পরাগ চৌধুরি মূলত অনুবাদক। বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য অনুবাদ করেছেন বাংলায়। ভীষণ পড়ুয়া মানুষ তিনি। অভিজ্ঞতার ঝুলিও বিশাল বড়। এবার তিনি প্রবেশ করেছেন স্মৃতির অন্দরমহলে। স্মৃতি মানুষের বড় শক্তি। স্মৃতি ছাড়া ইতিহাস হয় না, স্মৃতি ছাড়া সাহিত্যও হয় না। পরাগ চৌধুরির এই স্মৃতিলেখা একই সঙ্গে স্মৃতি ইতিহাস ও সাহিত্য। চমৎকার তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তি, স্মৃতির বয়ান ছাপিয়ে গিয়েছে উপন্যাসের কাঠামোকেও।
তাহের মামার বাড়ি ছেড়ে নিজেদের উঠানে ঢুকতেই দেখি নানু ডালিম গাছের ছায়ায় ছোট বাটিতে চুন হলুদ মিশিয়ে ছাগলের বাচ্চাটাকে হাঁটুতে চেপে রেখে তার আঘাতে মাপমতো দুইদিকে বাঁশের চটা বসিয়ে কাপড় পেঁচিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিচ্ছে। এবার এই তামাশা দেখতে বিনা নিমন্ত্রণে দাঁড়িয়ে পড়ি আমরা। নানু আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ঢাকায় তোদের ডাক্তাররা এমন দেখলে প্লাস্টার করে দেয়। আর আমরা এখানে চটা দিয়ে পট্টি বান্ধি না হয় হাড়ভাঙ্গা লতা পেঁচাই। দুই পদ্ধতির কাজ একটাই। জোড়া লাগানো। নানুর কথা শেষ হতেই বড় নানা বার বাড়ি থেকে মা ছাগলের দড়ি ধরে দেউড়ি পার হতেই সে ব্যাঁ ব্যাঁ করে হেঁচকা টানে মুক্ত হয়ে এক ছুট্টে চাটির চৌহদ্দিতে ঢুকে বাচ্চাটাকে প্রাণপণে চাটতে থাকে। আর কী আশ্চর্য বাচ্চাটা নানুর বেঁধে দেয়া বাঁশের চটিতে ভর করে মায়ের আদর খেতে খেতে দুধের বাঁটে মুখ দেয়। তখন নানু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কিরে নাতিন এতক্ষণ তাহেরের উঠানে বইসা যে তামশা দেখলি ডরাস নাই? — আমি মাথা নেড়ে না বলি। শিরিখালা বলে, যদি গুল দাগনের দিন দেখতি তাইলে নিসন্দ ডরাইতি।
: গরম করা লোয়ার শিক দিয়া পয়লা দাগ দেয়। দুইদিন ঘুমাইতো পারে নাই তাহের কাকা। এমন কষ্ট। গুল দেওনের আগে হাঁটতো পারতো না। আইজ কাইল হাল পর্যন্ত বায়।
নানু ছাগলের রশি ডালিম গাছেবেঁধে বড় নানুর কাজে সাহায্য করতে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়। আমরা বার বাড়িতে এসে দেখি বাহলুল মামারা চারজন মিলে পুরা জায়গা দখল করে মর্বেল খেলছে। আমাদের এগুতে দখে মহা বিরক্ত হয়ে সরে পড়ার ইঙ্গিত দিলে আমি ফিসফিসিয়ে বলি, চলো শিরি খালা আমারও বাড়ির উঠানে মার্বেল খেলি। শিরি খালা মুরুব্বিয়ানা গম্ভীরচালে বলে, মেয়েরা মার্বেল খেলে না। হাত শক্ত হয়ে যায়। মায় দেখলে বকাবকি করবে। মেয়েদের হাত আর শরীর নরম রাখতে হয়। না হয় বিয়া হয় না।
এখনো এইটা জানিস না?
