মোহাম্মদ আজমের সঙ্গে আলাপ ।। দ্বিতীয় পর্ব

মোহাম্মদ আজম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক। তাঁর গবেষণা-এলাকা বেশ প্রসারিত। তিনি যেমন গবেষণা করেছেন রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে, আবার গবেষণা করেছেন জনপ্রিয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রধান প্রতিনিধি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়েও। সহজিয়ার পক্ষ থেকে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি আমরা। দীর্ঘ এই আলাপে উঠে এসেছে ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রনাথ, হুমায়ূন, চলচ্চিত্র ইত্যাদি। তিনটি পর্বে আমরা পুরো আলাপচারিতা প্রকাশ করব। আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব

 

সহজিয়া: তরুণ তাত্ত্বিক, সাহিত্য-সমালোচক ও বক্তা হিসেবে আপনার দারুণ খ্যাতি। তত্ত্বচর্চায় আপনার আগ্রহ কবে থেকে? কেন এই ধরনের চর্চার দিকে মনোযোগী হলেন?

মোহাম্মদ আজম: আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। আফসোস, আপনার কথিত ‘খ্যাতি’ আমার কোনো কাজে আসল না। আপনি জানেন বোধ হয়, আমি বয়সের বিচারে বাংলাদেশের পাবলিক ইউনিভার্সিটিগুলার প্রবীণ সহযোগী অধ্যাপকদের একজন। সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগের অন্তত একটা বোর্ডে আমাকে শূন্যহাতে বিদায় করা হয়েছিল। যাই হোক, প্রথম বাক্যটি নিশ্চয়ই আপনার প্রশ্নের মুখবন্ধ। আপনি আসলে চর্চার একটা ধরন সম্পর্কে আলাপ করতে চাইছেন। সেদিকটা গুরুত্বপূর্ণ।

 

‘তত্ত্বচর্চা’ কথাটা আমার কাছে আলাদা করে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। কারণ, যদ্দুর বুঝি, অ্যাকাডেমিক চর্চামাত্রই তত্ত্বচর্চা। কোনো পুরানা তত্ত্ব ন্যাচারালাইজড হয়ে আমাদের চিন্তার স্বাভাবিক প্রবাহের মধ্যে মিশে গেলে সেটাকে আর আলাদা করে চেনা যায় না, এই যা। কথাটার আরেকটা দিক আছে। আপনি চিন্তা করেন, এবং লেখালেখি করেন – এ কথার মানেই হল, আপনি তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে কোনো সাধারণীকরণ করতে চান। এটাই তো তত্ত্ব। ফলে তাৎপর্যপূর্ণ যে কোনো লেখকই আসলে তত্ত্বচর্চা করেন। তবে আপনি বোধ হয় বিশেষভাবে গত কয়েক দশক ধরে দুনিয়াজুড়ে টেক্সটপাঠের বা সংস্কৃতিপাঠের যেসব তরিকা আলাদা করে ‘তত্ত্ব’ নামে চিহ্নিত হচ্ছে, সেগুলোর কথাই বলছেন। সেদিক থেকে আমি বিনয়ের সঙ্গে বলব, এসব তত্ত্বে আমার আসলে উল্লেখযোগ্য কোনো দখল নাই। তবে, সম্ভবত অন্য বেশিরভাগের অবস্থা এতই খারাপ যে, আমার অল্প চর্চাই বেশ উল্লেখযোগ্য মনে হয়। কথাটা বলে রাখা জরুরি মনে করলাম, কারণ, এসব আলাপে দুনিয়ার স্টান্ডার্ডটা আমাদের মাথায় রাখতেই হবে।

 

এ বস্তু আমি আমাদের অ্যাকাডেমি থেকে পাই নাই। এখানে এ বস্তু নাই, আপনি জানেন। আমার একটা সৌভাগ্য এই যে, অ্যাকাডেমির বাইরে ঢাকার যে একটা গরিব কিন্তু সচল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ধারা আছে, গত অন্তত আড়াই দশক ধরে আমি তার সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পর্কিত। আমাদের জেনারেশনে প্রথমবারের মতো ঢাকায় ডমিন্যান্ট ডিসকোর্সগুলো সম্পর্কে ক্রিটিকেল মনোভঙ্গি বিকশিত হয়েছিল। প্রথমে ফরহাদ মজহার এবং পরে সলিমুল্লাহ খান, এবং আরো কেউ কেউ এ ধরনের কাজের পথ দেখিয়েছিলেন। আমি বলছি না যে, কাজটা খুব গুছিয়ে হয়েছিল। সচল ইউনিভার্সিটি না থাকলে সেটা কখনোই সম্ভব নয়। কিন্তু ঢাকার এ ধরনের চর্চাগুলোর প্রায় সবগুলোর সাথেই আমার পরিচয় ছিল। বলতে পারি, ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি ইত্যাদি ইস্যুতে মিথ-আক্রান্ত একটা নগরে বসতির চাপ সামলানোর জন্যই আমি ক্রিটিকেল থিয়োরিগুলোর কোনো কোনোটির প্রশ্রয় চেয়েছিলাম। আর ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল, পোস্ট মডার্নিজম, নিউ লেফট ঘরানা, নিউ হিস্টোরিসিজম আর বিশেষত সংস্কৃতি অধ্যয়নের বিচিত্র ধারা আমাদের কাল থেকে ঢাকায় একটু-আধটু [একটু-আধটুই] ছাপ ফেলতে শুরু করে। আগ্রহী ভোক্তা হিসাবে আমি সেগুলোর টুকরা-টাকরা নিশ্চয়ই ভাগে পেয়েছিলাম।

 

তবে ব্যক্তিগত চর্চার দিক থেকে আরো গোড়ার কারণ যদি জানতে চান তাহলে বলব, ডমিন্যান্ট ডিসকোর্সে বিরাগই মুখ্য কারণ। বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সার্বিক মিথ ও কুসংস্কারপ্রিয়তাই আমাকে কাউন্টার-ডিসকোর্সে কাজ করতে প্রণোদনা দিয়েছিল। আমার লেখালেখির যদি কোনো মূল্য থেকেই থাকে [দুই-চারজন কিছু তাৎপর্য দ্যাখে বলে আমাকে জানিয়েছে], আর আমার বক্তৃতার, [আমি পাবলিকলি অ্যাপিয়ার করি নির্লজ্জের মতো বেশি, এবং আমার অপ্রমিত উচ্চারণ ও অপ্রীতিকর ভঙ্গি সত্ত্বেও দুই-চারজন শ্রোতা আছে বলে প্রমাণ পাই] – সেটা মর্মের দিক থেকে ও ভঙ্গির দিক থেকে কাউন্টার ডিসকোর্সেরই প্রতিফলন।

 

সহজিয়া: বাংলা সাহিত্য যাঁরা পড়ান, তাঁদের বেশির ভাগ সমালোচক ও গবেষক ভুলভাবে তত্ত্বচর্চা করে থাকেন। তত্ত্বভীতি ও তত্ত্বপ্রীতি দুটিই আছে। কথায় কথায় ফ্রয়েড, অস্তিত্ববাদ, মার্কসবাদ প্রভৃতি ব্যক্তি ও তত্ত্বনাম নিতে পছন্দ করেন অনেকে। কেউ কেউ মনেই করেন যে, কোনো একটি বিশিষ্ট তত্ত্বকাঠামোতে ফেলে সাহিত্যকে পাঠ করাই সাহিত্য-সমালোচকের কাজ। অনেকে আছেন একই গবেষণায় ফ্রয়েড, লাঁকা, সার্ত্রের প্রসঙ্গ নিয়ে আসছেন। সঙ্গে খানিকটা পোস্ট-মডার্নিজম, পোস্ট-কলোনিয়ালিজম। দেরিদা আর ফুকো হলে আরেকটু ভালো হয় বলে মনে করেন কেউ কেউ। কিন্তু কার বক্তব্য কেন, কোন পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োগ করা হচ্ছে তার সুস্পষ্ট পটভূমি নেই। এ বিষয়ে আপনার ভাবনা কী?

