শৈশব স্মৃতি ।। কিস্তি : ৪

পরাগ চৌধুরি মূলত অনুবাদক। বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য অনুবাদ করেছেন বাংলায়। ভীষণ পড়ুয়া মানুষ তিনি। অভিজ্ঞতার ঝুলিও বিশাল বড়। এবার তিনি প্রবেশ করেছেন স্মৃতির অন্দরমহলে। স্মৃতি মানুষের বড় শক্তি। স্মৃতি ছাড়া ইতিহাস হয় না, স্মৃতি ছাড়া সাহিত্যও হয় না। পরাগ চৌধুরির এই স্মৃতিলেখা একই সঙ্গে স্মৃতি ইতিহাস ও সাহিত্য। চমৎকার তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তি, স্মৃতির বয়ান ছাপিয়ে গিয়েছে উপন্যাসের কাঠামোকেও।

 

আজ বড়ির বাইরে সড়কের কাছের লিচু গাছের ছায়ায় দুই খালা ষোলগুটি খেলতে বসে। আমি দর্শক। দুই দান খেলা শেষ হতে না হতেই জমিলার মায়ের হাসি মুখ দেখা গেল। দেউড়ি পার হয়ে হাত ইশারায় হাসিমুখে ডাক দিলে আমরা একান্তই অনিচ্ছায় উঠে পড়ি। কাছে গেলে কিছু না বলে সে কাঁসার একটা বড় গামলা ভর্তি খোসা ছাড়ানো ভেজা কাঁঠাল বিচি কুয়ার পাকা চত্বরে রেখে চলে গেল। শিরিখালা কুয়ায় বালতি ফেলে দড়ি টেনে টেনে চরকির ক্যাঁচকোঁচ তুলে পানি এনে চত্বরে খানিকটা ঢেলে দেয়। আমরা দুই হাতে বিচিগুলো সিমেন্টের উপর ঘষে ঘষে ওপরকার লাল আবরণ তুলে ওগুলোকে ধপধপে শাদা করে তুলি। খানিক পরে নানু আমাদের কাজের হদিস নিতে আসে।

: হায় হায় রোদে আমার মেয়েগুলার মুখ যেন ডালিম ফুল হয়ে ফুটে আছে। শেষ কর তারাতারি। মুরগি কাটা ধোয়া শেষ। বলতে বলতে নানু পাশের গোয়ালের দিকে আগায়। ওখানে মাচার ওপর খড়ের বিড়ার মধ্যে আছ মুরগির ডিম।

 

নানু বিড়ার দিকে হাত বাড়াতেই একটা কুইচ্চা মুরগি গায়ের সব পাখনা ফুলিয়ে বিকট চিৎকারে প্রতিবাদ জানিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাটিতে। আমরা হেসে কুটিকুটি। ডিম নিয়ে ফিরে যেতে যেতে নানু বলে যায় : ও রে এইবারে দস্তর ভর্তা খাওইলি না শিরি?

 

কাজ শেষ হলে শিরি খালা প্রস্তাব করে, তেতুল দিয়া দস্তর ভর্তা খাই। পেয়ারা তুই রান্দাঘরতে তেতুল গুড় নুনমরিচ নিয়া মেওয়া গাছতলা আয়। আমাকে নিয়ে শিরি খালা বড় বড় পাতার মোটা মোটা কালো ডাঁটির মাথাসমান উঁচু কচুর জঙ্গলে ঢোকে। দা দিয়ে কচুর ডাঁটি খুব মিহিন করে কেটে দুধের মতো শাদা কলাই করা একটা বড় গামলা ভর্তি ভর্তা বানায়। তারপর আমাদের হাতের তালুতে ধরা ধোয়া কচু পাতায় ভাগ করে দেয়। ঝাল মুখে হু-হা করতে করতে খুব মজা করে সেই অমৃত প্রাণ ভরে খাবার পর বাকিটা চলে যায় রান্নাঘরে।

 

আজ দুপুরে খালারা ঘুমের জন্য চোখ বন্ধ করলে আমার উৎকর্ণ রোজকার মতো ঘরের ছায়ায় নানুর চাটি বিছানোর শব্দ পায়। নানু এখন পুরানো কতগুলো বেগমচাষী পত্রিকা নিয়ে বসবে। এই বাড়িতে নানুর বাবা কোরান শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের বাংলা পড়ার ব্যবস্থাও করেন। তবে সব বাড়ির ভেতর। স্কুলে যাবার অধিকার শুধু ছেলেদের। নানুদের একটা সিন্দুকে গাদা করা ছেঁড়াখোঁড়া মোটা কাগজের অনেক পুরানো পুঁথি দেখেছি আমি। নানুর কাছে শুনেছি মাঝেমাঝে বার বাড়ির উঠানে রাতে আসর বসিয়ে সুর করে এগুলো পড়া হতো। বাড়ির মেয়েরা অন্দর বৈঠক ঘরের দরজা খোলা রেখে অন্ধকারে তা শুনতো।

