বাল্যবিবাহ বিশ্বব্যাপী একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা। বাংলাদেশে ৫৯% কন্যাশিশুর বিয়ে হয় ১৮ তম জন্মদিনের পূর্বে এবং ২২% কন্যাশিশুর বিয়ে হয় ১৫ তম জন্মদিনের পূর্বে। শতকরা হারের দিক থেকে বিশ্বে চতুর্থ সর্বোচ্চ শিশুবিবাহের স্থানটি রয়েছে বাংলাদেশের দখলে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দেখা যায় যে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের মূলে রয়েছে দরিদ্র্যতা, সামাজিক সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, কর্মসংস্থানের অভাব ইত্যাদি।
অল্পবয়সে বিয়ে মেয়েদের ওপর মারাত্মক স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। স্বাস্থ্যবিদদের মতে, অল্প বয়সে বা পূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিকাশের আগে মেয়েদের বিয়ে হলে অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবের ফলে মেয়েরা নেতিবাচক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে। গর্ভ ও প্রসবকালীন জটিলতা থেকে শুরু করে ঘনঘন সন্তান প্রসব, অপুষ্টি ও শিশুর কম জন্ম ওজনসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকির সাথে সাথে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাল্যবিবাহের শিকার কিশোরী মেয়েরা যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। অল্পবয়সে বিয়ে দেয়া এবং যৌন সম্পর্কে যেতে বাধ্য করা যে এক ধরনের যৌন নির্যাতন বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণের সে সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। অন্যদিকে বাল্যবিবাহের নানাবিধ নেতিবাচক পারিবারিক ও সামাজিক প্রভাব রয়েছে; যেমন : মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ কমে যাওয়া, পড়ালেখার মান কমে যাওয়া, অর্থনৈতিক খাতে সংযুক্তি কমে যাওয়া এবং পারিবারিক সহিংসতার শিকার হওয়া প্রভৃতি।
গত দুইদশকে বাংলাদেশে আইন করে বিয়ের বয়স (মেয়েদের জন্য ১৮ ও ছেলেদের জন্য ২১) নির্ধারণ করা এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি কার্যক্রম গ্রহণ করার ফলে বাল্যবিবাহের হার কিছুটা কমে এসেছিলো। কিন্তু বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির সময়ে বাল্যবিবাহের হার আশংকাজনক হারে বেড়ে গেছে। ইউএনএফপিএ’র (যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থা) ২০২০–এর জনসংখ্যা সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনে (স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিপোর্ট) সম্প্রতি বলা হয় যে, কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাবে বিশ্বব্যাপী ১৩ কোটি অতিরিক্ত বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটবে এবং বাংলাদেশ এক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে।
ইউএনএফপিএ আরও বলেছে যে, প্রতি বছর লাখ লাখ মেয়েশিশু তাদের পরিবার, এবং সমাজের সম্পূর্ণ জ্ঞাতসারে এবং সম্মতিতে এমন কিছু ক্ষতিকর চর্চা/রীতি/অনুশীলনের শিকার হয় যা তাদেরকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং সেগুলো পরিষ্কার মানবাধিকার লঙ্ঘন। সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রচলিত দু’টি ক্ষতিকর চর্চা হলো : শিশুবিবাহ এবং পুত্রসন্তানের জন্য কন্যাসন্তানের প্রতি বৈষম্য। প্রতিবেদনে প্রথম ক্ষতিকর চর্চা শিশুবিবাহের উল্লেখ করে বলা হয় যে, এশিয়া অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশেই সর্বাধিক শিশুবিবাহ সংঘটিত হয় এবং অপর যে ক্ষতিকর চর্চাটি রয়েছে অর্থাৎ লিঙ্গীয় বৈষম্য সেটিও শিশুবিবাহকে উৎসাহিত করে। কেননা প্রথাগত চিন্তায় কন্যাসন্তান পিতামাতার ওপর এক ধরনের বোঝা যাদের পরিবার ও সমাজে পুত্র সন্তানদের মতো অবদান রাখার সামর্থ্য নেই।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হলেও কোভিড-১৯’র এই বিশেষ প্রেক্ষাপটে এই খাতে অব্যাহত বিনিয়োগ এবং অধিক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে ইউএনএফপিএ আরও উল্লেখ করে। কেননা যেকোনো দুর্যোগ এবং সংকটের সময়ে শিশুবিবাহের মত ক্ষতিকর চর্চা/রীতি/অনুশীলনের ঘটনা বৃদ্ধি পায়। তখন পরিবার ও সমাজ এক ধরনের চাপের মধ্যে থাকে, নিরাপত্তার অভাব পরিলক্ষিত হয় এবং নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পায়। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি নাজুক অবস্থানে থাকে কিশোরী মেয়েরা।
