জগদীশ চন্দ্র বসু : “ভারতীয়” বিজ্ঞান ও প্রজ্ঞার এক রূপ

সূত্র : বিবিসি

“…for the first time I understood the message proclaimed by my ancestors on the banks of the Ganges thirty centuries ago—“They who behold the One ,in all the changing manifoldness of the universe, unto them belongs eternal truth, unto none else, unto none else”. (Royal Institution Friday Discourse,1901)

বিজ্ঞানের দেশকাল ও জগদীশ প্রসঙ্গ  

‘ভারতীয়’ বা ‘পশ্চিমী’ বিজ্ঞান বলে কিছু আছে কিনা বা বিজ্ঞানকে সুনির্দিষ্ট ভূগোলের আওতাধীন করে  আলাদা আলোচনা করা যায় কিনা — এ প্রশ্নটা বিজ্ঞানের দার্শনিক মহলে প্রবলভাবেই জারি আছে এখনো। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও বিজ্ঞানকে ভূগোল, সমাজ বা সংস্কৃতির প্রশ্ন থেকে আলাদা করে বিবেচনা করাই পাশ্চাত্যের কয়েক শতাব্দীর রীতি। বিজ্ঞান সার্বজনীন আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিও সুনির্দিষ্ট; পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর প্রত্যক্ষ প্রমাণ নির্ভরতাই বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য। ‘পাশ্চাত্যে’র বিজ্ঞান-ঐতিহ্যে ‘ধর্ম,সামাজিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি’র ভূমিকা ‘বিশুদ্ধ’ বিজ্ঞান চিন্তা বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রত্যাখ্যাত বা অস্বীকৃত। সপ্তদশ শতাব্দীতেই পশ্চিমা জগতে বিজ্ঞানের সংজ্ঞার্থ নির্ধারিত হয়ে গেছে। এ সময়ে দর্শন থেকে আলাদা হয়ে পশ্চিমা বিজ্ঞান পরিণত হয় চর্চার স্বতন্ত্র ক্ষেত্রে। বিজ্ঞান বলতে পরীক্ষা বা প্রমাণযোগ্য ব্যাখ্যার আকারে বস্তুজগতকে জানার পদ্ধতিগত প্রচেষ্টাকে (systematic enterprise) বোঝানো শুরু হয়। বিজ্ঞান শুধু জ্ঞান নয়, এটি ‘জানা’র একটি বিশেষ পদ্ধতিও (a way of pursuing knowledge) বটে।

 

পশ্চিমা বিশ্বে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের ভিত্তিতে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানীরা প্রকৃতির নিয়মকে জ্ঞান আকারে সূত্রাবদ্ধ করার প্রচেষ্টা নিলেন, যেমন নিউটনের গতিসূত্র। ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে বিজ্ঞান শব্দটি ‘বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি’ (scientific method) অর্থেই ব্যবহৃত হওয়া শুরু করল। এম্পেরিকাল ও এক্সপেরিমেন্টাল সাইন্সকেই পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানের ধারক ও বাহকরা বিশ্ব জুড়ে ফেরি করলেন ‘সার্বজনীন’ হিসেবে। পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক ও জ্ঞানীয় আধিপত্যের হাত ধরে ‘পাশ্চাত্য জ্ঞান ও পদ্ধতি’ই ‘আধুনিক’ ও ‘আদর্শ’ হিসেবে প্রচারিত হলো বিশ্বজুড়ে, প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিও পেলো।

 

এ প্রবন্ধে আমরা যা কিছু পাশ্চাত্যের তার-ই বিরোধিতার প্রকল্পের অংশ হিসেবে ‘পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও পদ্ধতি’কে সমালোচনা করছিনা, বরং পাশ্চাত্য পদ্ধতিকে আদর্শায়িত করা, সার্বজনীন ও একমাত্র ‘নিখাদ’ বলার প্রবণতাকে প্রশ্ন করছি, বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানচিন্তার মধ্যে মূল্যবোধ, অন্তর্জ্ঞান ও অন্যান্য সংস্কৃতি ও বিশ্বাস ব্যবস্থার নিবিড় ভূমিকাকে অস্বীকার করার পাশ্চাত্য  প্রবণতাকে প্রশ্ন করছি, ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর (৩০ নভেম্বর ১৮৫৮ — ২৩ নভেম্বর ১৯৩৭) ভাব, ভাষা ও পদ্ধতির আলোচনা প্রসঙ্গে। জগদীশ চন্দ্রের গুরুত্বের একটি দিক এই যে, মানব সংস্কৃতির দুটি ভিন্ন উৎস থেকে উৎসারিত ভিন্ন দুটি চিন্তা ধারার মিথস্ক্রিয়ার  সম্ভাবনা  তৈরি হয়েছিল তার মধ্যে। বিজ্ঞান নিয়ে ভাবনার উত্তর-উপনিবেশিক নিদর্শনও জগদীশের মধ্যে আমরা লক্ষ্য করি সহজেই।

 

প্রাচ্য ও প্রতীচীর জ্ঞানগত ঐতিহ্যের ভেতরে জগদীশের ভাবনা, অনুভূতি ও পদ্ধতির বিশিষ্টতা বুঝে নেয়ার অভিপ্রায়ে প্রাচ্য, যার একটি অংশ ভারতবর্ষ ও পাশ্চাত্যের চিন্তাপদ্ধতির কিছু পার্থক্য, সরলীকরণের ভয় সত্ত্বেও, টুকে রাখছি :

ক. প্রাচীন কালে পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে সুসংবদ্ধ করেছিলেন এরিস্টটল এবং তা প্রায় দুই হাজার বছর ধরে পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি হয়ে থাকলো। রনে দেকার্তের নাম অনুসারে কার্তেজিয়ান ডুয়ালিজম বা কার্তেজীয় বিভাজন নামে যা পরিচিত তা-ই পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান-ভাবনার দার্শনিক ভিত্তি। মনকে বিচ্ছিন্ন করা হল শরীর থেকে, বস্তুকে ভাব থেকে,মনোজগতকে বস্তুজগত থেকে, বিষয়কে বিষয়ী থেকে; প্রতিটি মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়লো অনেকাংশে। কার্তেজীয় বিভাজন বিজ্ঞানীদের সুযোগ করে দিলো বস্তুকে মৃত, জড় ও পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবার। জগতকে বিভিন্ন বস্তুর পুঞ্জীভূত রূপ হিশেবে গ্রহণ করার যান্ত্রিক বিশ্ববীক্ষা ধারণ করতেন নিউটন। অপরদিকে, জগতকে দেখবার প্রাচ্যীয় বা ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি ‘অর্গানিক’। প্রাচ্যের প্রজ্ঞার ধারা বা আধ্যাতিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকলেও সবাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একত্বের অনুভবে একাট্টা। অদ্বৈতবাদী বা (monistic) দৃষ্টিভঙ্গি প্রাচ্যের চিন্তা ও দর্শনের অন্যতম ভিত্তি।

