ছয় ঋতু : দেড়শো বছর আগে?

ছবি : হরেন দাস

মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রণীত শিশুশিক্ষা বইয়ের দ্বিতীয় ভাগ থেকে গৃহীত। বইটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘এতদ্দেশীয় বালিকা বিদ্যালয়ের ব্যবহারার্থ’। বইটির প্রকাশকাল ১৮৫০।

গ্রীষ্ম।

বারো মাসের মধ্যে বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ এই দুই মাস গ্রীষ্মকাল। এই কালে সূর্য্যের তেজ বড় তীক্ষ্ণ হয়। জলাশয়ের জল শুকাইয়া যায়। দিনের বেলায় রৌদ্রের জন্য ঘরের বাহির হওয়া যায় না। অনবরত শরীরে ঘাম হয়। সর্ব্বদা পিপাসা পায়। শরীর জুড়াইবার জন্যে সকল জীব জন্তু শীতল স্থানে বাস করিতে বাসনা করে। দক্ষিণ দিক হইতে বেগে বায়ু বহিতে থাকে, মধ্যে মধ্যে অপরাহ্ণে ঝড় জল বজ্রপাত হয়, এবং আম জাম কাঁঠাল প্রভৃতি নানাবিধ ফল পাকে। এই কালে দিন বাড়ে রাত্রি ছোট হয়।

 

হে বালক বালিকাগণ, তোমরা গ্রীষ্মকালে রৌদ্রের সময় ঘরের বাহির হইও না। বিকাল বেলায়, যখন মাটী ও বায়ু শীতল হইয়াছে দেখিবে, তখন মাঠে গিয়া খেলা করিবে ও বেড়িয়া বেড়াইবে।

 

বর্ষা।

আষাঢ় শ্রাবণ মাস বর্ষাকাল। এই কালে আকাশ প্রায় মেঘে আচ্ছন্ন থাকে। সর্ব্বদা অতিশয় বৃষ্টি ও মেঘগর্জ্জন হয়। নদ নদী খাল বিল পুকুর প্রভৃতি সকল জলাশয় জলে পরিপূর্ণ হইতে থাকে। পথ ঘাট কাদা হইয়া যায়; পথিক লোকের যাতায়াত করা কঠিন হইয়া উঠে।

 

এই সময়ে ভেকগণের বড় আনন্দ; ইহারা নূতন জল পাইয়া নানা রঙ্গে খেলা করে ও উচ্চস্বরে ডাকিতে থাকে। ময়ূর ময়ূরী মেঘ দেখিয়া আহ্লাদে পেকম ধরিয়া নাচিয়া বেড়ায়। কেতক ও কদম্ব পুষ্প ফুটিয়া গন্ধে চারিদিক আমোদিত করে, এবং আতা পেয়ারা আনারস প্রভৃতি সুখাদ্য ফল সকল পাকে। চাসী লোকেরা মাঠে মাঠে ধান্য রোপণ করিতে থাকে।

 

এই কালে পূর্ব্বদিক হইতে অহিতকারী বায়ু বহে। হে শিশুগণ, সেই বায়ু শরীরে লাগাইলে এবং বৃষ্টিতে ভিজিয়া কাদায় কাদায় বেড়াইলে কফ কাশী জ্বর জ্বালা অনায়াসে হইতে পারে।

 

শরৎ।

ভাদ্র ও আশ্বিন মাসে শরৎকাল হয়। এই কালে আকাশমণ্ডল ও দিক্ সকল পরিস্কৃত হইতে থাকে। সূর্য্যের কিরণ খরতর হয়। পথের কাদা ও ভূমির জল প্রায় শুকাইয়া যায়। নদ নদীর জল নির্ম্মল হয়। চন্দ্র ও তারাগণের জ্যোতি উজ্জ্বল হওয়াতে রাত্রিকালে আকাশের বড় শোভা হয়। কমল কুমুদ প্রভৃতি জলপুষ্প এই সময়ে প্রস্ফুটিত হইয়া জলাশয়ের শোভা করে। হংস বক চক্রবাক সারস প্রভৃতি জলচর পক্ষী আনন্দে কেলি করিতে থাকে। লেবু নারীকেল তাল সুপারী প্রভৃতি নানাবিধ ফল পরিপক্ব হইয়া বৃক্ষের শোভা বৃদ্ধি করে।

 

