বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায় এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় — এঁরা তিনজনই রত্ন। আর এঁরা সবাই মিলে ত্রিরত্ন। এই ত্রিরত্ন মিলে বাংলা সিনেমা-জগতে তৈরি করেছিলেন এক আশ্চর্য আর ভেলকিময় ত্রিভুজ। ত্রিভুজ ব্যাপারটা যদিও অংকের, কিন্তু এই আলোচনায় হয়ে উঠবে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমার। ওপরে যাঁদের নাম নিয়ে ত্রিরত্নের ত্রিভুজ নির্মাণ করা গেলো, এঁদের দুজন আগেই গত হয়েছেন। ছিলেন একজন : সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় — তিনিও গত হলেন, গতকাল। ত্রিভুজের একটা বিচ্ছিন্ন বাহু সরলরেখার মতো দিন যাপন করে আমাদের জানান দিচ্ছিলেন বার বার, অপর দুই বাহু সম্পর্কে — তিনিও চলে গেলেন শেষমেশ!
তিনি যে অল্পতে শেষ হয়ে যাননি, তা তাঁর বেশি বয়সে অভিনীত সিনেমাগুলোর দিকে নজর দিলেই স্পষ্ট হয়। ‘বেলাশেষে’ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ‘বেলা শুরু’ মুক্তির আগেই মারা গেলেন। কেবল শেষের দিকের কেন, তাঁর প্রথম দিককার সিনেমাও তো ভুলবার নয়। আর অভিনয়-জীবনের মাঝামাঝিও তিনি ভালোই করেছেন। মানে আগাপাশতলা ভালো অভিনেতা যাকে বলে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাই আর কি! ‘বক্স অফিস’ কাঁপানোর মানদণ্ডেও তিনি সফল ছিলেন। কেউ কেউ বলেন, পুরোনো জিনিসের ব্যাপারে কে খোঁজ নেয়, রাখে? আসলে সবাই খোঁজ নিবে — এমনটা কোনোদিনই এই ভূমিতে চলতি বিষয় হিসেবে ছিল না। যাদের দরকার তারা নিবে। আদতে নেয়ও, নিবেও। আর তার পরিমাণও যে একেবারে কম, তা নয়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মারা যাবার পর এই বিষয়টা স্পষ্ট হয়েছে যে, জেনারেশনের পর জেনারেশন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সিনেমা বিষয়ে তৎপর ছিল, এবং আছে; আশা করি থাকবেও।
কাজের কথায় ফেরা যাক। মানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখলে তো লেখা শেষ হবে না। কিন্তু সবচেয়ে বড়ো যে বিষয়, তা হলো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম উচ্চারণের সাথে সাথে আরো দুটো নাম আপসেই চলে আসে : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়। এঁদের প্রতেক্যেরই আলাদা আলাদাভাবে বিখ্যাত হওয়ার মতো নানান কারণ ছিল, আছে। কিন্তু এই তিনে মিলে যে কম্বিনেশনটা তৈরি হয়েছিল, বাংলা সিনেমায় — তা এক কথায় অসাধারণ। অসাধারণ মানে অসাধারণ। একেবারে মডার্ন পিরিয়ডে ক্লাসিক বাজিমাত। ক্লাসিক তো তাই, যার আবেদন চিরকালীন। এঁদের তিনজনের কম্বিনেশনে যে সিনেমাও তৈরি হয়েছে, সেই সমস্ত সিনেমাও ক্লাসিক হয়ে উঠেছে।
ক্লাসিকের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য চিরকালীন আবেদনের ব্যাপার। অপুর সংসার কিংবা ফেলুদা এই বিষয়টা টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। পেরেছে মানে ভালো করেই পেরেছে। এখনো যে লোকজন আগ্রহ নিয়ে এই সমস্ত সিনেমা দেখে, আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে, এবং মাঝে মাঝে অশ্রুসজল চোখে সিনেমা শেষ করে বিদায় হয় — তাই এই ক্লাসিক গুণের বহিঃপ্রকাশ। অপু কিংবা ফেলুদা চরিত্র এক্ষেত্রে কার্যকারি ভূমিকা পালন করেছে।
