গল্পটির পটভূমি ষাট-সত্তর বছরের পুরনো — যখন বালিকারা বধূ হতো; রঙচঙে পৃথিবীর এই রঙিন আলোয় সে গল্প সাদা-কালো। পড়ুন সাদা-কালো পৃথিবীর গল্প — হয়তোবা আমাদের মায়েদেরও মায়েদের গল্প; লিখেছেন শায়লা সুলতানা।
টিংটিঙা, লিকলিকা আমি নিজের চুলটাও তখনও ঠিকমত গুছিয়ে বাঁধতে পারি না। উজবুকের মত টইটই করে ঘুরে বেড়াই। গেরস্থালি কাজে খেঁটে খেঁটে আমার মায়ের মেজাজটাও টঙ্গে উঠে থাকত প্রায়ই। বাবার সাথে তো কোনোদিন ভালো করে কথাই বলতে দেখতাম না মাকে। নাক দিয়ে সর্দি পড়া আমি যদি বা কখনো কোনো ছুঁতায় মায়ের আঁচলের গন্ধ নিতে চাইতাম, তার হাতের ঝটকায় ছিটকে পড়তাম কয়েক হাত দূরে। আর শুনতাম মায়ের খিচির মিচির, “আল্লাদ করার আর সুমায় পাও না?”
বড় বোনের শ্বশুর বাড়ির এক আত্মীয় কেন যে সেদিন এসেছিল জানি না। মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনের ছুট মাইয়াডা কনে?”
মা ফর্সা মুখটায়, প্রচ্ছন্ন একটু হাসি ফুটিয়ে আমার দিকে মাথাটা ঘুরিয়ে বলল, “উই না জুমবুলি।”
আমার বড় চার ভাই-বোনের সাথে মা এতটা খিঁটখিঁট করতো না। ছোট দুই ভাইয়ের সাথেও আমার চেয়ে একটু কম। দেখতে টিকটিকির মত ছিলাম বলেই বোধকরি মা ছোটবেলায় আমার সাথে এমন করতো। কিন্তু বড় হওয়ার পর আমাকেই সবচেয়ে বেশি আদর করে সেটা পুষিয়ে দিয়েছিল।
দেখতে যেমনই হই স্কুলে যেতাম নিয়মিত। আমাদের গ্রামে কোনো স্কুল ছিল না। পাশের গ্রাম নিমপাড়ার প্রাইমারি স্কুলে যাই। বি.এ ক্লাসে পড়া আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু ভাল ছাত্র হেলাল ভাই, কলেজ বন্ধ থাকলেই আমাদের স্কুলে ক্লাস নেয়। আমাদের বাড়িতে তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। কিন্তু তারপরও তাকে দেখলেই লজ্জা আর সংকোচে নুয়ে পড়তাম। আর আমাদের ক্লাসে যখন আসতো তখন তো ক্লাস ফাঁকি দিতে পারলেই বাঁচি এমন অবস্থা। কিন্তু তার কোনো উপায় তো ছিলই না বরং অংকে ভাল ছিলাম বলে আমার প্রতিই সে বেশি নজর দিত।
২
বৃষ্টিতে স্কুলে যাওয়ার পথটা এত কর্দমাক্ত আর পিচ্ছিল হয়েছে কিছুতেই পা ধরা যাচ্ছে না। সুফিয়া বলল, “চল্, হেলাল স্যারের বাড়ির সামনের রাস্তাটা দিয়া যাই।” আমার তো ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল। একবার মনে হল বলি যে আজ আর স্কুলে নাই গেলাম। কিন্তু কেন যেন আবার মনে হল, থাক, ওরা যদি কিছু মনে করে। অগত্যা সবাই সেই পথই ধরলাম।
