মোহাম্মদ আজমের সঙ্গে আলাপ ।। প্রথম পর্ব

মোহাম্মদ আজম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক। তাঁর গবেষণা-এলাকা বেশ প্রসারিত। তিনি যেমন গবেষণা করেছেন রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে, আবার গবেষণা করেছেন জনপ্রিয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রধান প্রতিনিধি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়েও। সহজিয়ার পক্ষ থেকে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি আমরা। দীর্ঘ এই আলাপে উঠে এসেছে ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রনাথ, হুমায়ূন, চলচ্চিত্র ইত্যাদি। তিনটি পর্বে আমরা পুরো আলাপচারিতা প্রকাশ করব। আজ থেকে শুরু হচ্ছে সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব

 

সহজিয়া: আপনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। আচ্ছা, গণহারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা পড়ানোর দরকারটা কী? শত বর্ষ ধরে বাংলা পড়ানো হচ্ছে, বাংলা অঞ্চলে বাংলা বিদ্যাচর্চার সামগ্রিক অবদান কী?  

মোহাম্মদ আজম : বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এবং কলেজগুলোতে গণহারে যে বাংলা পড়ানো হচ্ছে, আপনার এ দাবি ঠিক। দরকারটা কী – সে প্রশ্নের আলাপে গেলে অন্তত কয়েকটা দিক সামনে আনতে হবে।

 

প্রথম কারণটা বাংলাদেশের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার সাথে যুক্ত। এখানে চোদ্দ বছর সাধারণ শিক্ষার মধ্য দিয়ে অথবা সম্মানজনক কেতায় বৃত্তিমূলক শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করার কোনো বাস্তবতা প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। আগে বিএ-বিকম-বিএসসির একটা ধারা ছিল। সেটা এখন বিলুপ্তির পথে। ফলে অনার্স পড়া এখন ‘জাতীয়’ কেতা। অনার্স পড়ার জন্য ‘সহজ’ বিষয় হিসাবে বেশ কিছু বিষয় ছাত্রছাত্রীরা পছন্দ করে। সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলা তার মধ্যে পড়েছে।

 

দ্বিতীয় কারণটাও আমাদের জাতীয় সংকটই বটে। শিক্ষাব্যবস্থার সাথে মিলিয়ে বাজারের চাহিদা বোঝার কোনো রকম জরিপের ব্যবস্থা আমাদের নাই। ফলে কোন বিষয়ের কী পরিমাণ গ্রাজুয়েট আপনি তৈরি করবেন, তার হিসাব নাই। এমতাবস্থায় যত পারা যায় শিক্ষার্থী নিয়ে নিলে আপনাকে কেউ যে নীতিগতভাবে বিরোধিতা করবে, তার কোনো পরিষ্কার সুযোগ থাকছে না।

 

এখন আপনি তো ক্লাসে ঠিকমতো পড়াচ্ছেনও না। আমার ধারণা, এক ক্লাসে সর্বোচ্চ জনা চল্লিশেক শিক্ষার্থী থাকলে আন্ডারগ্রেড লেভেলে পড়াশোনাটা হতে পারে। যেহেতু আপনাকে ক্লাসে পড়াতে হচ্ছে না – সেই চল নাই – আপনি বেশুমার ছাত্রছাত্রী নিয়া নিলেন। তাতে আপনার দল ভারি হল। ছাত্রছাত্রীপিছু কিছু আর্থিক সুবিধাও হয়ত আছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ক্রমাগত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেড়েই চলছে, এমনকি ওই সমস্ত বিভাগেও যেগুলোর নির্দিষ্ট একটা চাকরিও বাজারে নাই, তার পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে বলে তো মনে হয় না।

 

কিন্তু আপনি যদি সংখ্যায় রাশ টেনে ধরতে পারেন, তাহলে আমি অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বা যে কোনো ‘বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে’ বাংলা বিভাগ খোলারই পক্ষপাতী। কারণ, সাহিত্য ও ভাষাচর্চার একটা সর্বজনীন চাহিদা আছে। সারা দুনিয়াতেই সে চাহিদা শিক্ষকতা ও অন্য নানা ফর্মে চাকরির সুযোগ তৈরি করে। ভাষা ও সাহিত্যচর্চার অন্য সামাজিক প্রভাবও আছে। কিন্তু আপনার হাতে পরিসংখ্যানটা থাকতে হবে। সেই পরিসংখ্যানই অনেক কিছু নিজে থেকেই বলে দেবে।

 

আপনার প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশে আসি। আপনি যদি পুরা বাংলাভাষী অঞ্চলের কথা বলে থাকেন, তাহলে বলব, বাংলাবিদ্যার প্রভাব, সাফল্য বা অবদান বেশ ভালো। অবশ্য ‘ভালো’ কথাটা আমাদের অ্যাকাডেমিক মানের নিরিখে ব্যবহার করছি – কোনো বিশ্বজনীন মানদণ্ডে নয়।

