বীজ উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে এক তরুণীর তীব্র সংবেদনা; পর্যবেক্ষণশীল চোখ দিয়ে সে দেখেছে নিজের ভেতর ও বাহির। মনিরুল ইসলামের লেখা এই উপন্যাস আপনাকে নিয়ে যাবে সমকালীন জীবনের অন্দরমহলে।
৯
বাসায় সারাদিন ব্যস্ততায় কাটলো। মাকে রান্না-বান্নায় হেল্প করলাম। একটার মধ্যেই রেডি হয়ে গেলো সব। গোসল-টোসল করে দরজা বন্ধ করে রাখলাম ঘণ্টাখানেক। বিষয়টা এমন যেন নামাজ পড়লাম। শুয়ে রেস্ট নিচ্ছিলাম। ফেসবুকে ঢুকলাম। শান্তা আপু কী একটা রান্না-বান্নার ছবি পোস্ট করেছে। মুগ ডাল দিয়ে মুরগির মাংস। পোলাও। আলু ভর্তা। বেগুন ভাজা। সুন্দর করে সাজানো। কিন্তু এটা কোথায়? তার সঙ্গে ইনি কে? তার বয়সী একজন আপু। তার হাজবেন্ড কোথায়? শান্তা আপুর ওয়ালে ঢুকে দেখলাম। ম্যারিটাল স্ট্যাটাস, ম্যারিড। কিন্তু কোথাও তার হাজবেন্ডের ছবি নেই। এটা আবার কেমন! পোস্টগুলোর মধ্যে কেমন একটা স্যাড-স্যাড ভাব। মানে কী? হাজবেন্ডের সঙ্গে উনার ঝামেলা চলছে নাকি। উনি কি মেসে থাকেন?
‘লোভ লাগছে। খাওয়াতে হবে।’ কমেন্ট করলাম। আমার ছবিটাতে শান্তা আপু কমেন্ট করেছিলো, ‘এটা কোথায়? একা একা যাওয়া হচ্ছে। হবে না। লোভ লাগছে। নিয়ে যেতে হবে।’ উনার কমেন্টই উনাকে ফেরত দিলাম।
হুজুররা এসেছেন দুইটা পনের নাগাদ। মা আর দাদিই সামলাবে। ওদিকে আমাদের কোনো কাজ নেই। রুমে বসে অপেক্ষা করাই এখন কাজ। কিন্তু ক্ষুধা লেগে গেছে। নতুন একটা পোস্ট দিয়েছে ইমরান। একটা বই সম্পর্কে তার মন্তব্য। পড়লাম। বেশিকিছু বুঝলাম বলে মনে হলো না। কেমন কঠিন করে লিখেছে। লেখকের নাম দস্তয়েভ্স্কি। তার একটা বই সম্পর্কে লেখা। বইটার নাম সাদা রাত।
ইমরান আমাকে পছন্দ করে কেন? এমনিতেই ভালো লাগা, নাকি অন্য কিছু? ও কী চায়? ও কি আমাকে বিয়ে করতে চায়? ভাবাই যায় না ওকে বিয়ে করার কথা। হঠাৎ মায়া হল ওর জন্য। কী সাদামাটা পরিবার। নিশ্চয়ই ওর উপরেই এখন তার পরিবারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। হয়তো ইনকামের বড় একটা অংশই সে বাসায় পাঠায়। ওর ভবিষ্যৎ কী? ও কেন এই চাকরি করে? এই চাকরি কয়দিন? এরপর সে কী করবে? ওর অবশ্যই বিসিএসের জন্য ট্রাই করা উচিত।