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি’ পড়ছি, বুকে ফুঁ দিচ্ছি আর যতটুকু দিলে চলে তার চেয়ে একটু বেশিই থুথু ছিটিয়ে দিচ্ছি বুকের মধ্যে। মনে মনে বলছি,”আল্লা হেলাল ভাইর সাথে জানি দেখা না হয়। আল্লা দেখা জানি না হয়।” কোনো দোয়া কালামেই সেদিন কাজ হলো না। মরতো মর এক্কেবারে রাস্তার মুখেই বড়ই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে আমার যম। কোথায় একটু তাড়াতাড়ি পাশ কাটিয়ে চলে যাব, তাতো হলোই না বরং হেলাল ভাইয়ের ডাকে পা দু’টো আমার ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করল। তিনি বললেন, “দাঁড়াও বড়ই গাছে একটা ঝাঁকি দেই। তোমরা বড়ই নিয়া যাও।”
সুফিয়া, সাথী, আম্বিয়া ওরা তো সবাই খুশি। আমার অবস্থাটা যদি ওরা বুঝত তাহলে ওদের করুণা হত আমার জন্য। কেমন করে যে সেদিন নিজেকে সামলিয়ে সেই দুর্যোগ পেরিয়ে এসেছিলাম সেটা শুধু আমি আর আল্লাহই জানেন। বড় আপার মুখের কয়েকটা শব্দ কানে আসতেই বুঝলাম আমাকে নিয়েই কথা হচ্ছে। লুকিয়ে শোনার চেষ্টা করলাম।
— ছুট তাতে কী? এমুন পুলা পাওন ভাইগ্যের ব্যাপার। না না এই সুযুগ আত ছাড়া করন যাইবো না।
আমি তখন ফাইভে উঠেছি। বড় ভাই বললেন, “তোর স্কুলে যাওয়ার দরকার নাই।”
আমিতো পড়লাম মহা ফাঁপরে। আড়াল থেকে শোনা মায়ের কথা আর বড় ভাইয়ের কথার মধ্যে কী যেন একটা যোগসূত্রের আভাস পেলাম। কিন্তু ঘন কুয়াশার অস্পষ্টতা আমার মধ্যে ঘনায়মান হতে থাকলো। “বুবু, তুইতো শ্বশুর বাড়ি চইলা যাবি। তর খাতা-কলম গুলা আমারে দিয়া যাইস।” — ছোট ভাই মিরাজের কথায় এবার আমার কাছে সবকিছু স্পষ্ট হলো। আমি রাগে বেলুনের মত ফুলতে লাগলাম। কিন্তু ঐ পর্যন্তই।
এগার বছর বয়সে, বি.এ পাশ করা বাইশ বছর বয়সী স্কুল শিক্ষক হেলাল ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল।
বিয়ে, শ্বশুর বাড়ি বিষয়গুলো ভালো করে বোঝার আগেই আমার জীবনে ঘটে গেল ঘটনাটা। আর বিয়ের পরদিন থেকে বুঝতে শুরু করলাম শ্বশুর বাড়ির মানে। সকালে শাশুড়ি নিয়ে গেল চুলার পাড়ে। একটা হাতা আরেকটা ঝাকা দিয়ে বলল “ছাই তোল বউ। তুমি হইলা আমার একটা পুলার বউ। আইজ থিকা সব দায়িত্ব তুমার।” ভয়ে, দুঃখে হাত কাঁপতে শুরু করল। কিছুতেই হাতায় এক ফোঁটা ছাইও ধরে রাখতে পারছিনা। যতই সোজা করে হাতা ঢুকাই, চুলার মুখে আসতেই সব পড়ে যায়। এভাবে একবার, দুইবার, তিনবার। চেষ্টা করেই যাচ্ছি। কিছুতেই সফল হতে পারছিনা। আমার অসহায়ত্ব দেখে মায়া হলো আমার নানি শাশুড়ির।
“উঠ বউ উঠ। আমি ফালাইয়া দেই।”
আমার প্রতি নানি শাশুড়ির এহেন সহানুভূতি দেখে শাশুড়ি আম্মা ঝমঝম গলায় বলল, “আমার বউডারে তুমিই নষ্ট করবা।”
“আস্তে আস্তে সব শিকপো। তুই এত চিন্তা করিস না।”
অপরাধের বোঝা মাথায় নিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আর নানীর ছাই তোলার দিকে তাকিয়ে থাকলাম অপলক।