মোহাম্মদ আজম: আপনি একটা পরিস্থিতির সুন্দর বিবরণ দিলেন। এ অবস্থা আমিও দেখছি, আর দেখে আমার পুলকিত হওয়ার কোনো কারণ নাই। তবে এজন্য বিশেষভাবে বাংলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দায়ী করাতে আমার আপত্তি আছে। ব্যাপারটা একদিকে ছোটলোক সংস্কৃতি অর্থাৎ গরিব মানুষের চিন্তাধারা অর্থাৎ উপনিবেশিত চিন্তাধারার ফল; অন্যদিকে প্রায় না-থাকা অ্যাকাডেমির বহিঃপ্রকাশ। বাংলা নয় শুধু, অন্য সব বিভাগেই আপনি একই মাল পাবেন। তবে সাহিত্যের ক্ষেত্রে তার একটা ভিন্ন মাত্রা আছে।

 

লিবারেল জমানায় সাহিত্য বিভাগগুলো পশ্চিমে যে পরিমাণ পাত্তা পেত, নিও লিবারেল জমানায় স্বভাবতই সে পাত্তায় টান পড়েছে। ‘বাজারে’ নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা অটুট রাখার মরিয়া ‍চেষ্টায় দুনিয়াজুড়ে বিশেষত ইংরেজি বিভাগগুলো একদিকে তত্ত্বের চর্চা বাড়িয়েছে, অন্যদিকে সে তত্ত্বে সামাজিক বিজ্ঞানকে অন্তত অংশত আওতাভুক্ত করে নেবার চেষ্টা করেছে। গত কয়েক দশকে দুনিয়ার বাজারে সাহিত্যতত্ত্বের রমরমার এটা অন্যতম প্রধান কারণ। এখন এই পরিপ্রেক্ষিতের সাথে বাংলাদেশের অ্যাকাডেমিকে মিলিয়ে দ্যাখেন – কিসের প্রণোদনায় এখানকার লোকজন এত পরিশ্রম করবে? ইউনিভার্সিটিতে বা সমাজে বা ইনস্টিটিউশনে গুণবিচারের কোনো প্রক্রিয়া কি জারি আছে? আর এ কাজ তো শুধু বাংলা বিভাগের নয়, ইংরেজিসহ অন্য যে সাহিত্যবিভাগগুলো আছে, তাদেরও। তারাই বা কোন ঘোড়ার ডিম পাড়ছে? কাজেই এ ব্যাপারে বাংলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আমি খানিকটা রেয়াত দেয়ার পক্ষপাতী। মানে, গরিব হিসাবে আর কী!

 

এসব কাজ ইউনিভার্সিটিতেই হয়। হওয়ার কথা। বাংলাদেশে ওই বস্তু নাই বলে, বিশেষত নব্বইয়ের দশকের পরে বইপুস্তক, মিডিয়া ও যোগাযোগ-ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন হওয়ার প্রেক্ষাপটে, ইউনিভার্সিটির বাইরেও এক ধরনের তত্ত্বচর্চার চেষ্টা দেখা গেছে। সেখানকার অবস্থাও বেশি ভালো না। ভালো হওয়ার কোনো কারণও নাই। কথাটার উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, আপনি যে নেইম-ড্রপিং প্রবণতার কথা বলেছেন, সেটা নব্বইয়ের দশকে আজিজ মার্কেটে অনেক বেশি ছিল। এখন এ প্রবণতা বাইরে খানিকটা কমেছে। কারণ, অনলাইন অ্যাকসেসের কল্যাণে এগুলো খানিকটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে। বাংলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি এখনো নাম-উল্লেখ চালিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে বলতেই হয়, তারা আরো পিছিয়ে আছে।

 

সহজিয়া: আমি বলতে চাই, সাহিত্য পাঠ ও বিশ্লেষণের ‘সনাতনী পদ্ধতি’ এবং সমকালের বৈশ্বিক ‘রূপান্তরগুলো’ সম্পর্কে বাংলাদেশের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-বিষয়ক বিদ্যার চর্চাকারীগণ পদ্ধতিগতভাবে ওয়াকিবহাল নয়। এমন করে কি ভাবা যায়? এ প্রশ্ন শুনে দয়া করে বলবেন না যে, বৈশ্বিক ‘রূপান্তরগুলো’ জানতেই হবে কেন! কারণ তার জবাবে আমি বলব, আমরা তো কোকাকোলা খাই, ইউনিলিভারের তেল-সাবান মাখি, ক্যাটরিনার নাচ দেখি, মিয়া খলিফাও হাজির হন মাঝে মাঝে। হা হা হা…। তাহলে সাহিত্য পড়ার ক্ষেত্রে রূপান্তরগুলো জানতে সমস্যা হবার কথা নয়। এ প্রসঙ্গে আপনার পর্যবেক্ষণ যদি বলতেন…

মোহাম্মদ আজম: রূপান্তরগুলো সম্পর্কে জানাই উচিত। আর আপনি রসিকতার ছলে অন্য যেসব বৈশ্বিক উপাদানের কথা বললেন, আমি সেগুলোরও ভোক্তা। ফলে সাহিত্যপাঠের বৈশ্বিক এনতেজামে আমার বা অন্য কারো অনাগ্রহী হওয়ার যুক্তি নাই। এক্ষেত্রে দুই কারণে ‘সনাতনী পদ্ধতি’ওয়ালারা ‘রূপান্তরগুলো’ সম্পর্কে অনীহা দেখাতে পারে না। প্রথমত, সনাতন পদ্ধতিগুলোও আসলে পশ্চিমাই বটে। আমাদের বাংলা বিভাগীয় অ্যাকাডেমি তো বিশুদ্ধ কলকাত্তাই প্রোডাক্ট। আর কলোনিয়াল শহর কলকাতা আমরা যতটা ভাবতে পারি ততটা বা তারচেয়ে বেশি পশ্চিমায়িত ছিল। আমাদের কাছে বাংলা লেখা আকারে পৌঁছালেও তার ভিত্তি পশ্চিমেই। দ্বিতীয়ত, ইউনিভার্সিটি কথাটার মানেই হল, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দুনিয়াজোড়া চর্চার সাথে সঙ্গতি রক্ষা করার দায়। প্রশ্ন হল, অন্যদের কাছ থেকে, বিশেষত পশ্চিম থেকে, গ্রহণ করার কোনো কলোনিয়াল আসপেক্ট আছে কি না। আছে। তবে এটা অতিক্রম করা খুবই সম্ভব। কলোনিয়াল সম্পর্ক আদান-প্রদানের বা এমনকি শুধু আদান দিয়েও প্রতিষ্ঠিত হয় না, বরং ক্ষমতা-সম্পর্কের অসমতাই এর মূল কথা। সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখলেই আপনি ওই দায় অনেকটাই কাটাতে পারবেন।