ওর চেহারায় কোথায় জানি নিম্নবিত্তের ফ্লেভারটা আছে। ওর ফ্যামিলিটা একটু গরিব দেখেই কী তার প্রতি আমার এই অনাগ্রহ। জানি না। কিন্তু এটাও একটা ফ্যাক্ট। ইমরানের পোস্টটাতে লাইক দিলাম। কী মনে করে শোভনের আইডিতে ঢুকলাম আমি। এখনো বিয়ের ছবিটাই কভার ফটো দিয়ে রেখেছে। খুব হাসি-হাসি মুখ করা ছবি। বৌয়ের চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। মেকাপে ঠাসা। সুন্দর লাগছে তবু। এই তো শোভন। তার সারাটা শরীর আমার চেনা। যেমন আমার শরীরটা তার চেনা। ওর বৌয়ের কাছে নিশ্চয়ই সে আমার কথা লুকাবে। যদি বলেও, বলবে খুব হালকা করে। বলবে, ‘এই একজনকে পছন্দ করতাম। ভালো লাগতো আর কি! কেন ভালো লাগতে পারে না! বলতে পারো একপাক্ষিক পছন্দ। আমাকেই পছন্দ করত। পরে জানতে পারলাম, চরিত্র ভালো না। এরপর থেকে মেয়েলোকের ব্যাপারে সাবধান হয়ে গেলাম।’ এইটুকু শুনেই অভিমান করে গাল ফুলিয়ে রাখবে ওর বৌ। হাসতে হাসতে শোভন বলবে, আরে বললাম তো তেমন কিছু না। তবু বারবার জানতে চাইবে, সে কি আমার চেয়েও সুন্দরী? বলো, আমার চাইতেও সুন্দরী? ছবি দেখতে চাইবে সেই মেয়ের। শোভন বলবে, ছবি পাবো কোথায়। মাস দুয়েকের সম্পর্ক।
বলে ফেঁসে যাবে শোভন। মেকি কান্নার ভাব করে বলবে তার বউ, দু…ই মা…স। জানতে চাইবে, এই বলো, তোমাদের মধ্যে কী কী হয়েছে? বলো? শোভন বলবে, তোমার কী মাথা খারাপ? এই দুই মাসের মধ্যে কী হবে? এই একটু হাত ধরাধরি! ওর বৌ আরও গাল ফুলাবে, বলবে, তুমি তার হাত ধরেছো? কেন ধরেছো, বলো, কেনো ধরেছো? শোভন তার মান ভাঙাবে। বলবে, সরি মাই সুইটহার্ট। কান ধরবে। প্রতিশ্রুতি দেবে যে সে আর কোনো মেয়ের দিকেই কখনো তাকাবে না। তারপর? তারপর তারা একজন আরেকজনকে অনেক অনেক চুমু খাবে। ইচ্ছে মত চুমু খাবে। সারা শরীরে চুমু খাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না আইসক্রিমটি গলে একদম শেষ হয়ে যায়। আগ্রহের বিন্দুমাত্র ঘাটতি দেখা যাবে না কারো মধ্যে। সেখানে নেই কোনো উৎকণ্ঠা। নেই কোনো সাপ ঢোকার সরু পথ। লখিন্দর তো সে নয়। এটা মিরপুর নয়। বইয়ে বোঝাই বন্ধুর রুম নয়। একান্তই নিজেদের একটি কামরা।
আমি কি হিংসা করছি মেয়েটাকে? হিংসা করবো কেন! আর হিংসা করলে করছি। এমনও তো হতে পারে যে, মেয়েটার জন্য করুণা হচ্ছে আমার। সে ও কি আমার মত একজন দিয়া নয়?