প্রতিদিন আমি অনেকটুকু করে বড় হতে লাগলাম। সকালে ছাই তুলে নাস্তা তৈরি করা, দুপুরের রান্নার আগে গরুর গোয়াল পরিষ্কার করা, মাটির কলসীর গলায় দড়ি লাগিয়ে কূয়া থেকে টেনে পানি তুলে গরুর গামলায় দেওয়া এসব আমার শাশুড়ি আম্মা আমাকে মাস ছয়েকের মধ্যে শিখিয়ে ফেলল। দুপুরের রান্না শেষ করে সবকিছু গুছিয়ে গোসলে যাবার জন্য কাপড়-চোপড় নিয়ে পা বাড়য়েছি । আম্মা দেখি আমার ননদকে চিল্লিয়ে বলছে, “অরে ওমনে কইরা কান্দাইতাছছ ক্যা? বাটি নিয়া আয়। তরকারি নিয়া অরে খাইবার দে।”
এমন ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটে। আমার ননদের স্বামীর বাবা-মা কেউ ছিল না তাই শ্বশুর আব্বা এতিম জামাইকে ঘরজামাই করে নিজের বাড়িতেই রেখে দিয়েছিলেন। স্বামী আর তিন সন্তান নিয়ে আলাদা ঘর আলাদা খাওয়া দাওয়া ওদের। কিন্তু রহিমা প্রায়ই আলসেমি করতো রান্না করতে। আর তার মাশুলটা দিতে হতো আমাকেই। তাই বাটি নিয়ে আসার কথা শুনে পেটের ক্ষুধাটা আরো বেড়ে গেল। সবার শেষে খাবার খেতে বসে কোনোদিনই মাছ, ডিমের টুকরা, মুরগির গিলা-কলিজাও অবশিষ্ট থাকে না আমার জন্য।
গোসল করে এসে নামাজ পড়ে খেতে যাই। নানি আমার জন্য না খেয়ে বসে আছেন। তরকারির পাতিলটা খুলে আঁতকে উঠি। আজ যে দেশি লাউ দিয়ে কৈ মাছ রান্না করার সময় জিভে পানি এসে পড়েছিল সেই কৈ মাছের তরকারির একটু ঝোলও অবশিষ্ট নেই। আম্মা বলল, “ভাজি আর ডাইল দিয়া খাইয়া উঠ।” রাগ করে না খেয়ে থাকার মত শক্তি বা সাহস কোনোটাই ছিল না। ভাতের লোকমা ঠেলে দিয়ে গলার কান্না আটকালাম। খুব ইচ্ছে হলো একবার মায়ের কাছে যেতে।
হঠাৎ করেই তার পর দিন বিকেলে বড় ভাই এসে আম্মাকে বলল, “চাচি, মালারে মায় দেখতে চাইছে। আপনে অনুমতি দিলে অরে এক সপ্তাহের জন্যে নিয়া যাই।”আসলে পরে বুঝতে পেরেছিলাম সাপ্তাহিক ছুটিতে এসে আমার স্বামীই বড় ভাইকে বলে গিয়েছে আমাকে কয়েকদিনের জন্য বাপের বাড়ি নিয়ে যেতে।
বড় ভাই কথাটা বলতেই আম্মার মতামত না শুনেই আমি শালিকের মত লাফাতে লাফাতে আমার ঘরে গিয়ে কয়েকটা কাপড় ব্যাগে ঢুকাই। আবার আম্মার ঘরে আসতেই শুনি তিনি বলছেন,”বাবা, পশুদিন বড় মাইয়ার বাড়ি থিকা দুই-তিন জন ম্যাজবান আইবো। বউ ই সুমায়ে বাপের বাড়ি গেলে কেমুন দেহা যায়? তুমি পরের হপ্তায় আইয়া অরে নিয়া যাইও বাবা।”
মুহূর্তে সবকিছু বিবর্ণ মনে হতে লাগলো আমার কাছে। এরকম অবস্থায় আমি কেমন শক্ত হয়ে যাই, সেই প্রথম দিনের ছাই তোলার সময় যেমন হয়েছিল তেমন। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে মলিন মুখে বিদায় নেওয়া বড় ভাইয়ের চলে যাওয়ার পদক্ষেপ গুলো একটা একটা করে গুনতে থাকলাম ততক্ষণ, যতক্ষণ দেখা গেল। তারপর ঘরে গিয়ে শক্ত বিছানার উপরে উপুর হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফোঁপাতে শুরু করলাম।