 

খ. পাশ্চাত্যে যাদের বিজ্ঞানী বা দার্শনিক বলা হয়, প্রাচ্যের ভোকাবুলারিতে তারাই সাধক, ঋষি বা গুরু। পাশ্চাত্যে যেটি বিজ্ঞান, প্রাচ্যে সেটির নাম দেয়া যেতে পারে প্রজ্ঞা। ‘Western Science, Eastern Wisdom’ । পাশ্চাত্যে যেটি ‘চর্চা’ বা ‘গবেষণা’, প্রাচ্যে সেটি আসলে ‘সাধনা’। ‘ল্যাবরেটরি’ শব্দের ব্যঞ্জনাকে বহুদূর বিস্তৃত করে ‘বিজ্ঞানমন্দির’ শব্দবন্ধটি (জগদীশ বসু ব্যবহৃত) ।

 

গ. পাশ্চাত্যের আধুনিক বিজ্ঞান পরীক্ষণনির্ভর যার জন্য প্রায়শই প্রয়োজন হয় উচ্চমানের প্রযুক্তি ও দলীয় প্রক্রিয়া। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণগুলো যেকোনো সময় যেকোনো ব্যক্তি দ্বারা পুনরাবৃত্তিযোগ্য। অপরদিকে, ঋষি, সাধক বা মরমিরা জ্ঞান অর্জন করেন অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে, কোন যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই, ধ্যানের নির্জনতার মাঝে। ‘অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তিযগ্যতা’ প্রাচ্যীয় সাধনার জন্যও অপরিহার্য। মরমি সাধকদের আগ্রহ মূলত বাস্তবের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আস্বাদনের ব্যাপারে, ওই অভিজ্ঞতা বর্ণনার ব্যাপারে নয়। আর পদার্থবিজ্ঞানের আগ্রহ  প্রাকৃতিক ঘটনার পর্যবেক্ষণ ও সুস্পষ্ট ভাষায় বা গাণিতিক সমীকরণে তা বোধগম্য করে প্রকাশে।

 

ঘ. প্রাচ্যের অভিজ্ঞতার সাথে প্রাচীন গ্রীসীয় অভিজ্ঞতা-ভাবনার মিল লক্ষ্যণীয়। পরীক্ষণনির্ভর আরোহী (ইন্ডাকশান) পদ্ধতি প্রাচীন গ্রিক মানসিকতায় প্রায় অপরিচিত ছিল। অন্তর্দৃষ্টির আলোয় মানুষের অভিজ্ঞাতায় জেগে উঠা কিছু স্বতঃসিদ্ধ নীতিই অবরোহী পদ্ধতিতে উপলব্ধি বা যুক্তির যোগান দিত প্রাচ্যে। প্রাচীন ভারতের মিস্টিক ঐতিহ্যে ‘সত্য’ লাভ হয় বুদ্ধির জগতের বাইরে এসে নিজেরই অভ্যন্তরে গভীর ও নিবিড় ধ্যানমগ্ন দৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণে। এই নিবিড় দৃষ্টির পরম্পরার মধ্য দিয়ে তৈরি হয় সত্যানুভুতি।

 

ঙ. বিজ্ঞানের ভাষা গণিত; প্রায়শই বিজ্ঞানে বিশেষ বক্তব্য সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশের প্রয়োজনে তৈরি করতে হয় সুনির্দিষ্ট ও সংকুচিত পরিভাষা। ভারতবর্ষের প্রজ্ঞার ঐতিহ্যে, বিশেষত হিন্দু ধর্মে, প্রতীক, রূপক, উপমা অথবা চিত্রকল্পের মাধ্যমে বাক্য বা বিবৃতি পায় পুরাণের রূপ। আনন্দ কুমারস্বামীকে উদ্ধৃত করে ফ্রিটজফ কাপরা বলছেন, ‘‘পুরাণ অঙ্গীভূত করে পরম সত্যের সবচাইতে কাছাকাছি কোনকিছু যা বর্ণিত হতে পারে ভাষায়।’’ পুরাণ বা কাব্যভাষা প্রাচ্যে প্রজ্ঞার প্রকরণ, ভাবের বাহন। হিন্দুধর্মে ‘মহাদেবের জটা’ ‘শিবনৃত্য’ ইত্যাদি পৌরাণিক অভিব্যক্তিগুলো প্রকৃতি ও বস্তুর স্বরূপ সম্পর্কে এদের রচয়িতার অন্তর্জ্ঞানকে বর্ণনা করে।

 

জগদীশ চন্দ্র বসুর ভেতরে আমরা লক্ষ্য করব পাশ্চাত্য পদ্ধতি ও প্রাচ্যীয় প্রজ্ঞার অপূর্ব মেলবন্ধন। যদিও পাশ্চাত্যের ‘নিখাদ বিজ্ঞানে’র প্রবক্তারা এর সমালোচনা করেন। ইউরোপ তার নিজ ঘরানার বিজ্ঞানচর্চাকে মানদণ্ড বানিয়ে অপরাপর সকল পদ্ধতি ও চিন্তা-অভিজ্ঞতাকে যখন অবৈজ্ঞানিক ঠাওরান তখন বিজ্ঞানের জাতীয়তাবাদী, ঐতিহ্যিক ও বিকল্প বিজ্ঞানের পারাডাইম তৈরি হয়। প্রতীক চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, “ভারতের হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির বৃহত্তর পরিসর  থেকে জগদীশের কাজ ও গবেষণা সংগ্রহ করেছে শক্তি ও শাঁস।“ ইউরোপীয় ‘বিজ্ঞানবাদ’ (scientism) এর সার্বজনীনতার ধারনার বিপরীতে বিজ্ঞানের ‘স্বদেশী’ রূপ জগদীশের নতুন প্যারাডাইম।

