রাষ্ট্র ও সহিংসতা

সম্ভবত আমরা বাস করছি সহিংসতার এক বিভীষিকাময় স্তরে — যেখানে রাষ্ট্র ও সহিংসতা পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেছে। সহিংসতা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জাতিক, লৈঙ্গিক, আন্তঃরাষ্ট্রিক। প্রকৃতপক্ষে সহিংসতা ছাড়া কোনো রাষ্ট্র নেই, রাষ্ট্র ছাড়া বৃহৎ মাত্রার কোনো সহিংসতা নেই। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস মূলত সহিংসতার ধারাবাহিক ইতিহাস। যুদ্ধ ও রক্তপাত ছাড়া কোনো ভূরাজনৈতিক অঞ্চলের রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কথা আমরা কল্পনা করতে পারি না।

 

প্রতিটি রাষ্ট্রে ছড়িয়ে আছে সহিংসতার বহুমুখী ধরন। সহিংসতার রূপ : জাতি বনাম জাতি, ধর্ম বনাম ধর্ম, রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্র, ধর্ম বনাম রাষ্ট্র, রাষ্ট্র বনাম ধর্ম, গোত্র বনাম গোত্র ইত্যাদি। আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়েছে অঞ্চল বনাম অঞ্চল, রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্রের পারস্পরিক সহিংসতার বৃত্তান্ত।

 

স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ভেতরও চোখেমুখে ভয় ও বিভীষিকার চিহ্ন নিয়ে আমরা ঘুরে বেড়াই। আমাদের সতর্ক করা হয়, সাবধানে থেকো, সাবধানে যেও, মুসলমানদের জন্য আমেরিকা নিরাপদ নয়, রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমার ভয়ানক, সংখ্যালঘুরা বাংলাদেশে সস্তিতে নেই, সংখ্যালঘু মুসলমানরা ভারতে সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের শিকার। আমরা পরস্পরকে বলি, দেশের অবস্থা খারাপ, সব কথা লিখো না, সব কথা বলো না, সব কথা বলতে হয় না, এমন করে লিখবেন না, কল্লা থাকবে না। এ ভয় কেবল স্থানিক নয়, বৈশ্বিক। সহিংসতারও বিশ্বায়ন ঘটেছে; যেমন : ধরা যাক, মার্কিন হামলা কিংবা আইএস-এর তৎপরতা। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন কিংবা ঔপনিবেশিক আধিপত্য ও দাসব্যবসাকে সহিংসতা ছাড়া আর কী বলতে পারি!

 

সহিংসতার একটিমাত্র কোনো বিশেষ চেহারা বা অবয়ব নেই। এটি সংঘটিত হতে পারে প্রকাশ্যে, হতে পারে নীরবে, হতে পারে সম্মতিতে ও অসম্মতিতে। সত্যি কথা বলতে কি, সহিংসতা ছাড়া কোনো সভ্যতাই বিকাশ লাভ করে নি। সহিংসতার পথেই বিশ্বমানচিত্রে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে নতুন রাষ্ট্রের মানচিত্র। এমন কোনো রাষ্ট্র কি আছে যার উদ্ভবের পেছনে সশস্ত্র সহিংসতার চিহ্নমাত্র ছিল না? পুলিশ, আদালত, বিচারব্যবস্থা, শাস্তি কীসের জন্য? সভ্য রাষ্ট্র সহিংসতা ঠেকানোর জন্য তৈরি করেছে এইসব রাষ্ট্রীয় কানুন ও প্রতিষ্ঠান। কিন্তু রাষ্ট্র নিজেই এগুলোকে ব্যবহার করে থাকে সহিংস ও আক্রমণাত্মক হাতিয়ার হিসেবে।

 

