বায়োগ্রাফিক্যাল ফিকশন বা আত্মজৈবনিক কথাসাহিত্য — যখন ফুটিল কমল। লেখার পরিণতি কী দাঁড়াবে লেখক নিজেই তা ভালো বলতে পারবেন। জাহিদুর রহিম চমৎকার গদ্যে উপহার দিয়েছেন জীবন ও দর্শনের মৌলিক প্রশ্ন ও উত্তর।
দিনেই হোক বা রাত্রিরে, রোদেই হোক বা বৃষ্টিতে , আমাকে মেলে ধরতে গেলেই আমি জাল টের পাই। কথার মোক্ষম গেরো — একটার পর একটা। আমি সরলতাকে ডাকি; আমাকে উদ্ধার করো , শব্দকে আশ্রয় দাও ঠোঁটে। — অরুণ মিত্র
সময় বয়ে চলছে সেটা কি টের পান, এবং বিশ্রী সময়। এতটাই বিশ্রী যে, যেসব কথা ও সংজ্ঞা ‘মানবিক বোধগুলো’কে ব্যাখ্যা করতোম — তা আজ ব্যাখ্যার অতীত এক বিষয়। সেনেকার মতো আমি বলতে চাই সবাইকে, ডাক দিয়ে বলতে চাই, বুক চাপড়ে কেঁদে কেঁদে বলতে চাই, ‘এই যে ব্যস্ত মানুষ, এই যে রাত জাগা ঘুম অসমাপ্ত রেখে কাজে বেরিয়ে পড়া সদা ব্যস্ত মানুষ একটু দাঁড়াও। শোন কথা আছে।’ শতায়ু বুড়োদের আটকে ধরে জিজ্ঞেস করতে চাই, যেমন সেনেকা করেছিলেন।
“আমি দেখেছি তুমি মানবজীবনের অন্ত্যে এসে পৌঁছেছ। তুমি শতবর্ষ পূরণ করতে যাচ্ছ বা তা ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টায় আছ। এবার দাঁড়াও, জীবনের একটু হিসাব করে দেখো তো! দেখবে, কত সময় চলে গেল মহাজনের কাছে, প্রেমিকা নিয়ে গেল কত সময়, কর্তাবাবু নিয়ে গেল কত সময়, মক্কেল নিয়ে গেল কত সময় আর বউয়ের সঙ্গে কলহ করেই বা গেল কত সময়। কর্মচারীদের শাস্তি বিধান করতে গিয়ে গেল কত সময় আর শহরের বিভিন্ন সামাজিক দায় মেটাতে চলে গেল কত সময়। আপন দোষে রোগ বালাই নিয়ে গেল কত সময়? আর যে সময়টাতে তুমি কিছুই করনি, স্রেফ আলস কাটিয়েছ, সেটা সহ যদি হিসাব কর তাহলে দেখবে তোমার হিসাবের খাতায় নিজের জন্য খুব অল্প বছরই বরাদ্দ ছিল।’’
নিজের জন্য তো কোন সময় নেই মানুষের। আপনি যদি একজন পূর্ণবয়স্ক স্বাভাবিক কোন মানুষকে জিজ্ঞেস করেন যে, দিনের আলোতে আপনি কী করেন, সে নিশ্চয় উত্তর দিবে, ‘জীবিকা উপার্জনের চেষ্টা করছে’। আর এই উত্তর প্রশ্ন করার সময় আপনিও প্রত্যাশা করেন, যেন এটাই একমাত্র স্বাভাবিক বিষয়। এর বাইরে অন্য কিছু আমরা ভাবতে পারিনা, এর বাইরে কিছু হলে সেটা যেন অস্বাভাবিক।
এই স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিকের সংজ্ঞার্থ কিন্তু নির্ধারণ করে সমাজ। মানুষের কাছে সমাজ কি চায় সেটা সমাজ আপন সংস্কৃতির মাঝে ধারণ করে। এখন প্রাচীন স্পার্টার লোকদের মতো আপনার সন্তানদের আপনি জন্মের পরে যুদ্ধবিদ্যা শেখার জন্য নগরীর বাইরের শিক্ষা কেন্দ্রে পাঠান না ঠিক, কিন্তু অন্য কিছু শিখতে অন্য কোথাও পাঠান, কি সেটা? সেটা কোন দুনিয়া?