 

ঠিক করলাম নানুর একান্তই একার এই অবসর সময়ে আজ আমি ভাগ বসাবোই বসাবো। গুটিগুটি উঠে কাছে গেলে আদর মাখা হাতে নানু আমাকে জড়িয়ে চুমু খায়।

: আজ দস্তর খাওয়া কেমন হৈল?

: খুবই মজার। নানু আমি আর কয়দিন থাকতে পারি না?

: পাগলে বলে কি। ইস্কুল খুলে গেছে না? আমিওতো মমিসিং ফিরবো। বেগম থেকে একটা গল্প পরি শোন।

:না। বানানো গল্প আমার ভালো লাগে না।

: তাহলে তো জীবন থেকে নেয়া গল্প বলা লাগবে। শোন যখন তোর বয়স দুই বছর তখন বিছানায় চিত্তাপটাং শুয়ে আমার শিখানো ছরা বলতি এইভাবে।

তুনতুনি দালবুনি পতালালালে

ফুৎকলে উলেদায় হাক্কানি বালালে।

: ধুৎ নানু। এইটা অনেক শুনেছি।

: তাহলে শোন আমার শ্বশুর বরি কালেঙ্গার জীবনের একটা সত্যিকারের গল্প?

 

নানু তার সবুজ চওড়া পাড়ের শাড়িটা ডান পায়ের হাঁটু পর্যন্ত তুলে সাদা রঙের অচেনা কোন দেশের মানচিত্রের মতো দেখতে দাগটায় ইঙ্গিত করে। আমার আরো ছোটবেলায় বাড়তে থাকা এই দাগ নিয়ে প্রশ্ন করলে নানু তার এক অবিশ্বাস্য বীরত্বের বয়ান দিতো। ঐ সময় নানুর সদ্য বিয়ে হয়েছে। বেশকিছু দিন ধরে অচেনা বাড়িতে নতুন জীবনে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। এই বাড়ির মুরুব্বিরা বলেছে সন্ধ্যার পর সে যেন একা ঘরের বাইরে না আসে। বাড়ির পিছনের ঘন মুক্তাগড়ে মাঝে মাঝে কোত্থেকে একটা মেছোবাঘ এসে খাপ ধরে বসে থাকে। ছোট ছেলেমেয়ে একা পেলে তুলে নিয়ে যায়।

 

সেদিন নানারা কয়েক বন্ধু মিলে হাটে গেছে দেখে নানু দুয়ার হ্যারিকেনের আলোয় বিয়েতে উপহার পাওয়া একটা উপন্যাস নিয়ে বসেছে। বাজার শেষে আড্ডাফাড্ডা দিয়ে সেদিন নানার বেশ রাত হলো। ফিরতি পথে নানার বন্ধুরা কেউ ডাইনে কেউ বাঁয়ে নিজের নিজের বাড়ির পথে এগিয়ে গেল। ওদের ছেড়ে আরেকটু এগিয়ে বাঁয়ে পুকুরের পাড় দিয়ে পনের বিশ কদম গেলেই মুনশী কাকার ঘর। পুকুর পাড় ধরে কয়েক পা এগোতেই নানা দেখে এক হাভাতে মেছোবাঘ বাঁয়ের কবরখানা থেকে বেরিয়ে তার পিছনে আসতে লেগেছ। এটা বাঘ নাকি অন্য কিছু ভেবে ওঠার আগেই নানা বিকট চিৎকার দিয়ে দৌড়ে বারোয়ারি উঠানে পৌঁছায়। আসলে তার হাতে ঝোলানো মস্ত রুই মাছের লোভে একটা মেছ বাঘ তাকে একা পেয়ে পিছু নিয়েছে। বাড়ির উঠানে পৌঁছালে বাঘটা যখন বুঝতে পারে যে মাছটা এখনই ঘরে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে যাবে তখন সে প্রাণপণে মাছটা কামড়ে ধরে। নানাও ছাড়ার পাত্র না। ফলে শুরু হয় বাঘ ও মানুষে মাছ নিয়ে রশি টানাটানি খেলা।

