ডিকলোনাইজিং দ্যা মাইন্ড ।। কিস্তি : ৮

ছবিসূত্র : ম্যাজিক্যাল কেনিয়া ডট কম

আফ্রিকান থিয়েটারের ভাষা

নগুগি ওয়া থিওঙ্গো সাহিত্য ও রাজনীতির দুনিয়ায় চেনা একটি নাম। তাঁর বিখ্যাত বই Decolonising the Mind: The Politics of Language in African Literature (1986)। ঔপনিবেশিক রাজনীতি, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি বোঝার দারুণ প্রতিনিধি-পুস্তক এই বই। বইটি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করবেন শিবলী নোমান

 

নাটকে গিকাম্বা নামের এক শ্রমিক চরিত্রের স্বগতোক্তির মাধ্যমে পুঁজি ও শ্রমের এই সংগ্রামের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছিল। আর এই চরিত্রটি তৈরি হয়েছিল এসব আলোচনা থেকেই। কিগুন্দার কাছে গিকাম্বার এই স্বগতোক্তি আসলে বলতে চায় যে কৃষকদের চেয়ে শ্রমিকরা খুব ভালো অবস্থায় নেই। আরও বলতে চায় যে শ্রমিক ও কৃষক উভয় শ্রেণিই একই সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদের ভুক্তভোগী। গিকাম্বার স্বগতোক্তির কেন্দ্রীয় বিষয় হলো বিংশ শতাব্দীতে পুঁজি ও শ্রমের ভেতর সংগ্রাম থেকে উঠে আসা মূল প্রশ্ন :
বড় বড় কারখানা ও শিল্প থাকা ভালো
খুবই ভালো!
এটি দেশের উন্নয়নের একটি উপায়।
প্রশ্ন হলো: এসব কারখানার মালিক কারা?
কাদের সন্তানরা এসব কারখানা থেকে লাভবান হয়?

 

এই নাটকটির আধেয় কেনিয়ার সমাজের প্রকৃতি নিয়ে অনেক প্রশ্ন সামনে তুলে ধরেছিল। আর এই নাটকের শুরু থেকে যে বিভিন্ন পর্যায় সেসবের ধরন ও আধেয় নিয়ে অনেক উত্তপ্ত আলোচনা হয়েছিল। এসব আলোচনায় নাটকটিতে অংশগ্রহণকারীদের সাথে সাথে এর নানা ধরনের অডিয়েন্সরাও যুক্ত হতো।১২

 

নাটকের জন্য বাছাই ও অনুশীলন হয়েছিল খোলা বা উন্মুক্ত স্থানে। প্রথমদিকে খোলা বা উন্মুক্ত ব্যপারটি আমাদের উপর অনেকটা চাপিয়ে দেয়া বা জোরপূর্বক মনে হলেও, আমাকে বলতেই হবে যে শৈল্পিক বিষয়াদির সমাধানের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ কখনো কখনো আপাত ধীর ও গোলযোগপূর্ণ মনে হলেও এর ফলে শৈল্পিক শ্রমিকদের সম্প্রদায়ে একটি উচ্চ শৈল্পিক ও দৃঢ় সম্প্রদায়গত সজীবতা উৎপাদিত হচ্ছে, এমন বিশ্বাসও বাড়ছিল। ইউনিভার্সিটি অব নাইরোবির পিএইচডি কিংবা কারখানা ও খামারগুলো থেকে বেরিয়ে আসা পিএইচডি কিংবা গোর্কির ‘সড়কসমূহের বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে বেরিয়ে আসা পিএইচডি — সবাইকে মূল্যায়ন করা হচ্ছিলো দলগত চেষ্টায় প্রত্যেকের অবদান বিচার করে। উন্মুক্ত স্থানে বাছাই ও অনুশীলনের ফলে সবাই থিয়েটারের সকল উপাদানসহ এর নির্মাণ প্রক্রিয়া দেখার সুযোগ পেয়েছিল। ফলে মানুষের মাঝে থিয়েটারের পুরো প্রক্রিয়াটির রহস্যমুক্তি ঘটেছিল।

 

বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও অপেশাদার গণ্ডিতে আমি যেসব থিয়েটারের সাথে যুক্ত ছিলাম সেগুলোতে অভিনয়শিল্পীরা কম-বেশি গোপনে অনুশীলন করতেন আর সরল অডিয়েন্সের সামনে তার অনুশীলনের উৎকৃষ্ট ফলাফল উপস্থাপন করতেন। এই উপস্থাপন অডিয়েন্সকে ঈর্ষাকাতর প্রশংসার দিকে নিয়ে যেত। যেমন, ওহ, কী নিখুঁত, কী প্রতিভা, যেন এক উদ্বুদ্ধ উপহার — নিশ্চিতভাবেই আমি কখনোই এমন কিছু করতে পারবো না। এ ধরনের থিয়েটার মূলত সাধারণ বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থার অংশ যেখানে শিক্ষাকে মানুষকে দুর্বল করার, তাদেরকে কিছু করার অযোগ্য হিসেবে মনে করতে গড়ে তোলা হয় — ওহ, এটা করতে নিশ্চয়ই খুব মেধার প্রয়োজন — অন্য কথায়, এই ব্যবস্থায় শিক্ষাকে জ্ঞান ও বাস্তবতাকে রহস্যে ঢেকে রাখতে ব্যবহার করা হয়। মানুষকে তার অক্ষমতার বিপরীতে আত্মবিশ্বাসী ও বাধা দূর করতে সক্ষম করে তুলতে অথবা মানুষ হিসেবে প্রকৃতির বহিঃস্থ বিষয়াদির উপর প্রভাব বিস্তারের সক্ষম না করে এই শিক্ষা ব্যবস্থা তাদেরকে বাস্তবতার মুখোমুখি হতে তাদের নিজেদের অপর্যাপ্ততা, দুর্বলতা এবং অক্ষমতার অনুভূতি দিতে চায়। একই সাথে এই ব্যবস্থা তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে এমন বিষয়াদির ক্ষেত্রে তাদের কিছু করার অক্ষমতার দিকেও নির্দেশ করে। এর ফলে তারা নিজেদের থেকে এবং তাদের প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ থেকে আরও বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বিচ্ছিন্নতা তৈরির প্রক্রিয়া হিসেবে এই শিক্ষা ব্যবস্থা একদল তারকা এবং কৃতজ্ঞ ও প্রশংসাপরায়ণ সমবৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সাধারণ জনগণ উৎপাদন করে। গ্রিক মিথলোজির অলিম্পিয়ান ঈশ্বর কিংবা মধ্যযুগের সাহসী নাইটরা বিংশ শতাব্দীতে পুনর্জন্ম লাভ করেছেন তারকা রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী, খেলোয়াড়, অভিনেতা, সুন্দর নায়ক হিসেবে যাদেরকে সাধারণ জনগণ সবসময় দেখে থাকেন পরোক্ষভাবে, কৃতজ্ঞচিত্তে ও প্রশংসাপরায়ণ হয়ে।

 

কামিরিথু ছিল এর উল্টো। কামিরিথু ছিল জ্ঞান ও বাস্তবতাকে রহস্যমুক্ত করার প্রক্রিয়া হিসেবে শিক্ষাকে ব্যবহারের চর্চা। এখানে মানুষ দেখেছিল সেই সব অভিনয় শিল্পীদের যারা মঞ্চে চলাফেরা বা কথা বলার সময় এক পাও নাড়াতে না পারা কিংবা একটি ছত্রও বলতে না পারা থেকে পরিবর্তিত হতে হতে এমন হয়েছিলেন যে পরবর্তিতে মঞ্চে তাদের দেখে মনে হতো তারা ঐসব ছত্র বলার জন্যেই বা মঞ্চে চলাফেরার জন্যেই জন্মেছেন। কিছু কিছু মানুষকে অভিনয় দলে নেয়া হয়েছিল যখন তারা শো চলার মাঝেই কোন চরিত্রকে কিভাবে উপস্থাপন করা উচিত তা নিয়ে মতামত দিয়েছিলেন। অডিয়েন্স তাদেরকে ঐ অংশটুকু করতে উৎসাহ দিয়েছিল। এভাবে নিখুঁত হয়ে ওঠাটা একটা পদ্ধতি হিসেবে সামনে আসে, একটি ঐতিহাসিক সামাজিক পদ্ধতি হিসেবে। কিন্তু একে কোনভাবেই কম প্রশংসা করা হয় নি। অন্যদিকে তারা এই নিখুঁত হয়ে ওঠাকে আরও বেশি চিহ্নিত করতে পেরেছিল কারণ এটা ছিল তাদেরই সামষ্টিক অবদানে তৈরি তাদেরই বিষয়। এটি ছিল সম্প্রদায়গতভাবে তাদের আরও উন্নীতকরণ।