প্রযুক্তিতাড়িত এই বিশ্বে আমরা দেখতে পাচ্ছি ভায়োলেন্সের দৈনন্দিন প্রদর্শনী; সাম্প্রতিক বিশ্বব্যবস্থায় রাষ্ট্র হলো সহিংসতা প্রদর্শনের প্রেক্ষাগৃহ। আমরা দেখছি, বহুমাত্রিক দৃশ্যায়ন। দৃশ্যের পর দৃশ্য তৈরি হচ্ছে, সচল ও সজীব, তীব্র ও তীক্ষ্ণ, ভয়াবহ ও আর্ত। প্রযুক্তির উদারতায় ছড়িয়ে পড়ছে সেই সহিংসতার দৃশ্য। আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার দৃশ্য আমরা দেখেছি। অডিওতে শুনেছি মৃত্যুপথযাত্রী পিতার করুণ কণ্ঠস্বর, কন্যার আর্তনাদ — যেন পিতাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বধ্যভূমিতে! আইন-শৃঙ্খলাবাহিনি নিজে সেইসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ধীরে ধীরে আদায় করে নিয়েছে নাগরিক সম্মতি। তাই এই উচ্চারণ আজ সাবলীল হয়ে উঠেছে যে, ‘ক্রসফায়ারে দেয়া হোক’, ‘ক্রসফায়ারে দেয় না কেন’। সম্মতি এখন এমন যে, পুরুষকর্তৃক পুরুষ শিশু ধর্ষণ ও লিঙ্গীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে সক্রিয় কোনো প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ নেই। যদিও সম্মতিনির্ভর সমকামিতা নিয়ে অনেকের মধ্যে প্রশ্ন আছে; সমকামিতার ব্যাপারে যতো ঘৃণা উৎপাদিত হয়, ততো প্রতিবাদ উৎপাদিত হয় না অসম্মতিসূচক সমলৈঙ্গিক বলাৎকার/যৌন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে। এটিও যে ধর্ষণ, এই বোধ তৈরি হয় নি অনেকের মনে। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে লিঙ্গীয় সহিংসতায় ব্যাপকভাবে পরাস্ত নারী ও শিশু। কিন্তু আমাদের প্রতিরোধগুলো স্তিমিত হয়ে আসে। আইন বদলালেও ধর্ষণ কমে না। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা জুড়ে ধর্ষণের রক্তাক্ত সংবাদ।

 

পরিস্থিতি এখন এমন যে, একটি বাহিনি অন্য একটি বাহিনির সদস্যকে হত্যা করতে দ্বিধা বোধ করছে না। আমাদের মনে পড়বে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিভীষিকাময় দৃশ্যায়ন ও প্রদর্শনী। আমরা দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য। আমাদের সামনে হাজির হয়েছে গণধর্ষণে রক্তাক্ত নারীর করুণ পোশাক। নারীর যোনী পিষে ফেলার বিভীষিকাময় দৃশ্য আমরা দেখেছি ভিডিওতে।

 

হিটলারের সাম্রাজ্যে ইহুদি নির্যাতনের ভয়াবহতা ইতিহাস আমরা মনে রেখেছি। ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিনের শিশুদের রক্তমাখা মুখ আমাদের মনে পড়ে। কাশ্মীরের রক্তক্ষরণ ও আর্তনাদ আমাদের চোখের সামনে। তার অর্থ এই যে, আমাদের সামনে প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্তে দৃশ্য তৈরি হচ্ছে। দৃশ্যগুলো সম্প্রচারিত হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে সংক্রমণশীল ভাইরাসের মতো, যে কারণে আমরা বলছি ভাইরাল

 

সেই সব দৃশ্য থেকে কী নিচ্ছি আমরা? সহিংসতা সহ্য করার মানসিক ক্ষমতা? সহিংস হয়ে ওঠার প্রেরণা? সহিংসতা বিলোপ করার দৃঢ় কোনো শক্তি? সম্ভবত শেষটির জবাব না-সূচক। প্রচুর ছড়াচ্ছে বলে ভাইরাল, কিন্তু তারও অধিক প্রবণতা এই যে, আমরা সংক্রমিত হচ্ছি। আমরা হয় সহ্য করছি, নয় মানসিক বিকৃতিতে ভুগছি। হত্যা-খুন-গুম-ধর্ষণের মতো বিভীষিকাকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে পরিগ্রহণ করে নিচ্ছি এবং সভ্যতার সৃষ্টি করা আইন-বিচার ইত্যাদির ব্যর্থতার সামনে নিজেও সঙ্গোপনে হয়ে উঠছি সহিংস। ইউজেন আয়োনেস্কোরগণ্ডার নাটকের গণ্ডার হয়ে যাওয়া মানুষের মতো তীক্ষ্ণ শিং দিয়ে আঘাত করতে উদ্যত হচ্ছি।