 

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও জগদীশ : পাশ্চাত্যপদ্ধতি বনাম প্রাচ্যমন

জগদীশ চন্দ্র বসু তাঁর গবেষণার বিষয় হিসেবে যে প্রতিপাদ্য নির্বাচন করেন তার পশ্চাতে তার পরিবারের ব্রাহ্ম ঐতিহ্য, তার আন্তর্ব্যক্তিক সম্পর্ক (interpersonal relationship), মাতার আচারনিষ্ঠা ও ভারতীয় মনন-ইতিহাস থেকে প্রথাগত ভাবে প্রাপ্ত বিশ্ববীক্ষার সুস্পষ্ট ভূমিকা ছিল। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্পর্কে তার ভাবনা তার নিজ মুখ থেকেই আমরা শুনি :

বৈজ্ঞানিককে যে-পথ অনুসরণ করিতে হয় তাহা একান্ত বন্ধুর এবং পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের কঠোর পথে তাঁহাকে সর্বদা আত্মসংবরণ করিয়া চলিতে হয়।সর্বদা তাঁহার ভাবনা,পাছে নিজের মন নিজেকে ফাঁকি দেয়। সেজন্য পদে পদে মনের কথাটা বাহিরের সঙ্গে মিলাইয়া চলিতে হয়। দুই দিক হইতে যেখানে না মিলে সেখানে তিনি একদিকের কথা কোন মতেই গ্রহন করিতে পারেন না। (জগদীশ ৬৫: ২০১২)

এখানে বিজ্ঞান, বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানীর মন সম্পর্কে স্পষ্ট তাঁর উপলব্ধি। প্রথমত, বিজ্ঞান ‘পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের কঠোর পথ’। দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞানীকে ‘আত্মসংবরণ করিয়া চলিতে হয়’। অর্থাৎ বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত বিশ্বাস যেন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ও পর্যবেক্ষণ-পরীক্ষণলব্ধ ফলাফলে কোন প্রভাব বিস্তার না করে। ইউরোপীয় ঘরানার বিজ্ঞান চর্চার আরোহী পদ্ধতি এটি। ১৮৯৪ থেকে ১৮৯৯ পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে তিনি ইয়রোপীয় ঘরানার বিজ্ঞান চর্চা শুরু করেন। এটি গবেষক হিসেবে তাঁর পূর্বপ্রস্তুতিমূলক পাঁচ বছর। এ সময়টা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত তাঁর নানা ধরনের যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের প্রচেষ্টায়। কোন দুঃসাহসী তত্ত্ব প্রণয়নের প্রচেষ্টা এই সময়ে ছিলনা তাঁর।

 

সে যাই হোক, আমাদের ভিন্ন ভাবনা জাগে জগদীশের উপর্যুক্ত উদ্ধৃতির শেষ দুই লাইনে যেখানে তিনি বলছেন ‘মনের কথাটা বাহিরের সঙ্গে মিলাইয়া’ দেখা আর ‘দুই দিক হইতে’ মিল হওয়াটা আবশ্যক। অর্থাৎ জগত সম্পর্কে অন্তরের অনুভবকে ‘বাস্তবতা’র সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে; পাশাপাশি। ‘বাহির’কেও মনের মধ্যে তৈরি করতে হবে সত্যানুভূতি। অন্তর ও বাহিরের সত্যের এমন অভেদাত্নক কল্পনা তো প্রাচ্যীয়, ভারতীয়। ল্যবরেটরিতে পরীক্ষণের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেও জগদীশ সাধকের নির্লিপ্ততায় উচ্চারণ করেন :

প্রকৃত পরীক্ষাগার আমাদের অন্তরে। সেই অন্তরতম দেশেই অনেক পরীক্ষা পরীক্ষিত হইতেছে। কেবলি বাহিরের দিকে যাহাদের মন ছুটে যায়…তাহারা সত্যের দর্শন পায়না। (জগদীশ ২০১২: ৬৯)

জগদীশের ভাবনায় ‘হৃদয় পদ্ম’ এ দেবী সরস্বতীর অধিষ্ঠান। জাগতিক উপায়-উপকরণের সীমাবদ্ধতায় কখনোই গবেষণা, সত্যানুসন্ধান থেমে থাকেনা। সত্যের পথ হৃদয়ের পথ — এটি নিরেট প্রাচ্যীয় অনুভব। মূল্যবোধবিহীন ও ‘অন্তরে’র সাথে সম্পর্কবিহীন বিজ্ঞানে জগদীশ আস্থা হারান তাঁর পরিণত বয়সে। জগদীশ অমত করবেন না ফ্রিটজফ কাপরার এই সাক্ষীতে :

বিজ্ঞানীরা প্রকৃতিতে যে সজ্জাগুলো পর্যবেক্ষন করেন এবং তারা যে প্রযুক্তিগত প্রয়োগ অনুসন্ধান করেন তা তাদের মনের কাঠামো দ্বারা প্রভাবিত হবে।যদিও তাদের বিশদ গবেষনার বেশিরভাগ নির্ভর করবেনা তাদের মূল্যবোধ-ব্যবস্থার উপর, তবুও এই গবেসনাটি যে বৃহত্তর কাঠামোর মধ্যে এর উদ্দেশ্য স্থির করেছে তা কখনো হবেনা মূল্যবোধমুক্ত। (কাপরা ২০১৩: ১৭)

 

বিজ্ঞানের  বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে যেয়ে অস্ট্রিয়ান দার্শনিক পল ফেয়ারবেন্ড বলছেন, বিজ্ঞান মূলত মানবিক প্রকৃতির। বৈজ্ঞানিকের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা, তাঁদের কল্পনা ও স্বপ্ন, তাদের আইডিয়লজি ও প্রশিক্ষণ, তাঁদের পরিবেশ ও পটভূমি, তাঁদের ভুল ও বিচ্যুতি — এ ধরনের সব কিছুই ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকবে তাঁদের সৃষ্ট বিজ্ঞানের সাথে। ফায়ারাবেন্ড যথার্থই বলেন, বিজ্ঞান মূলত এ ধরণের মানবিক গুনাবলি দিয়েই গড়া। তিনি এ ব্যপারে তর্ক হাজির করেন যে, ‘a universal scientific method does not exist’। অর্থাৎ বিজ্ঞানের সার্বজনীন পদ্ধতি নাই; জগদীশের হৃদয়ের পথ বা ‘অন্তরের পরীক্ষাগার’ ও বৈজ্ঞানিক সূত্রের জন্মাধার হতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, অধুনিক বিজ্ঞান গবেষণায় interdiciplinary research পদ্ধতির প্রধান পথিকৃৎদের মধ্যে তিনি অন্যতম। পদার্থ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে উদ্ভিদশরীর বিদ্যায় তিনি অসামান্য অবদান রাখলেন।