প্রেম করতে ইচ্ছা করছে আমারও। উড়াধুড়া একটা প্রেম। দেখাতে ইচ্ছা করছে তাকে, আমিও খুব পারি। ইমরান, বিভাস দা’ চাইলে এদের যে-কারো সঙ্গে প্রেম করতে পারি আমি। ইমরানকে হয়ত শোভনের পাশে একটু ড্যাম লাগবে। কিন্তু বিভাস দা’র কাছে পাত্তাই পাবে না শোভন। আবার তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো উচিত। যেভাবে আমার দিনগুলো কাটছে, তা যে আমি উপভোগ করছি, এটা তার জানা উচিত। আসলেই তো, বিভাস দা’র সঙ্গে প্রেম করলে কেমন হয়? নায়কদের মত সুন্দর না হোক, উনার মধ্যে কেমন একটা ড্যাশিং ভাব আছে।
শোভনকে আমি একদম বুঝতে পারতাম না। অবশ্য বোঝার চেষ্টাও করিনি কোনোদিন। ভাবতাম ভালো ছেলেরা সবাই শাহরুখ খানের মত। একটু অভিমানী, কিন্তু তারচেয়ে অনেক অনেক বেশি ভালো। এমন অনেক কিছুই আমি করেছি, কেবল ও চেয়েছে বলে। মনে হতো ওর প্রতিটি কথারই নিশ্চয়ই ভালো কোনো উদ্দেশ্য আছে। নিজের দোষে আমিই যা বুঝতে পারি না। ও রাগ করে থাকলে খুব খারাপ লাগত আমার। মনে হত, ভুলটা আমারই। কেন ওকে শুধু শুধু রাগালাম। দুইদিনও পার হতো না, আমি কান্না শুরু করতাম। সরির পর সরি বলতাম তাকে।
একবার শোভন বললো, ও আমাকে দেখতে চায়। অনেক অনেক দেখতে চায়। শুধু ও আর আমি। সে আমাকে দু’চোখ ভরে দেখবে। সে আমার সবকিছু দেখবে। কোনো আড়াল থাকা যাবে না। খুব ভালো লাগছিলো আমার। কী সুন্দর করে বলছিলো শোভন। আমারও খুব দেখতে ইচ্ছা করতো শোভনকে। কিন্তু তাকে সে-কথা আমি বলতাম না। ভয়ও হচ্ছিলো আবার। কীভাবে কী হবে! শোভনই সব ম্যানেজ করলো। বললো, মিরপুরে ওর এক বন্ধুর বাসা আছে। ফ্যামিলি বাসা। কোনো অসুবিধা নেই। বাসায় কেউ থাকবে না। শুধু সে আর আমি। তখন আমার ভয় আরও বেড়ে গেল। মনে-প্রাণে চাচ্ছিলাম, বিষয়টা বাদ হয়ে যাক। দুশ্চিন্তায় আর ভয়ে বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও আমার অবশিষ্ট ছিলো না। তবুও সেই বিশেষ দিনটি এলো। ঘটনার আগের কয়েকদিন বলতে গেলে ঘুমই হয়নি আমার। রাজ্যের যত দুশ্চিন্তা তাড়া করছিলো আমাকে। ঘুম হয়নি পরের কয়েকটা দিনও।
দুপুরে আমরা সেন্ট্রাল লাইব্রেরির ক্যান্টিনে খেলাম। খেয়ে ধীরে সুস্থে রওনা দিলাম মিরপুরের দিকে। সবকিছুই আমার কাছে তখন সিনেমার মত লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো, কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করছি আমি। কিন্তু খুবই বিসদৃশভাবে সেই সিনেমায় শোভনের কোনো ভূমিকা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
মিরপুরের আল-হেলাল হাসপাতালের পাশের একটা গলি দিয়ে আমরা ঢুকলাম। এলাকাটার নাম সেনপাড়া পর্বতা। যতই আমরা বাসাটার দিকে এগোচ্ছিলাম, শোভনকে ততই নার্ভাস দেখাচ্ছিলো। আমার বরং কেমন একটা ড্যাশিং ফিল হচ্ছিলো।
