মোহাম্মদ আজম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক। তাঁর গবেষণা-এলাকা বেশ প্রসারিত। তিনি যেমন গবেষণা করেছেন রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে, আবার গবেষণা করেছেন জনপ্রিয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রধান প্রতিনিধি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়েও। সহজিয়ার পক্ষ থেকে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি আমরা। দীর্ঘ এই আলাপে উঠে এসেছে ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রনাথ, হুমায়ূন, চলচ্চিত্র ইত্যাদি। তিনটি পর্বে আমরা পুরো আলাপচারিতা প্রকাশ করব। আজ পড়ুন তৃতীয় পর্ব ও শেষ পর্ব।
সহজিয়া : গত কয়েক দিনে বিশাল বিশাল অভিযোগ দেখা গেল বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধেও। তাঁর জন্মের দুইশো বছর পূর্তি না হলে হয়তো জানাই যেত না যে, এখনকার বাঙালিও তাঁর ওপর ব্যাপকভাবে ক্ষুব্ধ। উনিশ শতকের বাঙালিও ক্ষুব্ধ ছিল। কিন্তু এখনকার বাঙালি বিদ্যাসাগরের ওপর এত চটে আছেন কেন?
মোহাম্মদ আজম : আপনি শুধু অভিযোগ করাটাই দেখলেন, প্রচুর প্রশংসাও যে প্রচুর লোক করল, তা দেখতেই পেলেন না – এটাকে কি আপনার নিজের দেখার সমস্যা হিসাবে বিবেচনা করব? আমরা যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে একটা ওয়েবিনার করে বিশুদ্ধ প্রশংসাকীর্তন করলাম। দুই বাংলায় অসংখ্য অনুষ্ঠানের বিশুদ্ধ প্রশংসা ছাড়িয়ে আপনার কাছে যে ফেসবুকে অর্বাচীন তরুণ-তরুণীদের একাংশের সমালোচনা বড় হয়ে দেখা দিল, মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে এটার ব্যাখ্যা যে কত মারাত্মক হতে পারে, সেটা হিসাবে নিয়েছেন কি? প্রাথমিক ধরনের একটা ব্যাখ্যা হবে এরকম: যে বিপুল লোক প্রশংসা করেছে, তাদের প্রশংসার বিষয় ও ভাষা আপনার কাছে এতই তুচ্ছ মনে হয়েছে, আর যে অল্প লোক নিন্দা করেছে, তাদের নিন্দার ভাষা আপনার কাছে এতটাই কার্যকর মনে হয়েছে যে, আপনি প্রশংসাটা ভুলে নিন্দাটাই মনে রেখেছেন।
বিদ্যাসাগর বড় বটগাছ। কিছু অকারণ প্রশংসা যেমন তিনি পাবেন, ঠিক তেমনি কিছু অকারণ নিন্দাও তাঁর ভাগ্যে জুটবে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই। তবে করোনার কারণে কি না জানি না, দুইশ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানগুলো খুবই ম্যাড়মেড়ে ছিল। নতুন কথাবার্তা পক্ষে বা বিপক্ষে শোনা যায়নি। আমি এখনো আশা করি, দুইশ বছরের মতো বড় উপলক্ষ ধরে বিদ্যাসাগর নিয়ে কাজের কিছু লেখালেখি হবে।
সহজিয়া : বাঙালি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী? একটু রসিকতা করেই বলতে চাই, বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে আপনার অভিযোগ কী?
মোহাম্মদ আজম : আমি যেহেতু পক্ষ-বিপক্ষের ব্যবসা করি না, মানে পদ্ধতিগতভাবে আমাকে করতে হয় না, ফলে বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধেও আমার কোনো অভিযোগ নাই। তবে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে যারা মিথের ব্যবসা করে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কিছু আছে। বিদ্যাসাগর অসংখ্য মিথের জন্ম দিতে পেরেছিলেন, এটাকে আমি তাঁর প্রশংসনীয় গুণ হিসাবে নেব, কিন্তু যারা সে মিথের খরিদ্দার তাদেরকে তো খুব উঁচু আসন দেয়া যায় না।
মিথগুলা খেয়াল করেন। কয়েকটা উল্লেখ করছি। এক. বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের জনক।– ভয়ংকর ক্ষতিকর মিথ। রীতিমত মিথ্যাচার এবং প্রতিষ্ঠিত একশটা তথ্যের খেলাপ। বিদ্যাসাগর নতুন চালু হওয়া গদ্যরীতির প্রথম গুরুত্বপূর্ণ লেখক – এ বিবৃতির সাথে ‘বাংলা গদ্যের জনক’ কথাটার যোগ কোথায়? দুই. বিদ্যাসাগর বাংলা বিরামচিহ্নের ব্যবহার শুরু করেছিলেন।– বাজে কথা। শিশিরকুমার দাশ দেখিয়েছেন, যাঁরা কাজটা শুরু করেছিলেন, বিদ্যাসাগর তাঁদের একজন মাত্র। তিন. বিদ্যাসাগর সর্ববিদ্যার পণ্ডিত ছিলেন।– কথা ঠিক নয়। পশ্চিমা শিল্পসাহিত্যে মধুসূদনের তুল্য বা চিন্তা ও দর্শনে বঙ্কিমচন্দ্রের তুল্য বিদ্যার পরিচয় বিদ্যাসাগরের লেখালেখিতে পাওয়া যায় না। চার. বিদ্যাসাগর ইংরেজবিরোধী ছিলেন।– খুব বাজে জাতীয়তাবাদী মিথ। উনিশ শতকে ইংরেজ-বিরোধিতার কোনো ব্যাপার বাঙালি ভদ্রলোক সমাজে ছিল না। তারচেয়ে বড় কথা, ইংরেজ সরকারের প্রত্যক্ষ মদদ ছাড়া বিদ্যাসাগর তাঁর কাজকর্মের একটাও করতে পারতেন না।
কেন বিদ্যাসাগর নিয়ে এত মিথ তৈরি হয়েছিল, সেটা নিয়ে আলাদা গবেষণা হতে পারে। তবে তাঁর কৃতিত্ব তাতে লঘু হয় না। তাঁর প্রধান কৃতিত্ব বোধ করি চারটা। এক. গদ্যের এক সাধু মূর্তি প্রণয়নে সাফল্য। দুই. বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষার প্রায়োগিক দিকগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন। তিন. সমাজসংস্কার আন্দোলনের সাফল্যের মধ্য দিয়ে ‘আধুনিকায়নে’র একটা গভীর মনস্তাত্ত্বিক আনুকূল্য সমাজে তৈরি করা। চার. এমন একজন ভদ্রলোক হিসাবে নিজেকে তৈরি করা, ইংরেজ আমলের বিস্রস্ত কালে যাকে ব্যক্তিত্বে ও তৎপরতায় স্থিতধী মানুষের নমুনা হিসাবে সমাজ পড়তে পারবে।
আমি আগেই বলেছি, আমি পক্ষ-বিপক্ষের ব্যবসা করি না। তাহলে করি কী? আমি পর্যালোচনা করি। পটভূমির মধ্যে স্থাপন করে ব্যক্তিকে বুঝতে চাই এবং মিথকে অতিক্রম করতে চাই। যদিও জানি, মিথ ছাড়া কিছুই টিকে থাকে না। বিদ্যাসাগর কলকাতার লিবারেল মডার্নিটির (কথাটা পার্থ চট্টোপাধ্যায় থেকে ধার করা) জমানার মানুষ। ওই সময়ের প্রয়োজন মেটানোর জন্য তিনি সবচেয়ে বেশি যোগ্য প্রমাণিত হয়েছেন। কাজেই তাঁর গুরুত্ব অস্বীকার করার জো নাই। দরকারও নাই। তবে মিথকে প্রশ্রয় দেয়া ‘গুরুত্ব অস্বীকারের’ চেয়েও ক্ষতিকর। এ ব্যাপারে আমার একটা আলোচনা অনুষ্ঠানের লিংক আগ্রহীদের জন্য এখানে সংযোজন করে দিচ্ছি: https://www.facebook.com/Boiporua123/videos/2722779047986578/?t=38
সহজিয়া : বিদ্যাসাগরের ওপর একটি দোষ চাপানো হয় যে, তিনি বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতায়নের দিকে নিয়ে গেছেন? তাহলে কৃষ্ণদাস কবিরাজ কী করলেন শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত বইয়ে, কিংবা পদ্মাবতীতে আলাওল? এ ব্যাপরে আপনার বক্তব্য কী?