 

কলকাতায় পুরো চর্চার সাথে ‘বাঙালি’ সংস্কৃতির একটা যোগ ছিল। সেকালের দুনিয়াজুড়ে প্রভাবশালী প্রাচ্যবিদ্যাচর্চার বেশেও অ্যাকাডেমিক কাজ ভালোই হয়েছে। তাছাড়া, একেবারেই ঔপনিবেশিক বাস্তবতার কারণে, বাংলা সাহিত্যের যে বর্ণাঢ্য চর্চার ধারা এ অঞ্চলে উনিশ-বিশ শতকে তৈরি হয়েছিল, তাও বাংলাবিদ্যার একটা অন্যরকম মূল্য তৈরি করেছিল।

 

বাংলাদেশে অন্য একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল গত শতকের ষাটের দশকে। তখন ‘বাঙালি’ পরিচয় একটা রাজনৈতিক আভিজাত্য ও গুরুত্ব অর্জন করেছিল। সে সুবাদে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রায় যে কোনো চর্চা জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড হিসাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। সে ইতিহাস আমরা জানি। এবং সে সময়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা বেশ পরিমাণ ব্যক্তির খবরও আমরা জানি।

 

কিন্তু আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করে বসেন, বাংলাদেশে এই গুরুত্ব অ্যাকাডেমিক চর্চার মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছিল কি না, তাহলে আমি একটু থমকে যাব। আমাকে একটু ভেবে নিয়ে বলতে হবে, অর্জনটা মুখ্যত রাজনৈতিক-জাতীয়তাবাদী; গৌণত অ্যাকাডেমিক-বুদ্ধিবৃত্তিক। আর এর পরে যদি আপনি চলতি কয়েক দশকের হাল জানতে চান, তাহলে আমাকে বলতেই হবে, অবদানটা প্রধানত অ্যাকাডেমিক-বুদ্ধিবৃত্তিক ছিল না বলেই, জাতীয় রাজনীতির মূলধারা থেকে বিচ্যুত হবার সাথে সাথেই অবদানের পাল্লাটাও নিচের দিকে নেমেছে। এবং আজকাল প্রায় ভূমির সমতলে নেমে এসেছে।

সহজিয়া: বাংলার বদলে অন্য কোনো অর্থকরী, উন্নয়মূলক, জাতীয় ও গণ-চাহিদাসম্পন্ন বিষয়ের ওপর আলাদা করে গুরুত্ব দেয়া যেত না? এদেশে যতোগুলো বাংলা বিভাগ আছে, ততোগুলো দর্শন বা ইতিহাস বিভাগ নেই। ‍জনস্বাস্থ্য, চিকিৎসা, কৃষি, পোশাক শিল্প, শ্রম-ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিদ্যার পেছনে বেশি অর্থ ব্যয় করা যেত না?

মোহাম্মদ আজম: খুব যেত। আসলে হচ্ছেও তাই। অর্থকরী বিষয়গুলোর দিকেই লোকে ছুটছে। এই নিউ-লিবারেল জমানায় দুনিয়াজুড়ে ওই একই হাল। তার প্রমাণ আপনি পাবেন কথিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। কথিত বললাম এ কারণে যে, দুনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাংশ আদতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। সেগুলোর সাথে আমাদেরগুলার যে মৌলিক তফাত আছে, তা না বললেও চলে।

 

তবু যে আপনি এখানে বাংলার মতো অ-বাজারি বা কম অর্থকরী বিষয়ে বিপুল পরিমাণে ছাত্রছাত্রীদের পড়তে দেখছেন, তার কারণ, এতে টাকা খরচ হয় কম। আর অন্যদিকে যারা পড়ে ও যারা পড়ায় তাদের কোনো পক্ষই ‘পড়া’ ব্যাপারটা মিন করে না। অর্থাৎ, পুরো ব্যাপারটাই পরিকল্পনার বাইরে ঘটছে। যেমনটা আমি আগেই বলেছি।