 

 

এনগাহিকা এনদিনদা-র চিত্রনাট্য নিয়ে গবেষণা, এর সার-সংক্ষেপ লিখন, সার-সংক্ষেপ নিয়ে অন্যান্য পাঠ ও আলোচনা, বাছাই ও অনুশীলন এবং উন্মুক্ত থিয়েটার নির্মাণ করতে নয় মাস সময় লেগে গিয়েছিল। ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বও পর্যন্ত। সাধারণ মানুষের সময়ের সাথে পাঠ, আলোচনা ও অনুশীলনগুলোর সময় সমন্বয় করা হয়েছিল। তাই এগুলো কখনো কখনো শনিবার বিকেলে হলেও সাধারণত রবিবার বিকেল ছিল নিয়মিত সময়। বিকেলেই এর সময় নির্ধারিত করা হয়েছিল যেন কামিরিথু থিয়েটারের সাথে রবিবার সকালের চার্চে প্রার্থণার সময়ের সংঘর্ষ না ঘটে।

 

এ সকল চেষ্টারই উদ্দেশ্য ছিল আফ্রিকান থিয়েটারের যথার্থ ভাষার বিকাশ ঘটানো। আর এই উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট ছিল ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর যেদিন নাটকটি পরিবেশিত হয়েছিল আর টাকার বিনিময়ে অডিয়েন্সরা তা দেখেছিল। এই আয়োজনটিও করা হয়েছিল রবিবার বিকেলে। সন্ধ্যায় আয়োজন করা হলে তা অনেকের জন্যে কষ্টকর হতো ঠান্ডার কারণে। এনগাহিকা এনদিনদা নাটকটি তাৎক্ষণিক সফলতা পেয়েছিল। এটি দেখতে মানুষ এসেছিল দূর-দূরান্ত থেকে, এমনকি গাড়ি ও বাস ভাড়া করেও। থিয়েটার পরিণত হয়েছিল যা এটি সবসময় ছিল, একটি সামষ্টিক উৎসবের অংশ। কিছু কিছু মানুষ নাটকের সংলাপগুলো জানতেন ঠিক একজন অভিনয় শিল্পীর মতোই। আর আলাদা আলাদা দর্শকের সামনে আলাদা আলাদা উপলক্ষ্যে অভিনয় শিল্পীদের ভিন্নতা দেখে তারা আনন্দ পেয়েছিলেন। নাটকের চরিত্রগুলো নিজস্ব পরিচয় তৈরি করে নিয়েছিল। অনেকে নিজেদেরকে তাদের প্রিয় কৃষক বা শ্রমিক চরিত্রের নামে পরিচিত করেছিলেন। যেমন কিগুন্দা, গিকাম্বা, ওয়াংগেচি, গাথোনি। কিন্তু একই সাথে তারা অনেককে কিওই, এনদিতিকা, ইকুয়া এবং এনদুগিরে নামেও ডাকতেন, যারা কিনা থাকতো গ্রামের বাইরে আর যাদের ভেতর ছিল জনবিরোধী প্রবণতা। এনগাহিকা এনদিনদা-ও ভাষা প্রভাব ফেলেছিল মানুষের দৈনন্দিন শব্দভাণ্ডার ও অন্যকে কাঠামোবদ্ধ করতে। কিছু কিছু দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমার মনে পড়ে এক রবিবারে বৃষ্টি শুরু হলে মানুষজন দৌড়ে নিকটস্থ গাছ বা ছাদের নিচে আশ্রয় নিয়েছিল। বৃষ্টি থেমে গেলে অভিনয় শিল্পীরা আবার শুরু করেন এবং মিলনায়তন ঠিক আগের মতো পূর্ণ হয়ে যায়। সেই বিকেলে নাটকের মাঝে তিনবার থামতে হয়েছিল কিন্তু অডিয়েন্স কোথাও চলে যায় নি। কামিরিথুর সাথে সাধারণ মানুষের সংযোগ ও পরিচিতি হয়েছিল সম্পূর্ণ।