 

তাহলে কারো যদি ‘রূপান্তরগুলো’ সম্পর্কে কোনো অনীহা থেকে থাকে, তার কারণ দার্শনিক বা নৈতিক নয়, অক্ষমতাজনিত। এ অক্ষমতা ঠিক ব্যক্তির নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার। অ্যাকাডেমিকে আমি দেখি সংলাপ হিসাবে। মানে এভাবে দেখা যেতে পারে। কথাটা ধার করেছি বাখতিন থেকে। তবে বাখতিনে না ঢুকেও কথাটা ব্যবহার করা সম্ভব। আপনি অ্যাকাডেমিতে কাজ করছেন মানেই হল, আগের কাজের সাথে সংলাপ তৈরি করছেন, আর পরের কাজের জন্য সংলাপের প্রস্তুতি রাখছেন। আমাদের এখানে যেহেতু এ ধরনের কোনো প্রক্রিয়াই জারি নাই, কাজেই নতুন কিছু রপ্ত করে ওঠা একটা দুঃসাহসী অভিযানে নামার মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম: আপনার যদি কিছু পুঁজি থাকে, তাহলে আপনি নতুন লগ্নি করতে পারবেন। কিন্তু কিছুই না থাকলে সেটা সম্ভব হবে না।

 

কিন্তু যারা লিখছেন-পড়ছেন-পড়াচ্ছেন তাদের পুঁজি থাকবেই বা না কেন? এখানে আপনার ব্যবহৃত ‘পদ্ধতিগতভাবে’ কথাটা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমি আগের এক উত্তরে বলেছি, আমাদের সাহিত্যপাঠ ইম্প্রেশনধর্মী। মনে হয়, আমি যা বুঝি – এই কিসিমের। কিন্তু এরকম তো কথা ছিল না। অ্যাকাডেমিতে আপনি তো সাহিত্য পড়বেন পদ্ধতিমাফিক। তার মানে আগে থেকেই আপনার তত্ত্ব ও প্রণালি-পদ্ধতিতে কিছু পুঁজি থাকার কথা। মানে যে কারোরই তত্ত্বচর্চা করার কথা। এরকম কথা শুনতে পাওয়ারই কথা নয় যে, অমুক তত্ত্বচর্চা করে, অমুক করে না। আপনি যে ধারায় কাজ করেন, সে ধারার ভিত্তিতেই নতুন কোনো কোনো দরকারি বা পছন্দনীয় পদ্ধতি আপনি রপ্ত করবেন।

 

আমি বলতে চাচ্ছি, তত্ত্ব ও প্রণালি-পদ্ধতিতে আমাদের যে করুণ দশা তা ব্যক্তিবিশেষের গাফিলতির ফল নয়, অ্যাকাডেমির গরিবির প্রকাশমাত্র।

 

সহজিয়া: বাংলা সাহিত্য যাঁরা পড়ান, তাঁদের অনেকেই তত্ত্বচিন্তাকে ভয় পান এবং ভয় থেকে তত্ত্ব ও তাত্ত্বিককে সমীহ করেন। কিন্তু তত্ত্ব পড়তে বা পড়াতে আগ্রহী হন না। এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী মনে হয় বাংলা বিদ্যাচর্চার প্রথাগত ধারা। পুরনো ঘরানার অ্যাকাডেমিক পণ্ডিতরা সাহিত্যের চরিত্রচিত্রণ, সমাজবাস্তবতা, শিল্পমূল্য ইত্যাদি নিরূপণের বাইরে আর কোনো কিছুতে মাথা ঘামাতে চান নি। কেউ কেউ খানিকটা রাজনীতিকে টেনে আনলেও, অনেকের কাছে সাহিত্যপাঠে রাজনীতির আগমন সুখকর নয়। এই প্রসঙ্গে কিছু বলবেন?

মোহাম্মদ আজম: আপনি যেভাবে ‘তত্ত্বচিন্তা’ কথাটা ব্যবহার করেছেন, বা যেভাবে আমাদের এখানে কথাটা ব্যবহৃত হয়, তার মধ্যে বড় ধরনের ঘাপলা আছে। আমি এ ব্যাপারে আগেই ইঙ্গিত দিয়েছি। সে ঘাপলা এড়িয়ে কথাটা বললে বলতে হত, অমুক এই তত্ত্বে আগ্রহী, ওইসব তত্ত্বে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন বা পড়ান, কিন্তু তত্ত্বে আগ্রহ নাই – এটা সোনার পাথর বাটি কথাটার মতোই অসম্ভব ব্যাপার। আমাদের আর্টস এবং সোস্যাল সাইন্সের প্রায় সর্বত্রই যে কথাটা শোনা যায়, তাতেই আরেকবার প্রমাণিত হয়, এখানে ইউনিভার্সিটি ধরনের কোনো অ্যাকাডেমি বিকশিত হয় নাই।

 

এ কথা মাথায় রেখে বলতে পারি, পুরানা ধারার কেউ যদি ‘চরিত্রচিত্রণ, সমাজবাস্তবতা ও শিল্পমূল্য’ ধরনের আলাপও করে, তাতে তত্ত্বের সাথে তার বিরোধ দেখা দেয়ার কোনো কারণ দেখি না। আসলে যা ঘটে তা হল, এই আলাপগুলো ‘ঠিকমতো’ করা হয় না। উদাহরণ দিই। বাখতিন তার উপন্যাসতত্ত্বে খুবই গুরুত্বের সাথে আলাপ করেছিলেন ‘নায়ক’ বা ‘নায়কগণ’ নিয়ে। অনেকে বলেন, চরিত্রের তৎপরতা এবং তার সাথে দশের সম্পর্কই বাখতিনের সাহিত্যতত্ত্বে নৈতিকতার প্রধান ভিত্তি। বুঝতেই পারছেন, এ আলাপও চরিত্রের আলাপই বটে। তার মানে আমি আবার এও বলছি না, চরিত্রচিত্রণের আলাপ করতে হলে বাখতিন বা এরকম কারো বরাত দিয়ে করতে হবে। বলতে চাইছি, আপনাকে আগে সাহিত্য পড়ার কৌশলটা জানতে হবে। সাহিত্যের ইতিহাসটা জানতে হবে। পরিভাষার মধ্য দিয়ে সাহিত্যে ঢুকতে হবে। দুর্বল অ্যাকাডেমির কারণে আমাদের ছেলেমেয়েদের এই প্রাথমিক জ্ঞানটা হয় না। ফলে সে হয়ত সারাজীবনে এও বুঝে উঠতে পারে না, সাহিত্যের ভাষা অন্যসব আর্টের মতোই আলাদা ভাষা – আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্তার ভাষার সাথে তার যোগ প্রত্যক্ষ নয়, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। সাহিত্যের ওই কৃত্রিম নির্মিতি সম্পর্কে ধারণা না থাকলে আপনি কোনো আলাপই তো সন্তোষজনকভাবে তুলতে পারছেন না। এ কথা কিন্তু নতুন তত্ত্ব ও প্রণালি-পদ্ধতি নিয়ে যারা কারবার করে, তাদের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য।