এই সময়ে সমুদায় মাঠ ধানের গাছে পরিপূর্ণ দেখিয়া নয়নের বড় প্রীতি জন্মে। হে শিশুগণ, সকালে ও বিকালে যদি মাঠের দিকে বেড়াইতে যাও, তবে ধান্যের শোভা দেখিয়া বড় আহ্লাদ পাইবে। শরৎকালের রৌদ্র বড় উগ্র ও অপকারক, কদাচ শরীরে লাগাইও না।

 

হেমন্ত।

কার্ত্তিক অগ্রহায়ণ দুই মাস হেমন্ত। এই কালে উত্তর দিক হইতে অল্প অল্প শীতল বায়ু বহিতে আরম্ভ হয়, এবং অল্প অল্প শীত অনুভব হইতে থাকে। রাত্রিকালে এত হিম পড়ে যে প্রভাতে বোধ হয় যেন বৃষ্টি হইয়াছে।
এই কালে মনুষ্যেরা শীত বস্ত্র ব্যবহার করিতে আরম্ভ করে। দিনের পরিমাণ অল্প হইতে থাকে এবং রাত্রির পরিমাণ ক্রমে ক্রমে অধিক হয়। রৌদ্রের তেজ হ্রাস হইয়া যায়, হেমন্ত কালে ক্ষেত্রের ধান্য পাকিয়া উঠে।
হে শিশুগণ, হেমন্তকালের হিম শরীরে লাগিলে বড় পীড়া হয়, অতএব শীতবস্ত্র দ্বারা সর্ব্বদা শরীর ঢাকিয়া রাখা কর্ত্তব্য।

 

শীত।

হেমন্তের পর পৌষ মাঘ মাসে শীতকাল আগত হয়। উত্তরের বায়ু যত বেগে বহিতে থাকে ততই শীতের বৃদ্ধি হয়। রাত্রিকালে মনুষ্যেরা শীত নিবারণের জন্যে লেপ কাঁথা কম্বল ব্যবহার করিয়া থাকে। দিবসেও শাল রুমাল বনাত লুই পাছুড়ি প্রভৃতি শীত বস্ত্র গায় না দিলে শীত ভাঙ্গে না, কোন ব্যক্তিই জলের ত্রিসীমানায় যাইতে চায় না, কেবল আগুনের তাত ও রৌদ্রের উত্তাপ ভাল লাগে।

 

রাত্রিকালে আকাশ মণ্ডল ধূমে ও শিশিরে আচ্ছন্ন হইয়া থাকে। চন্দ্র ও তারাগণের প্রভা মলিন দেখায়। এই সময়ে রাত্রি অনেক বড় হয়, দিন একেবারে ছোট হইয়া যায়। মুগ মটর মাষকলাই রাই শরিষা প্রভৃতি রবি খন্দ শিশিরের জল পাইয়া প্রস্তুত হয়। কিন্তু পদ্ম আদি জলপুষ্প একেবারেই নষ্ট হইয়া যায়। মধ্যে মধ্যে প্রাতঃকালে কুজ্ঝটিকা হইয়া থাকে। শীতকালে সকল লোকেই অতিশয় পরিশ্রম করিতে পারে, অথচ ক্লেশ বোধ হয় না।

 

বসন্ত।

ফাল্গুন ও চৈত্র মাস বসন্তকাল। এই সময়ে দক্ষিণ দিক্ হইতে মন্দ মন্দ বায়ু বহিতে থাকে। আকাশ মণ্ডল নির্ম্মল ও সূর্য্যের তেজ তীক্ষ্ণ হয়। এবং চন্দ্র ও তারাগণের আলোক উজ্জ্বল হয়। সমুদয় তরু ও লতা অসাধারণ শ্রীবৃদ্ধি হয়। কাহারো নূতন পল্লব কাহারো মুকুল কাহারো মঞ্জরী কাহারো ফুল কাহারো ফল উৎপন্ন হইতে থাকে। পুষ্পের মধু পান করিবার অভিলাষে ভ্রমর ও মধুমক্ষিকাগণ এক পুষ্প হইতে অন্য পুষ্পে উড়িয়া উড়িয়া বসিতে থাকে। পক্ষিগণ বৃক্ষের শাখায় বসিয়া আহ্লাদে মধুর স্বরে গান করে। বসন্তকাল সকল কাল অপেক্ষা উত্তম। এই কালে না শীত না গ্রীষ্ম না বৃষ্টি না শিশির কিছুই থাকে না। সুতরাং সকল প্রকার জীবজন্তু আনন্দে কাল যাপন করে।

 

* শিরোনাম সহিজয়ার দেয়া।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here