মেহমানের জন্য রান্না করা গরুর মাংস থেকে নানির সাথে বুদ্ধি করে এক বাটি মাংস চুপ করে আলাদা রেখে দিলাম। খুব গরুর মাংস খেতে ইচ্ছে করছিল ক’দিন থেকেই। কিন্তু আমি খুব ভালো করেই জানি মেহমানের মধ্যে এক টুকরা আলুও আমার ভাগ্যে জুটবেনা। হলোও তাই।
পরদিন সকালের রান্নার সাথেই দুপুরের জন্য খিচুড়ি রান্না করে রেখে গেলাম এক বালতি কাপড় ধুতে। ভাবলাম এসে শুধু গরুর মাংসটা গরম করে সবাইকে খেতে দিব, আমিও খাব।
এ বাড়ি থেকে আরেক বাড়ির ভেতর দিয়ে গিয়ে বেশ খানিকটা নামা জায়গা তারপর একটা ক্ষেত পাড়ি দিয়ে কচুরিপানায় ভরা একটা পুকুর। বাঁশের বাতি দিয়ে বেড়া দিয়ে বেশ অনেকখানি জায়গা কচুরিপানামুক্ত রাখা হয়েছে। আশেপাশের কয়েক বাড়ির মানুষ কাপড় ধুতে আসে কাঠের পিঁড়ি পাতা সেই পুকুরে।
আমার সাথে সেদিন রহিমা ছাড়া আর কেউ ছিল না। ওরও বেশ কিছু কাপড় ছিল। কিছুক্ষণ ধোয়ার পর রহিমা বলল, “ভাবী আমার খুব খিদা লাগছে। আমার কাপড়ডি খালি ইকটু খলাইয়া তোমার কাপড়ের সাতে নিয়া যাইও। নির্জন চকের মধ্যে দেড় বালতি কাপড়সহ আমাকে একলা রেখে বাড়িতে চলে গেল রহিমা। কাপড় কাঁচা বাদ দিয়ে কতক্ষণ হাত গুটিয়ে বসে রইলাম। কিন্তু ক্ষুধায় পেটের মধ্যে আগুন জ্বলছে। ধোয়া শেষ করে তুলতে গিয়ে দেখি বালতি নড়াতে পারি না। সব দিকে তাকিয়ে দেখলাম সাহায্য করার মত একটা কাক পক্ষীও নেই।
বিপদে আল্লাহ্ মানুষকে শক্তি দেন। সেইরকম একটা শক্তি পেয়ে বাড়িতে যেতে যেতে গরুর মাংসর কথা মনে হতেই আমার গতি দ্রুত হয়ে গেল। বাড়ি পৌঁছাতে নানি কাপড় শুকিয়ে দিতে সাহায্য করলেন।
গোসল সেরে ঘরে গিয়ে মাংসর বাটিটা বের করতে গিয়ে বুকের মধ্যে চিড়িক দিয়ে উঠল। বাটিটা সেখানে নেই। বসে পড়লাম পাতিলের কাছে সুদা খিচুড়ি খাওয়ার জন্য। পাতিলটা ধরতেই ঠনঠনে খালি পাতিল কাত হয়ে পড়ে গেল আমার পায়ের কাছে। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। আম্মা খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, “আমরা খাইয়া তুমার জন্যে রাখছিলাম। তুমার ভাইগ্নারা আইয়া খাইয়া ফালাইল। একমুঠ চাইল আর ডাইল ধুইয়া মসলাপাতি দিয়া মাখাইয়া চুলায় বহাইয়া দ্যাওগা।”
তার কথাগুলো আমার কাছে খুব অস্পষ্ট মনে হচ্ছিল। অন্ধকার হয়ে আসছিল সমস্ত পৃথিবী। আমার মাথার সাথে সাথে আমিও দুলছি এমন সময় কে যেন দেবদূতের মত এসে আমার হাতটা খপ করে ধরে ফেলল। আমাকে টান দিয়ে নিতে নিতে বলল, “আমার সাতে আহ বউ।” কয়েক পা ফেলার পরে বুঝি, উনি পাশের বাড়ির আমার চাচি শাশুড়ি। আমাকে তাঁর ঘরে নিয়ে পাটি বিছিয়ে বসতে দেন। তারপর পোড়া বেগুনের ভর্তা, ডিম দিয়ে ভাজা নিজের গাছের চিচিঙ্গা আর কচি দেশি লাউ দিয়ে বড় বড় টুকরার বোয়াল মাছের তরকারি দিয়ে গরম ভাত বেড়ে দেন। বাটিতে হাত ধুইয়ে আমার হাতটা ভাতে বসিয়ে দেন।