 

পরবর্তী সময়ে তারা দূরে সরে গিয়েছিল। বৃষ্টি বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে নয়, বরং জনবিরোধী শাসনের কর্তৃত্ববাদী হস্তক্ষেপের কারণে। সেন্টারের যে কোন ধরনের জনসমাগমের লাইসেন্স প্রত্যাহার করে নিয়ে ১৯৭৭ সালের ১৬ নভেম্বর কেনিয়া সরকার এনগাহিকা এনদিনদা-র পরবর্তী সকল পরিবেশনা নিষিদ্ধ করে দেয়। ১৯৭৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কোন ধরনের বিচারিক কার্যক্রমের সুযোগ ছাড়াই ১৯৭৮ সালের পুরোটা সময় আমি ছিলাম সর্বোচ্চ নিরাপত্তামূলক কারাগাওে বন্দি। কেনিয়ান থিয়েটারের একটি যথার্থ ভাষার উদ্ভব রোধ করতেই তারা এসব করেছিল।

 

কিন্তু ধরন ও বিষয়ে আফ্রিকান থিয়েটারের যথার্থ ভাষার খোঁজে সেটিই কামিরিথুর শেষ ছিল না।
১৯৮১ সালের নভেম্বরে তারা আরেকটি প্রয়াস নিয়ে একত্র হয়েছিল। এটি ছিল মাইতু এনজুগিরা-র প্রযোজনা।১৩ ১৯৮১ সালের ৭, ১৪ ও ১৫ নভেম্বর ছল বাছাইয়ের তারিখ। ঠিক যেন যেখান থেকে কামিরিথু থেমে গিয়েছিল সেখান থেকেই আবার শুরু। আমি আমার বই ব্যারেল অব আ পেন: রেজিজিট্যান্স টু রিপ্রেশন ইন নিও-কলোনিয়াল কেনিয়া-তে এই নাটকের ভাগ্য নিয়ে আলোচনা করেছি। এখানে আমি শুধু বলতে চাই যে, ১৯৭৭ সালের থিয়েটারের সকল বিষয়াদি আরও উন্নয়ন সাপেক্ষে এই থিয়েটারে উপস্থিত ছিল। মাইতু এনজুগিরা নাটকে উঠে এসেছিল ভূমি বাজেয়াপ্ত করার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদের পুঞ্জীভূতকরণের ‘সেকেলে’ পন্থার প্রাথমিক পর্যায় ও কেড়ে নেয়া সেই ভূমিতে জবরদস্তিমূলক শ্রম প্রয়োগ ও সেটেলার দ্বারা পরিচালিত খামারগুলোর উন্নয়নের জন্যে জনগণের উপর চাপানো করের বোঝার বিরুদ্ধে কেনিয়ান শ্রমিকদের নায়কোচিত সংগ্রাম।

 

অবদমন ও প্রতিরোধের এই গল্প বলায় কথার চেয়ে নাচ, মূকাভিনয় ও গান ছিল অনেক বেশি প্রভাবশালী। এই আখ্যান ও বিশ্লেষণের ভার চিত্রকল্প ও শব্দের মাধ্যমে বহন করা হয়েছিল। বিশ ও ত্রিশের দশকের সময়গুলোকে সঠিকভাবে উপস্থাপনের জন্যে স্লাইডও ব্যবহার করা হয়েছিল। আর এই নাটকের বিকাশের প্রতিটি ভিন্ন স্তরে কেনীয় জাতীয়তার বিভিন্ন অংশের অনেক মানুষ যুক্ত হয়েছিল। মাইতু এনজুগিরা মূলত ছিল গানে গানে একটি নাটক যেখানে কেনিয়ার আটটির বেশি জাতীয়তার ৮০ টিরও বেশি গানের মাধ্যমে আনন্দ, দুঃখ, অর্জন, ক্ষতি, একতা, বিভেদ এবং কেনিয়ার মানুষের সংগ্রামের অগ্রগতি ও স্থবিরতা তুলে ধরা হয়েছিল।

 