মোহাম্মদ আজম : আপনার প্রশ্নের প্রথম অংশ খুবই আপত্তিকর। মানে, আপনি যাদের বরাত দিয়ে কথাটা বলেছেন, তাদের কথায় আপত্তি জানিয়ে রাখছি। আপত্তিটা কি সংস্কৃতায়ন নিয়ে? না। একজন ব্যক্তিকে একটা প্রক্রিয়ার কর্তা হিসাবে উপস্থাপনার ভুলের ব্যাপারে আপত্তি করছি। ব্যক্তিকে সময়ের চেয়ে বড় করে তোলা চিন্তার ভয়ঙ্কর গরিবি। কলোনিয়াল কলকাতায় কলোনির স্বভাবদোষেই এ প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গিয়েছিল, যদিও প্রবণতাটা একটু ভিন্ন অর্থে কিন্তু জোরালোভাবে লিবারেল ডিসকোর্সেই আছে।
আমি আমার বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন ও রবীন্দ্রনাথ বইতে, অর্থাৎ পিএইচ ডি থিসিসে, এ বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করেছি। সংক্ষেপে কথাটা এরকম। মোটামুটি ১৭৭৮ সালের হ্যালহেডের ব্যাকরণ প্রকল্প থেকে শুরু করে উনিশ শতক জুড়ে বাংলা ভাষা সম্পর্কে কয়েকটি ধারণা রাজত্ব করছিল। যেমন, বাংলা সংস্কৃতের কন্যা, আরবি-ফারসি বাংলার সতীত্ব নষ্ট করেছে, বাংলা ভাষার বিশুদ্ধতা সংস্কৃতের নিরিখেই কেবল নিরূপিত হতে পারে। এর ফলে প্রণীত হয়েছে সংস্কৃতবহুল অভিধান, সংস্কৃত ব্যাকরণনির্ভর ব্যাকরণ, আর সংস্কৃতবহুল ও আরবি-ফারসিশূন্য বাংলা গদ্য। এগুলা বহু লোক লিখেছে। আমি আমার থিসিসে এ প্রক্রিয়ার নাম দিয়েছি ‘বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন’।
প্রশ্ন হল, তাহলে কৃষ্ণদাস কবিরাজ বা আলাওলের কাব্যে যে সংস্কৃত শব্দ পাই, তার নাম কী? এ প্রশ্ন তুলে আপনি আমাকে বেশ বিপদে ফেলে দিয়েছেন। এ কথা বলেই ফরাসি ভাষার অধ্যাপক ভাষাতাত্ত্বিক শিশির ভট্টাচার্য্য আমার থিসিসকে প্রথমে বক্তৃতায় এবং পরে লিখিতভাবে বাতিল করে দিয়েছিলেন। আসলে কিন্তু পুরানা সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার আর নতুন কলোনিয়াল সংস্কৃতায়ন সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। বিস্তারিত লেখার অবকাশ নাই। আপনার প্রশ্ন যেহেতু বিদ্যাসাগরকে নিয়ে, তার নিরিখেই জবাব দিই। শিশিরকুমার দাশ তাঁর ১৯৬৬-র কিতাব ‘আর্লি বেঙ্গলি প্রোজ’-এ জানাচ্ছেন, বিদ্যাসাগরের সাহিত্যিক কেতাবাদিতে সংস্কৃত শব্দের পরিমাণ গড়ে পঁয়ষট্টি থেকে সত্তর ভাগ। আরবি-ফারসি শব্দের পরিমাণ শূন্য। আবার বলছি, শূন্য। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকদের কারো কারো রচনায় সংস্কৃতের সংখ্যা শতকরা বিরানব্বই পর্যন্ত পাওয়া যায়। মধ্যযুগে এ সংখ্যা ছিল মোটামুটি ৩৩ শতাংশ। কিন্তু শতকরা হিসাব দিয়ে আসলে মূল ব্যাপার বোঝা যাবে না। আলাওলের কাব্যে ব্যবহৃত সংস্কৃত শব্দগুলো আসলে বাংলা শব্দ। কারণ, ওগুলোর চোদ্দ আনা মুখের বাংলায় আজো ব্যবহৃত হয়। কিন্তু উনিশ শতকে এই বিপুল পরিমাণ সংস্কৃত শব্দ আদতে মুখ থেকে নয়, বই থেকে লেখায় এসেছিল। এ পর্যন্ত পড়ে যদি আপনি সন্তুষ্ট না হন, তাহলে অন্য বইপুস্তক পড়তে হবে।
প্রশ্ন হল, এ ব্যাপারের জন্য কি বিদ্যাসাগরকে দায়ী করা যায়। একবিন্দুও না। এটা একটা বিরাট প্রসেস, ব্যক্তি যার কাছে সবসময়েই তুচ্ছ। কথাটা হল, বিদ্যাসাগরের লেখায় ওই সংস্কৃতায়িত কলোনাইজড গদ্যের ভালো, হয়ত সবচেয়ে ভালো, নমুনা পাওয়া যায়।
সহজিয়া : আপনার পিএইচডি গবেষণায় গবেষণা-জিজ্ঞাসা কী ছিল? এই কাজ বেছে নেয়ার কারণ কী? রবীন্দ্রনাথের ভাষাচিন্তা বিষয়ে আপনার নতুন কোনো প্রস্তাব আছে?
মোহাম্মদ আজম : উপনিবেশায়ন বলে একটা রিগোরাস প্রক্রিয়া বাংলা ভাষার ইতিহাসের একটা কালপর্বে শনাক্ত করা, এবং বি-উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ার প্রস্তাব হিসাবে রবীন্দ্রনাথের ভাষাবিষয়ক রচনা পাঠ করাই ছিল আমার গবেষণার লক্ষ্য।
আমার পিএইচ ডি পরিকল্পনা পুরোপুরি নিজের, গভীরভাবে নিজের; এবং আমার সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক অস্তিত্বের সাথে অন্তরঙ্গভাবে সম্পর্কিত। কলোনিয়াল এবং পোস্ট কলোনিয়াল ডিসকোর্স আমরা নব্বইয়ের দশকে ঢাকায় পেয়েছি। আর আমার নিজের ভীষণভাবে মনে হয়েছিল, এবং এখনো হয়, বাংলাদেশের বিদ্যমানতা ব্যাখ্যার জন্য কলোনিয়াল হিস্ট্রির মতো জরুরি কোনো উপকরণ আর নাই। লোকে রাষ্ট্রটাকে এবং এর জনগণকে ব্যাখ্যার কাছাকাছিও যেতে পারে না স্রেফ কলোনিয়াল প্রসেসের জ্ঞানের অভাবে। যাই হোক, আমি এ বিষয়টাকে আমার অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার অঙ্গীভূত করতে চাইছিলাম। ভাষার ব্যাপারে আমার বেশ বিস্তৃত পড়াশোনার জন্য আমি হুমায়ুন আজাদের ‘বাঙলা ভাষা’ দুই খণ্ডের কাছে ঋণী। সলিমুল্লাহ খানের পরামর্শে পড়লাম এবং অনুবাদ করলাম শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায়ের অতুলনীয় প্রবন্ধ ‘বেঙ্গলি স্পোকেন এন্ড রিটেন’ (আমার ‘বাংলা ও প্রমিত বাংলা সমাচার’ গ্রন্থভুক্ত)। রবীন্দ্রনাথের ভাষাচিন্তা সম্পর্কে বিশেষভাবে সচেতন হয়েছিলাম ফরহাদ মজহারের ‘রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রনাথ’ বই থেকে। আর ভাষার উপনিবেশায়ন সম্পর্কে অসামান্য আলাপ পড়েছিলাম দেবেশ রায়ের মহাগ্রন্থ ‘উপনিবেশের সমাজ ও বাংলা সাংবাদিক গদ্য’ পুস্তকে। ফলে থিসিসের পরিকল্পনা আনিসুজ্জামান স্যারের কাছে উপস্থাপন করতে বেগ পেতে হয় নাই। আমি আগে থেকেই জানতাম, কী করতে যাচ্ছি। প্রধান ব্যাপারগুলো আগেই পড়া বা জানা ছিল।
আমার বইটিকে কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথের ভাষাবিষয়ক আলোচনা হিসাবে পড়েছেন। বলেছেন, এ সম্পর্কে এটাই এ যাবত রচিত সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ ও গ্রহণযোগ্য রচনা। আমি এ ধরনের প্রশংসায় খুশি হই নাই। কারণ, আমি রবীন্দ্রনাথের ভাষাবিষয়ক মতামতের পরিচয় দেয়ার জন্য কোনো থিসিস করি নাই। তাঁর দুটি বইকে বি-উপনিবেশায়নের নমুনা হিসাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছি মাত্র। তাও থিসিসের তা একাংশ।
১৯০০ সালের আগে-পরে বাংলাভাষী ভদ্রলোক জনগোষ্ঠী নানা কারণে সম্প্রদায়গত দিক থেকে এবং ভাবগতভাবে সবচেয়ে লিবারেল সময় কাটিয়েছিল। রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিকভাবে এর বিচিত্র বহিঃপ্রকাশ আমরা পরিষ্কারভাবে দেখি। যদিও দুই বাংলার বিদ্বৎসমাজ মুখস্থ আধুনিকতা, প্রগতিশীলতা, অসাম্প্রদায়িকতা বিছড়াতে গিয়ে, আর সব পশ্চাৎপদতার জন্য মুসলমান সমাজকে দায়ী করতে গিয়ে, এ সম্পর্কে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ থিসিস সামনে আনতে পারে নাই। অন্য অনেক কিছুর মতো ভাষার ক্ষেত্রেও ওই লিবারেল চর্চা দারুণ ফসল ফলিয়েছিল। শ্যামাচরণ, রামেন্দ্রসুন্দর, হরপ্রসাদ ও রবীন্দ্রনাথ এ যুগের প্রধান তাত্ত্বিক বৈয়াকরণ। তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথই প্রধান। আমি এই সময়ের ভাষাবিজ্ঞানচর্চাকেই আমার থিসিসে বাংলা ভাষার বি-উপনিবেশায়ন হিসাবে ধরতে চেয়েছি। ভাবগতভাবে কোনো প্রকার মিল না থাকলেও ধারণাটা আমি আবিষ্কার করেছি হুমায়ুন আজাদের লেখা থেকে। আর আমার আগ্রহের আরেকটা মূল জায়গা ছিল, বর্তমান কালের বাংলাভাষা চর্চার দুরবস্থার ঐতিহাসিক কার্যকারণ খতিয়ে দেখা। এ কাজগুলো রবীন্দ্রনাথের লেখালেখি অবলম্বনে যৌক্তিকভাবে দেখানো সম্ভব হয়েছে।
সহজিয়া : বাংলা ভাষা নিয়ে আপনার কাজ আছে। আচ্ছা, মান বাংলা ভাষা বলতে আপনি আসলে কী বোঝাতে চান? লিংগুয়াফ্রাংকা হিসেবে মান বাংলা থাকলে বা না থাকলে সমস্যা কোথায়? সাম্প্রতিক কালের বাংলাদেশের মান বাংলার সঙ্গে ভাষা-রাজনীতির কী সম্পর্ক?