এই কাজটা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একা করে উঠতে পারতেন না বোধহয়। যদি না বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কালজয়ী উপন্যাস পথের পাঁচালী লিখে রেখে না যেতেন; কিংবা সত্যজিৎ রায় না লিখতেন ফেলুদা সিরিজ। যে কোনো সিনেমার জন্য সিনেমার গল্প, অর্থাৎ প্লটটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্লট অনুযায়ীই সিনেমা হয়, সিনেমার স্ক্রিপ্ট লেখা হয়, সিনেমায় অভিনয় হয়, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয় করেন। আর পরিচালক? পরিচালক তো এইসব দেখভাল করেই পুরো সিনেমাটা তৈরি করেন। পরিচালক সামান্য কিছু নিয়েও জগদ্বিখ্যাত এবং কালচক্রজয়ী সিনেমা বানিয়ে ফেলতে পারেন; যদি তার সেই দক্ষতা থাকে। সত্যজিৎ রায় সেই কাজটাই করে উঠতে পেরেছিলেন। এই ব্যাপরটা অনেকটা ‘পাখি মারা বন্দুক নিয়ে বিশ্বযুদ্ধে সামিল হওয়ার’ মতো।
সত্যজিৎ রায় সেই মাপেরই সিনেমাওয়ালা ছিলেন, যিনি প্লট এবং অভিনেতা পেয়ে বানিয়ে ফেলেন জগদ্বিখ্যাত সব সিনেমা; সাজসরঞ্জামের সংকট থাকা সত্ত্বেও। আরেকটা ব্যাপার, বড়ো মাপের পরিচালকের যে সমস্ত গুণ থাকা দরকার তা হলো সিনেমার জন্য মানানসই অভিনেতা-অভিনেত্রী খুঁজে বের করা। সত্যজিৎ রায় বড়ো মাপেরই পরিচালক ছিলেন। না হলে নিষিদ্ধ পল্লীর পরিত্যক্তাকে দিয়েও যে দুর্দান্ত অভিনয় করানো যেতে পারে, তা সত্যজিৎ রায় ঠাওর করতে পারতেন না। এবং একথা হয়তো সত্য যে, পথের পাঁচালী সিনেমার ইন্দির ঠাকরুণের চরিত্রে অভিনয় করা চুনীবালা দেবী এই সিনেমা দেখেছে এমন প্রত্যেকের মনে বোধহয় সবচেয়ে বেশি গেঁথে আছেন। আবার কম জিনিসপাতি নিয়েও যে বিশ্বমানের সিনেমা তৈরি করা যায়, তারও জ্বলজ্বলে উদাহরণ সত্যজিৎ রায় ও তাঁর সিনেমা। আর এই বিষয়ে সাক্ষ্য-উদাহরণ : সত্যজিৎ রায়ের অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড জয়।
পথের পাঁচালী সিনেমার পরে এই সিনেমার সিকুয়্যাল হিসেবে নির্মাণ হলো আরেকটা সিনেমা, নাম : অপুর সংসার। বিভূতিভূষণের অপরাজিত উপন্যাসের সিনেমায়ন। প্লট, অর্থাৎ স্ক্রিপ্ট তৈরি হয়েছিল অপরাজিত উপন্যাস থেকে। দুর্দান্ত, দুর্দান্ত এবং দুর্দান্ত। চারদিকে সাড়া তো ফেললই। তবে বেশি সাড়া বোধহয় ফেললেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেই। তখনও তিনি পড়ছেন কলেজে : একেবারেই তরুণ। প্রথম সিনেমা তাঁর এই। কিন্তু কী দারুণ অভিনয়! যেখানে যা দরকার, যেভাবে অভিনয় করা দরকার — সবই ঠিকঠাক করতে পেরেছিলেন তিনি। অভিনেতা-অভিনেত্রীর ‘ভিভিড রিপ্রেজেন্টশন’ সিনেমার ভালো-খারাপ হওয়ার জন্য খুবই জরুরি। আর সেই ব্যাপারটা ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা — তাও দেখার দায়িত্ব পরিচালকের। আর স্ক্রিপ্ট তো আছেই। মানে প্লট আর কি। যার আবার রয়েছে স্রষ্টা।
তাহলে অপুর সংসার সিনেমার ভিত্তি-সমীকরণ এই দাঁড়ায় যে : ১. প্লট — বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের; ২. পরিচালনা — সত্যজিৎ রায়ের; ৩. অভিনয় — সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের — আর এই তিনে মিলে তৈরি হয়েছিল বিখ্যাত সিনেমা অপুর সংসার। বাজিমাত করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সিনেমা-জগতে পা রেখেই। তবে সিনেমায় প্লটের মালিক কিংবা পরিচালকের চেয়ে বেশি পরিচিত হয়ে ওঠেন অভিনেতা-অভিনেত্রী। একথা সত্য। অর্থাৎ ‘বিহাইন্ড দ্য সিনের’ ব্যাপারটায় দর্শকের আগ্রহ থাকে না। আদতে এ বিষয়ে দর্শকের আগ্রহ থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। একথা বাস্তবেও সত্যি বটে। কিন্তু এই আলাপের সূত্র ধরে অপুর সংসার সিনেমার কথা বলতে গেলে এঁদের তিনজনের একজনকে বাদ দিলে আরেকজন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। সিনেমাটাও যেন সম্পূর্ণ হবে না। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, এই সিনেমায় কি আর কেউ অভিনয় করেনি? প্রশ্ন তো যৌক্তিক। অনেকেই করেছেন, তবে আলোচনা যেহেতু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে, তাই এই আলাপে তাঁদের কথা চেপে গেলাম। পাঠক ক্ষমা করবেন।