১০ সপ্তাহ শ্রম দেয়ার ফলে এই গীতিনাট্যটি সকল জাতিসত্তার শ্রমিক, কৃষক এবং প্রগতিশীল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ জোটের বহিঃপ্রকাশে পরিণত হয়েছিল। আর ১৯৮২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কেনিয়া ন্যাশনাল থিয়েটারে এই গীতিনাট্যটি পরিবেশিত হওয়ার কথা ছিল। কেনিয়া ন্যাশনাল থিয়েটারে পরিবেশেনার মাধ্যমে গীতিনাট্যটি দেখাতে চাচ্ছিলো যে আফ্রিকান থিয়েটারের একটি যথার্থ ভাষা, সেটি যে নির্দিষ্ট ভাষাতেই ভাব প্রকাশ করুক না কেন, সকল জাতিসত্তার মানুষের সাথে তা যোগাযোগ করতে সক্ষম। এটি আরও প্রমাণ করতে যাচ্ছিলো যে এই বিশেষ চর্চায় কেনিয়ার সকল জাতিসত্তার মানুষের সমর্থন রয়েছে। এরকম একটি বিষয় প্রমাণের জন্যে সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান সেটিই যার নামই হলো কেনিয়া ন্যাশনাল থিয়েটার। বড়দিনের পর বছরের শুরুতে থিয়েটারের মৌসুম নয় এমন সময়ে দীর্ঘতম সময় ধরে চলার রেকর্ড এসময় নাটকটির দখলে ছিল।

 

কৃষক ও শ্রমিকদের এই জাতীয় থিয়েটারটি রাজধানী শহরে নিয়ে আসার কথা ছিল। কিন্তু তা আসলে হওয়ার ছিল না। কর্তৃপক্ষ এবার লাইসেন্স প্রশ্নে নয় বরং ব্যবস্থাপকদের কাছে দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেয়ার নির্দেশ পাঠিয়ে দেয় আর জনগণের শান্তি ও জননিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা বলে পাঠানো হয় পুলিশ বাহিনী। বিখ্যাত থিয়েটার টু, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আমাদের অনুশীলনের চেষ্টাও ব্যর্থ হয় ১০ দিন ‘অনুশীলন’-এর পর, যেগুলো প্রতিটি দেখেছিল ১০ হাজার মানুষ! বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে থিয়েটার টু-এর দরজাতেও তালা লাগানোর নির্দেশ দেয়া হয়। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার, ১৯৮২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। ১১ মার্চ ১৯৮২, বৃহস্পতিবারে কামিরিথু কমিউনিটি এডুকেশন অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারকে সরকার আইনবহির্ভূত ঘোষণা করে এবং পুরো এলাকায় থিয়েটার কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একটি ‘স্বাধীন’ কেনিয়ান সরকার তার ঔপনিবেশিক পূর্বসূরিদের পদক্ষেপ অনুসরণ করেছিল। তারা থিয়েটার ক্ষেত্রে কৃষক ও শ্রমিকদের খাঁটি জাতীয় ঐতিহ্যগুলোকে নিষিদ্ধ করে দেয়। কিন্তু এবার নব্য-ঔপনিবেশিক শাসকরা ব্যর্থ হয়েছিল। ১৯৮২ সালের ১২ মার্চ তিন ট্রাক ভর্তি সশস্ত্র পুলিশ কামিরিথু কমিউনিটি এডুকেশন অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে প্রবেশ করে ও উন্মুক্ত থিয়েটারটিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। এই কাজের মাধ্যমে তারা আসলে কামিরিথু ও আফ্রিকান থিয়েটারের ভাষার কৃষক-শ্রমিক ভিত্তির খোঁজের অমরত্ব নিশ্চিত করেছিল।

 