 

বাঘের রাগ নানার রাগ এই দুই রাগের গোঁ গোঁ শব্দে আমার নানু কোমরে গামছা বেঁধে হাতে দা নিয়ে উঠানে নেমে পড়ে। তারপর ? তারপর ধুন্ধুমার লড়াই। হা রে রে রে যুদ্ধ রীতিমত। নানুর সাহসিকতায় মাছ হারালেও নানা অক্ষত বেঁচে যায়। কিন্তু নানুর পায়ে বঘের লালা ছিটকে পড়ার ফল এই মানচিত্র। কিন্তু বাবার কাছে জেনেছি যে এটা মেলানিন নষ্ট করে দেয়া একটা চর্মরোগ। এখন ঐ গল্পে ভবিকে আর ভোলানো যায় না। আমি নানুর মুখ চেপে ধরি। ঐ গল্পের দিন শেষ।

 

আমার নানুরা তিন বোন। নানু মেঝ। তার বারো চৌদ্দ বছর বয়সে চোখে পড়ার মতো সুশীল সুন্দর এক কিশোরী। অনেক গুণের আধার। চাকুরীজীবী ছোট ভাইয়ের মন বুঝে নানুর দুলাভাই তাকে বৌ করে নিয়ে যায় নিজেদের বাড়ি। ফলে দুই বোন দুই জা। নানুর বড় বোন আজীবন এই বিষয়টা ক্ষমা করতে পারেনি। নানুর তিনটি সন্তান জন্মের পর নানার আকস্মিক মৃত্যু হলে ভেঙে পড়া নানুকে তার বাবা স্বয়ং গিয়ে এই বাড়িতে নিজের আশ্রয়ে নিয়ে আসে। বিধবার পোশাক সাদা থান পরা দুঃখের প্রতিমূর্তি অলঙ্কারহীন নানুকে জড়িয়ে ধরে তার মা কাঁদতে কাঁদতে নিজের সব গহনা খুলে ফেলেন। বাইশ বছরের যুবতী মেয়ের বৈধব্য সেই মায়ের কাছে মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মনে হয়েছে। আমার নানু ছেলেমেয়ে নিয়ে ফসলের মরশুমে শ্বশুর বাড়ি যেতেন।

 

এই পরিবারের দুর্ভাগ্য যে অল্প কয়েক বছরের মাথায় নানুর ছোট বোনও বিধবা বেশে একটি ছেলেসহ বাবার কাছে চলে আসে । নানুর ছোট বোন এখন শ্বশুর বাড়ি। নানু নিজের বিবাহিত জীবন নিয়ে শুধু বলতো : বড় সুখের সে জীবন। আল্লা এতো নিষ্ঠুর কেন? আমার তো সংসার করে সাধ মিটে নাই। স্বপ্নের মতো মনে হয়। হঠাৎ সবকিছু বদল গেল আমার জন্য। আমি তো তৈরি ছিলাম না। নানুকে বহুদিন আমি লুকিয়ে কাঁদতে দেখেছি আমাদের বাসায় থাকার সময়। এমন কি রাতের বেলায় আমার পাশের বালিশে শুয়ে। হয়তো সেই অতৃপ্ত স্বপ্নটাই তাকে কষ্ট দেয়।

 

কিন্তু এখন আমাকে খুশি করার জন্য তার ছোট বেলায় শোনা একটা গল্প বলে। এই গ্রামে একবার এক মুসাফির আসে অনেক দূর দেশ থেকে। এই গ্রমে সেই দেশের নামও কেউ শোনে নাই। লোকটা গ্রামে ঢুকলো শ্রান্তক্লান্ত বিপর্যস্ত চেহারা নিয়ে। কেরানি বাড়িতে তার থাকার ব্যবস্থা হলো। নাম তার গফুর। লোকটার ভাষা কিছু বোঝা যায় কিছু যায় না। কিছু কথা কিছু ইশারায় প্রয়োজনীয় সবই হচ্ছিল। কিছুদিন পরে সে নালিশ করতে শুরু করলো খাবার পরপরই তার পেটে ব্যাথা শুরু হয়। এই টোটকা ঐ টোটকায় কাজ না হওয়াতে শেষে কবিরাজ ডাকা হলো। তার জিজ্ঞাসাবাদে ইশারা ইঙ্গিতে জানা গেল যে দুপুরের কড়া রোদে পাশের গ্রামের বিশাল মাঠ পার হয়ে আসার সময় প্রবল পিপাসার্ত হয়ে আশে পাশে কিছু না পেয়ে সে গরুর মতো ঝুঁকে একটা গর্তে জমা পানি পান করে। অনেক বিবেচনা আলোচনার হাজার শব্দব্যয়ের পর কবিরাজ সিদ্ধান্ত দেয় যে তাকে চোখ বন্ধ করে এক টুকরা কলা না চিবিয়ে গিলে ফেলতে হবে। ঐ কলাতেই অসুধ লুকানো থাকবে। তথাস্তু। কবিরাজ পরদিন দুপুরে খাবার আগে ঘরে ঢুকে তাকে চোখ বন্ধ রাখতে বলে এক টুকরা কলা খেতে দেয়। কলা গিলে ফেলেই রুগী পেটে হাত বুলাতে বুলাতে জানায় একটু একটু ব্যথার ভাব হচ্ছে।

