃতি আমার কাছে এসে পৌঁছেছে, তার থেকে বহুগুণ বেশি করে সেই সংস্কার, সেই ইতিপূর্বকথা, সেই উত্তরাধিকার রবীন্দ্রনাথের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এসে আমার চিত্তক্ষেত্রকে সুফলা করেছে।

 

রবিঠাকুর তো কেবল সৌমিত্রেরই ‘চিত্তক্ষেত্রকে সুফলা’ করেননি, সংস্কৃতিতে সর্বব্যাপী একাধিক স্বাক্ষর রাখার মধ্য দিয়ে বাঙালির যাপন প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে উঠেছেন। ফলে সৌমিত্রের অভিনয় তথা তাঁর ব্যক্তিত্বের ভেতরে যখন আমরা ওই রবি–নন্দনকলার অনুভব পাই, তখন তাঁকে আপন ভাবতে আমাদের কোনো কিছু চিন্তা করতে হয় না।

 

সৌমিত্রের চিত্তক্ষেত্রের ওপর অমোচনীয় প্রভাব রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই রাবিন্দ্রীক মানসভঙ্গিই কি তাঁকে সত্যজিৎ রায়ের খুব নিকটে নিয়ে এসেছিল, তাঁর সাঙাত করে তুলেছিল? কে না জানে, সত্যজিৎও যে ছিলেন রবীন্দ্র ভুবনের আলোয় আলোকিত। ১৯৫৯–এ অপুর সংসার চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে মানিকবাবুর সঙ্গে তাঁর গাঁটছাড়া। এরপর একে একে করেছিলেন ১৪টি সিনেমা। বোঝাপড়ার রসায়নে কোথাও প্রগাঢ় ঐক্য না থাকলে সত্যজিতের মতো অনমনীয় পরিচালকের সঙ্গে এতটা পথ হাঁটা সম্ভব না। তাই বলা যায়, রবীন্দ্রনাথই জনমানসে সৌমিত্রের গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার প্রধান অনুঘটক। আর দুজনেই একই মানসগঠনের অধিকারী হেতু সৌমিত্রের পায়ের নিচে পোক্ত পাটাতন গড়ে দিয়েছিলেন সত্যজিৎই।

 

সত্যজিৎ পরিচালিত সিনেমায় সৌমিত্র এবং অন্যদের পরিচালনায় সৌমিত্র—এই দুইয়ের দিকে দৃষ্টি দিলে আরেকটি বিষয়ও হয়তো পাওয়া যাবে। অপুর সংসার, চারুলতা, কাপুরুষ মহাপুরুষ, অরণ্যের দিনরাত্রি, অশনি সংকেত, গণশত্রু, শাখাপ্রশাখা প্রভৃতি কাহিনিচিত্রে সৌমিত্রের যে অভিনয় এবং ম্যানারিজম ফুটে ওঠে তা খুব মাপা—একটি সুতোয় গাথা। কিন্তু অন্য পরিচালকদের রোমান্টিক ঘরানার ছবিতে আমরা সৌমিত্রের সেই রূপায়ণ পরিপূর্ণভাবে পাই কী? এখানে সৌমিত্র যেন খানিকটা ম্রিয়মাণ। তা কি ওই বাজার চলতি রোমান্টিকতার সঙ্গে রবীন্দ্র–নান্দনিকতার উপযুক্ত যোগাযোগ ঘটে না বলে? অথবা এমনও হতে পারে, এসব ছবিতে ওই নান্দনিকতা ও মূল্যবোধ নির্মাণের সুযোগই ছিল না।

 

তবে বেলাশেষেসহ জীবনের শেষ পর্বের অনেক ছবির অভিনয়ে আবারও সত্যজিতের সৌমিত্র যেন ফিরে এসেছিলেন। বলাবাহুল্য, এসব সিনেমার অনেকগুলোতেই নেপথ্যে যুগোপোযোগীভাবে ক্রিয়াশীল ছিল রবীন্দ্র মূল্যবোধও।

 