 

রাষ্ট্রনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রের বর্তমান দৃশ্যরূপ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের ব্যর্থতাকে নির্দেশ করে। বিশ্বের অগণিত রাষ্ট্র কোনো-না-কোনো মানদণ্ডে আসলে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’। হয় আইন ব্যর্থ, বিচারব্যবস্থা ব্যর্থ, মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ, নয় অর্থনৈতিক ভারাসাম্য রক্ষায় ব্যর্থ, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ব্যর্থ। এইসব ব্যর্থতার তালিকা দীর্ঘ হতে হতে তৈরি করছে গণহতাশা, গণহতাশার ভেতর থেকে তৈরি হচ্ছে ভায়োলেন্স। সেটি ছড়িয়ে পড়ছে গৃহে ও গৃহের বাইরে। এমনকি তা ছড়িয়ে আছে আন্তর্জালিক দৃশ্য-অদৃশ্য ভুবনে।

 

বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে ভায়োলেন্স রূপ পেয়েছে নানা মাত্রায়। ২৫ মার্চের কালরাত্রি ভায়োলেন্সের আকারে স্মৃতি হয়ে ঢুকে গেছে বাংলাদেশের মানুষের ঐতিহাসিক স্মৃতির ভেতর। ১৯৭১-এর মতো বিরাট ইতিহাসপর্ব পেরিয়ে তারপর থেকে রাজনীতির মঞ্চে ভায়োলেন্স এবং ভায়োলেন্স। একাত্তর-পরবর্তী সহিংসতার ভয়াবহ রূপ ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড। সরকারি বেতারযন্ত্রে সরাসরি ঘোষণা করা হয়েছে, ‘খন্দকার মুশতাক আহমেদের নেতৃত্বে আজ ভোরে সামরিক বাহিনী দেশের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। দেশের বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে।’

 

বাংলাদেশে এই প্রথম বেতার মাধ্যমে জনগণ জাতীয় খুনের স্বীকারোক্তি সরাসরি শুনেছে, সহ্য করেছে, গ্রহণ করেছে। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে কয়েক যুগ পর। জেলখানায় চার নেতার হত্যাকাণ্ড সহিংসতার মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সামরিক অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান, হত্যাকাণ্ড, সামরিক আদালত কর্তৃক পরিচালিত হত্যাকাণ্ড, সামরিক শাসনকালে ছাত্রজনতার ওপর পরিচালিত হত্যাকাণ্ড – বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সহিংসতার ধারাবাহিক উদাহরণ। মূলত ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০-এর গণ-আন্দোলন পর্যন্ত সামরিক বাহিনির সহিংসতা এতো প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, সামরিক বাহিনির প্রতি এখনও জনগণ সন্দেহের চোখে তাকায়। সাম্প্রতিক কালে প্রবলভাবে চোখে পড়ছে পুলিশ বাহিনির সহিংস আচরণ। আর তাই এই বাহিনিকে বারবার ঘোষণা করতে হচ্ছে ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু।’

 

এটি কি কেবল বাংলাদেশে রূপ? নিশ্চয়ই তা নয়; দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক, পুলিশ কিংবা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনির প্রতি আস্থার সংকট জনগণের গভীর হৃদয় পর্যন্ত বিস্তৃত। পড়শি রাষ্ট্র ভারত-পাকিস্তান-মিয়ানমারের দিকে তাকালেই বিষয়টি অনেকটা জলের মতো সরল হয়ে ওঠে।

 

সহিংসতার রূপ দেখতে হয়েছে আন্তর্জাতিক পরিসরে। ইরাক-ইরান যুদ্ধ, উপসাগরীয় যুদ্ধ, আফগানিস্তানে রুশ আগ্রাসন, আফগানিস্তান-ইরাক-সিরিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আক্রমণ ও আগ্রাসন নিশ্চিতভাবেই ভায়োলেন্স। সম্প্রতি শুরু হয়েছে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের নাগার্নো-কারাবাখ যুদ্ধ। তার অর্থ কি এই যে, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সহিংসতা পারস্পরের উপজাত?