এখন সাহিত্যের ‘সমাজবাস্তবতা’ বোঝার সময় আপনি যদি ইতর বাস্তববাদী একটা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজকে দেখতে চান, সাহিত্যে সমাজের হুবহু প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করেন, তাহলে আপনার লেখাটা হবে কীভাবে? স্রেফ এই কাণ্ডজ্ঞান থেকে লিখে কলকাতার বহু সমালোচক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। সেখানে রাজনীতি বা ইতিহাস নিয়েও কোনো সংকট হয় নাই। আদতে পুরানা ধারার সাহিত্য-গবেষণা ও সমালোচনায় রাজনীতি থাকা বা না থাকা মোটেই ম্যাটার করত না। আমি নিজে সৈয়দ আলী আহসানকে বাংলাদেশের সবচেয়ে কামিয়াব কাব্যসমালোচক মনে করি, আর এর পরেই নাম নিই হাসান হাফিজুর রহমানের। প্রথমজন আগাগোড়া অ-রাজনৈতিক, আর দ্বিতীয়জন পুরা রাজনৈতিক। চূড়ান্ত বিচারে তাতে তো মানের কিছু আসে যায় না। কলকাতার পুরানা ঘরানার কামিয়াব সাহিত্যসমালোচকদের মধ্যে আপনি এমন উদাহরণ খুবই কম পাবেন, যাদের লেখা উনিশ শতকীয় আধুনিকতার হিন্দু জাতীয়তাবাদী নির্মাণ দিয়ে প্রভাবিত নয়। আলবত জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মামলা। তাতে লেখার গুরুত্ব তো কমে নাই। আর নতুন ঘরানাগুলাতে তো লেখামাত্রই রাজনৈতিক। সেক্ষেত্রে আপনি রাজনীতি মাথায় রেখে লিখেছেন নাকি লেখেন নাই, তাতে কিছু যায় আসে না।

 

কথাগুলো বললাম এটা বোঝানোর জন্য যে, তত্ত্বভীতি বা তত্ত্বপ্রীতি, রাজনীতিলিপ্ততা বা রাজনীতিহীনতা আমাদের সাহিত্য-গবেষণা ও সমালোচনা না-দাঁড়ানোর কারণ নয়। মূল কারণ, আমরা আসলে অ্যাকাডেমিক দায়িত্বটাই পালন করছি না। অ্যাকাডেমিক হওয়া মানে কী? মানে দায়িত্বশীল রচনা লেখা। মানে যুক্তিনির্ভর বাক্য উৎপাদন করা। সেটা কিভাবে হবে? স্রেফ বলতে হবে, আমি এই কারণে এটা লিখছি, আমার পদ্ধতি এই, টেক্সটকে আমি এভাবে ব্যবহার করছি; আর আমি এই লেখাটা লিখছি, কারণ, আগে এই এই কাজ হলেও এ ধরনের কাজ হয়নি। মানে আপনি সংলাপ তৈরি করছেন – আগে যে কাজ হয়েছে তার সাথে পরের সম্ভাব্য কাজের। শুধু এটুকু রক্ষা করে সাহিত্যের পরিভাষা ব্যবহার করে বিবরণী প্রস্তুত করলেও গুরুত্বপূর্ণ লেখা উৎপাদিত হবে। সবগুলো নয়। তবে মাঝে-মধ্যেই। এখন আপনি জানেন, বাংলা বিভাগগুলোতে আক্ষরিক অর্থেই শত শত ‘গবেষণা’ হয়, যেখানে লিটারেচার রিভিয়্যু থাকে না, প্রণালি-পদ্ধতি সম্পর্কে একটা বাক্য থাকে না। এমতাবস্থায় আপনি তত্ত্ব করলেই বা কী, আর রাজনীতি করলেই কী! গলদটা আরো অনেক প্রাথমিক ধরনের।

 

সহজিয়া: আপনার অ্যাকাডেমিক উচ্চতর পড়ালেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ, যেখানে সাহিত্য পাঠদানের প্রাণভোমরা মূলত বাঙালির জাতীয় চেতনা, জাতীয়তাবাদ, সমাজবাস্তবতা, শিল্পমূল্য ইত্যাদি – সেখান থেকে আপনি অনেকটাই বহুরৈখিক পথে যাত্রা করেছেন। আপনাকে আমরা ভাষা নিয়ে ভাবতে দেখি। ফিল্ম নিয়ে কাজ করতে দেখি। সাংস্কৃতিক অধ্যয়নের দিকেও আপনার ঝোঁক। প্রথাগত পদ্ধতিতে পড়ালেখা করলেও আপনার ভেতর অপ্রথাগত বিদ্যাচর্চার ঝোঁক দেখা যায়। ডিসিপ্লিনের সীমানা অতিক্রম করতে দেখা যায়। বাংলাদেশের বাংলা বিভাগে এরকম সাধারণত ঘটে না। আপনার বেলায় ঘটল। এই রূপান্তরটা আপনার ভেতর কীভাবে ঘটল?

মোহাম্মদ আজম: আমাদের ডিসিপ্লিনে অ্যাকাডেমিক কাজকর্ম সম্পর্কে আপনি মোটের উপর ঠিক মন্তব্যই করেছেন বলে মনে হয়। আমি জাতীয়তাবাদী চেতনার পরিচয় হিসাবে আরেকটা জিনিস যোগ করতে চাই। ঢাকার রাজনৈতিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাথে, টু বি প্রিসাইজ, কলকাতার সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ যোগ করতে হবে। এর গোড়ায় থাকা উনিশ শতকীয় রেনেসাঁ তথা আধুনিকতার ধারণা যোগ করলে জাতীয়তাবাদী ধারণার পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যাবে। আর তিরিশি বা বিশ শতকীয় আধুনিকতা, যেটা বেশ অ-রাজনৈতিক, তার সাথে ‘বিশুদ্ধ’ সাহিত্যের ধারণা যোগ করলে পাওয়া যাবে ‘শিল্পমূল্য’ – মুখ্যত কবিতার শরীরী বিশ্লেষণ। অংশত কিন্তু পুরোপুরি নয় – নিওক্রিটিকদের অর্থে টেক্সট-নির্ভর পাঠ এই শেষোক্ত ধারাটির মূল টেকনিক। বুদ্ধদেব বসু এ ধারার প্রধান আলেম। পুরানা মার্কসীয় ধারা এখানে কেউ কেউ ব্যবহার করলেও কখনো ধারাবাহিক বা কার্যকর চর্চা হয় নাই।

 

আমার, যদ্দুর মনে পড়ছে, প্রথম বিরাগটা তৈরি করেছিল সাহিত্যের শরীর আর মনকে আলাদা করে শরীরী বিশ্লেষণের ব্যাপক প্রবণতা। উপমা-উৎপ্রেক্ষার তালিকা ইত্যাদি। সাহিত্যিক ভাষা বিশ্লেষণের দিক থেকে এ পদ্ধতির অসারতা আমি বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের গোড়াতেই আবিষ্কার করতে পেরেছিলাম। এর বাইরে আমার হাতে, যেমনটি আগেই বলেছি, এসে পৌঁছেছিল একরাশ প্রণালি-পদ্ধতি। টেক্সট এবং বিয়োন্ড টেক্সট পাঠের বিস্তর পদ্ধতি তখন আমাদের চোখের ও কানের কাছেই ঘোরাফেরা করছিল। এর কোনো কোনোটি আমি আমার মতো করে ব্যবহার করতে শিখেছি, আর পেয়ে গেছি আমার মূল মোক্ষধাম – রাজনৈতিক পাঠের দিশা ও প্রণালি-পদ্ধতি।