মোহাম্মদ আজম : আমি তো ঠিক ভাষাবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করি না, কাজ করি মুখ্যত ভাষার ইতিহাস ও ব্যবহারিক দিক নিয়ে। সেদিক থেকে ভাষার প্রমিতায়ন আমার কাজের খুব জরুরি এলাকা। প্রমিত বা মান বাংলা কথাটা ঢাকায় একটা গালি হিসাবে পুনরুৎপাদিত হয়েছে। আপনার প্রশ্নেও তার একটা দূরবর্তী ইশারা আছে। কিন্তু বাস্তবতা এর থেকে অনেক ভিন্ন। বলে রাখি, লিঙ্গুয়া-ফ্রাংকা কথাটাকে মান বা প্রমিত ভাষার বিকল্প হিসাবে ব্যবহারের সমস্যা আছে।
মান বা প্রমিত ভাষা একটা অত্যন্ত জরুরি অথচ নিপীড়ক ধারণা। ঠিক রাষ্ট্রের মতোই – বাই ডিফল্ট নিপীড়ক, কিন্তু বর্তমান কাল পর্যন্ত আপনি আসলে সারভাইবেলের আর কোনো উপায় জানেন না। আরো নানান অর্থে প্রমিত আর রাষ্ট্র সমান্তরাল ধারণা। এই ধরেন, লেখাপড়া, আইন-আদালত, অফিস, অনুষ্ঠান, মিডিয়া ইত্যাদি। যেখানে লিখতে হয়, সেখানে প্রমিত ছাড়া তো অসম্ভব। ঢাকায় যারা প্রমিত-বিরোধী, তারা এসব ভেবে-চিন্তে দ্যাখে নাই আসলে। ফলে তাদের প্রমিত-বিরোধিতা ঠিক আছে, কিন্তু লক্ষ্যটা অনিশ্চিত।
প্রমিত-বিরোধিতা ঠিক আছে – এ কথার মানে কী? মানে হল, আমাদের প্রমিতওয়ালারা ধইরা নিছে প্রমিত মানে এক বিশুদ্ধ, পবিত্র, অপরিবর্তনীয়, শুচিশুভ্র ভাষারূপ। মূর্খ হইলে যা হয় আর কী! আসলে প্রমিত দশের হক-মারা ভাষা। প্রভাবশালী গোত্রের মাস্তানির ভাষা। কেন্দ্রের ভাষা। আর সবসময়ের জন্য ভদ্রলোক সমাজের মুখের ভাষার সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে পরিবর্তিত হতে থাকা ভাষা। এটা কোনো অচল রূপ নয়। আমাদের এখানে প্রমিত নিয়া কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর মূল সমস্যা দুইটা। এক. প্রমিতায়নে অর্থাৎ মানরূপ নির্ধারণে ঢাকা বা বাংলাদেশ অঞ্চলের উচ্চারণভঙ্গিকে একবিন্দু পাত্তা না দিয়া কলকাত্তাই মাল এখানে চালানো হইছে। দুই. এটাকে ধইরা নেয়া হইছে অপরিবর্তনীয়। বাইবেল-বেদ-কোরান। ফলে প্রমিত-বিরোধীরা যে হাজারো তৎপরতা চালাচ্ছে ঢাকায় বা বাংলাদেশে, তা খুবই কাজের জিনিস। তবে, প্রমিত যে একটা জরুরি বর্গ, সে বোধ এসব তৎপরতায় খুব সুলভ নয়।
প্রমিত ভাষার পুরো ব্যাপারটাই ক্ষমতা-সম্পর্কের মামলা, সেদিক থেকে রাজনৈতিক তো বটেই। আপনি গাল চ্যাগাইয়া কলকাত্তাই উচ্চারণ করার চেষ্টা কইরা যাইতেছেন দশকের পর দশক – সাংস্কৃতিক রাজনীতির এরচেয়ে মোক্ষম উদাহরণ দুনিয়ায় খুঁজে পাবেন কি না, আমার তো সন্দেহ হয়।
সহজিয়া : সম্প্রতি ‘‘গরু’’ শব্দটির বানান নিয়ে বেশ তর্ক উঠেছে। গরু, না গোরু? – এই তর্ক করতে গিয়ে অনেকের বলদ হবার দশা। আপনি কি মনে করেন, সামগ্রিকভাবে বানানের প্রমিতকরণ সম্ভব? প্রমিতকরণের ভিত্তি কী হতে পারে? শব্দের ব্যুৎপত্তি? নাকি শব্দের বহুল প্রচলিত রূপ?