আমি দেখেছি যখন মাত্র সূর্য উঠছে, তিন বা চার বছর বয়সী বাচ্চাগুলোকে মা-বাবারা টানতে টানতে খাওয়াতে খাওয়াতে সেই আধো ঘুম আধো জাগরণে গাড়িতে, রিকশায়, কোলে করে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। কোন সে যুদ্ধ ক্ষেত্র? এই যে শিশু, যে এখনো ঠিক মতো কথা বলতে পারেনা তাকে আপনি কী শেখাচ্ছেন? শেখার কথায় পরে আসছি, তার এই স্বর্গীয় শৈশবকে নষ্ট করার অধিকার তো আপনাকে কেউ দেয়নি। আমি জানি এখন আপনারা দাঁত কেলিয়ে বলবেন, ‘সব তার ভবিষ্যতের জন্যই’।
যেন তার ভবিষ্যৎ আপনি নির্মাণ করে দেবেন। তার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ যেখানে আপনি কিছুই না, এমনকি আপনি যেই ভবিষ্যৎ অনুমানও করতে পারেন না, সেজন্য তার বর্তমানকে নষ্ট করে দিচ্ছেন। তাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন যেখানে তাকে নিপুণ নিখুঁত এক দাস হিসেবে গড়ে তোলা হবে, যারই হোক-না-কেন, একজন দাস।
আইনস্টাইনের মতো আমিও তো এই কথা বিশ্বাস করি, ‘বর্তমানে আপনাদের শিক্ষার সংজ্ঞার্থ হচ্ছে — অর্ধেক জীবন নষ্ট করে এটা শেখা যে কীভাবে জীবনের পরের অর্ধেক অপচয় করা যায়।’
আমি জানি এখন আপনারা আমাকে গালি দিতে শুরু করবেন। দয়া করে আগে আমার সবটুকু কথা শুনুন। আপনারাই সেই বাবা-মা যারা সন্তানকে ছোট বেলায় শেখান, ‘লেখা পড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে।’ তাই আশা করি আর যাই হোক আপনার সন্তানের শৈশব-কৈশোর-যৌবন নষ্ট করে যা যা শিখাচ্ছেন — এগুলোকে দয়া করে শিক্ষা বলতে আসবেন না কেউ। অন্তত অতীত দিনের প্রকৃত শিক্ষা আর গুণী শিক্ষকদের সম্মানের খাতিরে।
আপনারা আসলে সন্তানদের শেখাচ্ছেন কত বেশি দামে তাঁরা জীবনে নিজেদের বিক্রি করতে পারে। আপনারা এখন বলবেন, ‘আমরা তো তাদের নৈতিকতার শিক্ষাও দিচ্ছি।’ হাহ হাহ হাহ… আমি তো জানি আপনাদের এই নৈতিকতা কতটা সেকেন্ডারি। একটু সৎ, একটু নরম, একটু বিনয়ী হলে আপনারা যে প্রশংসা করবেন না, তা নয়, কিন্তু সাথে তাঁর টাকা থাকতেই হবে। অর্থাৎ ‘অর্থ’ আসল জিনিস, মানে আপনাদের শেখানো ও আরধ্য ওই ‘গাড়ি-ঘোড়া’।
বিনয়কে তো আজকাল দুর্বলতা হিসেবেই দেখা হয় কর্পোরেট সংস্কৃতিতে। অভদ্র-দুর্বিনীত লোকজনকে আপনারা স্যালুট করেন। বলেন, এটা নাকি ‘বোল্ডনেস’। এবং সেই কারণেই সবকিছু আজ ‘বোল্ড’।
আপনার শোবার ঘর থেকে পার্লামেন্ট আর উপসনালয় সবখানেই এই ‘গাড়ি-ঘোড়া’র জয় জয়কার। আমি জানি, আপনারা এখন নকল নৈতিকতায় হয়তো বলবেন, ‘দিনশেষে আসলে ওসব কিছু না’, দিন শেষে শিক্ষা, সততা ইত্যাদি এগুলোরই সম্মান। আমি বিনয়ের সাথে আপনাদের এই আত্ম-প্রতারণায় থু-থু দেই।
চেয়ে দেখুন আপনার সমাজের সবচেয়ে খারাপ, সন্ত্রাসী, লম্পট, কালোবাজারি, মাফিয়া, ঘুসখোর, সুদখোর, মানুষ ঠকানো লোকগুলো আপনার চারদিকে দলপতি হয়ে আজ দাঁড়িয়ে আছে। আপনি রাস্তায় তাঁদের দেখলে হাত লম্বা করে সালাম দেন। এতটা সম্মান কি আপনার এলাকায় থাকা কোন শিক্ষককে দেন?