 

সহিংসতার সোজাসাপ্টা দুটো রূপ : আক্রমণাত্মক ও আত্মরক্ষামূলক। প্রতিটি বিপ্লব, অভ্যুত্থান ও আন্দোলনে কোনো-না-কোনোভাবে যুক্ত থাকে আক্রমণকারী ও আত্মরক্ষকারীর মধ্যকার সহিংসতা। আধুনিক রাষ্ট্র এভাবেই এগিয়েছে। রাষ্ট্র যখন জনগণের সঙ্গে করা সাংবিধানিক চুক্তির বরখেলাপ করেছে তখনই তৈরি হয়েছে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। রাষ্ট্র-পরিচালক হিসেবে সরকার চলে গেছে দমন ও নিপীড়নের ভূমিকায়। রাষ্ট্রের সংবিধানে বাক্-স্বাধীনতার কথা উল্লেখ থাকলেও বাক্-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। কমিউনিস্ট রাষ্ট্রেও আমরা দেখেছি বাক্রুদ্ধতা ও মতাদর্শিক নিয়ন্ত্রণের ইতিহাস। বিপ্লব-উত্তর ইরানে দীর্ঘকাল ধরে জারি আছে একই অভিযোগ।

 

তাহলে সহিংসতা কি সভ্যতার দান? ‘বন্য’ ও ‘বর্বর’ বলে অভিহিত সময়পর্বের সহিংসতা কি এমন ছিল? মত, চিন্তা, দৈনন্দিন জীবন, গণমানুষ — সব কিছুর ওপর কি ছিল রাজ্য/রাজার নিয়ন্ত্রণ? নাকি রাষ্ট্র যতো শ্রেণিবিভক্ত, রাষ্ট্র যতো পুঁজিবিভক্ত হয়েছে ততো বেশি সহিংসতা ভরে করেছে রাষ্ট্রের অন্দরে? রাষ্ট্র যেমন শ্রেণিবিভক্ত, বিশ্বব্যবস্থাও তেমনি পুঁজিবিভক্ত। পুঁজি, ক্ষমতা ও প্রযুক্তি — এই তিন উপাদান আজ রাষ্ট্রের দম্ভ ও শক্তির প্রধান উৎস। জনতা সেখানে গৌণ অংশমাত্র; জনতা হলো শ্রম-কর-খাজনার যোগানদাতামাত্র। জনতা একই সঙ্গে দেখতে পাচ্ছে রাষ্ট্রের কর্তৃত্বপরায়ণতা। হাজার বছর আগেও সম্ভবত জনতার ওপর সার্বিক আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা শাসকের লক্ষ্য ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক বিশ্ব মানেই গলা টিপে ধরার ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রবহুল বিশ্ব।

 

নাগরিকের সমস্ত তথ্য সংরক্ষিত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। যে-ব্যক্তিস্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যের কথা ‘আধুনিকতা’র প্রধান দাবি, তার সবটুকুই রাষ্ট্রের তদারকি ও পরিদর্শনের আওতায় চলে গেছে বা যাবে বা যাচ্ছে। এই মুহূর্তে আপনি কোথায়? — রাষ্ট্র তা জানে। আপনি নিজেই রাষ্ট্রকে সেই তথ্য দিয়ে দিচ্ছেন প্রতি মুহূর্তে। আপনি কী করছেন, কোথায় যাচ্ছেন, কী খাচ্ছেন তাও আপনি দিয়ে দিচ্ছেন রাষ্ট্র বা প্রযুক্তিদুনিয়ার নিয়ন্ত্রকদের হাতে। তাহলে আপনার স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা থাকছে কি? মজার ব্যাপার, রাষ্ট্র নিজেও আরেক রাষ্ট্রের প্রযুক্তিকেন্দ্রিক নজরদারিতে আটকে আছে।