বোল যাকে ‘অবদমিতের থিয়েটার’ বলেছিলেন, সে ধরনের একটি সামষ্টিক থিয়েটার তৈরি করতে বিভিন্ন ধরনের বিষয়াদির প্রয়োজন হয়। যেমন, একটি আধেয় যা তার ধরনের কারণে সাধারণ মানুষ কর্তৃক শনাক্তকৃত ও পরিচিত; খামার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে জীবনের বিস্তারিত বিবরণ সংগ্রহের মাধ্যমে গবেষণামূলক পর্যায়গুলোতে এর বিবর্তনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ; মুথিরিগু, মুচুং’ওয়া কিংবা মুয়োমবোকোর মতো পুরনো গান ও নাচসমূহ সংগ্রহ এবং গিতুরোর মতো অপেরাসদৃশ ধরন; চিত্রনাট্য এবং আধেয় ও ধরন বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ; সবার ভেতর থেকে বাছাই ও সবার সামনে অনুশীলন; আর অবশ্যই চূড়ান্ত প্রদর্শনী। অবদমিত মানুষের সংগ্রামের ভেতরেই আফ্রিকান থিয়েটারের প্রকৃত ভাষা খুঁজতে হবে, যেসব সংগ্রাম থেকে নতুন আফ্রিকার জন্ম হয়েছে। পরিশ্রম ও নানা ধরনের হাঙ্গামার ভেতর দিয়ে আফ্রিকার কৃষক ও শ্রমিকরাই ভবিষ্যত তৈরি করছেন। এই পরিশ্রম ও বিভিন্ন হাঙ্গামা থেকে বের হয়ে আসলেও আফ্রিকান থিয়েটারের যথার্থ ভাষার এসব বিষয়াদি প্রতিফলিত করতে হবে। এ ধরনের থিয়েটার অংশগ্রহণকারীদের হৃদয় ও জীবনে তার সাড়া পাবে। এমনকি সাড়া পাবে তাদের হৃদয়েও যারা এই থিয়েটারের পার্থিব গঠন ও কার্যক্রমের পরিবেশ থেকে দূরে অবস্থান করছে।

 

১৯৮২ সালের ২২ জানুয়ারি দ্য ডেইলি ন্যাশন ৭০ বছর বয়সী অংশগ্রহণকারী এনজোকি ওয়া এনজিকিরার সাক্ষাৎকার নিয়েছিল, এনজোকি বলেন,

যখন কামিরিথু থিয়েটার দল কাজ শুরু করেছিল, আমরা বয়স্করা বুঝতে পেরেছিলাম যে তরুণদের আমরা এমন কিছু শেখাতে পারি যা তারা জানে না। আমি মনে করি এনগাহিকা এনদিনদা-তে ব্যবহৃত কিছু গান তাদের শিখিয়ে আমি জাতির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু করেছিলাম এবং এর ফলেই আমি মাইতু এনজুগিরা-র সাথেও যুক্ত থেকেছিলাম’’… এনজোকি মনে করেন এনগাহিকা এনদিনদা-র অভিজ্ঞতা আমদের দেখিয়েছে কীভাবে নাটকের মাধ্যমে ইতিহাসকে সামনে তুলে ধরতে হয় যেন ‘‘শিশুরা জানতে পারে তাদের অতীত কেমন ছিল এবং এর ফলে একটি সুন্দর সমাজ গঠনে তারা কিভাবে সাহায্য করতে পারে। নতুন নাটক মাইতু এনজুগিরা-ও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ আজকের খুব অল্পসংখ্যক কেনিয়ানই জানেন ১৯৩০ এর সময়কার উপনিবেশ আসলে কেমন ছিল, যা এই নাটকের বিষয়বস্তু।১৪

 

একই সংখ্যায় সাক্ষাৎকার দেয়া সবাই প্রায় একই রকম বলেছিলেন। তাছাড়া ১৯৮২ সালের ২৯ জানুয়ারি, শুক্রবারের দ্য স্ট্যান্ডার্ড যাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিল তারাও এমনই বলেছিলেন। ওয়ানজিরু ওয়া এনগিগি নামের একজন তরুনী কর্মচারি ও দুই সন্তানের মা সার সংক্ষেপ করেছিলেন,

অনুশীলনের সময়গুলোতে আমি আমার নিজের ইতিহাসের অনেক কিছু জানতে পেরেছি যা আমার জানা ছিল না। আমি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি যে আমার নিজের সংস্কৃতির অনেক বিষয় নিয়ে আমি এখন জানি এবং এখনও শিখে যাচ্ছি। অতীত স¤পর্কে আরও ভালো করে জানার মাধ্যমে আমি আমার বর্তমান ও ভবিষ্যত এবং আমার সন্তানদের ভবিষ্যত স¤পর্কে আরও বেশি সচেতন হয়ে উঠছি।১৫

 