অভিনয়-জীবনের শুরুতেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে প্রথম সিনেমায় কাজ করতে গিয়ে অভিনয়ের ভেলকি দেখিয়ে বিখ্যাত বনে গিয়েছিলেন; তার পিছনে বড়ো ভূমিকা তো অবশ্যই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়ের, একথা অস্বীকার করার জো নেই। কারণ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আলোচনায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়কে বাদ দিলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একা হয়ে যান; মানে হয়ে যান ত্রিভুজের এক নিঃসঙ্গ সরল বাহু। যা দিয়ে আসলে সিনেমা-জগতে অপুর সংসার সিনেমার মতো ক্যারিশম্যাটিক সিনেমা নির্মাণের কথা মুখে তোলা সম্ভব হয় না।
যে দুটো চরিত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে বাংলা সিনেমায় বিশেষ করেছে তার প্রথমটা অপু, দ্বিতীয়টা ফেলুদা। বাঙালির শৈশব ও কৈশোরে ঘোর লাগিয়ে রাখে এমন কয়েকটা বিষয়ের মধ্যে গোয়েন্দা কাহিনি একটি, এখন অবশ্য সে অবস্থা বদলেছে। বিশ্বব্যাপী গোয়েন্দা কাহিনির নির্মাণেও একটা রাজনীতি বিশেষভাবে সক্রিয় থাকে : নিজের দেশ ভালো, আর পরের দেশ কালো। নিজে সাধু, বাকিসব চোর। ফলে এই রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে গোয়েন্দা কাহিনি ও গোয়েন্দা সিনেমা তৈরি হয়। ধরুন, জেমস বন্ডের কথাই বলি। তামাম দুনিয়ায় এই লোক শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে আসলে কী করে বেড়ায়? গভীর দৃষ্টি দেন। চাক্ষুস প্রমাণ হাজির হবে। এই আলাপ বাড়ালাম না।
কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদায় এই রাজনীতি নেই। নিজস্ব আর নির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সীমানার মধ্যেই গোয়েন্দাগিরি করে ফেলুদা। যদি মাঝেমধ্যে একটু বাইরে যেতেই হয়, তাও কোনো ‘ভালো’ আর ‘কালো’র হিসেব করে গোয়েন্দাগিরি একেবারেই না। আর সত্যজিৎ রায়ের ‘ফেলুদা’র সিনেমায়ন আরো চমৎকার। যেখানে বেশিরভাগ সিনেমায়ই ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। (রিমেকে তো কতোজনই অভিনয় করেছেন, করছেন, করবেন নিশ্চয়ই) এখানেও দুর্দান্ত অভিনয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। আগের শান্ত আর সরল অপু বদলে গিয়ে হলেন দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা ফেলুদা।
ট্রান্সমিশনটাও একইসাথে গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি, অভিনেতা-অভিনেত্রীর জন্য। হতে হয় জলের মতো। যে পাত্রেই যাও, সে পাত্রেরই রূপ ধারণ করো। এটাই গুরুত্বপূর্ণ, অভিনেতা-অভিনেত্রীর জন্য। ‘ফেলুদা’য় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাদ। বাদ মানে তাঁর গল্প কিংবা প্লট ব্যবহৃত হলো না। কিন্তু আবার একেবারেই বাদ না, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। কারণ যে অপু অপুর সংসারে বাজিমাত করেছিলেন সেই অপুই ফেলুদায়ও বাজিমাত করেছিলেন। বাজিমাত করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ফেলুদার প্লট আর পরিচালনা — দুটোই সত্যজিৎ রায়ের। অভিনয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। এখানে আবার তিনে মিলে নয়, দুইয়ে মিলে চমৎকার!