 

উত্তর-উপনিবেশিক ইতিহাসতাত্ত্বিক ও মনোবিশ্লেষণবিদ আশিস নন্দীর মতে, জগদীশ গবেষণার এমন ধারণাকে জনপ্রিয় করেন যেটি আধুনিক বিজ্ঞানের প্রধান ‘মূল্যায়নমূলক’ অনুমানকে (a major evaluative assumption of modern science) অস্বীকার করে। প্রকৃতির স্বতঃপ্রকাশিত ও সতঃসিদ্ধ সাধারণ নিয়মকে পরীক্ষামূলকভাবে প্রদর্শন করার উপায় হিসেবে জগদীশ বিজ্ঞানের ধারণাকে তুলে ধরা শুরু করেন। (Nandy ১৯৭২: ৮২) অত্যন্ত সফল পদার্থবিদ ও উদ্ভাবনশীল উদ্ভিদবিজ্ঞানী জগদীশ বিশ্ববিজ্ঞানকে প্রদান করেন ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি।

 

প্রাণ ও প্রজ্ঞার ঐক্য সন্ধানী, ঋষির পথ

বিশ্ব ইতিহাসে ভারতবর্ষীয় জ্ঞানের বিশিষ্টতা সম্পর্কে জগদীশ চন্দ্র বসু বলেন :

 উহা সকল সময়ে ক্ষুদ্র ছাড়িয়া বৃহতের সন্ধান করিয়াছে। অন্যদেশে জ্ঞান রাজ্য এত বিভিন্নভাবে বিভক্ত হইয়াছে যে, তথায় সমগ্রকে এক করিয়া জানিবার চেস্টা লুপ্ত হইয়াছে। ভারতবর্সের চিন্তনপ্রণালি অন্যরূপ। তাই তাহার কাব্য, সাহিত্য, জ্ঞানের অন্তরনিহিত এই মহান সত্য ব্যক্ত করিবার চেস্টা করিয়াছে। জ্ঞানের অন্বেষণে আকাশে ভাসমান ক্ষুদ্র ধূলিকণা, বিশ্বের অগনিত জীব ও ব্রহ্মাণ্ডের কোটি সুর্যের মধ্যে সেই একতার সন্ধান করিয়াছে।

সারা জীবন জগদীশ সন্ধান করেছেন ঐক্য। তাঁর ব্যক্তি সত্তার ভেতরে আমরা লক্ষ্য করি কবি ও বিজ্ঞানী, এক যন্ত্রপ্রযুক্তিবিদ আর তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী এর একীভূত রূপকে। তাঁর বিজ্ঞান সাধনায় ঘুচে গিয়েছিল জীববিজ্ঞান আর জড়বিজ্ঞানের সীমারেখা। গাছপালার প্রতি তার টানের পেছনেও হয়তো কাজ করেছে প্রকৃতির সুবিপুল আয়োজনের মধ্যকার একমুখিনতা। সূর্যালোক, বায়ু, মাটি, পানির সম্মিলিত কার্যক্রমে বীজ থেকে বেড়ে উঠে চারাগাছ, বৃক্ষ। বীজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বৃক্ষের সম্ভাবনা কি তাকে  আকুল করেনি? বৃক্ষের মধ্যে তিনি দেখেছেন ‘ক্ষুদ্র ছাড়িয়া বৃহতের’ দিকে যাত্রার অভিমুখ; বৃক্ষের মধ্যেই তিনি লক্ষ্য করেন জীব (living) ও জড়জগতের (Non-living) মধ্যকার কাঙ্ক্ষিত যোগসূত্র। উদ্ভিদ শরীরতত্ত্বে (plant physiology) তাঁর অসামান্য অবদান তাঁর পর্যবেক্ষণে ধরা পড়া ঐক্যবোধের ফলাফল বলে মনে করা যায়। 

 

জগদীশের ঐক্যসন্ধানী মন তাঁর গবেষক সত্তার ওপরেও প্রভাব ফেলেছে। তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণার দ্বিতীয় পর্বে অদ্বৈতবাদী দর্শনের পক্ষ্যেই যেন তিনি ডেমন্সট্রেটিভ ও এম্পিরিকাল প্রমাণ সরবরাহ করা শুরু করলেন।জগদীশের অবরোহী মন আশ্চর্য ফল দিয়েছিল তাঁর গবেষণায়। প্রাণীদেহের পেশী ও ধাতব পদার্থের ওপর  বৈদ্যুতিক উদ্দীপনা চালিয়ে জগদীশ  তাদের মধ্যে প্রায় একই ধরনের সাড়া লক্ষ্য করেছেন। জীব ও জড়র পর একই ধরনের পরীক্ষা তিনি চালান উদ্ভিদ দেহে। বৈদ্যুতিক উদ্দীপনায় উদ্ভিদ দেহে যে সাড়ালিপি তিনি রেকর্ড করেন তার সাথে প্রাণপেশী ও ধাতব পদার্থের সাড়ার প্রচুর মিল। অজৈব জগত, জৈব জগত আর উদ্ভিদ জগতের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে একই জীবন স্রোত — এ ব্যাপারে তিনি লাভ করলেন দৃঢ় প্রত্যয়। জগদীশের বিহ্বল সিদ্ধান্ত : জীব ও অ-জীবের মধ্যে কোন বিভেদ রেখা টানা যায় না। জীব ও জড় ‘প্রাণ’-এর বিভিন্ন রূপ। জগদীশের কাছে ‘সাড়া দিতে পারা’-ই প্রাণের ‘সাফিসিয়েন্ট কজ’। ভারতীয় বা প্রাচ্যের মুনিঋষিদের অভিজ্ঞতায় জীব ও জড়ের অভিন্নতার অনুভব ছিল শত শত বছর ধরেই। ভারতীয় অদ্বৈতবাদ অনুসারে ‘সাড়া’ই প্রাণের লক্ষণ। বিজ্ঞানীর ‘অনুভব’ প্রমাণিত হলো পরীক্ষণের মধ্য দিয়ে।