কিন্ত আমি তো ঢাকায় ভাইদের সাথেখেলি। আম্মা তো কিছু বলে না।
: রাখ তর ঢাকা। এইখানে ঐসব চলে না। এইটা আমাদের নিয়ম। গ্রামের নিয়ম। সবাই মানে।
বিমর্ষ মনে বার বাড়ির সিঁড়ির পাকা পৈঠায় গালে হাত দিয়ে বসে ছেলেদের হট্টগোলময় খেলা দেখি। শিরি খালা উপরের বাকল সরিয়ে আম-আঁটির ভেতরকার সাদা-সবুজ পাটা দুটো বের করে দুটোর মাঝখানে লালচে পাতা ঢুকিয়ে ভেঁপু বানিয়ে পেয়ারা ও আমাকে দান করে। তিনজনে মিলে ভেঁপু বাজাই আমারা। সামনের বাঁদিকটায় জঙ্গল ঘেঁষে এই বাড়ির মসজিদ। তার বারান্দা লাগোয়া জায়গায় বরফিকাঁটা বাঁশের বেড়ায় ঘেরা ছোট্ট বাগানে ফুলভরা বেলি ফুলের ঝাড়। পাশেই কঞ্চি বেয়ে হালকা সবুজ রঙা ঝিরিঝিরি পাতাসহ লতিয়ে চালে উঠেছে নাকফুলের মতো খুদে টকটকে লাল কুঞ্জলতা। ডানদিকে ডালপালা ছড়িয়ে একটা বৃদ্ধ বকুল গাছ। তলায় কিছু শুকনো ফুল। বার বাড়ির ডানপাশ দিয়ে পায়ে চলা পথটা সামনে এগিয়ে গিয়ে মিশেছে মূল সড়কের সঙ্গে। সেই সংযোগেই আছে একটা দাদার আমলের ঢাউস জামগাছ। নিচে ক্লান্ত পথিকের বিশ্রামের জন্য বাঁশ চিরে বেত দিয়ে বাঁধা একটা লম্বা মাচান। স্কুলের বয়স হবার আগে আব্রু বজায় রাখতে শাড়ি পেঁচিয়ে দেয়া রিকশায় আসার সময় এখানে নেমে পড়তাম আমি। ভাবতাম গল্পের সেই বানর কুমিরের গাছ এটা। কারণ বর্ষার পরে সড়কের নীচ থেকে নদী পর্যন্ত পানি থৈ থৈ থাকতো।
একসময় বিরক্ত হয়ে শিরি খালা আমাদের নিয়ে বৈঠক ঘরে ঢুকলো। শেষবার এই ঘরটায় ঢুকেছিলাম জাফরান খালার দুলা দেখতে। মস্ত ঘরটায় লোহাকাঠের বিশাল চৌকি পাতা। তাতে দুইটা ডবল শীতল পাটি বিছানো। এখন মেহমান নাই বলে বালিশ টালিশ দেখা যাচ্ছে না। ঘরে ঢুকতেই বাঁ দিকে মাথার উপর বড়সড় একটা সামনের দিকে ফুল মোটিফের কারুকাজ করা কালো কাঠের পালকি। আর ডানদিকে একটা ছোট পালকি যার মাথার ছাউনিটা নৌকার ছইয়ের মতো বেতবোনা। হালকা। এটাকে বলতো মাফা। নানু চিনিয়ে ছিলো। নানুর ফুফুরা নাইয়োরি হয়ে দুই বেহারার মাফায় চড়ে বাপের বাড়ি আসতো কাছাকাছি গ্রাম থেকে। বড়টা চার বেহারার। সেটায় শুধু নানুর বাবা চড়তেন।
এখন ব্যবহার নাই। তবু হাজার হলেও দাদার সম্পত্তি বলে কথা। এখন শুধু দেখন বিলাস। বড় পালকিটার কাঠ কুঁদে তোলা কারুকর্ম দেখতে দেখতে ভাবতে ভালো লাগতো যে, একদিন এটায় চড়ে কেউ একজন বেয়ারাদের ছন্দোময় হুমহাম শুনতে শুনতে একসময় সদরে পৌছে যেতো। দরজা বরাবর বড় জানালাটা দিয়ে প্রথমে সোজাসুজি তাকালে বেগুন ক্ষেত আর দূরে গোরখানা দেখা যায়। বাঁদিকে পুকুরের অর্ধেক আর ডানদিকে দৃষ্টিসীমা জুড়ে কচি কলাপাতা রঙের ধুধু ধানক্ষেত। বাঁদিকের পুকুর পাড় ধরে পায়ে চলা পথ ডানদিকের গোরখানা পেরিয়ে এগিয়ে গেছে ইস্কুলের দিকে।