 

রাষ্ট্রের কাছে আপনি সম্ভবত এক বা একাধিক ডিভাইসবাহী প্রাণীমাত্র। পশু-পাখির গলায় ডিভাইস বেঁধে যেভাবে গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়, আপনিও সেই পর্যবেক্ষণের ভেতর থাকেন। কিন্তু আপনি তা টের পান না। কিংবা আপনার গতিবিধির হদিস নেওয়া জরুরি হলেই কেবল আপনার খোঁজ করা হবে। কারণ ডিভাইস বা যন্ত্রের ভেতর রেখে যাচ্ছেন আপনার পদচিহ্ন। হয়তো ভাবছেন, এসবের সঙ্গে সহিংসতার কী সম্পর্ক? রাষ্ট্র যদি গতিবিধি জেনেই থাকে, তাহলে সব অপরাধীকে ধরছে না কেন? সব অপরাধীকে রাষ্ট্র ধরবে না, কারণ সব অপরাধী ধরার দরকার রাষ্ট্রের নেই; এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আচরণ নৈর্বাচনিক। আর তখনই আসে সহিংসতার প্রসঙ্গ। কারণ আপনি দেখেন, কাউকে কাউকে ধরা হচ্ছে, কাউকে কাউকে ধরা হচ্ছে না। তখন আপনা মনে তৈরি হয় ইনসাফ বা ন্যায়বিচারের প্রশ্ন।

 

মিষ্টিমাখানো রঙচঙে বয়ান আপনাকে শোনানো হচ্ছে। আপনি শুনতে পাচ্ছেন : আইনের কাছে সবাই সমান, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়; আপনি শুনতে পেয়েছেন, War against Terrorism, War for Peace। কিন্তু আপনার সামনে হাজির হয়েছে সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসিতে ঝোলানোর দৃশ্য। আরব বসন্তের হাওয়ায় ভেসে এসেছে মৃত লাশের গন্ধ। লিবিয়ার তেলখনি পুড়ে যাবার উত্তাপ আপনি অনুভব করেছেন। তার মানে আপনি বাস করছেন সহিংসতা ও রাষ্ট্রের নির্মম তাঁবুর নিচে। রাষ্ট্র আপনার জন্য কোনো ছায়া নয়। বৃহৎ কোনো মতাদর্শের আওতায় রাষ্ট্র তৈরি হতো এবং হয়েছে — গণতন্ত্র, মার্কসবাদ, কমিউনিজম, জাতীয়তাবাদ, ধর্ম, উদারতন্ত্র; কিন্তু এই বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রে সম্ভবত কোনো গ্রহণযোগ্য মতাদর্শ নেই : যা মানুষকে তুষ্ট করতে পারে, এমন কোনো নেতৃত্ব নেই, যার আস্থার ছায়ায় মানুষ মিশে যেতে পারেন। হয়তো একেই বলা যেতে পারে, ‘সভ্যতার অসন্তোষ’।

 

বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে সমস্যা বহুমাত্রিক। এই রাষ্ট্র না আধুনিক, না উত্তর-আধুনিক, না সে টিকিয়ে রাখতে পেরেছে পুরনো রাজনৈতিক মূ্ল্যবোধ। যদিও পুরনো জাতীয়তাবাদই এখনও পুরনো সুধা আকারে পরিবেশিত হয়। অথচ যার দিকে নস্টালজিক চোরাটান ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্ব সম্ভবত আধুনিক কর্তৃত্ববাদের শেষ স্তরের দিকে যাত্রা করেছে — যা অন্তর্গতভাবে জাতীয়তাবাদী নয়, আঞ্চলিকতাবাদীও নয়; পুরো বিশ্ব ঢুকে পড়েছে প্রযুক্তিকেন্দ্রিক পুঁজিবাদের অন্ধ গলিতে। মানুষ দেখতে পাচ্ছে ‘রাষ্ট্র’ নামক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সার্বিক বিকার। হত্যা, খুন, জখম, গুম, গণহত্যা, জাতিনাশ প্রতিটিই রাষ্ট্রীয় বিকারের চিহ্ন বহন করে চলছে।