এই অধ্যায়ের আগের অংশে বর্ণিত কেনিয়ান থিয়েটার আন্দোলনে কামিরিথুর স্বল্পস্থায়ী অস্তিত্বের প্রভাব রয়েছে। এর ফলে জনগণের কাছে যাওয়া এবং সাধারণ মানুষের ভাষার উপর ধীর কিন্তু ক্রমবর্ধমান বিশ্বাস ও থিয়েটারে তার ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। কেনিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের বার্ষিক ভিহিগা কালচারাল ফেস্টিভালের মতো সাধারণ মানুষের উপর ভিত্তি করে পালিত সাংস্কৃতিক উৎসবগুলো নতুনভাবে পালিত হচ্ছে। এগুলো হুবহু কামিরিথু নয়। কিন্তু কেনিয়ান সংস্কৃতির রেনেসাঁর একই ধরনের প্রয়োজনীয়তার অনুভূতি থেকে উদ্ভূত যা অর্জিত হতে পারে সাধারণ মানুষের জীবন ও ভাষার গভীরে যাওয়ার মাধ্যমে। তাই কামিরিথুকে ধ্বংস করা ছিল একটি উন্মুক্ত থিয়েটার ধ্বংস করার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। আফ্রিকান থিয়েটারের যথার্থ ভাষার জন্যে কামিরিথুর এই সন্ধানপ্রক্রিয়া কেনিয়ার ভবিষ্যত সম্পর্কে বোধগম্য লক্ষ্য স্পষ্ট করেছে। যা হলো কেনিয়ানদের জন্যে কেনিয়া, আত্মনির্ভরশীল মানুষের আত্মনির্ভরশীল কেনিয়া, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার সম্প্রদায়গত মূল্যবধস¤পন্ন একটি মূর্ত লক্ষ্য। এই লক্ষ্য ছিল নব্য-ঔপনিবেশিক কেনিয়াত্তা ও ময়ের শাসনামলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের প্রতিফলনের স্পষ্ট বিরুদ্ধতা। তাদের ঐ শাসনামলের প্রতিধ্বনি এখন শোনা যাচ্ছে নায়ায়োবাদে (ঘুধুড়রংস), যার অর্থ ‘‘আমার পদক্ষেপ অনুসরণ করো’’।

 

কামিরিথুর গল্পে একটি কৌতুহলদ্দীপক মোড় আছে। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রপতি ময় কামিরিথুতে ‘আকস্মিক সফর’-এ যান এবং সেন্টারের আশেপাশের মানুষের দারিদ্রতা দেখে অশ্রুবর্ষণ করেন। এই অবস্থায় মানুষ কিভাবে জীবন ধারণ করতে পারে? একটি ‘আবেগী’, ‘অনুশীলন না করা’ ‘ব্যক্তিগত’ উদারতার বহিঃপ্রকাহ হিসেবে তিনি সেখানে এবং তখনই একটি পলিটেকনিক ভবন নির্মাণের জন্যে অর্থদান করেনÑঠিক সেই স্থানে যেখানে আগে উন্মুক্ত থিয়েটারটি ছিল। কিন্তু সেক্ষেত্রে কামিরিথু কমিউনিটি এডুকেশন অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারের কোন উল্লেখ ছিল না। কিন্তু সাধারণ মানুষ ধোঁকায় পড়ে নি। তারা একটি পলিটেকনিক ভবন নির্মাণের জন্যে আশা করছিল। সরকারি খরচে এর নির্মাণকে তারা স্বাগত জানাতো কারণ আসলে এগুলো ছিল তাদেরই টাকা। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর লক্ষ্য ছিল অন্যরকম। ১৯৮২ সালে কামিরিথু থিয়েটার ধ্বংসের মতো স্বেচ্ছাচারী কর্মের মাধ্যমে তারা তাদের জনবিরোধী নব্য-ঔপনবেশিক চেহারা দেখিয়েছিল এবং সাধারণের থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ১৯৮২ সালে কেনিয়ানদের উপর তাদের তীব্র নির্যাতন, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিনা বিচারে আটক ও মিথ্যা অভিযোগে জেলে রাখার ঘটনাগুলোতে তাদের ভাবমূর্তি এবং জনগণের থেকে বিচ্ছিন্নতার কোন উন্নতি হয় নি। এটি আশা করেছিল মানুষ তাদের বিকল্প লক্ষ্যগুলো ভুলে যাবে, যা পুরোপুরি বোধগম্য না হলেও যুক্ত ছিল কামিরিথুর অভিজ্ঞতায়। কামিরিথুকে কোনভাবেই একটি বিপ্লবী স্মৃতিচিহ্নে পরিণত হতে দেয়া যাবে না। জনগণকে শেখাতে হবে দাসত্বের গুণাগুণ এবং তারকাদের গ্যালারির প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ।

 

কিন্তু একটি চিন্তাকে কি মেরে ফেলা যায়? মানুষের বিপ্লবী চেতনায় সংরক্ষিত আছে এমন একটি বিপ্লবী সৃতিচহ্নকে কি ধ্বংস করা যায়?