চৌকির উপর বসে আমারা ইন্দারার বাঁধানো চত্বরের পাশ থেকে পেয়ারার কুড়িয়ে আনা তেঁতুল বিচি দিয়ে ঠোকাঠুকি খেলি। এই খেলায় পেয়ারা এতো পোক্ত যে সে প্রতিবারেই জিতে যেতে থাকে। এর মাঝখানে জমিলার মা এসে আমাদের গোসলের তাড়া দিয়ে গেল। ছেলের দল কখন যে হল্লাপিল্লা শেষ করে চলে গেছে বুঝতেই পারিনি। উঠতে উঠতে শিরি খালা বলে, জানস আমার জন্মের অনেক আগে দাদার জোয়ানকালে এই পালকি যখন কিনা হয় নাই, তখন তার আছিলো একটা ঘোরা। সেইটা নিয়া সারাদিন ঘুরাঘুরি। তো একবার সদরের কাম সারতে রাত আসলো। সবাই ঘুমায়ে যখন খেঁতা বালিশ তখন সে এক সুন্দরি মেয়েরে নিয়া বারিত ঢুকলো। অন্দর বৈঠকে ঘুমাইতো বুড়িবেওয়া। তারে উঠায়া বলল, ওরে এই ঘরে ঘুমাইতে দ্যাও। পরেরদিন সকালে দেখে সুন্দরি ফুরুৎ। বুড়িবেওয়া বলে, আমিতো ঘুমে। কখন গেছে কেম্নে কৈ। বারির কেউ কিছু জানেও নাই।
এরপরেই নাকি দাদায় পালকি কিনে। বুড়িবেওয়ার কতা এমুন সুন্দরী নাকি জন্মেও কেউ দেহে নাই। গুমের মদ্যে আসলে মানুষ দেকলো না আর কিছু কে জানে। এইসময় জমিলার মাকে দেউড়ি থেকে উঁকি দিতে দেখে আমারা জোরে পা চালাই।
#
আজ কাজের ফরমাশ আছে। বড় নানু জানিয়ে দেন আজ আর টইটই করা যাবে না। পুকুরপাড় থেকে দুইটা কচি মিষ্টি কুমড়া ও হেলেঞ্চা শাক তোলা আর লেবু এনে কেটে রাখা। সঙ্গে কাঁচা মরিচও লাগবে। জমিলার মা যোগ করলো যে, কাঁচামরিচ আগে দরকার। উঠান পার হয়ে রান্নাঘর বাঁয়ে রেখে পাতকুয়োর পাশ দিয়ে এগোলে পৌঁছা যায় পুকুরপাড়ের আগের ঝোরায়। পার হতে হয় সুপারি গাছের বাতায় বানানো পুল দিয়ে। তাতে গতরাতের বৃষ্টির স্বচ্ছপানি ধানক্ষেত মাড়িয়ে কলকল শব্দে গড়িয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে কী স্বচ্ছন্দে সাঁতরে আসছে ক্ষেতে জন্ম নেয়া হরেক রকম মাছের পোনা ।আর আমি তিন বছর ধরে চেষ্টা করেও ভয়ে দুই হাতের বেশি দূরে সাঁতরে যেতে পারলাম না। পুকুরের ঐ পাড়ে রমাদের বাড়ি ওঠার আগে একচিলতে জমিতে বড় নানার মরিচ ক্ষেত। রমাদের বাড়ির বাইরে একটা সাদা দুধেল গাই জাবর কাটতে কাটতে আমাদের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে মাথা ঝাঁকি দেয়। পাশেই মাচার উপর খড়ের পুঞ্জি। অনর্গল কথা বলি আমরা আর বাঁশের ছোট ঝাঁপি ভরে মরিচ তুলি। আশেপাশে