 

তাহলে মুক্তি কোথায়? মুক্তি কে দেবে? হাজির হবেন কোনো নতুন ত্রাতা? নেতার ধারণাও আজ অচল; প্রবল জনপ্রিয় নেতাও আজ প্রশ্নবিদ্ধ; মুহূর্তেই হারিয়ে যাচ্ছে তার প্রতিষ্ঠিত ভাবমূর্তি। উত্তর-আধুনিক মনস্তত্ত্ব যেহেতু মহাবয়ানে (grand narrative) বিশ্বাস করে না, সে কারণে মহান/ মহৎ/ মান্য নেতৃত্ব বিষয়েও তৈরি হচ্ছে অনাস্থা। কারণ মানুষের মনের মধ্যে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ‘সেলিব্রেটি সেল্ফ’ — সে উদযাপিত হতে চায়, সে মান্য হতে চায়; কিন্তু সে নেতা হতে পারে না, সে নেতৃত্ব দিতে চায় না, সে নেতৃত্ব দিতেও পারে না, সে কেবল চায় অনুসারী ও স্তাবক। এই ‘সেলিব্রেটি সেল্ফ’ ততোক্ষণই আনন্দদায়ক যতোক্ষণ সে অন্য একটি ‘সেলিব্রেটি সেল্ফে’র (celebrity self) সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই মানসিকতা থেকে জন্ম নেয় নীরব মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতা। রাষ্ট্র সেলিব্রেটি সেল্ফ এবং তার ফলে তৈরি হওয়া সহিংসতাকে দমন করতে চায়; ব্যক্তির উন্মুক্ত উদযাপনকে স্তব্ধ করে দিতে চায়। কারণ রাষ্ট্র বুঝতে পারে যেকোনো ‘সেলিব্রেটি সেল্ফ’ তার জন্যে হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। রাষ্ট্র তখন তুলে ধরে সেন্সরশিপের প্রাসঙ্গিকতা, সেলিব্রেটি সেল্ফ তখন বেছে নেয় `সেল্ফ সেন্সরশিপ’। অতঃপর… ব্যক্তি বনাম রাষ্ট্র, মুক্তি বনাম রাষ্ট্র, ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি…. শুরু হয়ে যায় বনামের খেলা… আর তাই শেষ পর্যন্ত হাতের মুঠোয় জমতে থাকে লুকিয়ে রাখা ধারালো নখ; এক সময় সেগুলোই বেরিয়ে আসে।

 

তাহলে বিকল্প মতাদর্শ ছাড়া কোনো মুক্তি নেই? রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার নতুন ধরন ছাড়া মুক্তি নেই? রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটির বিকল্পও খোঁজার প্রয়োজন পারে? রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের পথ খুঁজতে হবে এবং তখন কি আত্মরক্ষামূলক ভায়োলেন্সের দরকার পড়বে আমাদের? আমরা কি ভায়োলেন্সের ভেতরে নেই? একজন কাশ্মীরি, একজন ফিলিস্তিনি, একজন সিরিয়ান কীভাবে আত্মরক্ষামূলক সহিংসতা থেকে মুক্তি পাবে, আমি জানি না। মার্কিন হামলাগুলো থেকে বাঁচার উপায় কী সহ্য করার নীতি? মধ্যপ্রাচ্য কবে শান্ত হবে? কীভাবে থামবে উদ্বাস্তু মানুষের মিছিল? চীন কি এশিয়ার বিপদ? তুরস্ক কেন গির্জাকে মসজিদ বানায়? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো কি রাষ্ট্রব্যবস্থাকে হুমকিতে ফেলে দিচ্ছে? তাহলে কেন্দ্র কি ভেঙে পড়ছে? সত্যি সত্যিই কি আমরা ঢুকে পড়েছি উত্তর-আধুনিক রাজনৈতিক পরিসরে, মনস্তাত্ত্বিক নৈরাজ্যে? জমে উঠেছে প্রশ্নের পাহাড়!