এখন যে কেউ গুরুতর প্রশ্ন তুলতে পারেন : সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কি কেবল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কথাসাহিত্যের গল্প-প্লটের স্ক্রিপ্টেই সিনেমা করেছেন? আবার তিনি কি কেবল সত্যজিৎ রায়ের পরিচালিত সিনেমায়ই অভিনয় করেছেন? না। একেবারেই না। তিনি বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষ থেকে যে সিনেমায় অভিনয়-যাত্রা শুরু করেছিলেন, তা শেষ হলো একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের একদম শেষে। তার মানে প্রায় ষাট বছরের অভিনয়-জীবন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁর কোনো সময় অচল হয়ে পড়েনি। শেষ পর্যন্ত অভিনয় করেই পার করেছেন। তাঁর সিনেমা প্রকাশের সন-তারিখের হিসেবের দিকে নজর দিলেই ব্যাপারটা খোলসা হবে আরো। শেষমেশ মারা গেলেন, কিন্তু কর্ম বাদে ছিলেন এমন নয়, কর্মের সংস্পর্শেই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সৃষ্টি-জগৎ বৃহৎ, তাঁর সৃষ্টির পরিমাণও বৃহৎ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সিনেমার সংখ্যা তিনশ’র ওপরে।
এই তিনশ সিনেমা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা সাহিত্য-প্লট থেকে নির্মিত হয়নি। তেমনি সত্যজিৎ রায়ও এই সকল সিনেমা পরিচালনা করেননি। তিনি অনেক লেখকের প্লটেই অভিনয় করেছেন। যেমন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ আরো অনেকের। আবার অনেক পরিচালকের পরিচালনায়ই সিনেমা করেছেন। যেমন : তপন সিংহ, মৃণাল সেন, অসিত সেন, অজয় কর, তরুণ মজুমদার, দিলীপ রায়, দীনেন গুপ্তসহ অনেকের। কিন্তু যে কোনো কিছুর শুরুর গুরুত্ব বিশেষ। আবার ‘মাস্টারপিস’ বলেও একটা বিষয় রয়েছে। এই প্রসঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সিনেমা-জীবন আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সত্যজিৎ রায়। অর্থাৎ শুরুটা হয়েছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সিনেমা-জীবনের, সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায়। যে সিনেমার প্লট নির্মিত হয়েছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের মাধ্যমে। আর সেই সিনেমাই ‘মাস্টারপিস’ হয়েছিল। সেই সিনেমার অভিনীত অপু চরিত্রই প্রতিনিধিত্ব করে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। আবার যেমন ফেলুদা চরিত্র বলার সাথে সাথে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মুখাবয়ব ভেসে ওঠে আমাদের সামনে। আবার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সিনেমার কথা বলতে গেলেই ‘অপুর সংসার’ প্রথমেই এসে ধাক্কা দেয়, ধাক্কা দেয় ফেলুদা সিরিজের সিনেমা। তারপর আস্ত-ধীরে অন্যান্য সিনেমা।
আলোচনা শেষে তাই বলা যায়, সৌমিত্র চট্টোপ্যাধায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়ের ওপর নির্ভর করেই মস্ত বড়ো অভিনেতা হয়ে উঠেছেন ব্যাপারটা পুরোপুরি সত্য নয়। একেবারেই সত্যি নয়। বেলা শেষে সিনেমায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে ‘বুড়ো হাড়ের ভেলকি’ দেখালেন, সেখানে তো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা সত্যজিৎ রায়ের অবদান নেই, তারা তো ‘ঢের আগে’ গত হয়েছেন। কিন্তু এই বেলা শেষের সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মূলত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সত্যজিৎ রায়ের দুই চরিত্র : অপু এবং ফেলুদা-ই। তাই যদি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে আলাপ করতে হয়, তাঁর সিনেমা-জগতের উদ্ভব-বিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে হয় — তো সেখানেও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সত্যজিৎ রায়ের আলাপ আসবে। একজন ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়’ হওয়ার পিছনে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সত্যজিৎ রায়ের প্রভাব, প্রতিপত্তি এবং অবদান অস্বীকার করা মূলত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে অস্বীকার করারই নামান্তর। শেষে আর দু-এক কথা বলে শেষ করবো। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর ফলে চারদিকে যে হাহারব শোনা যাচ্ছে, তার বোধহয় এতো কারণ দেখি না। কারণ এক জীবনে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সবদিক থেকে সার্থক — কর্মে এবং অর্জনে; যা যে কারো জন্যই ঈর্ষণীয় তো বটেই।