অবশ্য সম্মান পাওয়ার উপযুক্ত শিক্ষকও আজ বিরল। আসলে নষ্ট হলে কোন কিছু পরিপূর্ণভাবেই নষ্ট হয়। দেশের সব কিছু নষ্ট হবে আর শিক্ষকরা ভালো থাকবেন যারা মনে করছেন, তাঁরা কেবল বোকার স্বর্গে বাস করছেন না, তাঁরা প্রতারক ও মিথ্যা বাদী। খারাপকে খারাপ বলে মানতে আপনার দ্বিধা কেন?
যেমন আরও অনেক কিছুতে দ্বিধা আপনাদের। নিজেদের তৈরি সব খারাপ মানতে দ্বিধা। যে মানুষ এক সময় আপনি ছিলেন অরণ্য ঘেরা ঘরে, সেই আপনি এখন সবুজ আন্দোলন করেন, ধরিত্রী দিবস পালন করেন, বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচি পালন করেন। দেখুন কী নির্লজ্জ, কী মুনাফেকি, কী প্রবঞ্চনা!
আপনারা এখন গলা ফুলিয়ে, চশমা দুলিয়ে গোঁফে তা দিয়ে দিয়ে বলবেন, ‘আসলে এসব তো সব সভ্যতা সংস্কৃতির জন্য। এই যে নগর গড়ে তুলতেই গাছ কাটতে হলো।’ আর এখন আপনি ছোট ছোট টবে করে বনসাই গাছ লাগান ঘরের ভিতরে আর উজ্জ্বল সব মঞ্চে বসে আপনার মতো মানুষ গুলোকেই জ্ঞান দিচ্ছেন, ‘বাড়িতে একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগাতে।’
আসলে ঐ গাড়ি-ঘোড়া যতই চড়ুন, আপনি বেলা শেষে কই যাচ্ছেন ভেবেছেন কখনো, আপনার ভবিষ্যৎ কত বছরে, কত বছরের ভবিষ্যৎ? এই যে সিরিয়াস মানুষ আপনি যে কোট-সুট, এটিকেট, কাটা চামচ নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষ, একটু বলবেন ‘হোয়াট ইস আল্টিমেট, শেষে কী?’’
এখন আপনি বলবেন, মরে যাবো শেষ পর্যন্ত, তাই বলে কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবো? দয়া করে ভুল বুঝবেন না। আমি তা বলছি না। আপনি কাজ তো করবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু এতো সিরিয়াস হওয়ার কী আছে! আপনি যাদের কাছে সিরিয়াসনেস শিখেছেন, তাঁদের সিরিয়াসনেস তাঁদের কোথায় নিয়ে গিয়েছে দেখেছেন? আপনাদের সিরিয়াসনেস তো সাফল্যের এক প্রতিযোগিতা, একটা অস্থিরতা, একটা উন্মাদনা তাই তো? নাকি সেটাও আপনার বা আপনাদের কাছে ‘আধুনিক জীবনের কেতাদুরস্থতা।’
একবার তাকিয়ে দেখুন তো তাঁদের চকচকে পথ-ঘাট, দামি গাড়ি আর পোশাকের আড়ালে ঢাকা অসুখগুলো দেখতে পাচ্ছেন, পাচ্ছেন না? আমার এইসব কথাগুলো কি একটু একটু করে আপনাকে ক্লান্ত করে দিচ্ছে? কত দূরে গেলে আপনি বুঝতে পারবেন, জীবন একটা স্বনির্মিত বিষয়, একটা অভ্যাস।
আপনি ভালো বা খারাপ যেমন খুশি জীবনের অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন। আর একসময় এই আপনার মতো আপনার চেয়ে আধুনিক মানুষগুলো বুঝে যায়, তাঁরা সুখি না। যে অর্থ উপার্জনের জন্য আপনার ও আপনার সন্তানদের জীবনকে উৎসর্গ, যে টাকা সুখ কেনার কথা ছিল, মানুষ দিন শেষে সেই টাকা দিয়ে কিনে আনে বিরক্তি ও বিস্বাদ।