সেইভ দ্য চিলড্রেন-এর তথ্য মতে, করোনা মহামারির কারণে যে ২৮টি দেশে শিশুরা স্কুল থেকে ঝরে পড়ার উচ্চ বা মাঝারি ঝুঁকিতে রয়েছে, বাংলাদেশ সেগুলোর মধ্যে একটি। বিশেষজ্ঞরা এও বলছেন, শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার পাশাপাশি বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতেও রয়েছে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে আমরা বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনে দেখতে পেয়েছি যে করোনা পরিস্থিতিতে স্কুল কলেজ বন্ধ থাকা, পিতামাতার আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়া, নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণ বেড়ে যাওয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার অভাব প্রভৃতি কারণে অনেক অভিভাবকই কন্যাশিশুদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন আর তাছাড়া বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের যে সামাজিক অনুশীলন জারি আছে সেখানে করোনা মহামারি বাল্যবিবাহের জন্য একপ্রকার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে বলা যায়।
অল্পবয়সে বিয়ের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ সংযোগ রয়েছে যৌন নিপীড়ন, সহিংসতা, সম্মতিযুক্ত যৌনক্রিয়া (consensual sex), অপরিকল্পিত গর্ভধারণ, যৌন ও প্রজনন অধিকার এবং প্রয়োজনীয় যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ার মতো বিষয়গুলো। কেননা নববিবাহিত, গর্ভবতী অথবা সদ্যপ্রসূত কিশোরী মায়েদের মধ্যে যাদের পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির চাহিদা রয়েছে, গর্ভকালীন, প্রসবপূর্ব ও প্রসব পরবর্তীকালে স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন রয়েছে তাদের সেই চাহিদাগুলো কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে — যা অনেকটাই উদ্বেগজনক।
মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ইউনিসেফ-এর এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি ঘোষণার পর থেকে পরবর্তী নয় মাসের মধ্যে বাংলাদেশে অন্তত ২৪ লাখ শিশু জন্মগ্রহণ করবে। সংখ্যাটি আবার পড়ুন — ২৪ লাখ। শিশুর এই অস্বাভাবিক জন্মহার শুধু করোনা পরিস্থিতিতেই ঘটছে বা বাংলাদেশেই ঘটছে তা নয়। যেকোনো জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতিতেই এটি ঘটতে পারে। ইবোলা মহামারির সময় দেখা গেছে যে সিয়েরালিওনের কিশোরী মায়েরা ১৮,০০০ অতিরিক্ত শিশুর জন্ম দিয়েছে মহামারিটির প্রথম ধাপেই।
করোনা মহামারীর ফলে বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রে ২৪ লাখ শিশুর জন্ম শুধু ব্যক্তি ও পরিবারের ওপরই না দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপরও মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করবে এবং নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা খাতের ওপর অত্যন্ত সুদূর প্রসারী প্রভাব বিস্তার করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলোতে অবিলম্বে কিশোরী মেয়েদেরকে ফোকাস করে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা করার উপায় নির্ধারণে উদ্যোগী হতে হবে। সেজন্য প্রথমেই প্রয়োজন কিশোরী মেয়েরা জরুরি পরিস্থিতিতে যেসমস্ত বাধার সম্মুখীন হয় সেই ক্ষেত্রগুলোকে চিহ্নিত করা এবং পর্যায়ক্রমে সেই বাধাগুলো উত্তরণের উপায় নির্ধারণের মাধ্যমে ভবিষ্যতের মহামারি মোকাবিলার প্রস্তুতি গ্রহণ করা।