লিঙ্গ প্রকরণে নারীবাদের প্রকোপ

নারীর জন্য কি আলাদা ভাষা আছে? নারী-পুরুষের ভাষা কি আলাদা? নারীবাদীরা ভাষাকে কীভাবে দেখেন? এই দেখায় সমস্যা আছে কি? বুঝতে চেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক তারিক মনজুর

 

তত্ত্বীয়ভাবে নারীবাদ দারুণ! কিন্তু নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠাই যদি প্রশ্ন হয়, তবে সমাজতাত্ত্বিক অন্য কারণগুলোর সুগতি করা দরকার। নারীবাদ অবশ্য নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে না। নারীবাদের লক্ষ্য থাকে লিঙ্গ-অসাম্যের প্রকৃতি বোঝা। কিন্তু কীভাবে লিঙ্গ-সমতা আসবে, তা এই তত্ত্ব দেখাতে অক্ষম। সমাজে নারী ও পুরুষের ভূমিকা কখনোই এক রকম ছিল না, তা কখনো হবেও না। নারী বা পুরুষের কেউ কোনোভাবে অবমূল্যায়িত (কিংবা পিষ্ট) হচ্ছে কি না, এর খোঁজই জরুরি ছিল। এ অর্থে মানবতাবাদ কিংবা লিঙ্গ-সাম্যবাদের ধারণা জনপ্রিয় হওয়ার কথা। কিন্তু একুশ শতকের সূচনালগ্নে দেখা যাচ্ছে, মানবতাবাদের চেয়ে নারীবাদ জনপ্রিয় তত্ত্ব।

 

নারীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে নারী-পুরুষ যে-কেউ কথা বলতে পারে। কিন্তু নারীবাদ তত্ত্বের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে শব্দের উপর আক্রমণ করার অধিকার কারও নেই। নারীর কোন্ স্বার্থে ছেলেবেলাকে ‘মেয়েবেলা’ বলতে হবে? কেন চেয়ারম্যানকে বলবে সবাই ‘চেয়ারপারসন’? ‘সম্পাদিকা’ বললে সম্পাদনা-কাজে নারীর কতখানি সম্মানহানি হয়? এসব প্রশ্ন ওঠে। কারণ, এভাবে শব্দ বদলিয়ে নারীর অধিকার বা সমতা কোনোটাই আদৌ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। কেউ বলতে পারেন, দৃষ্টিভঙ্গি তো বদলাবে। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর হাজারো উপায় আছে; নির্বিষ ভাষাকে বিষাক্ত করে নয়।

 

শব্দের মধ্যে লিঙ্গ-সম্পর্ক খোঁজার কারণ কী? শব্দের সঙ্গে লিঙ্গ-সম্পর্ক থাকে ধ্রুপদী ভাষায়। সংস্কৃত ভাষায় দেব, জনক, বণিক, সম্রাট এগুলো যেমন পুংলিঙ্গ শব্দ, তেমনি দিবস, চন্দ্র, সূর্য, মেঘ, হ্রদ এগুলোও পুংলিঙ্গ শব্দ। আধুনিক ভাষায় কোনো শব্দই নিজে পুরুষ বা স্ত্রী নয়, এমনকি ক্লীবও নয়। মামা পুরুষ, কিন্তু মামা শব্দটি পুরুষ নয়। মামি স্ত্রী, কিন্তু মামি শব্দটি স্ত্রী নয়। মামা, মামি ইত্যাদি শব্দ দিয়ে পুরুষ বা স্ত্রী প্রাণীকে নির্দেশ করে মাত্র। আবার, কলম, মেঘ ইত্যাদি শব্দে বস্তু নির্দেশিত হয়; বস্তুবাচক কোনো শব্দ আধুনিক ভাষায় কোনো ব্যাখ্যাতেই পুরুষ বা স্ত্রী নয়, এমনকি ক্লীবও নয়।

 

শব্দের মধ্যে পুরুষতন্ত্র খুঁজে বেড়াচ্ছেন বৃথাই। পুরুষের পৌরুষ ও শক্তির হীনতার খোঁজ ভালো পাবেন সমাজের আর দশটি প্রত্যয়ের দিকে তাকালে। তবে পুরুষ-গন্ধের অজুহাতে ভাষায় দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত শব্দের পরিবর্তন করা ‘ভাষা-আদালতে’ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ছেলেবেলা, চেয়ারম্যান আর সম্পাদিকার মতো নিরপরাধ শব্দকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন না।

 

অবাক লাগে, মামা আর মামি, ভাই আর বোন, বাবা আর মা — এসব ক্ষেত্রে পুরুষ-স্ত্রীর ভেদে কোনো দোষ হয় না। দোষ হয় সম্পাদক আর সম্পাদিকায়, কবি আর মহিলা কবিতে। বাদীপক্ষ অবশ্য একটা খোঁড়া যুক্তিকে ক্র্যাচে ভর দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন: আত্মীয়-নির্দেশক শব্দগুলোয় নারী-পুরুষ ভেদ থাকতে পারে; কিন্তু পেশাগত পরিচয়ের শব্দগুলো এক হতে হবে!

 

পৃথক পৃথক শব্দ দিয়ে যদি চেনা যায় তিনি পুরুষ বা নারী, তবে সমস্যা কোথায়? তবে এই যুক্তিতে সব শব্দেরই পুরুষ-স্ত্রী নতুন করে তৈরি করার দরকার নেই। ভাষা নিজের মতো করে ভাঙা-গড়ার কাজটি করে নেয়। এর উপর অযাচিতভাবে হাত চালাতে গেলে শুধু ভাঙার কাজটি হয়, গড়ার কাজ হয় না।

 

‘ম্যান অব দ্য ম্যাচে’র বদলে এখন শুনবেন প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ। তার মানে, বিশ্ব জুড়ে ‘নারীবাদে’র আগ্রাসী অথচ ভ্রান্ত দৃষ্টি পড়েছে শব্দের ওপর। চেয়ারম্যান শুধু চেয়ারপারসন হয়েই শেষ হয়নি, অনেকক্ষেত্রে শুধু চেয়ার হয়ে গিয়েছে। বস্তুগত উপাদানে নারী-পুরুষের সমতার পরিচয়ে কোন্ সুখ উৎপাদিত হয়, বুঝি না।

 

সবশেষে বলি, বদল যদি করতে চান, রাষ্ট্রপতি, দেশপ্রেমিক — এসব শব্দেরও বদল করুন। কারণ, এসব শব্দের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক গন্ধ শুধু নেই, এসব শব্দের মধ্যে পুরুষের বাহুবলের কদর্য ইতিহাসও জড়িয়ে আছে। আধুনিক রাষ্ট্র নারীকে ‘রাষ্ট্রপতি’ হওয়ার অধিকার দিতে চায়নি; আর নিজের তাগিদেই নারী যুদ্ধে গিয়ে ‘দেশপ্রেমিক’ হয়েছে।

 

আরও পড়ুন ।। ক্লিক করুন নিচের লিংকে

এ্যা-র সর্বনাশা প্রকোপ

1 COMMENT

  1. যৌক্তিক আলোচনা। অফিসপাড়ায় নারী কর্মকর্তাদের স্যার ডাকা এখন আবশ্যিক বিষয়। এর অন্যথা হলে বেশ ঝক্কিঝামেলা সামলাতে হয়।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here