এই যে সারা দুনিয়ায় আধুনিকতা বিকাশের সাথে সাথে নানা রকম মাদকের বিস্তার ঘটেছে, এর কারণ বলে কী মনে হয় আপনাদের? যদি চাহিদা না থাকতো তাহলে কি এতো উৎপাদন হতো? এই মাদককে মানুষ ব্যবহার করছে জীবন থাকে পালানোর জন্য, জীবনকে ভুলে থাকার জন্য। চিন্তা করুন আজ থাকে পাঁচশ বা হাজার বছর আগে কত শতাংশ মানুষ সমাজে নেশা করতো, আর আজ? ছাত্রদের মধ্যে যদি জরিপ চালান তাহলে নেশা করেনা কে সেটা খুঁজে পাওয়া বরং সহজ হবে। এই বাস্তবতা কি নির্দেশ করে ভাবুন খুব ঠাণ্ডা মাথায়।
দেখুন জীবনে বড় হতে হতে একপর্যায়ে আপনি কী করে একটা যন্ত্র হয়ে যান, বন্ধুহীন হয়ে যান। আপনার ইচ্ছে অনিচ্ছা বলে কিছু থাকছে না তখন। আপনি গতকালের ধাক্কায় আজকের দিনটা কাটিয়ে দিচ্ছেন, আজকের ধাক্কায় আগামী কাল। সবচেয়ে বড় যে শ্রমিক, কর্পোরেট হাউসের বস — তাঁরও নিজের জীবন বলে কিছু নেই।
আপনারা কি কখনো নিজের মুক্তির কথা ভেবেছেন, অবসরের কোন মুহূর্তে? ভেবেছেন কী হারাতে হচ্ছে আপনাকে রোজ? আপনার এই ভদ্র কাপড়ে ঢেকে রাখা জান্তব শরীর কেবল না, আপনার আত্মাকে আপনি বিক্রি করছেন প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। কিন্তু নিজের আত্মার ওপর এই জুলুম করার অধিকার কে দিলো আপনাকে। কতগুলো উন্মাদ মাতাল উন্মত্ত আত্মভোলা পাগলের ইশারায় তাঁদের লালসার সমাজ গড়ে তুলতে পিষ্ট হচ্ছে আপনার সুন্দর মন, আত্মা, আপনার অপার্থিব প্রেম। সামান্য দামে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে কুমারী হৃদয়, সুতনু শরীর, বিক্রি হয়ে যাচ্ছে সব, এই সামান্য গাড়ি ঘোড়া চড়ার সাধনায়।
আপনি হয়তো ভাবেন এই গাড়ি ঘোড়ায় সম্মান আছে। আছে তো বটেই, আমি বলেছি, কিন্তু সেটা আপনার মতো আত্মা বিক্রি করে দেয়া লোকদের কাছে। যাদের কাছে মানুষকে পরিমাপের মাপকাঠি অর্থ তার কাছে। কিন্তু আদি অকৃত্রিম আত্মার কাছে এর কোন মূল্য নেই, কিছু নেই, কোন শ্রদ্ধা নেই।
আর আপনার চারপাশের অন্য সবাই যারা আপনার মতোই ক্রীতদাস, সবাই আপনার সাথে মজা-তামাশা করে। যেমন আরও অনেকের জীবনের সাফল্যকে মানদণ্ড ধরে হিংসায় জ্বলে মরেন, তেমনি বাকিওরাও বসে আছে কৌতুহল নিয়ে, কখন লুট করে নিয়ে যাবে টাকা দিয়ে কেনা আপনার সুখ। তাঁদের দংশন আর বিষের জ্বালা আপনাকে ভোগ করতেই হবে। আপনিও ভোগ করে চলছেন কিন্তু কেন? ভালো থাকা খাওয়ার জন্যই তো নাকি? সেটা কদিনের জন্য, সেটা কত সাময়িক? ভাবুন কত অনিশ্চিত এই ভালো থাকা খাওয়ার সময়টুকু, কয়েক মুহূর্ত। অথচ আপনি সামান্য ভালো খাওয়া আর কাপড়ের জন্য এক অপমানের জীবন বেঁছে নিয়েছেন। নিয়েছেন এক স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক পাশবিক জীবন। কি অমানুষিক এক মাতাল জীবন।
আপনি যে মাঝে মাঝে ভাগ্যকে গালি দেন, আপনার চারপাশে ভিড় করা কারো চোখে কি সামান্য সহানুভূতি দেখেন তখন? না, নেই। থাকার কথাও নয়। সবাই মজা পায়। কারণ তারাও আপনার মতোই। আপনার জীবন তাদের মতোই একটা কার্পেট যেন। এই পৃথিবীতে এই যে আপনাদের পরিণতি, সেটা অভাবিত নয় যুগে যুগে, আপনাদের মতো মানুষই তো প্রায় সবাই। আর সবার একই পরিণতি হয়েছে।