দশগাঁ মশহুর ধন্বন্তরি কবিরাজ বলে কথা। ঘরভর্তি মানুষের জোড়া জোড়া জুল জুল চোখ লোকটার মুখে আঠার মতো আটকে আছে। সারা ঘর দমবন্ধ করে অপেক্ষায় থাকে। কারণ চোখবন্ধ গফুর না বুঝলেও লোকজন দেখতে পাচ্ছে সে সুতাসুদ্ধ কলা গিলেছে। সুতার অপর প্রান্ত কবিরাজের আঙ্গুলে পেঁচানো।গফুর যখন বলে ব্যাথাভাব নাই তখন তাকে বড়ো করে হাঁ করতে বলে কবিরাজ সুতা ধরে ধীরে ধীরে টানতে থাকে।তারপর হঠাৎ কবিরাজ বিকট চিৎকারে অস্পস্ট কিছু বলে খোলা জানালার দিকে আঙুল দেখালে ঘরসুদ্ধ লোক দেখে একটা অমঙ্গুলে কালো কাক জানালার চৌকাঠে বসে ভেতরের দিকে ইতিউতি তাকাচ্ছে। ঐদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে লোকজন তাজ্জব হয়ে দেখে সুতার প্রান্তে বড়শিগাঁথা বিঘৎখানেক লম্বা একটা জীবন্ত বাইম মাছ কবিরাজের হাতে ঝুলছে ।

 

কবিরাজ এবারে ঘোষণা কর : খুব সম্ভব গফুর গর্ত থেকে গরুর মতো পানি খাবার সময় পোনা হিসেবে ওকে গিলেছিল। এই প্রায় দুই মাসে সে এতো বড়। গফুর আরো অনেকদিন এই গ্রামে বেড়িয়ে শেষে একদিন ভোররাতে নিঃশব্দে পথে নেমে যায়। গ্রামের মানুষদের বলেকয়ে দিনের বেলা মমতার বন্ধন কেটে বেরিয়ে যাওয়া হয়তো তার জন্য কঠিন হতো। তার যাবার পর লোকজন অনুমান করলো যে সে সম্ভবতকাবুলিওলা। হয়তো ব্যবসার নতুন জায়গার সন্ধানে এসেছিলো।

 

গল্প শেষ করে নানু আমার চুল আঁচড়ে চার গুছির একটা চ্যাপ্টামতো বেনি করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি গভীর মনযোগে গল্পটার সত্যমিথ্যা নিয়ে নানুকে কোথায় পাকড়ানো যায় তাই ভাবতে থাকি। এমন সময় বারোটা এন্ডিগেন্ডি ছানাপোনা নিয়ে উঠান পার হতে থাকা মুরগির উপর কোত্থেকে এক হাড়-হাভাতে চিল ছোঁ মারে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট কাঁথা সেলাইরত বড় নানু দাওয়া থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে উঠানে। মা মুরগি তার গায়ের সমস্ত লোম খাড়া করে উড়ন্ত চিলের পিছে পিছে জঙ্গল অব্দি পাখির মতো উড়ে যায়। ছানাগুলো মায়ের শেখানো কৌশল যথাযথ রপ্ত করে প্রাণ বাঁচাতে যার যার মতো আড়াল খুঁজে কি দক্ষতায় নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে থাকে।

 

পড়ুন ।। কিস্তি ৩ ।। ক্লিক করুন নিচের লিংকে

শৈশব স্মৃতি ।। কিস্তি : ৩

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here