 

১৯৮২ সালের জুনে আমি ইউরোপে ছিলাম যখন খবরটা শুনি। সাহিত্য বিভাগের সভাপতি এবং ১৯৭৭ সালের এনগাহিকা এনদিনদা-র পরিচালক ড. কিমানি গিকাউ জিম্বাবুয়েতে পালিয়ে গিয়েছেন। তিনি ১৯৮১-৮২ সালে ওয়াইগোয়া ওয়াচিরার সাথে একত্রে মাইতু এনজুগিরা-রও পরিচালক ছিলেন। সাধারণ মানুষের স্বার্থে সবচেয়ে নিবেদিত ও ক্লান্তিহীন কর্মী এবং কামিরিথু কমিউনিটি এডুকেশন অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারের সমন্বয়কারী পরিচালক নগুগি ওয়া মিরিকেও পালিয়ে যেতে হয়েছে তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি ও সম্ভাব্য বন্দিত্বের কয়েক ঘণ্টা আগে। তারা গ্রামনির্ভর সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গঠনে সহায়তা করে যাচ্ছেন এবং ১৯৮৩ সালে শোনা ভাষায় প্রযোজনা করেছেন দ্য ট্রায়াল অব দেদান কিমাথি। ১৯৮২ সালের জুন ও জুলাই মাসেই, কেনিয়ায় ফেরার সময় আমি বিভিন্ন উৎস থেকে কতিপয় উদ্বেগী বার্তা পেয়েছিলাম যেগুলোতে বলা হয়েছিল নাইরোবির জোমো কেনিয়াত্তা বিমানবন্দরে অবতরণের সাথে সাথে আমাকে আটক ও বিনা বিচারে বন্দি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমার কি ফিরে যাওয়াকে বিলম্বিত করা উচিত নয়? আমি তাই করেছিলাম এবং যখন ও যেখানে সুযোগ পেয়েছি তখন ও সেখানেই কামিরিথুর গল্প বলেছি। একটি ব্যক্তিগত পর্যায়ে এটি আমার জীবন বদলে দিয়েছে।

 

হ্যাঁ, এটি আমাকে জেলে নিয়ে গিয়েছে। হ্যা, এটি আমাকে নিষিদ্ধ করেছে ইউনিভার্সিটি অব নাইরোবিতে শিক্ষাদান থেকে। আর এটি এখন আমাকে করেছে নির্বাসিত। কিন্তু একজন লেখক হিসেবে এর মাধ্যমেই আমি আফ্রিকান থিয়েটারের ভাষা বিষয়ক পুরো প্রশ্নটির মুখোমুখি হয়েছিলাম, যার মাধ্যমে তারপর আমি মুখোমুখি হয়েছিলাম আফ্রিকান কল্পকাহিনীর ভাষার।

 

সূত্র ও টীকা

১২. নগুগি ও নগুগি, আই উইল ম্যারি হোয়েন আই ওয়ান্ট, নাইরোবি ও লন্ডন, ১৯৮২, পৃ. ৩৯ — লেখক

১৩. মা, আমার জন্যে গান গাও — অনুবাদক

১৪. ডেইলি নেশন, ২২ জানুয়ারি ১৯৮২ — লেখক
১৫. দ্য স্ট্যান্ডার্ড, ২৯ জানুয়ারি ১৯৮২। দ্য ডেইলি নেশন ও দ্য স্ট্যান্ডার্ড-এর দুইটি ফিচারে আরও অনেক অংশগ্রহণকারীর মন্তব্য ও সরাসরি উদ্ধৃতি রয়েছে যা থিয়েটারের জনপ্রিয় ভিত্তি স¤পর্কে উপলব্ধি তৈরি করে — লেখক

 

পড়ুন ।। কিস্তি : ৭

ডিকলোনাইজিং দ্যা মাইন্ড ।। কিস্তি : ৭

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here