কত কিছু হারিয়ে গেছে। যেন হারিয়ে যাওয়াটাই নিয়ম। হারিয়ে যাওয়ার তালিকায় ঢুকেছে জীবন ও সংস্কৃতির বিভিন্ন রকম অনুষঙ্গ। হারিয়ে গেছে শিল্পকলাও। হয়তোবা পুরোপুরি লোপ পায় নি। অন্য কোনো আঙ্গিকে, অন্য কোনো অবয়বে টিকে আছে। ১৯৩৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছিল অজিতকুমার মুখার্জি রচিত বই Folk Art of Bengal। বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন স্যার উইলিয়াম রদেনস্টাইন। তিনি ‘জীবন্ত জনপ্রিয় শিল্পকলা’র পুনরুজ্জীবনের জন্য অপেক্ষা করার কথা বলেছেন।
অজিতকুমার মুখার্জি তাঁর বইটিতে বাংলার ঐতিহ্যিক শিল্পকলার একটি রূপরেখা উপস্থাপন করেছেন। তাঁর মতে, লোকশিল্প কোনো একক ব্যক্তির আকস্মিক সৃষ্টি নয়; একটি গোষ্ঠী, সম্প্রদায়ের যৌথ সৃষ্টি। সংস্কার, বিশ্বাস, ধর্ম ও যাদুর বিমিশ্রণ ঘটে লোকশিল্পে। Folk Art of Bengal বই থেকে দেখা যাক বাংলার হারিয়ে যাওয়া শিল্পকলার কয়েকটি দিক।
আলপনা
আলপনা এখনও আঁকা হয়। তবে আলপনা ছিল প্রতিটি বাড়ির উৎসব, পার্বণের অংশ। বিশেষত নারীরাই চালের গুঁড়ো দিয়ে বাড়ির উঠোন, মেঝেতে আলপনা আঁকতেন। নিচের আলপনাটির নাম তারাব্রত আলপনা। এটি সংগ্রহ করা হয়েছিল ফরিদপুর থেকে। আলপনায় ফুটে উঠত নানা রকম বৃত্তাকার, চারকোনা, ফুলেল নকশা।
লক্ষ্মীর সরা
এখনও বিভিন্ন বাড়ির দেয়ালে শোভা পায় লক্ষ্মীর সরা। কখনও ধর্মীয় কৃত্যের অংশ হিসেবে, কখনওবা সৌন্দর্যবোধের দৃষ্টিকোণ থেকে। লক্ষ্মীর সরা সমৃদ্ধি ও সাফল্যের প্রতীক হিসেবে বাড়িতে রক্ষিত হয়। প্রথম সরাটির উৎসস্থল ফরিদপুর, দ্বিতীয়টি ছিল ঢাকার।
মনসার ঘট
এক সময় দক্ষিণ বাংলায় সাপের দেবী মনসার পূজার ব্যাপক প্রচলন ছিল, ছিল মঙ্গলকাব্যের সমাহার; সেজন্য দরকার পড়ত মনসার ঘটের। ঘট সাজিয়ে মনসার পূজা করা হত। নিচে দেখতে পাচ্ছি দুটি মনসার ঘট। বাম পাশের ঘটের উৎস ফরিদপুর, দ্বিতীয় বরিশাল অঞ্চলের।
মুখোশ
মুখোশ এখন কাগজ ও প্লাস্টিকের বস্তু। কিন্তু এক সময় মুখোশ ছিল মাটি ও কাঠের। মুখোশ পড়ে গম্ভীরা পরিবেশনায় অংশ নেয়া হত। এছাড়া ছিল মুখোশ-নৃত্য। প্রথম মুখোশটি মাটির তৈরি। এটি ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে সংগৃহীত। দ্বিতীয়টি কাঠের মুখোশ; এটি ফরিদপুর অঞ্চল থেকে সংগৃহীত।
কাঁথা
কাঁথা এখনও ব্যবহৃত হয়; কিন্তু নকশা, আকার, আকৃতি ও উদ্দেশ্য বদলে গেছে। নকশি কাঁথা এখন ঘরের দেয়ালে ঝোলানোরও বস্তু। কিন্তু এক সময় কাঁথা ছিল একই সঙ্গে প্রয়োজন ও সৌন্দর্য। দস্তরখানা বলতে একটি বস্তু ছিল — যেটি বিছিয়ে অতিথিদের সামনে খাবার পরিবেশন করা হত। এটিও ছিল নকশাদার কাঁথার মতো। নিচের দুটি কাঁথা মূলত বালিশ ঢাকার কাজে ব্যবহৃত হত। বাংলা অঞ্চলেই লেখা হয়েছে নক্সী কাঁথার মাঠ। প্রথম কাঁথাটি যশোর অঞ্চলের, দ্বিতীয়টি বীরভূম অঞ্চলের।
দেবী মূর্তি
মাটি বা ধাতু দিয়ে দেব-দেবীর মূর্তি নির্মাণের ইতিহাস পুরনো। বাংলায় শিল্পকলাতেও ছিল এর প্রতিপত্তি। নিচের ছবিটি ব্রোঞ্জের তৈরি। মুর্শিদাবাদ থেকে সংগৃহীত।
মিনিয়েচার চিত্রকলা
নিচের দুটো ছবি মিনিয়েচার চিত্রকলা। এ ধরনের শিল্পকলা বাড়িতে শোভা পেত। এক দিকে ধর্মবিশ্বাসের টান, অন্য দিকে সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ; তাই মিনিয়েচার শিল্পকলা জায়গা করে নিয়েছিল বাঙালির অন্দরমহলে। নিচের প্রথমটি বৈষ্ণবী, দ্বিতীয়টি বৈষ্ণব। দুটিই বাঁকুড়া থেকে সংগৃহীত।


পটচিত্র
পটচিত্র ছিল বাংলা অঞ্চলের বিনোদনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পটচিত্রের পসরা জমে উঠত। কাপড়ের ওপর বা তুলোট কাগজে আঁকা হত ছবি। রাধা-কৃষ্ণ, রাম প্রমুখের গল্প উঠে আসত পটচিত্রে। নিচের প্রথম পটচিত্রটি বীরভূম অঞ্চলের কৃষ্ণলীলা বিষয়ক পটচিত্র। দ্বিতীয় পটচিত্রটি রামলীলা বিষয়ক। এটি হুগলি অঞ্চল থেকে সংগৃহীত।


মাটির পুতুল
মাটির পুতুলের এই আকৃতি এখন প্রায় দুর্লভ। শিশু কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মা। মাটির পুতুল ছিল খেলার সামগ্রী। কাপড় ও কাঠ দিয়েও তৈরি করা হতো পুতুল। নিচের পুতুলটি মাটির তৈরি। এটি সংগৃহীত হয়েছে ময়মনসিংহ থেকে।

মাটির ফুলদানি
মাটি দিয়ে কী না হতো! হাড়ি, পাতিল, থালা, খেলনা — এমনকি ফুলদানি। মাটির ফুলদানির কদর ছিল এক সময়। নিচে দেখা যাচ্ছে মাটির ফুলদানির প্রতিকৃতি।