 

কিন্তু আপনি যেভাবে আমার কাজের বিস্তারের পরিচয় দিলেন, তা বোধ হয় ঠিক নয়। আমি মূলত সাহিত্যকে ব্যবহার করে সংস্কৃতি ও রাজনীতি পড়ি। নব্য-ইতিহাসবাদী কিছু টেকনিকও আমার প্রিয়। সেক্ষেত্রে আপনার কথিত সংস্কৃতি অধ্যয়নই আমার মূল এলাকা। সিনেমা দেখি ও সিনেমা নিয়ে লিখি। সেও একই কায়দায়। গোপনে বলি, আমার সিনেমা-বিষয়ক লেখালেখিতে সিনেমার পরিভাষা ও ইতিহাস প্রায় অনুপস্থিত থাকে। ভাষা নিয়ে কাজ করলেও ভাষাবিজ্ঞানে আমি খুব একটা ঢুকিনি। এসব কথা মাথায় রাখলে আমার কাজের পরিধিকে মোটেই বিস্তৃত বলা যাবে না। বরং কেউ যদি সংকীর্ণতার অভিযোগ এনে বলে, আমি মূলত টেক্সট-রিডিং করি, তাহলে মোটেই ভুল বলা হবে না। টেক্সট-রিডিংই আসলে আমার মূল পদ্ধতি। এ ব্যাপারে আমার মোটামুটি দক্ষতা জন্মেছিল লেখালেখির শুরুর দিকেই। আর কেবল সাহিত্যিক টেক্সট নয়, বরং চিহ্নব্যবস্থার জট অনুসরণের আমন্ত্রণ আছে, এমন যে কোনো টেক্সট আমাকে আকর্ষণ করে। আপনি বলতে পারেন, এ ব্যাপারে আমার মোটামুটি কাজ চালানোর মতো পারঙ্গমতা আছে। এখন আপনি যদি টেক্সটকে বিচ্ছিন্ন একক হিসাবে না দেখে ঐতিহাসিক বাস্তবতার পটে স্থাপন করতে পারেন, আর যে ডিসকোর্সগুলোর ভিত্তিতে ও বিন্যাসে টেক্সট প্রণীত হয়েছে সেদিকে নজরদারি বাড়াতে পারেন, তাহলে আমার লেখালেখির পদ্ধতিগত সূত্রটা পেয়ে যাবেন।

 

এসব আলাপের তো আসলে অ্যাজ সাচ কোনো তাৎপর্য নাই। আমি এমন কোনো লেখক না যে, আমার লেখার কলাকৌশল ব্যাখ্যা করতে হবে – আমার বা অন্য কারো। আলাপটা খানিকটা তুললাম এ আশায় যে, আমাদের তুলনামূলক নতুন চর্চাকারীদের এক-আধটু কাজে লাগতে পারে। সেদিক থেকে আরেকটা কথা বলে রাখতে চাই। আমি আসলে কনফিডেন্সটা পেয়েছিলাম সাহিত্য থেকেই। আমাদের ছাত্রছাত্রীরা এক ধরনের নমঃনমঃ ভঙ্গিতে সাহিত্য পড়ে, যেনবা কোনো পবিত্র বস্তুর সামনে পড়ে গেছে। লেখকদের প্রতিও উচ্চারণ ও ‍লেখায় আসল-আদি-অকৃত্রিম শ্রদ্ধা পরিলক্ষিত হয় – কথায় এবং লেখায়। কেউ কাউকে নিয়ে লিখলে বা পিএইচ ডি-র মতো কোনো ডিগ্রি নিলে দেখবেন, সে ওই লেখককে এমনভাবে ওউন করছে যেন তার শ্বশুর/শাশুড়ি লাগে। এই ভক্তিপ্রবণ বাংলাজীবীরা ক্রিটিকেল দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রণালিপদ্ধতিতে প্রবেশের অযোগ্য। একদিকে এরকম অবস্থা; অন্যদিকে আবার বাংলায় পড়তে হয়েছে বলে তার অস্বস্তির সীমা থাকে না। এই দুই বিপরীত ভাবের ডায়ালেকটিকসে পড়ে আমাদের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের একটা অংশ কখনো এই প্রত্যয়ে পৌঁছাতেই পারে না যে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাহিত্য পড়ে এবং ভাষার কারবার করে সে অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় ও অবস্থানে আছে। ফলে সাহিত্যের ন্যাকা ন্যাকা একটা এরিয়া ছেড়ে জীবন ও জগতের বড় পরিসরে সে পা রাখার কথা ভাবতেও পারে না।

 

আমি ভাষা ও সাহিত্য পড়ার জোরের জায়গাটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার প্রায় শুরুর দিকেই অনুভব করতে পেরেছিলাম। বাখতিন বা মরিস ব্লাশোঁ বা অন্যদের থেকে এই ‘সুপিরিয়রিটি’র ব্যাখ্যা পেয়েছি পরে। কিন্তু অনুভূতিটা আমার বরাবরই ছিল। আমি বুঝতে পারতাম, সাহিত্য একমাত্র ক্ষেত্র (এমনকি অন্য আর্টফর্মগুলোর তুলনায়ও), যেখানে সামষ্টিক অস্তিত্বের নিখুঁত ফর্দের মধ্যে ব্যক্তির অস্তিত্ব পরীক্ষিত হয়। ফলে জীবনের ‘প্রকৃত’ পরিচয় সাহিত্য যতটা এবং যে অর্থে দ্যায়, অন্য কোনো শাস্ত্র তা দেবার স্পর্ধা রাখে না। আমার এ কথার মানে আবার এ নয় যে, অন্য ডিসিপ্লিনগুলো জীবনকে যেসব বিচিত্র তলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, তার গুরুত্ব কমিয়ে দ্যাখার কোনো জরুরত আছে। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই-যে ভাষা ও সাহিত্য আমাকে বেশ সুবিধাজনক পাটাতন দ্যায়, সে বোধটা তো জরুরি। আমার ধারণা, এ বোধ আমাকে আশপাশটায় ঢু মারতে সাহায্য করেছে। সাহিত্য নিয়ে কারবার করে, এমন কারো কারো কাজে আসতে পারে ভেবে এই ব্যক্তিগত গোপন প্রকাশ করলাম। আত্মপ্রচারের জন্য নিশ্চয়ই নয়, কারণ, প্রচারের মতো বিদ্যা আমার নাই।

 

সহজিয়া: রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে আপনি পিএইচডি গবেষণা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষীদের অনেক অভিযোগ। জাতীয়তাবাদী, মার্কসবাদী, মডারনিস্ট, পোস্ট-কলোনিয়ালিস্ট, পোস্ট-মডারনিস্ট – প্রায় সকল ঘরানার কোনো কোনো অংশ রবীন্দ্রনাথকে দুই চক্ষে দেখতে পারেন না। রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে আপনার কী কী অভিযোগ? কেন অভিযোগ?