ওড়াওড়ি করে মস্ত চোখের লাল পাখনার ফড়িং। কুমড়া তুলে পাতকুয়ার পাশের মস্ত লেবুবাগানে পৌঁছাই আমরা। লেবুগাছ তো না যেন বৃক্ষ। চারটা মোটা উঁচু উঁচু লেবুগাছ সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে উপরের দিকে উঠতে উঠতে এমনভাবে পরস্পরে জড়াজড়ি হয়ে গেছে যে কোনটা কার ডাল বুঝতে সারাদিন গবেষণা করতে হবে । কী মুশকিল! আমাকে মরিচঝাঁপি ধরিয়ে দিয়ে দুই বোন তরতরিয়ে উঠে গেল জটপাকানো সেই জটিল লেবু গাছে। হলুদ ও সবুজ রঙের লেবুগুলো গাছে চূড়ার ঝাঁকুনিতে ছন্দে ছন্দে দুলতে থাকে। ঘাগড়ার কোঁচর ভরে নেমে আসে দুই বোন ।
দুই বোন মিলে লেবু কাটে আর আমি বিচি ছাড়াই । সঙ্গে চলে ফিসফিসিয়ে গল্প ও হাসাহাসি। আমাদের সামনে নানুর কোমর সমান উঁচু একটা চৌকোনা মাটিনিকানো স্তম্ভের উপর মধ্যখানে ক্ষয়ে যাওয়া একটা মস্ত পাটা। একটু পরে জমিলার মা ওটাতে কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ বাটা শুরু করে। তার পায়ের কাছে লালুভুলু এসে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকে । আমরা কাজ শেষে উঠে দাঁড়াতেই সে পিছু ধরে।
যাবো শাক তুলতে। শিরি খালা আমাকে হুকুম করে, রান্নাঘরের বেড়া থেইকা চালনিটা পাড়। ওটা তুলতে গিয়ে চোখ পড়ে চালের বাতায় গোঁজা কী একটা । বাঁশের মাথায় চিকন লোহার তীক্ষ্ণ শিক গুঁজে বানানো। আঙুল তুলে দেখানোয় পেয়ারা বলে, পাড় ওটা । কোঁচ। পাড় দেখি মাছ ধরবো।
এক্কা দোক্কা খেলা মকশ করতে করতে আমরা আবার পুকুরের দিকে এগোই। কোনায় পৌঁছে শিরি খালা শাক তুলতে সরসর করে পাড়ের ঢাল ধরে নেমে যায় নিপুণ। পাড়ে বসে আমি পানির উপরে জলমাকড়ির ছোটাছুটি করতে থাকা ও ক্লান্ত হয়ে নাকফুলের মতো ছোট সাদা ফুলের লতার নিচে লুকিয়ে পড়া দেখি। ঐ পাড়ের আম গাছ থেকে একটা রঙিন মাছরাঙা শিকার ধরার অনবদ্য কৌশলে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়লে জলের নিখুঁত বৃত্তগুলো যেন ওর রঙের আভা নিয়ে এগিয়ে আসে আমাদের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে জলেভাসা হালকা ঢেউয়ে দুলতে থাকা হেলেঞ্চা শাকের ফাঁকে উঁকিঝুঁকি দেয় একটা মাছ। পেয়ারা ওঁৎপেতে থাকা অভিজ্ঞ শিকারীর মতো কোঁচ বাগিয়ে মাছটা লক্ষ্য করে নিঃশব্দে পাড় থেকে নামতে থাকে । এমন সময় শিরি খালা পাড় বেয়ে উপরে উঠে আসতে থাকায় সেই আলোড়নে মাছটা চকিতে সটকে পড়ে । পেয়ারা খালা ক্ষেপে ওঠে, তুই যতো নষ্টের গোড়া। না হইলে আইজ মাছটা ধরতে পারতাম । শয়তান ।