আমি ভাত মুখে দিতে পারি না। তাঁর বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফোঁপাতে থাকি। কান্না থেকে নিবৃত্ত করে তিনি আমাকে খাওয়ায় প্রবৃত্ত করেন। মাথায়-পিঠে হাত বুলাতে থাকেন। নাকের পানি- চোখের পানি এক করে এক অপার্থিব তৃপ্তি নিয়ে গরুর মাংসের কথা ভুলে গিয়ে খাওয়া শেষ করি তারপর হীরা চাচির দিকে তাকিয়ে তার মুখের মধ্যে মায়ের মুখটা দেখতে থাকি।
৩
“মা, জামাল ভাই আসলে মালাকে তার সাথে পাঠাইয়া দিও। অনেক দিন ধইরা আসছে। কয়দিন বাপের বাড়ি থাইকা আসুক।” আমার স্বামী সাপ্তাহিক ছুটি কাটিয়ে যাওয়ার দিন সকালে খেতে বসে আম্মাকে বলল এ কথা। আমি শংকিত হলাম, উনি চলে যাবার পর আমার উপর আবার কোন ঝালটা যে ঝাড়া হবে সেই ভেবে। আমি যে ঘরে থাকি সেই ঘরের জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে তার চলে যাওয়া দেখছিলাম। দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাবার পরও নিষ্পলক তাকিয়ে আছি সেদিকেই।
আম্মা তার স্বভাব সুলভ চিৎকারে ততক্ষণে বাড়ি মাথায় তুলেছে। “তলে তলে এই কাম? এমনে কইরা আমার পুলাডার মাতা খাইছ তুমি? দশটা না পাঁচটা না একটা পুলা আমার।” পুরো কথাটা স্পষ্টই কানে ঢুকে আমার।
যে পথ দিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যেতাম, যে পথের প্রতিটি ধূলিকণা, প্রতিটি গাছ লতাপাতার সাথে ছিল নিত্য আলাপন, এতদিন পরে বড় ভাইয়ের সাথে যেতে যেতে সেই চিরচেনা পথটার ধূলামাটিত এক অভিনব মায়ায় পা ফেলে ফেলে বাড়িতে এলাম। এই প্রথম মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। মাও আমাকে বুকের মধ্যে লেপ্টে ধরে থাকল অনেকক্ষণ।
বড় ভাইকে সেদিন ওভাবে ফিরিয়ে দেওয়াতে মা যেমন কষ্ট পেয়েছিল তেমনি নিজের জীবন দিয়েই বোধকরি আঁচ করতে পেরেছিল আমার সংসার জীবনের সাতকাহন। “তুই হেলালের কাছে কইতে পারস না?” আমার প্রতি মায়ের শক্ত অভিযোগ এভাবে ব্যক্ত করলে আমি বলি,”মা,একদিনের জন্য উনি বাড়িতে আসে । এইসব কথা উনারে কেমনে কই কও? তবে তিনি যে কিছু কিছু বুঝতে পারেন এইটা আমি বুঝি।”
“জামাল ভাই, নবাবপুরের নরদানা ইউনিয়নে বড় নামকরা যে স্কুলটা। ঐ স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের একজন আমারে হেড মাস্টার পদের জন্যে দরখাস্ত দেয়ার কথা খুব বলতেছে। ওইখানে যদি চাকরিটা হয় তাইলে চিন্তা করতাছি মালারে নিয়া যাব। তা তুমি কী বল? দরখাস্তটা কী করব?”