মোহাম্মদ আজম: রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে আমার প্রধান অভিযোগ, এই ব্যাটা বিশ্রীরকমে বেশি লিখেছে। পড়ে শেষ করা যায় না, অথচ পড়া জরুরি মনে হয়। এ এক বিতিকিচ্ছিরি সমস্যা। গৌণ কিছু অভিযোগও আছে। ভাগ্যের বরপুত্র। লম্বা নিরোগ (এই শব্দ আমি ঈ-কার দিয়ে লিখি না) সৃষ্টিশীল জীবন। তার মধ্যে আবার অর্ধেক উনিশে, অর্ধেক বিশে। দেশ-বিদেশে বিস্তর বন্ধু, ততোধিক বান্ধবী। অভিযোগ তোলার জন্য আর কী লাগে!

 

তবে রবীন্দ্রপ্রেম আর রবীন্দ্র-বিরোধিতার যে প্রভাবশালী ডিসকোর্স বাংলা মুল্লুকে বহুকাল চলে আসছে, তাকে আমি নাগরিক-শিক্ষিত বাঙালির অসুস্থতার লক্ষণ মনে করি; এবং এই সামষ্টিক অসুস্থতার জন্য দ্বিতীয় পক্ষের তুলনায় প্রথম পক্ষকে আমি বেশি দায়ী করি। অর্থাৎ প্রেমটাই সমস্যার গোড়া, বিরোধটা তার পরিণতি মাত্র। কথাটা বুঝিয়ে বলা জরুরি। ধরুন, মার্কসবাদী কোনো ‘উগ্র’’ স্কুল রবীন্দ্রনাথে নিজেদের তত্ত্বকাঠামোর মিলঝিল না পেয়ে সিদ্ধান্ত নিল, এ সাহিত্য দিয়ে আমাদের চলবে না। এতে রবীন্দ্রপ্রেমীদের ক্ষেপে যাওয়ার কারণ কী হতে পারে? মার্কসবাদীরা অতি সঙ্গত কারণেই (তাদের একটা বড় অংশ দুনিয়াজুড়ে সাহিত্য ও তৎপরতাকে একসূত্রে মিলাতে চেয়েছিল) দুনিয়ার বহু সাহিত্যিক সম্পর্কে এরকমের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়ার মাত্রা যেমন হয়েছিল, অন্য কোনো ক্ষেত্রে সেরকম হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ কী? কারণ হল, আপনি আসলে রবীন্দ্রপ্রেমী হিসাবে রবীন্দ্রনাথকে সাহিত্যিক রাখেন নাই, নবি বানিয়ে ফেলেছেন। পির-পয়গম্বর বানিয়েছেন। ফলে আপনার মধ্যে ব্লাসফেমির একটা আইডিয়া কাজ করে যাচ্ছে। আপনি রবীন্দ্রনাথের কোনো সমালোচনাই শুনতে পারছেন না। রিঅ্যাক্ট করছেন।

 

ঢাকার অবস্থা এ বাবদ কলকাতার চেয়ে শতগুণ খারাপ। গত শতকের ষাটের দশকে রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে পড়েছিলেন জাতীয়তাবাদী আবেগের সাথে। তাতে অসুবিধা নাই। কিন্তু আজতক আপনি ওই আবেগকে যে-পদ্ধতিতে লালন করে থাকেন, তাতে ধার্মিকতার বাইরে আপনার অন্য কোনো বৃত্তিকে তো সক্রিয় দেখি না। আপনি সেই সময়ের বিরোধিতার পটভূমিতে সৈয়দ আলী আহসানকে রবীন্দ্র-বিরোধী হিসাবে ট্যাগ মাইরা দিছেন। কিন্তু ওই ব্যাটাই আবার রবীন্দ্রকাব্য সম্পর্কে – বাংলাদেশের নিশ্চিতভাবে, আর কলকাতাসহ সম্ভবত – সেরা বইটা লিখেছে। আমি রবীন্দ্র কাব্যবিচারের ভূমিকার (১৯৭৪) কথা বলছি। আপনি বলবেন, স্বাধীনতার পরে ভোল পালটাইছে। ভালো কথা। কিন্তু সে তো ষাটের দশকে রবীন্দ্রনাথ নিয়া কমপক্ষে দুইটা, তার কবিতার মাপে, গুরুত্বপূর্ণ কবিতা লিখেছে। আর স্বাধীনতার পরে ভোল পালটাইয়া যদি এক রবীন্দ্র-বিরোধী এই মাপের বই লিখতে পারে, রবীন্দ্রপ্রেমী হইয়া তো আপনার খুশি হওয়ার কথা। আপনি ব্যাজার হন ক্যান? একই কথা তুলতে চাই আবুল মনসুর আহমদ নিয়া। শেষ ষাটের ওই ‘রবীন্দ্র-বিরোধী’ প্রস্তাবে আবুল মনসুর সাবও সই করেছিল। ভালো কাজ করে নাই নিশ্চয়ই। কিন্তু এর ভিত্তিতে আপনি কী করলেন? আপনি ‘আয়না’ থেকে শুরু করে ‘বেশি দামে কেনা’ পর্যন্ত, ভাষা আন্দোলন আর যুক্তফ্রন্ট থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর ‘লিডার’ পর্যন্ত যে আবুল মনসুর আহমদ, যাকে আমি এই বাংলায় জন্ম নেয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক-সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী মনে করি, তাকে কলমের এক খোঁচায় বাতিল করে দিতে চাইলেন। কার নামে? রবীন্দ্রনাথের বরাতে।

 

আমার আসলে তাতেও কোনো আপত্তি নাই। আবুল মনসুর আহমদের অনুরাগী হিসাবে আমি গণতান্ত্রিক এবং সেক্যুলার। কেউ যদি রবীন্দ্রপ্রীতির বাটখারা ব্যবহার করে সৈয়দ আলী আহসান এবং আবুল মনসুর আহমদকে খারিজ করতে চায়, আমি তার সেই ‘গণতান্ত্রিক’ অধিকার মেনে নেব। কিন্তু এই মূর্খগুলা যে জিনিসটা বুঝতে পারে না তা হল, তখন এই কাজটা আর শিল্প-সাহিত্যের গণ্ডিতে থাকে না, হয়ে ওঠে রাজনৈতিক কাজ, যা ধর্মের আদলে সম্পন্ন হয়েছে। তাহলে এ ধরনের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আপনি রবীন্দ্রনাথকে সাহিত্যিক গণ্ডি থেকে রাজনৈতিক ও ‘ধর্মীয়’ বর্গে এনে ফেললেন। এখন, সাহিত্যের প্রতিপক্ষ থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে; কিন্তু রাজনীতির প্রতিপক্ষ থাকবেই, ধর্মের প্রতিপক্ষ থাকবেই। ফলে আপনিই কিন্তু রবীন্দ্রপ্রেমী সাজার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্র-বিরোধিতার অনিবার্যতা তৈরি করলেন। ধর্মের আকারে রাজনীতির উপাদান বানিয়ে বিরোধিতার কাঠামো প্রস্তুত করে দিলেন। এরপর আপনি পরের পাপটি করতে থাকবেন। রাজনৈতিক রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতাকে আপনি সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা বলে মাঠ গরম করবেন। একে আমি ‘পাপ’ বলছি, কারণ, এর মধ্য দিয়ে সামগ্রিকভাবে জনমানসে যে পরিস্থিতি তৈয়ার হয়, সেটা ‘পাঠে’র জন্য উপযোগী কিছু নয়।