তবে বাংলার মতো বিষয়ের ক্ষেত্রে এমনকি পরিকল্পনার ভিতরেও এবং আর্থিক ও অন্য প্রয়োজনের নিরিখেও গ্রাজুয়েট তৈরি করা জরুরি। বাংলা বিভাগগুলোতে ভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হয়, বা পড়ানোর কথা। দুনিয়াজুড়ে শিক্ষাতত্ত্বের যে কোনো ধারাতেই ভাষাশিক্ষার জরুরতটা স্বীকৃত। আর এটাও মনে করা হয়, অন্তত বার ক্লাস পর্যন্ত সব ছাত্রছাত্রী সাহিত্য পড়বে। ভাষা শেখাটা দরকার; কারণ, অচেতনভাবে রপ্ত করা প্রথম ভাষা সচেতনভাবে শিখে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জন ও অন্য দুনিয়াবি কাজে লায়েক হবে। এজন্য লেখার ভাষাটাও ভালোভাবে রপ্ত করা জরুরি। ওটা অচেতন প্রক্রিয়ায় হয় না। রীতিমতো ওস্তাদ রেখে, অর্থাৎ ক্লাসরুমে শিখতে হয়। আবার সাহিত্য পড়তেও অভ্যস্ত হতে হবে ছাত্রছাত্রীদের। অন্তত বার ক্লাস পর্যন্ত সাহিত্যের সাথে আনুষ্ঠানিক পরিচয় সাধিত হলে তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক যে মূল্য তৈরি হবে, সেটা জনগোষ্ঠীর সার্বিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয়। দুনিয়াজুড়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে এটা খুবই কমন চিন্তা। এ কারণেই ভাষা ও সাহিত্যে পারঙ্গম গ্রাজুয়েট দরকারি। যাতে তারা শিক্ষক হিসাবে ওই বার/ চোদ্দ ক্লাসের চাহিদা পূরণ করতে পারে। অন্য চাহিদাগুলোর কথা এখানে মুলতুবি রাখলাম।

 

তার মানে হল, বাংলাদেশের বাংলা বিভাগগুলো জনগোষ্ঠী, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য জরুরি কাজই করছে। প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, আদৌ কি এই গ্রাজুয়েটরা সেই দায়িত্ব পালন করতে পারছে? সেটা অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু বাংলা বিভাগের বিপুল গ্রাজুয়েট যে দরকার, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। যদি প্রশ্ন ওঠে, জরুরি অন্য নানা বিদ্যার চেয়ে কি বাংলা পড়ানো বেশি জরুরি, তাহলে আমি বলব, এ দুয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ তো নাই। অর্থাৎ আপনি বাংলার জন্য প্রয়োজনীয় গ্রাজুয়েট তৈরির পরেও চিকিৎসা, বিজ্ঞান, প্রকৌশল বা ব্যবসা-প্রশাসনের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে পারছেন। দরকার পরিকল্পনা ও পরিসংখ্যান। আর আরেকটা বস্তু দরকার, যা আমাদের দেশে নাই: পড়াশোনার সুষ্ঠু প্রবাহের মধ্য দিয়ে স্কিলফুল গ্রাজুয়েট তৈরি করা।

 

সহজিয়া : বাংলাদেশে অ্যাকাডেমিক গবেষণার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কোনো সম্পর্ক নেই। জনগণেরও কোনো সম্পর্ক নেই। ইচ্ছেমতো বিশ্ববিদ্যালয় আর বিভাগ খোলা হয়। জনগণ বিচ্ছিন্ন গবেষণা, শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কী দরকার?

মোহাম্মদ আজম: আপনার প্রশ্নকে দুইভাগ করতে চাই, আর শেষাংশের উত্তর দিতে চাই আগে।

 

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভাগ খোলার পেছনে অ্যাকাডেমিক কোনো যুক্তি কাজ করেছে – এমন ঘটনা সত্যযুগে ঘটেছিল কি না জানি না, কিন্তু গত অন্তত কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে মনোযোগের সাথে ব্যাপারটা, অন্তত আর্টস-সোস্যাল সাইন্স পরিসরে খেয়াল করছি, এরকম কিছু দেখি নাই। তাহলে কোন বিবেচনা থেকে ‘বিভাগ’ খোলা হয়? নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নন-টেকনিকেল বিষয় খোলা হয় স্রেফ বিভাগ-সংখ্যা বাড়ানোর জন্য; আর পুরানা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বহু নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে – অনেকের কাছে হয়ত অবিশ্বাস্য মনে হবে – শুধুই একজন ব্যক্তির চেয়ারম্যান হবার মতো তুচ্ছ খায়েশ পুরা করবার জন্য। কোনো বিভাগের কিছু চাকুরিপ্রার্থীর আশা পূরণের জন্য বিভাগ খোলা হয়েছে, এমন উদাহরণ বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ আছে। যতটা ভাবা যায়, বা যতটা মনে করা হয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছ্যাঁচড়ামির মাত্রা তারচেয়ে অনেক বেশি।

 