“হেলাল তুমি বুদ্ধিমান ছেলে। তোমার উপরে আমার ভরসা আছে। তোমার যা ভালো মনে হয় কর। তাতে ভালো হইব বইলাই আমি মনে করি। মালার দিকে খালি একটু খেয়াল রাইখো।”
“জামাল ভাই এইরকম একটা সুযোগের জন্যে অপেক্ষা করতেছিলাম। চাকরিটা হইয়া গেলে দেইখেন আর কোনো সমস্যা থাকব না।”
এ সপ্তাহের ছুটিতে আমার স্বামী মায়ের সাথে দেখা করে আমাদের বাড়িতেই এসেছে। জ্যোৎস্নার আলোতে ফকফক করছিল আমাদের উঠানটা। ঘরের চালের উপরে গাছের থোকা থোকা পাতার ভেতর দিয়ে দিয়ে জোনাকিরা পিটপিট করে যেন আমাকেই দেখছে। উঠানে কয়েকটা কাঠের চেয়ার নিয়ে গোল করে বসে বড়দের মধ্যে গল্প হচ্ছে এইসব জীবন জীবিকার।
সেই গল্প আমার শোনার প্রয়োজন আছে কিনা আমি বুঝি না। সেখানে আমার উপস্থিতির প্রয়োজন আছে কিনা তাও বুঝি না, তবুও বসে আছি জ্যোৎস্নায় স্নাত হতে নাকি জোনাকির পিটপিট চোখের তারায় আটকে থাকতে সবই আমার বোধের বাইরে।
হঠাৎ গলার ভেতর থেকে ভক করে উটকি আসে। তাড়াতাড়ি উঠে কূয়ার পাড়ের দিকে যাই। বমি করার আওয়াজ পেয়ে মা তড়িঘড়ি করে ছুটে আসে। আমার গলার ভেতর জ্বলে যাচ্ছিল আর মায়ের খুশি মুখ দেখে পিত্তিটাও জ্বলা শুরু হলো। বমি করা শেষ করে কুলি করে, মুখ ধুয়ে বিরক্তি নিয়ে বললাম, “মা আমার কষ্টে তুমি এত খুশি হইতাছ ক্যান্?”
“ওরে পাগলী এই কষ্ট যে খুশি হওয়ার কষ্ট। তুই মা হইবি ।”
স্বামীর নতুন চাকরির সুবাদে নতুন জায়গায় পেটে সন্তানের সুরসুরি দেওয়া এক নতুন অনুভূতি নিয়ে নিজের সংসার শুরু করলাম। সহযোগী হিসেবে পাশের বাড়ির হতদরিদ্র কদ্দুস মিয়ার পাঁচ নাম্বার মেয়ে ছোমিরনকে মা আমার সাথে দিয়ে দিয়েছিল। কাছে পেয়ে আমার স্বামীকে আমি চিনতে শুরু করি। বড়ই পেড়ে দেবার দিনের কথা মনে করে আমার নব যৌবনে প্রেমের শিহরণ লাগে।
সকালে স্কুলে যাবার আগে টুকটাক সাহায্য করার ছুতায় আমার পাশে পাশে থাকা, এখানে একটা গাছ লাগানো, ওখানে গাছ ছেটে দেয়া, এক চিলতে খালি জায়গায় মাটি ফুঁড়ে ওঠা লাউ, শশা, চিচিঙ্গা লতার পরিচর্যা করা তারপর গোসল করে খেয়ে দেয়ে আমাকে আদর করে দিয়ে তার স্কুলে যাওয়া। বাইরে কোনো আড্ডা নেই, খারাপ কোনো অভ্যাস নেই। ফিরে এসে পুরো সময়টা আমার জন্যই বরাদ্দ।
৪
“বউ এমনে কইরা মাইনষেরে দিলে গুলা খালি আইয়া যাইব।”
আমি তখন পাঁচ সন্তানের মা। প্রথমে নানি শাশুড়ি তারপর শ্বশুর আব্বা মারা যাওয়ার পর আম্মাকে আমার কাছেই নিয়ে আসি। পাশের বাড়ির ময়নালের বউ এলেই টুকটাক কাজ করে দেয়। কাজ না করে দিলেও খাবার দাবার যা থাকে তা থেকে ওকে একটু বেশি পরিমাণেই দেবার চেষ্টা করি। আম্মা আসার পর প্রথম প্রথম এরকম বললে আমি বলতাম, “আম্মা মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় কষ্ট খিদার কষ্ট। প্যাট ভরা থাকলে কাজের কষ্টরেও কষ্ট মনে হয় না। আপনের ছেলে কয়, গরিব মানুষরে দিলে সংসারে বরকত হয়।”
স্বামী-সন্তান-সংসার সব সামলিয়ে শিক্ষক স্বামীর তাগিদে আমাকে পর্যায়ক্রমে সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত সব ক্লাসের বই পড়তে হয়েছে। ম্যাট্রিক পরীক্ষার প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম কিন্তু দেওয়া হলো না মুক্তিযুদ্ধের জন্য।