অভিনয়-জীবনের প্রথম থেকেই নদীয়ায় বড় হওয়া সৌমিত্র চাটুজ্যে চলনে–বলনে ও ব্যক্তিত্বে কলকাতার আর সব অভিনেতা বা ‘স্টার’দের মতো ছিলেন না। বাংলা চলচ্চিত্র তার শুরু থেকে যে নাটুকে অভিনয়ের সযত্ন পরিচর্যা করে এসেছে, সৌমিত্র সেই ধারায় কখনো হাঁটতে চাননি। সতীর্থ উত্তমকুমারের ‘নায়কোচিত’ প্রতিকৃতির পাশে তাঁর ভাবমূর্তি ছিল একেবারে স্বাভাবিক অভিনেতার। উত্তমের অভিনয়ে কখনোবা নাটুকেপনার আভাস মিললেও সৌমিত্রের অভিনয় ছিল আরও বেশি স্বাভাবিকতায় পরিপূর্ণ। এক ধরনের নিরাভরণ অভিনয়ের চর্চা আমৃত্যু করে গেছেন তিনি, যাকে অন্য নামে ‘মিনিমালিস্টিক অ্যাক্টিং’ বলা যায়।

 

না, উত্তম ঠিক অতোটা সময় পাননি। দীর্ঘদিন অভিনয় করার সৌভাগ্য সৌমিত্র পেয়েছিলেন। আর অভিনয়ের সঙ্গে তাঁর এই দীর্ঘ জীবন লেপ্টে থাকার ফলে টালিউডের চলচ্চিত্রে স্বাভাবিক অভিনয়ের একটি ধারাও তৈরি হয়েছে—তৈরি করেছেন তিনি।

 

গত শতকের আশির দশকে টালিউডের সিনেমায়—প্রসেনজিৎ, চিরঞ্জিত, তাপস পাল, রণজিৎ মল্লিকদের অভিনয় উচ্চকিত না হলেও ছিল খানিকটা নাটকীয়তামাখা। এই সময়ে সৌমিত্রও অভিনয় করেছেন। কিন্তু ওঁর অভিনয় ছিল বরাবরের মতো—নাটকীয়তার রেশশূন্য। ২০০০ সাল থেকে কলকাতার সিনেমায় যখন নতুন হাওয়া বইতে শুরু করে, সৌমিত্রও যেন ধুয়ে মুছে নিজেকে আবার গড়ে তোলেন অন্য মূর্তিতে। বিশেষত, এই সময় তাঁর যে স্বাভাবিক অভিনয়ধারা, সেই ধারায় অভিনয়চর্চা করেন একদল তরুণ। এই সূত্রে আজকের পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, যিশু সেনগুপ্ত, আবীর চট্টোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য হয়তো সেই ধারারই পরিপুষ্ট প্রতিনিধি। ফলে তাঁদের অভিনয়প্রতিভার প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই মোটা দাগে এই অভিনয়শৈলীকে যদি ‘সৌমিত্র ম্যানারিজম’ নামে অভিহিত করি, অপরাধ হবে কি?

 

আরেকটা ব্যাপার বলা দরকার, সৌমিত্র অভিনেতা ছিলেন বটে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ছিলেন সংস্কৃতিবান মানুষ। তিনি কবিতা লিখেছেন, এন্তার গদ্য রচনা করেছেন, ছোটকাগজ সম্পাদনা করেছেন, আবৃত্তি করেছেন, প্রগতিশীল আন্দোলনেও ছিলেন সক্রিয়। সব মিলিয়ে শিল্পকে চারধার থেকে পরিপূর্ণভাবে বুঝে নেওয়ার যে চেষ্টা, সেটা তাঁর মধ্যে সব সময়ই ছিল। আফসোসের কথা হলো, এই চেষ্টাটা এখন বড্ড অনুপস্থিত আমাদের ‘স্টার’দের মধ্যে।

 

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বিগত হলেন সত্য, একই সঙ্গে এটাও কি সমান সত্য নয়, সেই শৈশব থেকে বড় হতে হতে, তাঁকে দেখতে দেখতে আমাদের স্মৃতির মধ্যে তিনি যেভাবে নির্মিত হয়েছিলেন, সেই নির্মাণেরও এখন ইতি ঘটল?

 

বাংলাদেশে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ই বোধ হয় কলকাতার ‘ক্লাসিক’ যুগের শেষ অভিনেতা, রবীন্দ্র মূল্যবোধের আবহে যাঁকে দেখে আমরা আপ্লুত হতাম, স্মৃতির পিঞ্জরে যাঁকে বাঁচিয়ে রাখতাম।

1 COMMENT

  1. তাইতো সৌমিত্র নিজে বলেছিলেন এক সাক্ষাৎকারে, বাংলা চলচ্চিত্রে শুধুমাত্র তাঁর অভিনয় দেখে কবিতার কথা মনে পড়ে।স্যালুট টু হিম।লেখাটি ভালো লেগেছে।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here