মোহাম্মদ আজম : ‘সামগ্রিকভাবে বানানের প্রমিতকরণ কি সম্ভব?’ – এ প্রশ্ন যে-আন্দাজের উপর ভিত্তি করে রচিত, সে আন্দাজটাকে আমি আরেকবার নাকচ করছি। এ প্রশ্নে ধরে নেয়া হয়েছে, প্রমিতকরণ মানে কোনো একক প্রস্তাব, যা অনন্তকাল চলবে। প্রমিতকরণ আদৌ এরকম কিছু নয়। এটা একটা ব্যবহারিক বর্গ, যে কথাটার অর্থ হল, আপনি একটা বানানরূপ প্রস্তাব করছেন, যা জনগোষ্ঠী একইভাবে ব্যবহার করবে, যাতে তার ব্যবহারগত সুবিধা হয়। তার মানে এ নয় যে, আপনি সকাল-সন্ধ্যা সেটা বদলাবেন। লেখার ভাষায় এরকম বদল করা যায় না। তাতে ভাষার কৌমার্যহানী হয় তা নয়, যেমনটা আমাদের আবাল ভাষাপ্রেমিকরা মনে করেন, তবে ব্যবহারিক নানা সমস্যা তৈরি হয়। ভাষা ব্যবহারিক জিনিস – অন্তত লিখিত ভাষা; ফলে ব্যবহারিক বাস্তবতাই ভাষার প্রমিতকরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হতে হবে।
ইদানীং ‘গরু’ নিয়ে, এবং এর আগে ‘ইদ’ নিয়ে যে জন-অসন্তোষ তৈরি হয়েছে, তাতে ব্যাকরণ বা বানান কতটা আছে জানি না; কিন্তু আমাদের প্রতিষ্ঠান বা বিশেষজ্ঞদের প্রতি অবজ্ঞা যে ষোল আনা আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। বাংলাদেশে প্রমিত ভাষারূপ নিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে, আগামী দিনগুলোতে, কারণ, খোদ প্রমিতের ধারণা এখানে যেরকম জুলুম তৈরি করেছে, ব্যবহারকারীদের সম্মতির তোয়াক্কা না করে অবৈধ পন্থায় প্রমিতরূপ নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে লোকে বুঝে-না বুঝে এর বিরোধিতা করেই যাবে। মাফ নাই।
বানান প্রমিতকরণের ভিত্তি এককভাবে ব্যুৎপত্তি বা উচ্চারণ বা প্রচলন বা আর কিছু নয়। বরং যুক্তি। যুক্তি লাগবে ব্যবহারকারীদের বশ করার জন্য। যু্ক্তি আসবে কিছুটা ব্যুৎপত্তি থেকে, কিছুটা উচ্চারণ থেকে, কিছুটা ব্যবহারিক দিক বা প্রচলন থেকে। সামগ্রিকভাবে ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক বড় কাঠামোর সাথে যেন সংঘাতপূর্ণ না হয়, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। আর নীতিগুলা এমনভাবে ধার্য করতে হবে, যেন এক নিয়মে যথাসম্ভব বেশি শব্দ আঁটে।
এখন, আমি যেগুলা বললাম, সেগুলা আসলে দুনিয়ার সব লোকই জানে। তাহলে বাংলা বানানের প্রমিতায়নে এত সমস্যা কেন? সমস্যাও সবাই জানে। সমস্যার নাম ‘আপনার শাশুড়ি’ সংস্কৃত, যে আপনার ছলাকলাপ্রবণ শালির মতো আপনাকে তার দিকে টানছে তো টানছেই, এই শালির আর বয়স বাড়ে না। সংস্কৃত দুনিয়ার সর্বকালের সেরা ভাষা। এ ভাষার কিছু প্রণালি-পদ্ধতি যদি আপনি বাংলা ভাষা বিধিবদ্ধকরণে ব্যবহার করতে পারেন, আপনার জন্য ভালো হওয়ার কথা। কিন্তু আপনার ধারণা হয়েছে, যা কিছু সংস্কৃতের তার সবই বাংলারও। ওই যে আপনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আলাওলের সংস্কৃত-ব্যবহার আর বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত-ব্যবহারে ফারাক কোথায়? প্রধান ফারাক হল এইখানে, যার মাশুল আপনি এখনো প্রতি মুহূর্তে দিচ্ছেন। মুশকিলটা হল, হিন্দির সাথে মিলালেই আপনি বুঝবেন, সংস্কৃতের সাথে বাংলা শব্দের ডেভিয়েশন অনেক বেশি। ফলে সংস্কৃত-অনুযায়ী আপনার আজকে মনে হচ্ছে একটা, কালকে আরেকটা। মিল নাই তো। খুব সিলি একটা উদাহরণ দিই। ‘বন’ শব্দটি সংস্কৃত ধরে নিয়ে আপনি ব্যাকরণ সাজিয়েছেন। কিন্তু ধ্বনিগতভাবে বাংলা শব্দটিতে আপনি সংস্কৃতের উচ্চারণ আনতেই পারবেন না। অথচ সন্ধি করতে গিয়ে আপনি লিখছেন ‘বন + অঞ্চল = বনাঞ্চল’। সূত্র কী? অ + অ = আ। তো, ‘বন’ শব্দে ‘অ’ কোথায়? কেন – আপনার শাশুড়ির আঁচলে! এই উদ্ভট বস্তু আপনি বাংলা ব্যাকরণের নামে গত দেড়শ বছর ধরে এখানে চালাচ্ছেন।
কেন? ব্যাপারটা তো সবাই জানে। সবাই। তাহলে? আগে আপনাকে আমি বাংলা ভাষাচর্চার লিবারেল যুগের কথা বলেছিলাম, তার পরে এসেছিল রক্ষণশীল জমানা। বুঝতেই পারছেন, হিন্দু-মুসলমান বিরোধ, দাঙ্গা, পাকিস্তান আন্দোলন ইত্যাদি। বাংলা বিভাগের অ্যাকাডেমিগুলা আপনাকে শেখাবে, তখন মুসলমানরা ‘স্বাতন্ত্র্যবাদী’ হইছিল। ডাহা মিথ্যা। এরা স্বাতন্ত্র্যবাদী হয় নাই তা না। কিন্তু বাঙালি হিন্দুর স্বাতন্ত্র্যবাদ ছিল এর দশগুণ। কথাটা জয়া চ্যাটার্জির থিসিসের আগেও আমরা জানতাম। জয়ার (জয়া আহসান নয়) পরে আমরা খুব আরামে বলতে পারছি। তো, ওই স্বাতন্ত্র্যবাদের জমানায় বাংলায় সংস্কৃত আবার নতুন করে আসর গড়েছিল। এই ধারার পরিণতি আপনি দেখছেন সুনীতিকুমারের ১৯৩৯-এর ‘ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’-এ। আপনি গত কয়েক দশকে বাংলা ভাষার প্রমিতায়নে যেসব সংকট দেখতে পাচ্ছেন, তার বেশিরভাগের গোড়া আছে এই সংস্কৃতায়িত ব্যাকরণে, এবং লেইট সুনীতিকুমারের সংস্কৃতায়িত অন্য সিদ্ধান্তগুলোতে। ‘গরু বনাম গোরু’ সংকট তার এক উদাহরণ মাত্র।
বলে রাখি, বাংলা একাডেমির সাম্প্রতিক সংশ্লিষ্ট প্রকাশনাগুলো আগের চেয়ে বেশি সংস্কৃতায়িত হয়েছে। এর কারণ বোধ হয় এই যে, ভাষার তথ্য-উপাত্ত ছেনে নতুন নিয়ম বা সূত্র চালু করার জন্য যে হেকমত, হিম্মৎ আর হেডম দরকার হয়, ঢাকার লোকজনের তা আদতে নাই। ফলে ‘শুদ্ধতা’র বরাত হিসাবে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতায়িত বিধিগুলো চালানো ছাড়া তাদের আর উপায় নাই। অন্যদিকে কলকাতার বাংলা পড়াশোনা, ওদের প্রতিভাবান লোকেরা মূলত ইংরেজিতে লিখলেও, এখনো আমাদের চেয়ে ঢের ভালো। কিন্তু ওরা বাঙালি কম্যুনিটি হিসাবে নানামাত্রিক অস্তিত্বসংকটে ভোগার কারণেই সম্ভবত রক্ষণশীলতাকেই শিরোধার্য করেছে। ফলে যে কথা একশ বছর ধরে প্রায় সব লোকই বলে আসছে, বাংলা ভাষার প্রমিতায়ন প্রশ্নে সে কথাগুলোর বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
সহজিয়া : বাংলা একাডেমি শব্দকে শ্রেণিকরণের মাধ্যমে প্রমিত রূপ নির্ধারণ করেছে। কিন্তু কোন শব্দ তৎসম, কোনটি অতৎসম, কোনটি মিশ্র – ভাষাবিশেষজ্ঞের পক্ষেও কি সবসময় এসব মনে রাখা সম্ভব? বানানের প্রমিতকরণের ব্যাপারে আপনার কোনো প্রস্তাব আছে?