যতটা বাজে ভেবেছিলাম, আমার জীবনে সেই দিনটা ছিলো তারচেয়ে শতগুণ বাজে। শোভন বলেছিলো, আমাকে সে দেখতে চায়। অনেক দারুণভাবে দেখতে চায়। আমি ভেবেছিলাম, অনেক অনেক চুমু দিবো শোভনকে। মনে মনে অনেক অনেক আদর করার প্রিপারেশান আমি নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেদিনই শোভন সেক্স করে আমার সঙ্গে। একপ্রকার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে। এখন আমার স্পষ্ট মনে হয়, আমার আপত্তিকে সেদিন মোটেও সম্মান করেনি শোভন। সত্যিই আমি অবাক হয়েছিলাম। সব রকমের প্রস্তুতিই নিয়ে এসেছিলো শোভন। অথচ আমাকে কিচ্ছু বলেনি সে। সামান্য ইঙ্গিতও দেয়নি। এখন বুঝতে পারি, সেদিনই হয়ত তার প্রতি বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো আমার।
এই ঘটনার পরও আমিই সরি বলেছিলাম তাকে। বলেছিলাম, বুঝতে না-পেরে তার মনে আমি কষ্ট দিয়েছি। এজন্য আমি সরি। অবশ্য সে-ও সরি বলেছিলো, আমাকে আগেই না জানানোর জন্য। এবং এরপর সেই বাসায় আরও অনেকবার গিয়েছি আমরা। এখন ভাবলে ঘেন্নায় আমার গা রি রি করে। ছিহ্! আমার মত একটা বাজে মেয়ের সঙ্গে কারো আসলে কথাই বলা উচিত না।
খাওয়ার-দাওয়ার পরও ব্যস্ততা বেশ। বাসন-কোসন ধোও, ওগুলো আবার আগের জায়গায় রাখো। মাকে রেস্ট নিতে পাঠিয়ে আমিই ধুয়ে-মুছে ফেললাম সব। বিকেল-বিকেল নাগাদ পুরো বাসায় এক ধরনের নিস্তব্ধতা নেমে এলো। বাবা বাইরে গেছেন। হাঁটাহাঁটি করে একেবারে মাগরিবের নামাজ পড়ে ফিরবেন। মা ঘুমাচ্ছে। জানালা বন্ধ করেনি। ঘরসুদ্ধ মশা ভন ভন করছে। মশারি খাটিয়ে নেয়নি। আমি জানালা লাগিয়ে দিলাম। সবচেয়ে মজার কাণ্ড করেছে হিয়া। বুকের উপর বই রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে। হাতে পায়ে মশা কামড়িয়েছে। রক্ত খেয়ে পেট ঢোল করে আছে একেকটা। আলতো করে আমি ডাকলাম। বললাম মশারি খাটিয়ে ঘুমাতে। ধড়মড় করে জেগে ওঠলো সে। কী করবে বুঝতেছে-না ভাব। মশারি খাটিয়ে দিলাম। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা।
জায়নামাজে বসে দোয়া দরুদ পড়ছে দাদি। মাগরিবের সময় নাকি দোয়া কবুল হয়। মাগরিবের ওয়াক্তেই কেয়ামত হবে। বিভিন্ন সময়ে এইসব কথা আমাদের মনে করিয়েই দেয়াই তার কাজ। সারাদিন কেমন গম্ভীর চোখমুখ নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। আজ তাকে অচেনা লাগছিলো। বোঝাই যাচ্ছিলো, মন তার ভিন্ন বিষয়ে নিবিষ্ট। নিশ্চয়ই দাদার স্মৃতি ভর করেছে তাকে। রোজা রেখেছে। জিকির-নামাজ নিয়েই ছিলো। তাই ভাবি, আমাদের থেকে কত আলাদা তাদের জগৎ। তার ইফতারের জন্য শরবত বানালাম। চিনি ঠিক আছে। হিয়ার রুমে রেখে এলাম এক গ্লাস। নিজেকে কেমন বড় বড় লাগছে। মনে হচ্ছে এই নিস্তব্ধ বাসার আমিই এখন অভিভাবক।