দত্তা, পরিণীতা, গৃহদাহ, শ্রীকান্ত, বিষবৃক্ষ, কপালকুণ্ডলা যখন যে বইটা কিনে নিয়ে আসে প্রতিটা বইয়ের প্রথম পাতায় লেখা থাকে,
“প্রীতি উপহার
প্রিয় মালাকে
হেলাল”
আর আমারও কোনোটাই অপাঠ্য থাকে না। বিকেলের অবসরে, রাত জেগে জেগে ডুবে থাকি বইগুলোর পাতায় পাতায়।
৫
“মাগো, কয়দিন দইরা ইলশা মাছের সালুন দিয়া ভাত খাইবার কী মুনে কইতাছে।”
“সোমবারের হাটে থিকা তো ইলিশ মাছ আনতে চাইছে। খালা, আপনে মঙ্গলবার দিন এক ঘুরানি আইসেন।”
একজন বৃদ্ধ ভিখারিনী প্রতি শনিবারে আমার কাছে আসে। আমার হাড়িতে যা রান্না হয় তা থেকেই তার জন্য বরাদ্দ থাকে। আজ করলা ভাজি, ডাঁটা দিয়ে পুঁটি মাছের ঝোল আর ডাল দিয়ে তৃপ্তি নিয়ে ভাত খেয়ে হাত ধোয়ার পর কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে এ কথা বলছিল। আম্মা আমার কথা শুনে বলল, “বউ তুমার যত আজিরা আল্লাদ। গরিব মানুষরে দিয়া তুমি কুনোদিন খুশি করা পারবা না। একটা দিলে অরা আরেকটা চায়।”
আমি বৃদ্ধার সামনে একটু বিব্রত হলেও বললাম, “আম্মা, মানুষ হইয়া যদি মানুষের কষ্ট আমরা না বুঝি তাইলে ক্যারা বুঝব কন?” আম্মার কথার উত্তরে আমি কিছু বললে দেখি সে এখন চুপ হয়ে যায়। আস্তে আস্তে তার মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করি।
আম্মা আর আমি একসাথেই খেতে বসেছি। মুখটা কাঁচুমাচু দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “আম্মা কী হইছে? ভাত খাইতাছেন না ক্যান?”
“বউ, আমার মুকে কিছুই মজা লাগে না। ভাত মুকে দিবারই মনে কয় না।”
তার গলার স্বরে একটা ভাঙনের আভাস পাই। আমি বিচলিত হয়ে বলি,”আম্মা, আপনের কী কিছু খাইতে ইচ্ছা করে? কন আমি কইরা দিমু।”
“বউ, কয়দিন দইরা মনে অইতাছে গরুর মাংস অইলে চাইরডা ভাত খাইয়া পারুম।”
“আমারে তো কন নাই। আইচ্ছা হাট ছাড়া তো গরুর মাংস পাওয়া যাইব না। সোমবার দিন ইলিশের সাথে গরুর মাংসও আনাইয়া আপনেরে রান্না কইরা দিব। এখন কী একটা ডিম ভাইজা দিব?”
“না মা, না ।”
“তাইলে দুইটা বেগুন পুইড়া ভর্তা কইরা দেই?”
তার আপত্তি উপেক্ষা করে তাই করে দিলাম। ভর্তা দিয়ে বেশ খানিকটা ভাত খেতে পারল দেখে আমি স্বস্তি পেলাম।
সোমবারের হাটে ইলিশ মাছ পাওয়া গেলেও সেদিন হাটে কোনো গরু জবাই হয়নি। আমার ভেতরে খচখচ করছে আর ভাবছি কী করে আম্মাকে গরুর মাংস খাওয়াব। পরের সোমবার আসার আগেই আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। প্রতিদিন আমার স্বামী আম্মার জন্য দুইটা সন্দেশ নিয়ে এসে কাছে বসে খাওয়ায়। কিন্তু আজ না খেয়ে ছেলের হাতে সন্দেশ গুঁজে দিয়ে বলল,”তুমি খাও বাবা।” “আইচ্ছা শুনেন, আম্মার শরীরটা মনে হইতাছে অনেক খারাপ। আপনে সোমেজ দোফতরিরে দিয়া শহর থিকা দেড় কেজি গরুর মাংস আনাইয়া দেন।”