শিরি খালা পেয়ারাকে পাত্তা না দিয়ে মহা গৌরবে পাড়ে উঠে শাকের চালুনিটা আমাকে ধরিয়ে দিয়ে মরিচ ক্ষেতের দিকে হাঁটা ধরে। কাছে পৌঁছে চালুনিটা মাটিতে রেখে আমাকে বলে, আয় তোকে একটা জিনিস দেখাই। গাঁইগুই করতে করতে পেয়ারা খালা কোঁচটা মাটিতে গেঁথে গোঁ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। মরিচ ক্ষেতের পাশে পুকুরের ঢালে নরম সবুজ রঙের বড় বড় পাতার ঝোপালো একটা সতেজ লকলকে গাছ। কল্কি আকৃতির হালকা হলুদ রঙের পাঁচ ছয়টা ফুল আর সর্বাঙ্গে কাঁটাশোভন সবুজ ছোট ছোট বল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছটা । শিরি খালা সাবধানে একটা বল ছিঁড়ে নিয়ে উপরের দিকে ছুঁড়ে দেয়। তারপর নিচে নামতে থাকা বলটাকে মুঠো করা ডান হাতের উল্টা পিঠে পড়তে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে হাতটা চরকির মতো বাঁই বাঁই করে ঘোরাতে থাকে। ঘোরানো থামতেই মুঠোটা আমার নাকের সামনে এনে দেখায়। সেখানে চার ফোঁটা রক্ত ভাঙা থার্মোমিটারের অসহায় পারদের মতো টলমল করছে। আমি বুঝতে পারলাম না এটা কেমন খেলা। রক্তারক্তি কী করে খেলা হলো।
: বুঝলি এইটাকে বলে ধুতুরা। যদি কারুর মরার ইচ্ছা হয় তখন এই বলের ভিতরের বিচি বাটা খাইলে মানুষ মরে যায় । — কিন্তু খালা মানুষ মরতে চাইবে কেন? তুমিই তো বল যে মানুষের হাঁটা চলা খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে গেলেও বলে আল্লা আর কয়টা দিন বাঁচতে দাও।
: ধুর ছেরি। আরেকটু বর হইলে নিজেই বুজবি। দুনিয়া বর কটিন জায়গা। মানুষ কতো কষ্টের পরে জীয়ন্তে মরনেরে ডাকে। আমার অতো সময় নাই। বরং চল রমাদের বারিত যাই। পেয়ারা আমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে, মাসেক আগে জাফরান বুবাইর শ্বশুরবারির এক বৌ জামাই আর হৌরির সাতে কাইজ্জা কইররা ধুতরা খাইয়া মরছে। বারিত পুলিশ আইয়া জামাইরে ধইররা নিছে। অহনো ছারে নাই। শিরি খালা জাবর কাটতে থাকা গরুটার পাশ দিয়ে রমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। আমার পিছন পিছন আসে পেয়ারা। কথা বলে রাগটা মনে হয় কমেছে । লালুভুলু এতক্ষণ সঙ্গে থাকলেও কিসের শব্দে হঠাৎ লাফিয়ে উঠে তীব্র গতিতে ক্ষেত লাগোয়া ঝোপ লক্ষ্য করে ছুট দেয়।