বাবারা তিন ভাই। বাবা সবার বড়। বাবারও বড় একজন বোন ছিলেন। মারা গেছেন যুদ্ধের সময়। কী একটা রোগ হয়েছিলো দাদি বলতে পারেন না। নাক দিয়ে সমানে রক্ত আসতো। পচা রক্ত। বিয়ের বয়সে মারা গেছেন। মেয়ে বলতে পাগল ছিলেন দাদা। মা ছাড়া ডাকতেন না কখনো। যখন যা আবদার করতো, তাই হাজির। সেই সময়ে সেভেন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন আমাদের সেই ফুপু। ফুপু যখন মারা যায় বাবা তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। কোন ক্লাসে পড়তো ঠিক করে বলতে পারে না দাদি। একবার বলে, হেলাল তখন কেবল-কেবল স্কুলে যায়। আরেকবার বলে থ্রি-না-ফোরে পড়তো। হাবিব চাচা তখন কোলে। জন্মই হয়নি হিরা চাচার। বড় লক্ষ্মী মেয়ে ছিলেন ফুপু। কোনো কাজেই হাত দিতে হতো না দাদিকে। আগ বাড়িয়ে সব কাজ করে ফেলতো। তারপরও দাদি রাগারাগিই করতেন মেয়েটার সঙ্গে। দাদির সঙ্গে ঝগড়া করে সারাক্ষণ গাল ফুলিয়ে থাকতো। একেবারে বাপের দুলালী ছিলো। দাদি বলে আর কাঁদে। এই এক মুশকিল। শুনতে শুনতে আমারও খুব কান্না পায়। জোর করে কান্না আটকে রাখি আমি। মনে হয় রুমে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদি। আর আমার খুব রাগ-রাগ লাগে।
ফুপুর চেহারাটা কল্পনায় আমি আঁকতে চেষ্টা করি। দাদি বলে দুধের মত ফর্সা আছিল। চুল আছিল কোমড় পর্যন্ত লম্বা। চুলরে চুল! বেনি করা যাইত তিনটা। আমার তখন প্রাইমারি স্কুলের এক আপার মুখ মনে পড়ে। মনে হত ফুপু মনে হয় ঐ আপাটার মতই ছিলেন। আপা কী সুন্দর! সারা শরীরে উনার কী সুন্দর ঘ্রাণ। কী এক দুষ্টামি করাতে একদিন ধমক দিয়েছিলেন আপা। আমার সে কী কান্না। পরে জড়িয়ে ধরে আমাকে আদর করেছিলেন আপা। আপার কি তখন বিয়ে হয়েছিল? জানি না। হয়তো হয়নি। এমন সুন্দর মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। সেই সৌন্দর্যের যেন কোনো তুলনা নেই।
হাবিব চাচা পড়াশোনা করেননি বেশিদূর। দাদি বলে, মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার বছরেই পড়া বাদ দেয়। কাঠের ব্যবসা উনার। গাট-টাছ কিনে স-মিলে কাটিয়ে নেন। কাঠ বিক্রি করেন। নয়তো সেই কাঠ দিয়ে সস্তা ফার্নিচার বানিয়ে বিক্রি করেন। আমাদের দাদার ছিল কাঠের ব্যবসা। সেই সিলসিলা হাবিব চাচা পেয়েছেন। চাচা বাবার মতই একটু গম্ভীর প্রকৃতির। আমাদের বোনদের সবাইকেই মা বলেন ডাকেন। এ-নিয়ে দাদি আমাদের সঙ্গে মেকি হিংসা দেখায়। খুব ভলো লাগে তখন। হাবিব চাচার দুই ছেলে। এক ছেলে পড়ে নাইনে। ফাহিম। আরেকজন ফাইভ পাশ করে এবার সিক্সে উঠবে। ওর নাম জিসান। বিলকিস চাচি ট্রাডিশনাল। উনার জায়গা থেকে উনি হয়তো ঠিকই আছেন। ঈদে-টীদে শেরপুর গেলে যথেষ্ট আদর করেন। আদরের চেয়ে সমীহ শব্দটাই এখানে বেশি মানানসই।