 

পশ্চিমা জ্ঞানরাজ্যের ভেদবুদ্ধি ও বিজ্ঞানের বহু শাখার মধ্যকার অভেদ্য প্রাচীর ‘সত্যের পূর্ণমূর্তি প্রত্যক্ষ’ এ বিঘ্ন সৃষ্টি করে। ফলে সাধনা চললেও সিদ্ধি লাভ হয়না। ‘বিজ্ঞানে সাহিত্য’ নামক প্রবন্ধে ‘বহুর মধ্যে এক যাতে হারাইয়া না যায়’ ভারতবর্ষের সেই ঔৎসুক্যের দিকে তিনি বার বার আমাদের নজর ফিরিয়েছেন, “যাহা বিচ্ছিন্ন মনে করিতাম, প্রকৃত পক্ষে তাহা বিচ্ছিন্ন নহে” (জগদীশ ২৬: ২০১২)। ‘নিজেদেরকে এক বৃহৎ পরিচয়ে জানিবার’ প্রাচ্যীয় প্রচেষ্টার কথা বিভিন্ন প্রবন্ধে জানান দেন তিনি এবং বিজ্ঞানে তাঁর অবদানকেও শত শত বছর ধরে চলে আসা ভারতীয় ‘সর্বব্যপী একতার’ সাধনার অংশ মনে করেন :

এত বৈষম্যের মধ্যেও ভারতীয় চিন্তা প্রণালি একতার সন্ধানে ছুটিয়া জড়, উদ্ভিদ ও জীবের মধ্যে সেতু বাঁধিয়াছে।… পদার্থবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, এমন কি মনস্তত্ত্ববিদ্যাও এক কেন্দ্রে আসিয়া মিলিত হইয়াছে। বিধাতা যদি কোন বিশেষ তীর্থ ভারতীয় সাধকের জন্য নির্দেশ করিয়া থাকেন তবে এই চতুর্বেনী-সংগমেই সেই মহাতীর্থ। (জগদীশ ৯৮: ২০১২)

পদার্থ, উদ্ভিদ, প্রাণী ও মনস্তত্ত্ববিদ্যার ‘চতুর্বেণী-সঙ্গমে’ই ভেতর ও বাহির, জীব ও জড়র মধ্যে সেতু রচিত হয়, ক্রমে বিলীয়মান হয় পার্থক্য সকল। ‘সেতু’ ও সম্পর্ক অন্বেষণ যেমন ভারতীয় প্রজ্ঞার বৈশিষ্ট্য, তেমনি ভারতীয় বিজ্ঞান সাধকের অভীষ্ট বা ‘মহাতীর্থ’ও তাই।

 

বিজ্ঞানের বাণিজ্যিকীকরণ বনাম তাত্ত্বিক তৃপ্তি

আশীস লাহিড়ী জগদীশ চন্দ্র বসুর  ‘ঐক্য সন্ধানী মন’ ও ‘সাদৃশ্য প্রদর্শন’-এর ঝোঁকের মধ্যে বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর আরও সাফল্য ও সম্ভাবনার বিনষ্টি লক্ষ্য করছেন। আশীস লাহিড়ী মূলত ‘বিজ্ঞানের সার্বজনীনতা’ ও ‘সেকুলার জাতীয়তাবাদ’-এ তাঁর আস্থার ভিত্তিতে জগদীশের পর্যালোচনা করেছেন। তিনি জগদীশের  বিজ্ঞানকর্মের মধ্যে বিজ্ঞানবহির্ভূত ‘মতাদর্শ’-এর অনুপ্রবেশ নিয়ে অনুযোগ করেছেন; বিজ্ঞান নিয়ে বিবেকানন্দ, নিবেদিতা, জগদীশ বা রবীন্দ্রনাথের অবস্থানকে বলেছেন ‘দ্বিচারিতা’ বা ‘না- ঘরকা- না ঘাটকা’। পরীক্ষা-নিরীক্ষানির্ভর বিজ্ঞানে জগদীশের আগ্রহ অব্যাহত থাকলে জগদীশ বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে  অপ্রতিরোধ্যভাবে আরও অসামান্য সফলতা অর্জন করতে পারতেন বলে লাহিড়ী অনুমান করেন। তবু জগদীশ ও ভারতীয় বিজ্ঞান সম্পর্কে মূল্যবান কিছু পর্যবেক্ষণ পাওয়া যায় তাঁর বইটিতে।

 

হার্তজীয় তরঙ্গ নিয়ে পরীক্ষাকালে তিনি দৃশ্য আলো আর অদৃশ্য আলোর চরিত্রগত সাদৃশ্য উপলব্ধি করেন তার-ই তৈরি ‘কল’ দিয়ে। এই ঐক্য আবিস্কারেই তার মন তৃপ্ত ছিল। অপূর্ব নৈপুণ্যে একের পর এক যন্ত্র নির্মাণ করে তিনি দেখাতে থাকেন কী করে নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ পাঠানো ও গ্রহণ করা যায়। লাহিড়ী লক্ষ্য করেন :

জগদীশের গবেষণার মূল লক্ষ্যই ছিল তাত্ত্বিক তৃপ্তি অর্জন।… তিনি রেডিও নামক কোন যন্ত্র উদ্ভাবন করতে চাননি, সন্তুষ্ট ছিলেন রেডিও তরঙ্গের ভৌত চরিত্র নির্ণয় করে, রেডিও-তরঙ্গ উৎপাদন ও তা গ্রহণ করার কৌশলকে উত্তরোত্তর নিখুঁত করে তুলে।

পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বে ব্যবহারিক উপযোগিতা সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন, কিন্তু হয়ত তার অভিজাত পারিবারিক পটভূমি, তাঁর ব্যবসায়ে অকৃতী আদর্শবাদী পিতার স্মৃতি, এবং উপনিষদীয় ভারতীয় জাতীয়তাবাদ তাঁকে বিজ্ঞানের বাণিজ্যিকীকরণের অংশ হয়ে উঠতে দেয় নি। জগদীশ মার্কনির সাথে তার নিজের পার্থক্য বিষয়ে সচেতন ছিলেন। মার্কনির কৃতিত্ব বিজ্ঞানের ‘ব্যবহারিক উন্নতি সাধনে’, বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রণয়নে না। আবিস্কারের অনির্বচনীয় অনুভূতিতে অভিভূত ও বিহ্বল হয়ে তৃপ্ত থাকার প্রাচ্যীয় মন ছিল জগদীশের। যদিও বিশ্বের বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের প্রচলিত রীতি মেনে তিনি তাঁর কিছু আবিস্কারের পেটেন্ট নিয়েছিলেন, কিন্তু লাভালাভের বাজারি হিসাবে মগ্ন ছিল না তার মন কখনোই।

সূত্র : বিবিসি

জগদীশের ‘সত্য’

ইউরোপে সতেরো শতকে দর্শন ও বিজ্ঞানের যে বিচ্ছেদ ঘটে তা পশ্চিমের মননশীল সকলকেই স্পর্শ করে। ইউরোপীয় রেনেসাঁ ও এনলাইটেনমেন্টের ফলে ধর্ম, বিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে পার্থক্য ঘটে যায়। তবে প্রাচ্যীয় বিশ্ববীক্ষায় ধর্ম ও দর্শন সর্বদাই থাকে জড়াজড়ি করে, আলাদা করা যায়না একটিকে অপরটি থেকে। জগদীশ প্রাচীন ভারতীয় প্রজ্ঞাকে বিজ্ঞানের পরিসরে প্রবেশের সুযোগ করে দেন। তবে জগদীশের বিশ্বাস : সত্য অন্বেষণের নানা পথ আছে; দার্শনিক, ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক সত্য প্রায়শই মিশে যেতে পারে এক মোহনায়। জগদীশ চন্দ্র বসু পরীক্ষা-নিরীক্ষার দুর্গম পথে প্রাপ্ত ‘বৈজ্ঞানিক সত্য’ সম্পর্কে নিম্নোক্ত বাক্যে উত্থাপন করেন এক জরুরি প্রসঙ্গঃ

ইহার পুরস্কার এই যে তিনি যেটুকু পান তাহার চেয়ে কিছুমাত্র বেশি তিনি দাবি করিতে পারেন না বটে, কিন্তু সেটুকু তিনি নিশ্চিতরুপেই পান এবং ভাবি পাওয়ার সম্ভাবনাকে তিনি কখনো কোন অংশে দুর্বল করিয়া রাখেন না।

বিজ্ঞানের পথ ‘কঠিন নিশ্চিতের পথ’। অর্থাৎ যা সম্পর্কে আমাদের নিশ্চয়তা নাই তাকে আমরা সত্য বলে মানতে পারি না। তবে ভবিষ্যতে নতুন সত্য পাওয়ার সম্ভাবনাকে বিজ্ঞানী ‘দুর্বল করিয়া রাখেন না’। যদিও শাশ্বত সত্যই তাঁর লক্ষ্য, তবুও পরীক্ষণের মাধ্যমে যা সত্য বলে প্রতীয়মাণ হয়েছে তাতে ভবিষ্যতে যেমন ভুল পাওয়া যেতে পারে, তেমনি তার নির্ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও আছে। বিজ্ঞানীর যেহেতু প্রমাণের দায় আছে, তাই যতোটুকু প্রমাণিত ততটুকুর বেশি তিনি দাবি করতে পারেন না। শুধুমাত্র বিজ্ঞানের সত্য সম্পর্কে, ধারণা করি, জগদীশের তৃপ্তি ও সংশয় দুটিই আছে। কার্ল পপারের সাহায্য নিয়ে আমরা বলতে পারি, “সত্য পরম, কিন্তু সত্য সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে।’’ সে যা হোক, ‘সত্যে’র ওপর শুধু বিজ্ঞানেরই একচেটিয়া অধিকার আছে এমনটি মনে করেন না জগদীশ, ‘সকল পথই যেখানে একত্র মিলিয়াছে সেইখানেই পুর্ণ সত্য।’ (‘কবিতা ও বিজ্ঞান’, অব্যক্ত)

 

‘বোস বিজ্ঞান মন্দির’ প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে বলতে গিয়ে জগদীশ চন্দ্র বোস সত্য, বিশ্বাস ও পরীক্ষণ সম্পর্কে যে পর্যবেক্ষণ হাজির করেছেন তা নিম্নরূপঃ

আজ যাহা প্রতিষ্ঠা করিলাম তাহা মন্দির, কেবলমাত্র পরীক্ষাগার নহে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্য পরীক্ষা দ্বারা  নির্ধারিত হয়; কিন্তু ইন্দ্রিয়েরও অতীত দুই-একটি মহাসত্য আছে, তাহা লাভ করিতে হইলে কেবলমাত্রর বিশ্বাস আশ্রয় করিতে হয়। বৈজ্ঞানিক-সত্য পরীক্ষা দ্বারা প্রতিপন্ন হয়।… বিশ্বাসের সত্যতা সম্বন্ধেও পরীক্ষা আছে; তাহা দুই-এক ঘটনার দ্বারা হয় না, তাহার প্রকৃত পরীক্ষা করিতে সমগ্র জীবনব্যাপী সাধনার আবশ্যক।

আধুনিক কালে বিজ্ঞানকেই সত্যাসত্যের মানদণ্ড ভাবা হয়; জগদীশ ‘বৈজ্ঞানিক সত্যে’র বাইরেও সত্যের নানা মানদণ্ডে — যেমন, ধর্ম, দর্শন, অন্তর্জ্ঞান — আস্থা রাখেন। তাঁর মতে কবি ও বিজ্ঞানীও একই ও অভিন্ন সত্যের সন্ধানী। শুধু পার্থক্য এই যে, “কবি পথের কথা ভাবেন না, বৈজ্ঞানিক পথটাকে উপেক্ষা করেন না।’’ কবি ও বৈজ্ঞানিকের পার্থক্য শুধু ‘পথ’-এ; দুজনেরই গন্তব্য অভিন্ন। জগদীশের সত্যান্বেষণের মধ্যে বহুত্ববাদী সমাজের (pluralistic society) কল্পনা আছে যেখানে যুক্তি ওবিশ্বাস, ধর্ম ও বিজ্ঞান অভিন্ন সত্যের নানা মানদণ্ড, যেন একই সমাজবৃক্ষের নানা প্রত্যঙ্গ। এখানেই জগদীশ ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্ট প্রকল্পের বাইরে অবস্থান করেন, অনেকটাই। 