মোহাম্মদ আজম : আপনি বাংলা একাডেমিকে যথেষ্ট বেশি মূল্য দিয়েছেন। আসলে বাংলা একাডেমি তেমন কিছুই করে নাই। কলকাতার নিয়মগুলাই একটু এদিক-সেদিক করে চালিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যাচর্চা এবং অভিনিবেশ ওই মানে কখনোই ছিল না যে, আপনি ভাষার কোনো মৌলিক বিধিবদ্ধকরণের উদ্যোগ নেবেন। আর এখনকার অবস্থা তো ভয়াবহ। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গিটা এ ক্ষেত্রে আরো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কারের কোনো কথা তুললেই দেখবেন অনেকে চিৎকার শুরু করেছে – পাকিস্তান আমলে বাংলাভাষা-বিরোধী ষড়যন্ত্র ইত্যাদি। এ কথার উপর মোটামুটি ষাট-সত্তর বছর চলে গেল। গরিব মানুষের এরকমই হয়।
আপনি সংস্কৃত-অসংস্কৃত বলে যে কথা তুললেন, সেটা শুধু বানান নয়, গোটা বাংলা ব্যাকরণ এবং বাংলা ভাষার প্রমিতায়নের গোড়ার গলদ। আপনি ব্যাকরণের যে কোনো অধ্যায় উল্টান। দেখবেন, সংস্কৃত নিয়ম আর অসংস্কৃত নিয়মে অধ্যায়টি বিভাজিত। বোঝার উপায় নাই, আপনি বাংলা ব্যাকরণ পড়ছেন, নাকি সংস্কৃত ব্যাকরণ। কারণ, সব ক্ষেত্রেই সংস্কৃত নিয়মগুলা আবার শুরুতে থাকে। এখন, ধ্বনিতত্ত্বের একটা প্রাথমিক কিন্তু সর্বব্যাপি নিয়ম হল, কোনো বিদেশি শব্দ আসলে ভাষায় থাকে না। কারণ, অন্য ভাষার যে কোনো শব্দ ধ্বনিতাত্ত্বিক-রূপতাত্ত্বিক বদলের মধ্য দিয়েই গ্রহীতা ভাষায় প্রবেশ করবে। বাংলা ব্যাকরণে কিন্তু সংস্কৃতের ক্ষেত্রে এ নিয়ম মানার রেওয়াজ নাই। সংস্কৃতের সাথে সংশ্লিষ্ট শব্দগুলোর জন্য আপনাকে সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম মানতে হবে। কেন? ওই যে বললাম, শাশুড়ি। মায়ের ইজ্জত যাক, শাশুড়িরটা রক্ষা করতেই হবে। বাংলা ভাষার প্রমিতায়ন প্রকল্পকে বলতে পারি, শাশুড়ির ইজ্জতরক্ষা প্রকল্প।
বাংলা একাডেমির প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ প্রথম কোনো ব্যাকরণিক প্রকল্প, যেখানে ‘বাংলা শব্দের উৎসগত শ্রেণিকরণ’ নামের কুসংস্কারাচ্ছন্ন অধ্যায়টি বাদ দেয়ার সাহস দেখানো হয়েছে। এ ব্যাকরণ সম্পর্কে একটা কথা বলে রাখি। এ প্রকল্প আসলে কলকাতার প্রকল্প। লেখক-তালিকা দেখলেও বুঝবেন, আর অধ্যাপক পবিত্র সরকারের লেখালেখির সাথে পরিচয় থাকলেও বুঝবেন। কলকাতার সংকীর্ণতার মধ্যে বোধ হয় এটুকও সম্ভব হচ্ছিল না। বাংলা একাডেমির টাকায় এখানে তা হল। বাংলা একাডেমিও খুশি। কারণ এর মধ্য দিয়ে ঘোষিতভাবে কলকাত্তাই প্রমিতের একচ্ছত্র প্রতিষ্ঠা ঘটল। আপাতত সে কথা থাক। ওই যে এ ব্যাকরণ তৎসম-অতৎসম অধ্যায় বাদ দিল, কিন্তু ব্যাকরণ থেকে বাদ দিল কি? না। হাস্যকর এবং বিস্ময়কর এক প্রস্তাব দিয়েছে তারা এ বাবদ। বলেছে, এ ব্যাকরণ বাংলা ভাষার অ-সংস্কৃত অংশই কেবল ডিল করবে। সংস্কৃতের নিয়মে গঠিত শব্দাবলির জন্য অন্য ব্যাকরণ বই, বিশেষত সুনীতিকুমার, দেখার পরামর্শ দিয়েছে বাংলা একাডেমির এই বৃহদাকার রাষ্ট্রীয় প্রজেক্ট। বোঝেন ঠ্যালা।
বাংলা ভাষার বিধিবদ্ধকরণের যাবতীয় সংকটের গোড়ায় আছে ওই সংস্কৃত ভাষা ও ব্যাকরণের কিম্ভূতকিমাকার অনুকরণ। আপনি অনুসরণ করবেন সংস্কৃতের অসাধারণ ব্যাকরণের প্রণালি-পদ্ধতি ও দর্শন। তা না করে আপনি একটা বিরাট জনগোষ্ঠীর জন্য কী মারাত্মক সমস্যা তৈরি করেছেন দ্যাখেন। স্রেফ আপনার প্রশ্নে উল্লেখিত তৎসম-অতৎসমের মতো অতি অপ্রয়োজনীয় ক্যাটাগরি দিয়ে আপনি পুরা জনগোষ্ঠীকে দৌড়ের উপর রেখেছেন। আর প্রত্যেক পাঁচ-সাত বছর পরপর আপনার মনে পড়ে যায়, ওই ওই শব্দগুলো সংস্কৃত নয়। বা সংস্কৃতে বিকল্প বানান পাওয়া যায়। বা মিশ্র শব্দ। ফলে বানানবিধির নতুন সংস্করণ। লে হালুয়া।
সহজিয়া : মাঝে মাঝে হঠাৎ করে একটি জিকির শোনা যায়, পূর্ব বাংলার বাংলা ভাষা আলাদা, বাংলাদেশের বাংলা ভাষা আলাদা। উভয় দাবির ক্ষেত্রে একটি মিল সম্ভবত এই যে, ভাষাবিচারের শুরুতেই ধর্ম ও সম্প্রদায়কেন্দ্রিক পরিচয়কে প্রধান বিবেচনা করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে এমন জিকিরও শোনা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশে প্রচলিত বাংলা আদৌ বাংলা ভাষা কি না! এই দুই জিকিরের পার্থক্য আছে কি? দুটি রাষ্ট্রে বাংলা ভাষার স্বতন্ত্র পরিচয় দাবি করার কারণ কী? সাংস্কৃতিক ও আর্থ-সামাজিক কারণে ভাষার স্বতন্ত্র স্বভাব তৈরি হবে, এটিই স্বাভাবিক নয় কি? বাংলাদেশের বাঙালি, চাকমা, গারো, উর্দুভাষী, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান – স্পিচ কমিউনিটি হিসেবে সবাই আলাদা বাংলার অধিকারী। বাংলাদেশের বাংলা ভাষাও তো হোমোজেনাইজড কিছু নয়। তাছাড়া এই মুহূর্তের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় ‘পূর্ব বাংলার ভাষাস্বাতন্ত্র্য’ বা ‘বাংলাদেশের স্বতন্ত্র বাংলা ভাষা’কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক পরিচিতি নির্মাণের তাগিদ তৈরি হওয়ার কোনো কারণ আছে কি?
মোহাম্মদ আজম : আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনি ‘সাংস্কৃতিক ও আর্থ-সামাজিক’ কারণে ভাষার পার্থক্য হওয়া উচিত বলেই মনে করেন, আর ‘ধর্ম ও সম্প্রদায়গত’ পরিচয়ে এই পার্থক্য হওয়াটা আপনার অপছন্দের। যদি আপনার প্রস্তাব মোটামুটি এরকম হয়, তাহলে আপনার সাথে বাংলাদেশের প্রভাবশালী ধ্যান-ধারণার মিল আছে। বাংলাদেশে ‘সেক্যুলার’ বলে এক বিখাউজ ধারণা চালু আছে, যার সাথে শব্দটির দার্শনিক ও রাষ্ট্রবৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণার কোনো সম্পর্ক নাই। ধর্মকে জুতমতো গালি দিতে পারলে বা নিদেনপক্ষে হিসাবের বাইরে রাখতে পারলেই সেক্যুলার হওয়া যায়। কিন্তু ভাইরে, যাকে আপনি ‘সাংস্কৃতিক ও আর্থ-সামাজিক’ বলছেন, সকল শাস্ত্রই বলছে, তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ধর্ম। আমি বলতে চাইছি, ভাষার আলোচনায় ধর্মও অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক।
তবে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার ভাষার ফারাক সামনে আনার জন্য ধর্ম ও সম্প্রদায়গত বর্গ সামনে না আনলেও চলে। এই ফারাক বহু আগে থেকেই স্বীকৃত। উনিশ-বিশ শতকের কলকাতার মশহুর ভাষা-আলোচকদের মধ্যে একজনও নাই, যিনি এই ফারাকের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন নাই। তাহলে বাংলাদেশে যদি এখন কেউ অন্যরকম দাবি করে থাকে, তবে আপনার উচিত তার ধান্দা নিয়া প্রশ্ন তোলা – বাংলাদেশের কেউ ধর্ম ও সম্প্রদায়গত বিবেচনা সামনে রাখছে কি না, বা পশ্চিম বাংলার কেউ অন্য কোনো ধান্দায় বাংলাদেশের ভাষাকে ডিমিন করছে কি না, সে উছিলায় পার্থক্যের প্রশ্নটাকে আড়াল করা নয়।
কারণ, পার্থক্যের প্রশ্নটা মুখ্যত ভাষাবর্গীয়, আর একাকার করে দেখার প্রশ্নটা মুখ্যত সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক। শেষোক্তটি কতটা রাজনৈতিক একবার বুইঝা দ্যাখেন। আপনি জিন্দিগিতে শুনবেন না, কেউ আসামের বাংলা, ত্রিপুরার বাংলা বা কলকাতার পশ্চিমে যে আরো অনেক বাংলা আছে, সেগুলা নিয়ে কথা বলছে। কথাটা কিন্তু কলকাত্তাই প্রমিত মাইনা নেয়ার বা না নেয়ার। এ এমন এক আবদার, যেটা দুনিয়ার কোথাও নাই। আমি অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা বা কানাডার ইংরেজির কথা বলছি না, কিন্তু ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড আর স্কটল্যান্ডের ইংরেজির যে ফারাক তা তো বাংলাভাষী পাশাপাশি ভূমিগুলোতে পাওয়া যাওয়ারই কথা। মধ্যপ্রাচ্যের আরবির যে ফারাক, তা বাংলার ক্ষেত্রে কেন ঘটবে না। এটা যে বা যারা অস্বীকার করতে চায়, তারাই বাজে পলিটিকসটা করছে। বিপরীত পক্ষ নানাভাবে ওই বাজে পলিটিকস ঠেকানোর চেষ্টা করছে মাত্র।
সত্যি বলতে কী, এ ধরনের একটা ব্যাপার যে আমাদের বিরাট মুল্লুকে এতদিন ধরে এতটা অমীমাংসিত অবস্থায় আছে, তার প্রধান কারণ, আমরা বাংলা ভাষার সম্ভাবনার আলাপে এখনো ঢুকতেই পারি নাই। আপনি চিন্তা করেন, পঁচিশ-ত্রিশ কোটি মানুষের একটা ভাষা – রাষ্ট্রীয় কাজে আভিজাত্যের সাথে ব্যবহৃত হয় না, উচ্চশিক্ষায় কোনো ব্যবহার নাই, কার্যকর আইনের চর্চা নাই, বিজ্ঞান-দর্শন-প্রযুক্তিচর্চায় ঢুকেই নাই। এর আর্থিক সম্ভাবনার পাইর পাইও এখনো ব্যবহৃত হয় নাই। বিদ্যাজাগতিক সম্ভাবনার দিকে যায় নাই। সে কী করছে? ভাষার শুদ্ধতা, সতীত্ব, পবিত্রতা এসব রক্ষা করছে! ভাষার ঈষৎ ভিন্ন ভিন্ন মানরূপ ভাষার কোনোপ্রকার ক্ষতি করেছে, এমন কোনো প্রমাণ দুনিয়ায় নাই। কেবল এই বাংলা মুল্লুকেই আপনি জুজুর ভয়টা কার্যকর দেখতে পাবেন।
সহজিয়া : হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য নিয়ে একটি বই লিখেছেন আপনি। বইটির শিরোনামে ‘পাঠপদ্ধতি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এক্ষেত্রে আপনার পাঠপদ্ধতিটি কী?