 

আমি অনেককে দেখেছি, যারা আক্ষরিক অর্থেই রবীন্দ্রনাথকে পিরের মতো মান্য করে। রবীন্দ্রনাথে জীবনসমস্যার সমাধান আছে বলে মনে করে। বাঙালি শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্তের এ এক সামষ্টিক মনস্তাত্ত্বিক সংকট। সে আধুনিক হতে চায়। কলোনিয়াল আধুনিকতা তার ধর্মের ব্যাপারে তার মনে যে বিরূপতা তৈয়ার করেছে, তার ফলে সে ধর্ম মান্য করতে চায় না, সম্ভব হলে বিরোধিতাই করতে চায়। অথচ সে তো মনে-প্রাণে ধার্মিক। ফলে সে রবীন্দ্রানাথে সওয়ার হয়েছে – রবীন্দ্রনাথকে ধর্ম বানিয়ে তা-ই পালন করে। আমার কোনো আপত্তি নাই। ধর্ম পালনের অধিকার মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু সমস্যা হয় সাকুল্যে দুই জায়গায়। এক. এই ধর্ম পালনের মধ্য দিয়ে সে নিজেকে সুপিরিয়র দাবি করে। মানে এর ভিতর দিয়া অন্যদেরকে দাবায়া রাখতে চায়। দুই. জীবন-সমস্যার সমাধান হিসাবে রবীন্দ্রনাথকে প্রস্তাব করার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের নাকাল হওয়ার চমৎকার শর্ত তৈরি করে। একটা উদাহরণ দিলে দশ কথার চেয়ে বেশি কাজ হবে।

 

আমাকে একবার রবীন্দ্রনাথের নারী বিষয়ে কথা বলার জন্য কোনো এক নারী সংগঠন ডেকেছিল। ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে আমেরিকান কালচারাল সেন্টারে বোধ হয় সভাটা হচ্ছিল। আমি জানি, রবীন্দ্রসাহিত্যের নারী প্রায় আপাদমস্তক ভিক্টোরীয় নারী, আর তাঁর সাহিত্য-বহির্ভূত রচনা ও জীবনে প্রতিফলিত নারীচিন্তা আমাদের কালের বিবেচনায় রীতিমত রিঅ্যাকশনারি। আমি সেভাবে বলার প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে হাজির। গিয়ে দেখি, প্রাবন্ধিক আরো কয়েক কাঠি সরেস। আসলে তার মেথডলজি ছিল আধুনিক নারীবাদ। কাঁচামাল ছিল রবীন্দ্রনাথের চিঠি ও ব্যক্তিগত জীবন। বুঝেন ঠ্যালা। রবীন্দ্রনাথকে ধরাশায়ী দেখে আমার এমন মায়া লাগল, আমি প্রস্তুতকৃত বক্তৃতা মুলতবি রেখে ঐতিহাসিক পাঠের লাইনে যেতে বাধ্য হলাম। বললাম, সেকালের পরিপ্রেক্ষিতে… ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন খেয়াল করেন, রবীন্দ্রনাথ আমাদের কালের তুলনায় রীতিমত পুরানা লোক। তাঁর বেশিরভাগ পজিশন তো আমাদের কাছে সেকেলে মনে হতে বাধ্য। চিন্তার লেভেলে আর সৃষ্টিশীলতার লেভেলে আপনি তাঁকে অনবরত হালনাগাদ পাবেন, যদি আপনি সক্ষম পাঠক হন। তা না করে আপনি যদি ধরেই নেন, রবীন্দ্রনাথ যা বলেছেন বা করেছেন, তা আপনার অনুসরণীয়, তাহলে অন্যদেরকে বারবার বলতে হবে, রবীন্দ্রনাথ এই এই ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ। আপনি অনুসরণীয় না বললে কিন্তু পশ্চাৎপদ বলার দরকার হয় না। কারণ, রবীন্দ্রনাথ যে তাঁর কালের অধীন, সে কথা কে না জানে। ফলে তাঁর নারী-বিষয়ক ভাবনা তো আমার নরম্যাটিভ কায়দায় পড়ার কোনো দরকার নাই। পুরানা অভিজ্ঞতা হিসাবেই আমি পড়ব। আমাকে অন্যরকম পাঠে বাধ্য করল কিন্তু সামাজিক মিথ, যেটা রবীন্দ্রপ্রেমী হিসাবে আপনি তৈরি করেছেন। আশা করি, পদ্ধতিগতভাবে রবীন্দ্রপ্রেমীরাই যে রবীন্দ্র-বিরোধিতার উৎস, সে কথাটা বলতে পেরেছি। শেক্সপিয়রের বিরোধিতা করতে যাবে কোন শালা! কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের দোসর, যে শেক্সপিয়র তার বিরোধিতা করা নিদেনপক্ষে ফরজে কেফায়া।

 

আমার এও মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের মতো স্মার্ট মানুষ এরকম পুতুপুতু ভক্ত টলারেট করতেন না। চাইতেন পুনর্নির্মিত পাঠে সক্ষম সজীব পাঠক। বাংলাদেশের শতকরা সাড়ে নিরানব্বই ভাগ রবীন্দ্রভক্ত যে আদতে ‘পাঠক’ নয়, অনুসারী মাত্র, সেটা দু-চারজনের সাথে কথা বললেই আপনি টের পাবেন। আর এই ২০২০ সালে এসে রবীন্দ্রবিষয়ক লেখালেখির যে হালত, তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। তুলনায় পশ্চিম বাংলার রবীন্দ্রপূজা আর রবীন্দ্রপাঠ – দুইটাই বেশ সলিড। সেখানেও ভক্তির সংকট আছে। তবে সৃষ্টিশীল পাঠ অনেকগুণ বেশি। সেটা দেখবেন আপনি সিনেমায়, সৃজনশীল সাহিত্যে আর তুখোড় সব সন্দর্ভে।

 

এতক্ষণে আপনার এবং পাঠকদের হয়ত খানিকটা গোস্বা হয়েছে এই ভেবে যে, আমি রবীন্দ্র-বিরোধীদের পুরা সিন থেকে চালান করে দিলাম! আসলেই দিলাম। কারণ, যতক্ষণ আপনি শিল্প-সাহিত্যের আলাপ করছেন, ততক্ষণ এটা আসলে কোনো ফ্যাক্টরই না। আমি বরং আপনাকে সাথে নিয়ে কথিত রবীন্দ্র-বিরোধীদের জন্য খানিকটা ‘মায়া’ ধার্য করতে চাই। রবীন্দ্রপ্রেম যেমন একটা সাংস্কৃতিক নির্মাণ, রবীন্দ্র-বিরোধিতাও তাই। এই ফেরে পড়ে আমাদের রবীন্দ্র-বিরোধী সমাজ রবীন্দ্রনাথ পড়ার আরাম ও আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের অতুলনীয় ক্লাসিক, এবং বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম গুরত্বপূর্ণ লেখক। এটা না পড়ার সাহিত্যিক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক প্যাঁচে পড়ে যদি কেউ এ রকম সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে বাধ্য হয়, তাহলে তার জন্য মায়া না দেখিয়ে উপায় কী!