আনন্দমোহন কলেজে হিরা চাচা ডিগ্রি পর্যন্ত পড়েছেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনিই ছোট। মনে হয় পাশ করেননি। শেরপুরের ভূমি-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল-লেখক। স্থানীয়-রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন একসময়। আওয়ামী লীগ করতেন। এখনও হয়ত করেন। নেশা আর রাজনীতি নাকি কখনো ছাড়া যায় না। রাজনৈতিক ঝামেলার কারণে প্রায়ই চাচা আমাদের এখানে আসতেন। থাকতেন অনেকদিন। আমার তখন খুব ভালো লাগতো। চাচাকে আমার খুব পছন্দ। ছোটো চাচার সঙ্গেই আমার বেশি খাতির। চাচা আমার ছোটো বেলার হিরো। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কথা চাচাই আমাকে বলতেন। উনার মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প শুনেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা হতো আমার। বলতেন, পড়লে পড়তে হবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে। নয়তো দরকার নাই। বিশ্ববিদ্যালয় একটাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আমারও জেদ চাপতো। পড়তেই হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। চাচা কত বদলে গেছে এখন। আগের মত আর নেই। হিরা চাচার এক মেয়ে — নার্গিস। সামনের বছর স্কুলে দেবে। সবচেয়ে অসাধারণ হলেন চাচি। শেরপুর গেলে চাচিই আমাদের খোঁজখবর করেন। শাসনের ঢঙে আদর করেন। উনার নাম পরী। কিন্তু মোটেই উনি পরীদের মত নন। দেখতে খুবই সাদামাটা। কিন্তু মন ভালো। পরীদের চেয়েও সুন্দর।
আমাদের সংসার চলে বাবার পেনশনের টাকায়। উত্তরায় একটা কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত আছেন বাবা। বাবাকে সঙ্গে রেখেছেন; এই আরকি। বাবা হয়তো সেখানে দুয়েকটা ব্যাচও পড়ায়। একদিন বললাম, এখন আর তোমার ব্যাচ-ট্যাচ পড়ানোর দরকার কী। বাবার কথাও অবশ্য ঠিক। বসে থাকলেই বরং শরীর ভেঙে পড়বে।
শেরপুরে আমাদের কিছু ধানী জমি আছে। চাচারাই দেখাশোনা করেন। বাসার চাল শেরপুর থেকেই আসে। তারপর আমি এখন চাকরি করি। বিশিষ্ট গাইড বই লেখিকা। এর আগে একটা কলেজে ক্লাস নিতাম। হাত খরচ আসতো। এভাবেই চলছে আমাদের সংসার। চলছে বোনদের পড়াশোনার খরচ।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অসময়ে ঘুমালে মাথা ব্যথা করে। মাথাটা কেমন ভার হয়ে আছে। শুক্রবার আসলেই কেবল মনে হয়, চাকরি-বাকরির জন্য একটু পড়া উচিত। প্রিলিটা হয়ে গেলে, প্রয়োজনে চাকরি ছেড়ে, রিটেনের একটা কড়া পিপারেশন নেওয়া যাবে। কীসে যে কী হবে, আর না হবে, হিসাব মেলাতে পারি না। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। জীবন নিয়ে কোথায় যেন এক গভীর ভালো-না-লাগা। আবার কোথাও একধরনের সূক্ষ্ম ভালো লাগা রয়েই যায়।
হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ-ট্রেশ হয়ে হা… কফিতে চুমুক দিয়ে একটু ভালোই লাগছে। নেসক্যাফে থ্রি-ইন-ওয়ান। সাধারণ জ্ঞান বইটা বের করলাম। ড্রয়িংরুম থেকে টিভির সাউন্ড আসছে। বিজ্ঞাপন চলছে লাক্সের। লাক্সের ছোঁয়ায়, আমি স্টার হয়ে যাই।
পড়ুন ।। কিস্তি : ৬