মোহাম্মদ আজম : বইটির নাম ‘হুমায়ূন আহমেদ : পাঠপদ্ধতি ও তাৎপর্য’। এখানে ‘পাঠপদ্ধতি’ শব্দের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুলে আপনি মোক্ষম জায়গায় ঢিল ছুঁড়েছেন। কারণ, নামের মধ্যে শব্দটি জুড়ে দিয়ে আমি একটা প্রাথমিক ঘাত তৈরি করতে চেয়েছি। প্রধানত আমার পাঠপদ্ধতির নয়, হুমায়ূন পড়ার পদ্ধতি সম্পর্কে আমার প্রস্তাবের।
আমার ধারণা, নানা কারণে – বেশ কিছু কারণ আমি বইতে ব্যাখ্যা করেছি – হুমায়ূন এখানে ‘ঠিকমতো পঠিত’ হয় নাই। এখানে সমালোচনার ধারা যেহেতু সজীব নয়, প্রতিষ্ঠান খুবই দুর্বল, ইউনিভার্সিটির সাহিত্যবিভাগগুলো মৃতপ্রায়, আর পত্রপত্রিকা প্রাতিষ্ঠানিকতা ও সম্পাদনার স্পর্শবঞ্চিত, ফলে সব সাহিত্যের পাঠই যেনতেন; কিন্তু হুমায়ূনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো গুরুতর হয়ে দেখা দিয়েছে। মানে, ঠিকমতো পঠিত না হওয়াটা। হুমায়ূনের লেখা প্রচুর লোক পড়েছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে কোনো ‘সাহিত্যিক’ বা ‘শিল্পগত’ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। না হলে আমার কিছু এসে যায় না। কিন্তু আমি নিজে তা দেখতে পাচ্ছিলাম বলেই অন্যদের জানানোর প্রয়োজন বোধ করছিলাম। সেক্ষেত্রে এ বইয়ে ‘পাঠপদ্ধতি’ কথাটি দুই অর্থে প্রযোজ্য।
প্রথমত, আমি হুমায়ূন পাঠের কিছু তরিকা প্রস্তাব করেছি। যেমন, হুমায়ূন জনপ্রিয় লেখক। ফলে জনপ্রিয় সাহিত্য বা সংস্কৃতি পড়ার যেসব দুনিয়াজোড়া তরিকা খুবই সুলভ, তার কোনো কোনোটা হুমায়ূনের ক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হওয়া উচিত। সাথে সাথে হুমায়ূন ‘সিরিয়াস’ মূলধারার লেখকও বটে। ফলে তার গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো বাছাই ও প্রভাবশালী পাঠের মধ্য দিয়ে অন্তত কিছু কিছু পাঠ বাজারে হাজির থাকা বাঞ্ছনীয়, যেটা অন্য সব লেখকের ক্ষেত্রে কমবেশি ঘটে থাকে।
আর এ কাজ করার জন্য আমি আমার বইয়ে যে ‘পদ্ধতি’ অনুসরণ করেছি, তাকেও এরকম দুইভাগে ভাগ করা যায়। একভাগে পড়বে জনপ্রিয় লেখক হিসাবে হুমায়ূন পাঠের কতগুলো ইশারা। অন্যদিকে পড়বে, হুমায়ূনের প্রধান বেশ কিছু রচনা নানাভাবে চিহ্নিত করে সেগুলোর নানামাত্রিক পাঠ হাজির করা। আমি হুমায়ূনের লেখায় কতগুলো ক্যাটেগরি চিহ্নিত করতে চেয়েছি, যেগুলো দিয়ে তার সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব বোঝা যাবে এবং লেখালেখির অন্য প্রভাবশালী ধারার মধ্যে তাকে আলাদা করে চিনে নেয়া যাবে। যেমন, মুক্তিযুদ্ধ বা গ্রামের মতো বর্গে আমি আলাদা অধ্যায় সংযোজন করেছি, যেগুলো অন্য অনেক লেখকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, আর সে কারণেই খানিকটা তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে একজন লেখকের মূল্যায়ন করা অপেক্ষাকৃত সহজ। আসলে আমি হুমায়ূনকে গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসাবে উপস্থাপনের ‘পদ্ধতি’ আবিষ্কার করতে চেয়েছিলাম। এটা আমাকে করতে হয়েছে, কারণ, বাজারে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা প্রভাবশালী ছিল এবং আছে, আর অন্য অনেক লেখকের তুলনায় হুমায়ূনের ক্ষেত্রে কাজটা জটিল। কারণ, তাকে চেনা হয় জনপ্রিয় সাহিত্যিক হিসাবে, আর আমাদের অঞ্চলে জনপ্রিয়তাকে ‘সিরিয়াস’ শিল্প-সাহিত্যের বিপরীত বস্তু ভাবা হয়। এ জিনিস পালটে ফেলা খুব সহজ কাজ নয়।
সহজিয়া : আধুনিকতাবাদী, ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ ধারণায় বিশ্বাসী এবং মার্কসবাদী ধারার অধিকাংশ পাঠক, সমালোচক ও গবেষক হুমায়ূন আহমেদকে বাতিল করে দিতে চান। অ্যাকাডেমিক পরিসরে তাঁকে অপাঠ্য বলে বিবেচনা করা হয়। আপনি কেন পাঠ করতে গেলেন? হুমায়ূন আহমেদের লেখাপত্রকে ‘অ্যাকাডেমিক সনদপত্র’ দিলেন কেন? আমাদের দেশে অ্যাকাডেমিক লোকজনের জন্য জনপ্রিয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিশ্লেষণ তো হারাম বা মাকরুহ।
মোহাম্মদ আজম : আমাদের এখানে সিরিয়াস সাহিত্য বলতে বোঝায় এমন কিছু যেটা কেউ পড়ে না, জনজীবনের সাথে যার কোনো যোগ নাই; যাকে ঘিরে কিছু জারগন তৈরি হয়, এবং প্রধানত অধ্যাপকবৃন্দ জড়বৎ সেগুলা বিশেষ মৌসুমে আওড়ায়। যেমন তিরিশের চার কবি। খোন্দকার আশরাফ হোসেন ‘একবিংশ’ পত্রিকার বিষ্ণু দে আর সুধীন দত্ত [যদ্দুর মনে পড়ছে] সংখ্যা করেছিলেন। ওমা! দেখি কী, কয়েকজন অধ্যাপক শুধু লিখেছেন। আমি সম্পাদককে বললাম, এসব মৃত কবিকে নিয়া ক্যামনে চলবেন। আপনার মতো ডাকসাইটে সম্পাদক, ‘একবিংশে’র মতো নামি পত্রিকা – তাতেও জিন্দা কোনো লেখক অংশ নেয়ার তাগিদ বোধ করে নাই। কবি হিসাবে এরা কতটা মরা!
