একে একে নিভে যাচ্ছে সব প্রদীপ আর মহীরুহ পতনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। চিরপ্রস্থানের দেশে চলে গেলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অভিনেতা হিসেবেই আমরা তাঁকে চিনি ও জানি। আদতে প্রগাঢ়ভাবে তিনি শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। শিল্পকে উদযাপন করেছেন বিবিধ মাধ্যমে। তিনি যে কবি, একথা আমাদের অনেকেই জানেন না; শুধু জানি, মেঘ-গম্ভীর কণ্ঠের আবৃত্তিকার তিনি। অথচ তিনিই লিখেছেন ১৪টি কবিতাপুস্তক।
এ কথা কজন জানেন যে, একদা তিনি নির্মল আচার্যের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করতে এক্ষণ নামের একটি পত্রিকা। ওই পত্রিকার পাতায় পাতায় ছড়ানো আছে শিল্পমনস্ক ব্যক্তিত্বের ছাপ। সৌমিত্র ছবিও আঁকতেন। অভিনয় ও চলচ্চিত্রের লাইট, ক্যামেরা আর অ্যাকশনের নিচে চাপা পড়ে গেছে সৌমিত্রের প্রতিভার অপরাপর আলো। এক সৌমিত্র – কত তার রূপ!
তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ – সকল বয়সী চরিত্রেই তাঁকে দেখা গেছে। অপুর সংসারে অপু, গোয়েন্দা ফেলুদা, ষাট বছর বয়সী বৃদ্ধ ফাদার চরিত্র, বেলাশেষের সেই বুড়ো মানুষটি, তরুণী স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করা রাধিকা আপ্তের বুড়ো স্বামী – কোন চরিত্রে তিনি বেমানান? চরিত্রের সঙ্গে মিশে যাওয়ার যে ধারণা প্রবলভাবে চলচ্চিত্র জগতে বিদ্যমান, সৌমিত্র নিঃসন্দেহে তার প্রতিনিধিত্ব করেন।
সৌমিত্র লিখেছেন, ‘অভিনয়ের ক্ষেত্রে চরিত্রের শারীরিক ও মানসিক গঠন দুই বোঝায়।’ আরও বলেছেন, ‘অভিনয়ের জন্যে চরিত্রের মানসিকতা বোঝার চেষ্টার সঙ্গে তার শারীরিক আচার ব্যবহারকে কল্পনা করার চেষ্টা…।’ এ কারণেই তারাশঙ্করর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অগ্রদানী’ গল্পের পূর্ণ চক্রবর্তীর চরিত্র রূপায়ণ করতে গিয়ে তাঁকে সাজতে হয়েছিল ‘কুৎসিৎ এবং উদ্ভট’। কিন্তু এও তাঁরই স্বীকারোক্তি যে, অতিরিক্ত রূপসজ্জার কারণে সব চরিত্র ‘দর্শকের আনুকূল্য’ পায় না।’
সৌমিত্রের ভেতর দিয়ে দেখা যাবে শহর কলকাতার বাঙালি মধ্যবিত্তের আদ্যোপান্ত। সৌমিত্রের অভিনয়-জীবন যদি হয় একটি জীবনপ্রবাহ, তাহলে সেই প্রবাহের ভেতর শুনতে পাওয়া যাবে নাগরিক কলকাতার কণ্ঠস্বর –- হররোজ বদলেছে যে-শহর সৌমিত্র যেন সে-শহরে গল্পওয়ালা। সৌমিত্রের বয়স বেড়েছে, বয়স বেড়েছে কলকাতারও, বদলে গেছে কলকাতার গল্প, অভিনেতা হিসেবে সৌমিত্র মিশে গেছেন সেই সব গল্পের ভিড়ে। অপুর সংসারের অপুকে নিয়ে বলেছেন, ‘জীবন সম্পর্কে গভীর আস্থা এবং আশা তখনও আমাদের অপুর মতোই রোমান্টিক করে রেখেছিল। তাছাড়া মফস্বল থেকে শহরে আসা যুবকের মানসিকতাটা আমরা বুঝতাম। আমরা নিজেরা অনেকেই সেরকম গ্রামগঞ্জ বুকে করে কলকাতার রাস্তায় হেঁটে বেড়িয়েছি। আমরা তীব্রভাবেই অপুর মধ্যে নিজেদের কল্পপ্রতিকৃতি মিলিয়ে নিতে পারতাম।’
গণনায়ক বা জননায়ক তিনি নন, একথা তিনিও জানতেন। সত্যজিতের ১৪টি সিনেমায় অংশ নিয়েও নায়কে তিনি নেই; সত্যজিৎ তাঁকে নেন নি। সৌমিত্র চমৎকার অভিনেতা হওয়া সত্ত্বেও প্রথাগত অর্থে ‘নায়কে’র গ্ল্যামার মিশে আছে উত্তমের গায়েই — সত্যজিৎ তা শতভাগ বুঝেছিলেন। উত্তমই সত্যিকার অর্থেই গ্ল্যামারাস নায়ক; শ্রেণি-বর্গ নির্বিশেষে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা। কিন্তু সৌমিত্র? – তাঁর আছে সেই মধ্যবিত্ত মন, যার গ্ল্যামার নেই, আছে বুদ্ধিজীবিতা, চিন্তনদক্ষতা, পোড় খাওয়া জীবনের গ্লানি, হতাশা; কেবল নেই চমকপ্রদভাবে জীবন ও বাস্তবতাকে বদলে দেয়ার অসম্ভব ক্ষমতা — জনপ্রিয় সংস্কৃতির চলচ্চিত্রে যা কমবেশি উপস্থিত থাকে।
সৌমিত্রের অভিনয় জীবনে ছিল ‘অচরিতার্থতার যন্ত্রণা’; এটি তাঁর পিছু ছাড়ে নি। এক যুগ অভিনয় করে একথা তাই সৌমিত্র লিখতে পেরেছিলেন, ‘একের পর এক ছবিতে বিভিন্ন পোশাক পরে একই চরিত্রে অভিনয় করার সময় অন্তরাত্মা হাঁপিয়ে ওঠে। তখন বাধ্য হয়ে পেছনের দিকে তাকাই, তাকাই সেই সজীব সৃষ্টিশীল আরম্ভের দিনগুলির দিকে।’ সতর্ক থাকতে চেয়েছেন বারবার — ‘নতুন জাতের অভিনয় করব’ এমন বাসনার স্থলে যেন জায়গা না করে নেয় ‘চিত্রতারকার উপযু্ক্ত অগভীর আত্মপরায়ণ’ লালসাকাতর মন। তার মানে, সৌমিত্র অভিশিল্পী হতে চেয়েছিলেন, প্রথাগত চিত্রতারকা নন।