সময়ের দীপ্ত ঘোড়ায় সবাই নিজেকে রাজা ভেবেছে। সবাই ভেবেছে কেবল সামনের প্রশস্ত অবারিত পথের কথা। কেউ ভাবেনি পথ থাকলেও নিজের পথ চলা এক সময় ফুরিয়ে যাবে। অর্ধ-নগ্ন পরিত্যাক্ত বার্ধক্যে সবাই মাতালের মতো স্মৃতিকাতর হয়ে দেখে জীবনে নিজ পরিবারের সাথেও দুটা কথা বলার সময় মানুষের ছিল না।
আপনি সাত সকালে যেসব সন্তানকে আপনার মতো ক্রীতদাস করার জন্য পাঠালেন, এদের কাউকে পাবেন না মৃত্যুশয্যায়। এরা প্রত্যেকে ব্যস্ত ঠিক আপনার মতো এক ব্যস্ত জীবনে, গাড়ি ঘোড়ার জোগাড় করার জন্য। আপনি অসুস্থ হলে আপনি যতই বিত্তশালী হন, যেই বিত্ত জোগাড়ের জন্যই জীবনে কোন দিক তাকালেন না, সেটা আপনাকে কোন সেবা দিবে না। বরং আপনার আপনজনরাই গালি দিবে আপনাকে অসুস্থতার এই ‘ফালতু ঝামেলা’ বাঁধানোর জন্য, নাক সিঁটকাবে, বিরক্ত হবে। কারণ আপনি জীবনের ঘোড় দৌড়ে এক বাতিল বুড়ো ঘোড়া, আপনাকে দিয়ে আর রেস হবে না। আমি এসব জীবনকে দেখেছি খুব কাছে থেকে। হয়ত আপনিও আমার মতো দেখেছেন বা দেখবেন- মনে হবে প্রত্যেকেই এটা জানেন। এক প্রকাশ্য সত্য।
আপনি জানেন, কত অবহেলায় অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে ফেলে রাখবে আপনাকে। আপনি মারা গেলে অচেনা অজানা লোকজন আপনার সৎকার করবে নিতান্ত কেজো ভঙ্গিমায়। ঝামেলা কত তাড়াতাড়ি কাঁধ থেকে নামানো যায়, এই চিন্তায় অস্থির থাকবে লোকেরা। কিছু সস্তা কাপড় কিনবে আপনার দেহ ঢাকার জন্য। আমি নিজে দেখেছি, এক হসপিটালে এক ছোট বাচ্চা মারা গেলে এক লোক পলিথিন ব্যাগ এনেছিল সেই শিশুর লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য। চমকে উঠবেন না। এমন নির্মম অস্বাভাবিক উন্মাদ এই সমাজ, এমন মমতাহহীন আর স্বার্থপর আজকের তথাকথিত আধুনিক আর উন্নত দুনিয়া। হৃদয়হীন জান্তব মেশিন দিয়েই যে এখন পৃথিবী ভরা, আপনার কি সন্দেহ আছে?
মরে গেলে আপনার কেনা কোন দামি কাপড়ও কেউ আপনার জন্য নষ্ট করবে না। সস্তা কাপড়ে জোড়াতালি দিয়ে অন্ধকার অসজ্জিত আর নির্জন এক কবরে ফেলে আসবে আপনাকে। এসেই তারা যার যার কাজে চলে যাবে। আবার কোন ধান্দায়। ঠিক এভাবেই পৃথিবী থেকে আপনার বিদায় হবে। পৃথিবী থেকে মুছে যাবে আপনার নাম। কেউ জানবে না এই আপনি কোনদিন জন্মেছিলেন। কেউ দু’ফোঁটা অশ্রু ফেলবে না আপনার কথা ভেবে। কেউ আর ভাববে না আপনার কথা। আপনার জন্য থাকবে শুধু নোংরা কাঁদা, মাটি আর সীমাহীন আফসোস। তখন কি করবেন আপনি?
সেই অন্ধকার থেকে চিৎকার করে বলবেন, “ওগো ভালমানুষেরা একটু দয়া করো, আমাকে বাইরে নিয়ে যাও, পৃথিবীর আলো দেখতে দাও, আমার জীবন তো মানুষের জীবন ছিল না, এঁটো আবর্জনার মতো ফেলে দেওয়া হয়েছে আমাকে। আমার জীবন উৎসর্গিত হয়েছে মদের দোকানে মাতালদের উৎসবে। আমাকে নতুন জীবন ফিরিয়ে দাও। আমি আমার জীবন নিয়ে মানুষের মতো একটু বাঁচতে চাই। আমাকে একটু দয়া করো। আমার কবরের মাটি সরিয়ে একটু আলো আসতে দাও। আমার সারা জীবনের সব উপার্জনের বিনিময়ে আমাকে একটু আলো দাও”।
কোন লাভ হবে না, সেটা আজকেই জেনে রাখুন। অ্যান্ড দিস ইস দ্যা আল্টিমেট!
পড়ুন ।। কিস্তি : ৪