কিন্তু স্কুলে ইন্সপেকশনের ঝামেলায় সোমেজকে শহরে পাঠাতে পারছিলনা। এর মধ্যে আবার হাটবার চলে এল কিন্তু এ সপ্তাহেও হাটে গরু জবাই হয়নি। সোমেজকে যেদিন মাংস আনতে পাঠানো হয় সেদিন ও ফিরে আসার আগেই আম্মার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। থানা সদরের ডাক্তার ডাকা হয়। তিনি সবকিছু দেখে বলেন, উনার গলায় বেশ সমস্যা। কোনো শক্ত খাবার দেয়া যাবে না। লিকুইড খাওয়াতে হবে।
প্রথম দুই মাস চামচ দিয়ে শুধু লিকুইড খাবার খাওয়াতাম তারপর আটাশ দিন নাকে নল লাগানো ছিল। এই তিন মাস আমি রান্নাঘরে খুব কম গিয়েছি। নতুন সহযোগী সালেহাই তখন যা রান্না করে সবাইকে তাই খেতে হয়। ময়নালের বউ সবসময় খোঁজ খবর নেয়। আমি আম্মার কাছ থেকে প্রয়োজন ছাড়া একটুও উঠি না।
হীরা চাচি আম্মাকে একদিন দেখতে এলে আমি সেদিন তাকে জোর করে রেখে দিই। তিনি খুব অবাক হয়ে বলেন, “বউ, বুজি তুমারে কত কষ্ট দিছে, আর তুমি তার জন্যে জান দিয়া করতাছ। আল্লায় তুমার ভালো করব মা, ভালো করব।” আমি বললাম, “চাচি, মানুষের জীবনটা বেশি বড় না কিন্তু জীবনের সময় গুলা যেন ভাগ ভাগ করা। আর সেই একেকটা ভাগ একেক রকম কাটে মানুষের। কোনো ভাগে থাকে সুখ -শান্তি, কোনো ভাগে থাকে দুঃখ -কষ্ট , জ্বালা-যন্ত্রণা। এই নিয়াই জীবন। তবে কেউ কেউ নিজের সুখের সময় এই কথা ভুইলা যাইয়া অন্যেরে কষ্ট দেয়। তাই বইলা কী সবার একরকম হওয়া যাইব?”
পরদিন ময়নালের বউকে সাথে নিয়ে আম্মাকে ঘরের সামনে পাটিতে শুইয়ে রেখে পরিষ্কার করে গোসল করাই। বড় ছেলেকে নিয়ে ধরাধরি করে বিছানায় উঠিয়ে মাথাটা ভাল করে মুছিয়ে দিচ্ছি। আম্মা তার ডান হাতটা কষ্ট করে উঠিয়ে আমার কাঁধের উপরে রাখে। আমার মুখটা তার কাছে নিয়ে কপালে আলতো করে একটা চুমু দেয় তারপর অস্ফুট স্বরে বলে, “বউ, আমারে মাফ কইরা দিও ।”
বলতে বলতেই তার হাতটা আমার কাঁধ থেকে ধপ করে পড়ে যায়। ব্যস্ত হয়ে আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি চোখ দু’টো বড় বড় করে উপরের দিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কী যেন দেখছে। আমার গলা থেকে চিৎকার বেরিয়ে আসে – “আম্মা জানি কেমন করতাছে।” আমার চিৎকার শুনে সবাই ছুটে আসে। ততক্ষণে আম্মার গলা থেকে একটা হিচকা উঠে তারপর তার খোলা চোখ দু’টো স্থির হয়ে যায়। আমার ডান হাত দিয়ে তার চোখের পাতা দু’টো আস্তে করে নামিয়ে দেই।
এগার বছরের টিংটিঙা, লিকলিকা আমি এখন পঁচাত্তরের বেদীতে পা রেখেছি। চারদিকে তাকিয়ে আমার আর আমার স্বামীর মত সুখী ও সফল মানুষ আমার চোখে পড়ে না। পাঁচ সন্তানকে শুধু উচ্চশিক্ষিত না মানুষও করতে পেরেছি। কেউ কেউ আমাকে বলে ‘স্বর্ণগর্ভা’। ছেলে-ছেলের বউ, মেয়ে-মেয়ের জামাই সবাই আমাদের মাথায় তুলে রাখে।
প্রতিক্ষণে আমরা দু’জনেই পরিপূর্ণতা ও পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলি। কিন্তু ত্রিশ বছর ধরে, প্রায় সেদ্ধ হয়ে আসা ধানের ডেকচিতে শাঁ-শাঁ শব্দ ছড়ানো ভাপের শিসের মত বুকের মধ্যে শিস দিয়ে যাচ্ছে একটা আক্ষেপ – “আমি আম্মার গরুর মাংস খাওয়ার ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারিনি।”