তো, আপনি জানেন, এদের নাম ফাটানো আর দু-এক ছত্র উদ্ধৃত করা ঢাকার সাহিত্যের পরম মোক্ষ।
জীবনের সাথে সাহিত্যের এই বিচ্ছিন্নতা সাধারণভাবে কলোনিয়াল আর বিশেষভাবে তিরিশি বামনমার্কা সাহিত্যতত্ত্বের পরিণতি। ফলে আপনি ঠাট্টা করে যা যা বলেছেন, তার সবই আমি আসলে কবুল করে নিচ্ছি। শুধু একটা কথা যোগ করি। জনপ্রিয় সাহিত্য বা শিল্পোৎপাদন পড়তে না পারাকে আমি কোনো সুপিরিয়রিটি নয়, বরং ইনফেরিয়রিটি বলেই মনে করি। কারণ, হাই আর্টের রমরমা বাজার ছিল আজ থেকে মোটামুটি শ-খানেক বছর আগে। এখন হাই আর্ট আগের মতো করে পড়া রীতিমতো প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাৎপদ চর্চা। আর জনপ্রিয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি পাঠের অসংখ্য তরিকা গত শতবর্ষে বিকশিত হয়েছে। এগুলো অভিজাত, প্রভাবশালী এবং কাজের জিনিস। এসব না জেনে আপনি যে বেঁচেবর্তে আছেন তাই তো ঢের। আবার শিল্প-সাহিত্য!
হুমায়ূনকে আমার সনদপত্র দেবার কিছু নাই। লেখক তো লেখার পরই মরে গেছেন। আমি মনে করেছি, হুমায়ূন পড়ার কাজটা অন্য যে কারো চেয়ে আমি ভালোভাবে করতে পারি। কারণ, আমি পঁচিশ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে হুমায়ূন পড়ছি। আমি তার ‘ভালো’ লেখাগুলো চিনি। বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে এবং সার্বিকভাবে বাংলাদেশ অধ্যয়নের দিক থেকে হুমায়ূনের সম্পূর্ণ অনাবিষ্কৃত অনেক তাৎপর্য্ও আমার তহবিলে আছে। তদুপরি, জনপ্রিয় সাহিত্যের গুরুত্ব আর তার পাঠপদ্ধতি সম্পর্কেও আমার কমবেশি ধারণা আছে, আগ্রহ আছে। কাজেই বলতে পারেন, কারো উসকানি বা ফুসলানি তো নয়ই, নিজের তাগিদে একপ্রকার ঝুঁকি নিয়ে আমি এ কাজে লিপ্ত হয়েছিলাম।
সহজিয়া : আমার মনে হয় হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে কেবল তাঁর সাহিত্য নয়, ‘কালচার ইন্ডাস্ট্রি’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ধরা যাক, একটি উপন্যাস ঈদ সংখ্যায় ছাপা হলো, কিছুদিন পর সেটি টিভি নাটকে রূপান্তরিত হলো, তারপর সেটি উপন্যাস আকারে বাজারে এলো। অর্থাৎ, মুদ্রণ ও ভিজ্যুয়াল মাধ্যম তাঁকে সহায়তা করল। একই জিনিসের বহুরূপী উপস্থিতি এবং পুনর্সৃষ্টি পাঠক-দর্শকের সংখ্যাকে বাড়িয়ে তোলে। যাঁরা পড়ছেন না, তাঁরা দেখছেন। যাঁরা দেখছেন না, তাঁরা পড়ছেন। এতে করে এমনিতেই হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টির ভোক্তা-সংখ্যা বেড়ে যায় না কি? আপনার কী মনে হয়? ‘কালচার ইন্ডাস্ট্রি’র উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের এই ছকটাকে আপনি আপনার বিশ্লেষণে এনেছেন?
মোহাম্মদ আজম : আপনি যে প্রক্রিয়ার বর্ণনা দিলেন তা তথ্যের বিচারেও ঠিক আছে, আর হুমায়ূন নিজেও বহুবার নানা ছলে কথাটা উৎপাদন-পুনরুৎপাদন করেছেন।
আমি এ ব্যাপারটাকে আমার বইয়ের বিষয় হিসাবে ইলাবরেট করি নাই। বিভিন্ন প্রসঙ্গে বার কয়েক উল্লেখ করেছি মাত্র। হুমায়ূনের সিনেমা নিয়া বইতে একটা আস্ত অধ্যায় থাকলেও সেটা পরিশিষ্ট আকারে আছে। মূল বইয়ের মূল প্রকল্পের অংশ হিসাবে নয়। তবে আমার আলোচনায় এমন কোনো অভিমত বা দৃষ্টিভঙ্গি নাই, যা থেকে মনে হতে পারে, আপনার কথিত প্রক্রিয়ার বিপরীতে আমার অবস্থান। এ ব্যাপারে এখানে শুধু আমার একটা কথা বলবার আছে।
আপনার কথা শুনে মনে হতে পারে, বাংলাদেশে এরকম বুঝি হরহামেশা হয়। আসলে তো তা নয়। পশ্চিমে হয়। সেখানে ‘ইন্ডাস্ট্রি’ আছে। বাজারের হরেক কিসিমের ছাকনি আছে। প্রক্রিয়ার মধ্যে লেখক তৈরি এবং পুশ করার ব্যাপার আছে। হুমায়ূন এরকম কোনো প্রক্রিয়ার ফসল নন। কারণ, বাংলাদেশে আদৌ এরকম কোনো প্রক্রিয়া নাই। অন্য সবকিছু বাদ দেন। একটা পত্রিকা বা প্রতিষ্ঠানই তো নাই, যা কোনো লেখক সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ কোনো মত তৈরি করবে। কাজেই হুমায়ূনের ক্ষেত্রে যা হয়েছিল তা তার নিজেকেই তৈরি করতে হয়েছে। আবার সে কথা বলাও যথেষ্ট নয়। তার দেখাদেখি অন্য যারা একই পন্থা নিয়েছে, বা ‘ইন্ডাস্ট্রি’ যাদেরকে একই পন্থার মধ্য দিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে, তাদের কারো ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা অ্যাক্ট করে নাই। তার মৃত্যুর পরেও এরকম বা কাছাকাছি কিছু আর দেখা যায় নাই। কারণ, ওই যে বললাম, এ ধরনের কোনো প্রক্রিয়া তো আদৌ চালু নাই। হুমায়ূনের সাফল্যের কারণেই বিপরীত কিছু মনে হয়েছিল।
সহজিয়া : সম্প্রতি আপনার একটি অনুবাদ-পুস্তক প্রকাশ পেয়েছে। সিনেমা বিষয়ক তিনটি প্রবন্ধের অনুবাদ এতে সংকলিত হয়েছে। কোন বিশেষ প্রণোদনা এই অনুবাদগুলোর জন্ম দিয়েছে?