উঠানে পা দিতেই কোত্থেকে যেন মুহূর্তে ছুটে এসে একটা মেয়ে পেয়ারাকে জড়িয়ে ধরলে দুজনের মুখই হাসিতে ঝলমলিয়ে ওঠে । শিরি খালা তার বন্ধুকে ডাক দিলে হৈ হৈ করে ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে রমা। আমি এই দুই বোন আর তাদের তিন ভাইকেও চিনি। ওদের উঠানটা লেপাপোছা তকতকে পরিষ্কার। ছোট ঘরের দাওয়ায় কপালে চন্দনের সুন্দর তিলক কাটা ঠান দিদি কোলের উপর জপের মালা নিয়ে বিড় বিড় করে কিছু আবৃত্তি করছে। বেড়াহীন চালার নিচে পিঁড়ি পেতে বসে রমার মা দুপুরের রান্নার যোগাড়ে ব্যস্ত ।
তবু আমার দিকে তাকিয়ে বলে, কিরে নাতনি বালা তো? – আমি বুলি খরচ না করে ঘাড় নেড়ে জবাব দেই। আমার দুই খালা আমাকে বেমালুম ভুলে যার যার বন্ধুর কোমর জড়িয়ে একজন ডানদিকে তো আরেক জন বাঁদিকে সরে গেল।
এই বাড়িতে আমি আগেও এসেছি। তাই উঠানের দক্ষিণের আম গাছ তলায় মোড়ায় বসে ডাবাতে গুড়ুক গুড়ুক টান দিতে থাকা ঠাকুর্দাকে পাশ কাটিয়ে একটা নিচু পেয়ারা গাছের ডালে খাঁচায় ঝোলানো বুলিফোটা ময়নার দিকে এগিয়ে যাই।
আমাকে দেখে ময়না সোৎসাহে খবর জানায়, ও মাইয়া …মেমান আইছে পিরি দেও। ও মাইয়া… মেমান আইছে পিডা দেও। তারস্বরে বারংবার একই কথা বলতে থাকে সে। আমি বলি, ময়না নতুন কোন কথা বল। বল হোয়াট ইজ ইওর নেম। আমার সঙ্গে বল । হোয়াট ইজ ইওর নেম? বল হোয়াট ইজ ইওর নেম? বল ….ময়না হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে বল বল। তারপর মানুষের মতো হেসে ওঠে। ওর সঙ্গে সঙ্গে আমিও হাসতে থাকি। অনেক্ষণ এই চলে আমাদের। শুনেছিলাম সকালে ঘুম থেকে উঠেই অনেকদিন ধরে ওদের সামনে বার বার একই কথা বলে যেতে হয়। অনেক সময় লাগে শিখাতে।
খানিক পরে প্রায় কাছাকাছি সময়ে দুই খালাই ফিরে আসে উঠানে। রমা আমাকে দেখিয়ে বলে, খারো ভাগ্নিরে লাড়ু খাওয়াই। একছুটে ঘরে ঢুকে একটা রেকাবিতে কতগুলি তিলের নাড়ু নিয়ে ফিরে আসে রমা। আমি হাত বাড়িয়ে দুইটা তুলে নিলে হৈ চৈ করে ওঠে, শরমাস কেন রে বেটি? বেশি কইররা নে। আমি জানি এইগুলা ঢাকায় পাওয়া যায় না।
নাড়ু খেয়ে শিরি খালা রমার কাছে পানি চায়। ঘরের ভেতরে থেকে রমা একটা ঘটি এনে দাওয়ার উপর দাঁড়িয়ে পানি ঢালতে থাকে। শিরি খালা প্রথমে হাত ধুয়ে নিয়ে দুই হাত আঁজলা করে পানি খায়। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসি আমারা। শাক নিয়ে বাড়ি ফেরার তাড়া আছে। ফিরতি পথে শিরি খালাকে জিজ্ঞেস করি, খালা ওদের পানির গ্লাস নাই ? গরুর মতো নাক ডুবিয়ে চুষে পানি খেলে যে? — অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে শিরি খালা । তারপর দুঃখ দুঃখ গম্ভীর গলায় বলে, ওদের ধর্মের মানা আছে।
পড়ুন ।। কিস্তি : ২ ।। ক্লিক করুন নিচের লিংকে