 

আমাদের দেশপ্রেম আছে, কিন্তু রাষ্ট্রপ্রেম বলে কিছু নেই; ‘দেশ’ আমাদের কাছে আশ্রয়; দেশ একটি আইডিয়া, একটি কল্পনা, একটি অনুভব। রাষ্ট্র মানে ভয়, রাষ্ট্র মানে শাসন ও শাস্তি; রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্ক প্রশাসনিক ও চুক্তিভিত্তিক। দেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আনুভূতিক, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক। রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্ক অনুরাগের নয়; কারণ রাষ্ট্রকে নাগরিক দেখে সন্দেহের চোখে। রাষ্ট্রের অবয়বে নাগরিকরা দেশের মুখ দেখতে চায়। কিন্তু সেই মুখ খুঁজে পায় না। তাই তাঁর দেশকল্পনা থেকে যায় কল্পনার ভেতরেই। রাষ্ট্রের সঙ্গে তা সাংঘর্ষিক। রাষ্ট্র মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তবে কোনো কোনো ভাবাদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিক শক্তিকে জোরালোভাবে ব্যবহার করে। হিটলার বা মুসোলিনি যেমন আচ্ছন্ন করতে পেরেছিল। মোদি যেমন ভারতকে আচ্ছন্ন রেখেছে কিছু দিন। ভাবাদর্শের ঘোর কেটে গেলে নাগরিকরা বুঝতে পারে একটি মিথ্যের মোড়কে আবদ্ধ ছিল এতো দিন। চারদিকে তারা দেখতে পায় অসমতা, বৈষম্য ও বিভক্তি; ঐক্য শুধু দেখা যায় রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন লুটেরাদের।

 

লুটকারীদের কাছ থেকে রাষ্ট্রের শুভাশুভ, আইন, জনকল্যাণ বিষয়ক ‘ধর্মকাহিনি’ শুনে নাগরিকের মনে অবারিত অসন্তোষে তৈরি হয়ে। তার ভেতর জমতে থাকে ঘৃণা, অবদমন, ক্ষোভ। সে তার প্রতিকার চায়, অবদমিত ভাবনা প্রকাশের রাস্তা খোঁজে। সে বেছে নেয় সহিংসতার পথ, সহিংসতাকে সে বৈধ করে তোলে নিজের কাছে। এজন্য রাষ্ট্রের প্রতি কোনো দায়বোধ তৈরি হয় না, কিন্তু ‘দেশে’র প্রতি মানসিক দায় বোধ করে। কিন্তু এই দায় তাকে রাষ্ট্রমুখী করে না, কারণ নাগরিকের অনুভূতির জগতে ‘‘দেশ’’ ও ‘‘রাষ্ট্র’’ দুটি ভিন্ন বস্তু। ভারতীয় উপমহাদেশেই রাষ্ট্রপ্রেম বলতে কিছু নেই, ভারতীয় উপমহাদেশের দেশ-কল্পনায় থাকে ভৌগোলিক, আঞ্চলিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয়ের ভাবনাপুঞ্জ। সত্যিকার অর্থে কোনো রাষ্ট্রকে সহিংসতা ও বিভক্তি থেকে বাঁচাতে চাইলে ফিরে তাকাতে সনাতনী দেশ-কল্পনায় এবং পুরনো জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র-কল্পনা দ্বারা রাষ্ট্রশাসন ভবিষ্যতের পৃথিবীতে নতুন কোনো কিছু দেবে না। কেননা জাতিরাষ্ট্রগুলো ইতোমধ্যে বিশ্বায়ন নামক অর্থনৈতিক আধিপত্যের শিকার। বিশ্বায়ন থাকলে জাতীয়তাবাদ থাকে না, জাতীয়তাবাদ থাকলে বিশ্বায়ন থাকে না। দুটোর সহাবস্থান কার্যত অসম্ভব।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here