মোহাম্মদ আজম : না, সত্য বলতে কী, কোনো প্রণোদনা তো নয়ই, এমনকি পরিকল্পনাও এগুলার পেছনে ছিল না। আপনি বলতে পারেন, এ বইয়ের উৎপাদন ব্যক্তিগততার বাইরে এক ধরনের সামাজিক-সামষ্টিক চর্চার প্রক্রিয়া হিসাবে দেখার যোগ্য। আমরা যা পড়ি বা যা নিয়ে ভাবি, তার তো একটা সামাজিক-সামষ্টিক পটভূমি থাকে। কিছু নাম আমাদের কানে আসে, কিছু মানুষকে আমরা বিশেষ বিশেষ চর্চা করতে দেখি। সজীব অ্যাকাডেমিতে ব্যাপারগুলো আরেকটু অন্যভাবে হয়। প্রকাশনা যেখানে বেশ কতকটা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়েছে, সেখানেও ব্যাপারগুলা হয়ত আরেকটু প্রত্যক্ষভাবে বাজারনির্ভর। কিন্তু আমাদের এখানে অনেক বেশি সামাজিক।
ওয়াল্টার বেনজামিনের লেখাটা ফরহাদ মজহার আমাকে যখন অনুবাদ করতে দেন, তখন আমি এর নামও শুনি নাই। স্টুয়ার্ট হল অনুবাদ করতে দিয়েছেন ফাহমিদুল হক। আমি এর আগে লেখাটা পড়ার চেষ্টা করেছিলাম আরেক বন্ধুর প্ররোচনায়। কিন্তু অনুবাদ করব ভাবিনি। জাঈদ আজিজ দিয়েছেন ত্রিন মিন হা-এর প্রবন্ধটি। এর নামও আমি আগে শুনিনি। আপনি বলতে পারেন, সবাই আমাকে অনুবাদ করতে দেয় কেন? আবার বলতে পারেন, যে যা বলে তা-ই কি আমি অনুবাদ করি? এর উত্তরে বলতে পারি, আমার হয়ত প্রাইমারি কিছু স্কিল আছে বলে অন্যরা মনে করে। আমি সিনেমা পছন্দ করি বলে কিছু প্রমাণ মিলেছে। আর পছন্দ হয় নাই বলে অনুবাদের অনেক প্রস্তাব আমি গ্রহণ করি নাই। তার মানেই হল, এ ধরনের কাজের এক ধরনের সামাজিক নেটওয়ার্ক থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই। আমার এ বইয়ের অনুবাদগুলার পেছনে যেমন ছিল।
অনুবাদগুলো তের বছর সময়ের ব্যবধানে করা। ছাপানোর আগে প্রতিটি, বিশেষত প্রথমটি, ব্যাপকভাবে বদলে ফেলেছি। তাতে হয়ত পাঠযোগ্যতা খানিকটা বেড়েছে। কিন্তু এ ধরনের একটি বই যে ছাপানো যায়, তাও আমাকে অন্যরাই ভাবতে প্ররোচিত করেছে। পাঠকেরা এবং প্রকাশকেরা। তবে সবার আগ্রহটা ছিল মুখ্যত বেনজামিনের প্রবন্ধটার প্রতি। আমি বাকিগুলা যোগ করেছি। এর মধ্যে একটা ব্যাপারে নিজের কিছু কৃতিত্ব দাবি করতে পারি। স্টুয়ার্ট হলের প্রবন্ধটা মূলত যোগাযোগ শাস্ত্রের তত্ত্ব হিসাবে লিখিত ও চর্চিত। আমি একে সিনেমা অধ্যয়নের জন্য জরুরি আলাপ হিসাবে উপস্থাপন করেছি। আমার ভূমিকা বলতে এটুকুই। আর হ্যাঁ, একটা ছোট ভূমিকা আছে। পরিচিতিমূলক। সেটাও কারো কারো কাজে আসতে পারে।
সহজিয়া : সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের সম্পর্ক নিয়ে আপনার ভাবনা কী? সাম্প্রতিক কালের বাংলাদেশে সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণের ঝোঁক কমে গেছে। কারণ কী? আশির দশকে প্রচুর সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে।
মোহাম্মদ আজম : সাহিত্যের সাথে চলচ্চিত্রের আত্মীয়তা যথেষ্ট বেশি, অন্য অনেক আর্টফর্মের তুলনায়। প্রধানত দুইটাই ন্যারেটিভ-নির্ভর বলে। আমি নিজে ব্যাপারটা টের পাই, বোধ হয় আগে একবার বলেছি, সাহিত্যের টেকনিক দিয়ে চলচ্চিত্র কতকটা পড়তে পারি বলে। মানে, এভাবে পড়া যেহেতু মোটামুটি সম্ভব হয়, কাজেই একটা গভীর আত্মীয়তা টের পাই। আমার ধারণা, চলচ্চিত্রকে হাই আর্টের আওতাভুক্ত করে হাই আর্টের সংখ্যা ছয়টা বলার রেওয়াজ চালু হওয়া উচিত।
এসব ব্যাপারে কথা বলার কোনো প্রকার বিদ্যাগত ভিত্তি আমার নাই। তবে একটা কথা জানিয়ে রাখি। সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র বিবেচনার ক্ষেত্রে সারা দুনিয়ায় সাহিত্যকর্মটি থেকে নির্মিত চলচ্চিত্রকে আলাদা করে বিবেচনার রেওয়াজ আছে। আমি এ রেওয়াজকে ঠিক মনে করি না। আমার ধারণা, চলচ্চিত্রে যেহেতু সাধারণভাবে বড় বাজেট লাগে আর বড় সাংগঠনিক ক্ষমতার দরকার হয়, সে কারণে সামগ্রিকভাবে ‘ক্রিয়েটিভিটি’কে লোকে খানিকটা ছাড় দিতে চায়। তা না হলে সাহিত্য থেকে যদি আইডিয়া, ইমেজ, চরিত্র, ঘটনা, জীবনদৃষ্টি সবই নেয়া হয়, যদি উল্লেখযোগ্য ট্রান্সক্রিয়েশন না থাকে, তাহলে শিল্প হিসাবে চলচ্চিত্রটি ওই মর্যাদা তো পেতেই পারে না, যে মর্যাদা নিজের আইডিয়া নিয়ে করা সিনেমার জন্য একজন সিনেমা-বানিয়ে পাবেন। কথাটা উল্লেখ করলাম এজন্য যে, সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র জনরাটি চলচ্চিত্রের ‘আর্ট হিসাবে ইনডিপেন্ডেনসে’র ক্ষতি করছে বলেই আমার ধারণা।
বাংলাদেশে সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র সম্পর্কে আপনি যে পরিসংখ্যান দিলেন, তা মনে হয় ঠিক নয়। আসল কথা হল, আগে সিনেমা এখনকার তুলনায় অনেক বেশি তৈরি হত। তার মধ্যে সাহিত্যনির্ভর সিনেমাও হত বড় বাজেটের। এখন তো এফডিসির সিনেমা নাই বললেই চলে। কিন্তু বিকল্প যেসব মাধ্যমে কিছু কিছু সিনেমা হয়েছে, ধরা যাক গত বিশ বছরে, তার মধ্যে সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র তুলনায় বেশি হবে বলেই আমার ধারণা। এগুলা বেশিরভাগ পাতে দেয়ার মতো নয় বলে আপনি খেয়াল করেন নাই সম্ভবত। পাবলিক যদি না দ্যাখে, তাহলে সেটা সাহিত্যনির্ভর হলেই কী, আর না হলেই বা কী!
সহজিয়া : আচ্ছা, আমরা আলোচনার জাল গুটিয়ে আনতে চাই। নতুন কী লিখছেন? প্রকাশনার কোনো পরিকল্পনা করেছেন?
মোহাম্মদ আজম : কয়েকটা বইয়ের পরিকল্পনা করছি। বাখতিনের উপর একটা পরিচিতিমূলক বই। আমার নিজের কথাবার্তা ছাড়াই। যারা বাংলায় প্রাথমিকভাবে পড়তে চায় তাদের জন্য। তালাল আসাদের নির্বাচিত সাক্ষাৎকারের অনুবাদ করছি আমরা কয়েকজন। বইটি হয়ত দুই-চার মাসের মধ্যে শেষ হবে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজনীতি নিয়ে একটা বইয়ের পরিকল্পনা করছি। বেশিরভাগ প্রবন্ধ লেখা আছে। গোটা দুই লিখতে হবে। আর লম্বা ভূমিকা, যেটা বাংলাদেশের গত প্রায় একশ বছরের সাংস্কৃতিক রাজনীতিকে ব্যবহার করে আমাদের রাষ্ট্রের বর্তমান সংকটকে ব্যাখ্যা করতে চাইবে। নজরুলকে নিয়ে একটা বই – অন্তত তিনটি প্রবন্ধ লিখতে হবে নতুন করে। আর একটা বই ‘উপনিবেশ উত্তর উপনিবেশ’ নামে। আমার প্রিয় প্রসঙ্গ। আগামী জুনের মধ্যে এগুলো শেষ করার পরিকল্পনা করছি। আরো দূরবর্তী পরিকল্পনা আপাতত তোলা থাকুক।
সহজিয়া : আপনার অনেক মূল্যবান সময় নিয়ে নিলাম। সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ও শুভকামনা জানাই।
মোহাম্মদ আজম : আমার সময় এমনিতে এত মূল্যবান কিছু নয়। তবে সময় লাগল অনেকটা। আপনি নেয়ার কারণেই হয়ত সময়টা খানিকটা মূল্যবান হল। আপনার জন্য শুভকামনা। আপনার পাঠকদের জন্যও। ‘সহজিয়া’র কার্যকর উন্নতি কামনা করি।
দ্বিতীয় পর্ব ।। নিচের লিংকে ক্লিক করুন
প্রথম পর্ব ।। নিচের লিংকে ক্লিক করুন
ভাইরে, গুরুর বক্তব্য শোনার (পড়া) পরে চোখে সর্শের ফুল দেখছি। কি লিখবো, কি লিখবো না মাথায় ঠুকছে না। পাঠ শেষে মদ্দা কথা যা বোঝলাম, বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আদতে মূর্খ তৈরীর কারখানা, শিক্ষকরা (আদোও যদি তা থাকে?) মূর্খ তৈরীর কারিগর আর ছাত্ররা এক একজন সফল মূর্খ হয়ে বেরুচ্ছে। গুরুকে নমস্কার।