 

বিজ্ঞান ও জাতীয়তাবাদ : জগদীশের নয়া প্যারাডাইম 

উপনিবেশিত ভারতের ‘আত্মআবিস্কার’ আর স্বাতন্ত্র সন্ধানের অংশ হিশেবে জাতীয়তাবাদের সাথে মিলিত হয় বিজ্ঞান। বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদে ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের সম্প্রসারণ কালে যেকোন বিজ্ঞানীরই ছিল দ্বৈত দায়বদ্ধতা (dual commitment): একদিকে বিজ্ঞান, অন্য দিকে জাতি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বেদ ও উপনিষদীয় টেক্সট গুলো থেকে ‘ভারতীয়ত্ব’-এর রূপ অনুসন্ধানের চেষ্টা চলেছে সফল ভাবেই। বেদের অদ্বৈতবাদী চেতনার মধ্যে বুদ্ধিজীবিরা খুঁজে পান ‘শ্বাশত ভারতীয়ত্ব’ (quitessential Indianess)-এর নমুনা ও নিদর্শন। ভারতীয় মনিজমের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সরবরাহের মাধ্যমে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক প্রয়োজন মেটান জগদীশ বসু। ‘ভারতবাসীরা ভাবপ্রবণ ও স্বপ্নাবিষ্ট, অনুসন্ধানকার্য কোনদিনও তাহাদের নহে’ পাশ্চাত্যের এই প্রাচ্যকল্পনার (orientalist view) বিপরীতে এক নতুন ইন্ডিয়াকে জগদীশ পরিচিত করেন পাশ্চাত্য বিশ্বে। যাহোক, জগদীশের ভারতীয়ত্বের প্রগাঢ় অনুভূতির পেছনে তাঁর পিতা-মাতা, তার শৈশবে বেড়ে উঠার ইতিহাস ও উপনিবেশিতের অভিজ্ঞতা ছাড়াও আরও কয়েকটি বিষয় আমরা লক্ষ্য করি।

 

প্রথমত,  রামমোহন রায়ের রচনার মধ্যে জগদীশ চন্দ্র বসু সাক্ষাৎ পান বেদ-উপনিষদে নিহিত মনিজম বা অদ্বৈতবাদের ধারণার। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ডিসকোর্সের প্রধান ব্যক্তি এই রামমোহন রায়। ধ্রুপদী ভারতীয় চিন্তায় রামমোহন চিহ্নিত বা বলা যায়, পুনরাবিষ্কার করেন মনিজম। দ্বিতীয়ত, ১৮৮৭ সালে অবলা বসুর সাথে জগদীশের বিবাহের পর  বছরের দুই ছুটিতে তারা ব্যপক ভ্রমণ করেছেন ভারতের প্রাচীন গৌরবময় স্থান গুলোতে যেমন আগ্রা, রাওয়ালপিন্ডি, দীল্লি, অশোকের স্টুপাস, নারমদা বাঁধ, কাশ্মীর, অজন্তা ইলোরা, সিলনের বৌদ্ধ মন্দির, তক্ষশীলা, নালন্দা ইত্যাদি। তিনি তাঁর একটি চিঠিতে জানিয়েছেন, এ সময়েই তিনি ভারতমাতার সন্তান হিসেবে ভারতীয় পরিচয়ের গৌরব উপলব্ধি করেন নিবিড়ভাবে। ১৮৯৪ সালে অসামান্য আবেগ প্রদীপ্ত ভাষায় রচিত ‘ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে’ রচনায় তিনি যেন ভারতের আত্মার সন্ধান পান হিমালয় চূড়ায়। তৃতীয়ত, ১৮৯৬-৯৭ সালে ইংল্যান্ডে থাকা কালে বিবেকানন্দের শিষ্যা নিবেদিতার সাথে তার সাক্ষাত হয় এবং বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতা গুলো মুগ্ধ করে জগদীশকে। বিবেকানন্দের চিন্তাও তাকে প্রবলভাবে  আগ্রহী করে ভারতীয় চিন্তার আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের প্রতি। চতুর্থতঃ রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর ক্রমবর্ধমান বন্ধুত্বও তাকে জাড়িত করে  উপনিষদীয় ভাবনা ও অনুভবে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও বৈদিক ও উপনিষদীয় অদ্বৈতবাদ তাকে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের পর্যালোচক  করে তোলে। প্রতীক চক্রবর্তী জগদীশকে উদ্ধৃত করেন এভাবে :

The excessive specialization of modern science in the west has led to the danger of losing sight of the fundamental fact that there can be one truth. One science includes all branches…… India, through her particular habit of mind, is fitted to realize  the idea of unity and to see in the phenomenal world an orderly universe. (Pratik chakrabarty 201: 2004)

অর্থাৎ, পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের ‘excessive specialization’ বা ‘সুনির্দিষ্ট বিষয়মুখী বিশেষজ্ঞতা’র ধারণা পাশ্চাত্যকে ‘একতার অনুভব’ থেকে বিমুখ করে; তা-ই প্রয়োজন ‘Indian intervention’।

 

পশ্চিমা পদার্থবিদ, রসায়নবিদ আর শরীর তত্ত্ববিদদের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদ থেকেও পশ্চিমা বিজ্ঞানের প্রতি সমালোচনামূলক দৃস্টিভঙ্গি গড়ে উঠে তাঁর মধ্যে। জগদীশ চন্দ্র বসু ৫ অক্টোবর, ১৯০০ সালে রবীন্দ্রনাথের কাছে লিখিত একটি চিঠিতে এটি উল্লেখ করেন। এ প্রসঙ্গে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে, পাশ্চাত্য বিশ্বের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা, যেমন কেলভিন, লিস্টার, রামসে স্বীকৃতি দেন প্রাচ্যের এই বিজ্ঞানীর পদ্ধতি ও আবিষ্কারকে। ১৮৯৬ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডি এস সি (DSC) ডিগ্রি পান। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বিজ্ঞান জগতে বোসের সাফল্যকে কোন ব্যক্তি প্রতিভার জয় হিসেবে না দেখে ভারতীয় মনের মহিমা হিসেবে দেখলো। প্রতীক চক্রবর্তী আমাদের জানাচ্ছেন:

ঊনবিংশ শতাব্ধীতে যন্ত্রের ক্লান্তি (Metal fatigue) এর ঘটনা অপরিচিত ছিল না বৈজ্ঞানিক মহলে, বিশেষত A Wohler এর রচনায়। কিন্তু ভারতবর্সে জগদীশের এই আবিস্কারের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা ছিল অপরিমেয়, যেটি ইউরোপে ছিলোনা। (Pratik Chakrabarti 2004:200)

রবীন্দ্রনাথ, ভগ্নি নিবেদিতা সহ প্রায় সবাই জগদীশের গবেষণা ও আবিষ্কারে শুনতে চেয়েছিলেন ‘ভারতীয় আত্মা’র অনুরণন। জগদীশ চন্দ্র বসুও তার আবিস্কারের তত্ত্বায়ন (Theorisation) করেন প্রাচ্যীয় প্রজ্ঞার ভাবে ও ভাষায়। জাতীয়তাবাদ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য চেতনা এখানে জন্ম দেয় ‘বিকল্প বিজ্ঞান’ (Alternative science) বা ‘ অন্য বিজ্ঞান’ (Other science)-এর ধারণা।

 

জগদীশের পক্ষ-বিপক্ষ

জগতকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য এই দুই ভাগে বিভক্তির সমীকরণের মধ্যে বিজ্ঞানী হিসেবে জগদীশচন্দ্র বসু বিশেষ অর্থপূর্ণ হয়ে উঠেন। জগদীশের পক্ষ-বিপক্ষ মূলত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অধ্যয়নের (Science and Technology studies) দুটি মতাদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করে :

এক. জগদীশকে ইতিবাচকভাবে যাঁরা বুঝতে চান তারা মূলত বিজ্ঞানকে  ‘বিউপনিবেশিকীকরণ’ (Decolonising), ‘সামগ্রিক বিজ্ঞান’ (Holistic science), বৈচিত্র্যপূর্ণ বিশ্বাসব্যবস্থা ও স্থানীয় জ্ঞান ও সংস্কৃতির ঐতিহাসিক শক্তির জায়গা বিবেচনা ও বিশ্লেষণ করেন। তারা উত্তরাধুনিকতাবাদী, পোস্টকলনিয়ালিস্ট, ‘বিকল্প বিজ্ঞানের প্রবক্তা’ নানা নামে তারা অভিহিত।

দুই. জগদীশের বিপক্ষের তাত্ত্বিকরা যে ধারার মধ্যে পড়েন তাঁরা বিজ্ঞানকে সেকুলার, এনলাইটেনমেন্ট ও  র‍্যাশনালিস্ট ট্রেডিশান ও বিজ্ঞানবাদিতার (scientism) অবস্থান থেকে দেখেন। দুই পক্ষেই গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক রয়েছেন। প্রথম পক্ষে আছেন, আশীস নন্দী, শিব বিশ্বনাথন, ক্লড আল্ভারেজ, রজনি কোঠারি, জিয়াউদ্দিন সরদার, বন্দনা  শিবা প্রমুখ। দ্বিতীয় পক্ষে থাকবেন  Meera Nanda, Joseph Needham, Alan Sokal, Jean Bricmon, আশীষ লাহিড়ী আরো অনেকে। তবে দুই পক্ষই জগদীশকে গুরুত্ব দিবেন তাদের ভিন্ন ভিন্ন কারনে। পশ্চিমের পরীক্ষা নিরীক্ষানির্ভর  ‘নিখাদ বৈজ্ঞানিক’ ঐতিহ্য যতটুকু জগদীশ মেনেছেন, তাঁদের কাছে তিনি ততটুকু গুরুত্বপুর্ণ। বিজ্ঞানকে যাঁরা বৃহত্তর মানবিক অভিজ্ঞতা, জ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতগত ন্যয্যতা ও পশ্চিমা হেজিমনি বিরোধিতার জায়গা থেকে দেখেন তাদের কাছেও জগদীশ মূল্যবান। দুই পক্ষই স্বীকৃতি দিবেন জগদীশের প্রতিভার,কামনা করবেন জগদীশের আরও অবদান রাখতে পারার সম্ভাবনার,আক্ষেপ করবেন ভারতে ও বিশ্বে তার বিলীয়মান প্রভাবের ।

 

তথ্যসূত্র

১. http://en.wikipedia.org/wiki/Science

২. ফ্রিটজফ কাপরা, দ্য টাও অব ফিজিকস, আসাদ ইকবাল মামুন (অনূদিত) (নারায়ণগঞ্জ : এশিরিয়া ব্যবিলন ২০১৩)

৩. আশীস লাহিড়ী, বিজ্ঞান ও মতাদর্শ, দ্বিতীয় সংস্করণ (কলকাতা : অবভাস ২০১১)

৪. জগদীশ চন্দ্র বসু, অব্যক্ত, (ঢাকা : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ২০১২)

৫. Ashis Nandy, “Defiance and Conformity in Science: The Identity of Jagadis Chandra Bose” Science Studies, Vol. 2, No. 1, (Jan., 1972), pp. 31-85

৬. Pratik Chakrabarti: Western Science in Modern India: Metropolitan Methods, Colonial Practices (Orient Blackswan 2004)

৭. গালিব আহসান খান, বিজ্ঞান, পদ্ধতি ও প্রগতি (ঢাকা : জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ ২০১২)

৮. Paul Feyerabend, Against Method, (UK: Verso 1993)

2 মন্তব্যসমূহ

  1. আমাড় ট্যাগ করার জন্যে কৃতজ্ঞতা।
    প্রাথমিকভাবে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানকে উপনিবেশ, সাম্রাজ্য, পুঁজি, পূর্বের জ্ঞানলুঠ এবং কেন্দ্রিভূত উৎপাদন ব্যবস্থা ছাড়া বিচার করা যায় কী না ভাবা দরকার, আপনি শেষে যে দ্বিতীয় ধারার মানুষদের নামোল্লেখ করেছেন, তারা প্রত্যেকেই নবজাগরণীয় সাম্রাজ্য নির্ভর বিজ্ঞান যা আদতে মূলত প্রযুক্তিতে হয় প্রত্যক্ষ্য বা পরোক্ষভাবে আস্থাবান এবং কেন্দ্রিভূত লুঠেরাপুঁজির গবেষণাগার নির্ভর প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের পক্ষ নেন।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here