 

আমার এ লম্বা আলাপ থেকে যদি কারো মনে হয়, রাজনীতি সংশ্লিষ্টতাহীন এক বিশুদ্ধ রবীন্দ্রনাথ আমি প্রচার করছি, তাহলে বলব, মোটেই তা নয়। কিন্তু রাজনৈতিক পাঠ আর রাজনীতির পাঠ – এ দুইয়ের পার্থক্য তো আমাদের করতে হবে, নাকি?

 

সহজিয়া: রবীন্দ্রনাথের কী কী ভালো লাগে আপনার? কেন ভালো লাগে?

মোহাম্মদ আজম: রবীন্দ্রসাহিত্যে আমি সবচেয়ে উপভোগ করি তাঁর স্মার্টনেস, কনফিডেন্স এবং কমন সেন্স। তাঁর সময়টা দারুণ ছিল। তিনি প্রায় অতুলনীয় সপ্রতিভতায় সে সময়কে অনুসরণ করেছেন, আবার সময়ে নিজের চিহ্নও এঁকে দিয়েছেন। সময়ের কথাটা যে কোনো কৃতী ব্যক্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো এতটা সম্ভবত আর কোনো বাংলাভাষী মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কথাটা সংক্ষেপে বলি।

 

ব্রিটিশ বাণিজ্যবহর আর শাসনযন্ত্রের সবচেয়ে সুবিধাভোগী পরিবারগুলোর একটি ছিল ঠাকুর পরিবার। অর্থ-বিত্তের সাথে সংস্কৃতি আর শিক্ষা যোগ হয়েছিল এ পরিবারে। অন্যদিকে আবার স্বাদেশিকতার নতুন মূর্তি যখন জাগছিল ‘জাতীয়’ নানান চেতনা ধরে, তখনো ঠাকুর পরিবার ছিল সেই তৎপরতার কেন্দ্র। ফলে দেশি আদমিদের মধ্যে অবস্থানগত দিক থেকে যতটা কেন্দ্রত্ব কল্পনা করা যায়, রবীন্দ্রনাথ তার সবটার সুবিধা পেয়েছিলেন। এ ধরনের অবস্থান কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন প্রতিভাবান ব্যক্তির গলায় যে কর্তৃত্বব্যঞ্জক স্বরে প্রকাশিত হওয়ার কথা, রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক সাহিত্যকর্মে তার দেখা মিলবে। রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে মার্জিত অ্যাংলিসাইজেশনের কেন্দ্রে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু নানা কারণে ওরিয়েন্টালিস্ট ভাবপ্রবাহে তিনি নিমজ্জিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর সময়টি মধুসূদনের মতো বিশুদ্ধ ওয়েস্টার্নাইজেশনের নয়, বঙ্কিমের মতো হিন্দু জাতীয়তাবাদের নয়; বরং এ দুয়ের সংশ্লেষে এবং অন্য স্থানীয় বাস্তব কারণে ১৯০০ সালের আগে-পরে বাংলায় যে লিবারেলিজম কিছু কালের জন্য বেশ প্রমিন্যান্ট হয়ে উঠেছিল, সেটিই রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল সময়। রবীন্দ্রনাথ এ লিবারেলিজমের সেরা ফসল নন, যে অর্থে আমরা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, দীনেশ সেন বা বিনয় সরকারকে পাব; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এ সময়ের সুবিধা পুরো পেয়েছিলেন, আর সাথে যুক্ত হয়েছিল রোমান্টিকতা ও পশ্চিমা লিবারেল চিন্তার এক তুরীয় মিশ্রণ। এ সময়েই পশ্চিম এবং পুব কলকাতার সংস্কৃতিতে গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে নিজ নিজ অবস্থান পোক্ত করছিল। এ ‍দুইয়ের ডায়ালেকটিকস রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রাণভোমরা। একই কারণে অদ্যাবধি সাংস্কৃতিক যে কোনো বিবেচনায় রবীন্দ্ররচনাকে হালকালের মনে হয়; কারণ সমস্যাটা এখনো প্রকট।

 

সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দারুণ সক্রিয়তা রবীন্দ্রনাথের এক অনন্য দিক, তাঁর লেখালেখির জিন্দা স্বভাবেরও অন্যতম উৎস – যে দিকটা তিরিশি কবি-লেখকদের বামনসুলভ মধ্যস্থতায় রবীন্দ্রপাঠ থেকে প্রায় উধাও হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ যে দ্বিতীয়-তৃতীয় পর্বের উত্তুঙ্গ সৃষ্টিশীলতার খুবই বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, সেটার ব্যাখ্যায় দেখবেন আমাদের রবীন্দ্রপ্রেমীরা আমতা আমতা করে প্রতিভা-টতিভা এসব কথা বলে। এরচেয়ে রবীন্দ্রনাথের ওই বাস্তবলিপ্ততা আর সক্রিয়তাতেই আসলে ভালো ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। এর প্রমাণ, শিক্ষা, ভাষা, প্রকৃতিসহ রবীন্দ্রচিন্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোতে আপনি বাস্তব তৎপরতার প্রত্যক্ষ প্রতিফলন পাবেন।

 

আমার আন্দাজ, আগামী ‍দিনগুলোতে ভাষা, শিক্ষা আর প্রকৃতি প্রশ্নে রবীন্দ্রসাহিত্যের নতুন পাঠ ক্রমশই জোরদার হবে। নতুন পশ্চিমায়িত-নাগরিক-শিক্ষিত বাঙালির যে সংস্কৃতি কলকাতার বাস্তবতায় উনিশ শতকে রূপলাভ করেছিল, রবীন্দ্রনাথ তার প্রধান স্থপতি – তাঁর লেখালেখি-যে অদ্যাবধি নিত্য-প্রাসঙ্গিক আছে, তার অন্যতম রহস্য সেখানেই। আর সাহিত্য-শিল্পী হিসাবে রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার এবং সম্ভবত ভারতীয় যে কোনো ভাষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসিক – এটা খানিকটা বুঝতে পারা, আর খানিকটা ব্যাখ্যা করতে পারাই একজন পেশাদার রবীন্দ্র-ব্যবসায়ী হিসাবে আমার ভালো লাগার দিক।

আগামীকাল পড়ুন তৃতীয় পর্ব

প্রথম পর্ব পড়ুন ।। ক্লিক করুন নিচের লিংকে

মোহাম্মদ আজমের সঙ্গে আলাপ ।। প্রথম পর্ব

1 COMMENT

  1. খুব মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। ২পর্বই। আসলেই তাই। আমাদের সমস্যা টেক্সট পাঠের পদ্ধতিতে, চিন্তা করার প্রক্রিয়ায়। সময় এসেছে এই সমস্ত আরও অনেক গভীর থেকে চিন্তা করার। ভেবে সাহিত্য পাঠের দৃঢ় অবস্থান তৈরি করার যুগ এসে গেছে।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here