তাহলে কী হওয়া উচিত ছিল? হিসাবটা খুবই সহজ। আমি আগেই বলেছি, আন্ডারগ্রেডের সাথে বাজারের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। ধাপটি মুখ্যত স্কিলফুল গ্রাজুয়েট সরবরাহের জন্য। যে বিষয়ের সাথে বাজারের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নাই, সে বিষয়ে অনার্স লেভেলে পড়ানোর প্রশ্নই আসে না। যদি দেখা যায়, বাজারে একটি বিষয়ের স্নাতকের চাহিদা বাড়ছে, অথচ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সে বিষয়টা অনার্স হিসাবে পড়ানো হচ্ছে না, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগ খোলার উদ্যোগ নিতে পারে। সম্ভবত দশ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা লাগবে। প্রথমে সংশ্লিষ্ট কোনো বিভাগে মাস্টার্সের একটা স্ট্রিম চালু করা, ওই বিষয়ে দু-চারজন উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করা শিক্ষকের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। তারপর অনার্স খোলা।

 

প্রশ্ন আসতে পারে, যদি বাজারই মুখ্য হয়, তাহলে ‘জ্ঞান’ ও ‘গবেষণা’র কী হবে? এগুলা থাকবে। পালিয়ে যাবে না। বাজারের সাথেই থাকবে। জ্ঞানের জন্য আর গবেষণার জন্য আছে মাস্টার্স এবং আরো উচ্চতর শিক্ষা। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বহু বিভাগ থাকার কথা, যেখানে শুধু মাস্টার্স বা নানা ধরনের ডিপ্লোমা দেয়া হবে। এ ধরনের কিছু আপনি পাবেন না। অনার্সে শিক্ষার্থী নিলে বোধ হয় বেশি সালাম পাওয়া যায়। টাকাও কি কিছু পাওয়া যায়? বিভাগে বেশি শিক্ষক নিয়োগ দেয়া যায়। পুরা ব্যাপারটার সাথে লাঠিয়ালির একটা যোগ আছে। শিক্ষার নয়। জনগণ তো পরের কথা। পরিকল্পনাহীন বিভাগ আর বেশুমার ছাত্রছাত্রী ভর্তি করানো আমাদের এন্টায়ার আন্ডারগ্রেড পড়াশোনার প্রধান ত্রুটি।

 

আমি যাকে ‘বাজার’ বলছি, সেটাই আসলে আপনার কথিত ‘জনগণের সাথে সম্পর্ক’। আন্ডারগ্রেড লেভেলের ‘বাজার’ হল চাকরির বাজার। উচ্চতর পড়াশোনায় ‘বাজার’ হল প্রয়োজনীয় জ্ঞান উৎপাদন। আপনি বলছেন, আমাদের গবেষণার সাথে শিক্ষার্থী বা জনগণের সম্পর্ক নাই। এ বিষয়ে আমার আসলে কোনো বক্তব্য নাই। কারণ, আপনি জনবিচ্ছিন্ন ‘গবেষণা’ দেখছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা হয় – এটাই আমার অজানা। আমার হিসাবমতে, গবেষণা হলে সেটা কিছুতেই ‘জনবিচ্ছিন্ন’ হতে পারে না।

 

আমি বহুদিন ধরে বলে আসছি, বাংলাদেশে আসলে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নাই। কারণ, গবেষণার পরিমণ্ডল ও সংস্কৃতি ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় হয় না বলেই জানি। আপনি নিশ্চয়ই সম্প্রতি প্রচারিত উদ্ভাবনী খাতে বিশ্বতালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দেখেছেন। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দেখার পরও কি বলবেন, এখানে গবেষণা হয়, এবং সে গবেষণা জনবিচ্ছিন্ন? আমি বরং আপনাকে সাথে নিয়ে আশা করতে পারি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণায় প্রবেশ করবে। কারণ, বিশ্বমানের গবেষণা হয়, এমন যথেষ্ট প্রতিষ্ঠান আমাদের আশপাশের দেশগুলোতেই আছে।

 

সহজিয়া: বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা পাঠক্রম প্রধানত সাহিত্যভিত্তিক। ভাষাচর্চার গুরুত্ব কমে এসেছে। এক সময় ভাষাবিজ্ঞান, ভাষার ইতিহাসও সাহিত্যের সঙ্গে প্রায় সমান গুরুত্বের সঙ্গে পড়ানো হত। এখন তা কমে এসেছে। কারণ কী?

মোহাম্মদ আজম: ‘ভাষাচর্চার গুরুত্ব কমে এসেছে’ বললে মনে হয়, একসময় খুব ভাষাচর্চা হয়েছে। কথাটা সীমিত অর্থে বলা যাবে না, তা নয়। তবে এখানে অন্য কাহিনি আছে।

 

কলকাতায় উনিশ শতকের শেষাংশে এবং বিশ শতকের গোড়ায় বাংলা ভাষাচর্চার অবস্থা বেশ ভালো ছিল। এর প্রথমাংশ সরাসরি প্রাচ্যবিদ্যা ও সংস্কৃতচর্চার সাথে যুক্ত। পরে এর সাথে যোগ হয়েছে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা। তার সাথেও ‘সোনালি ভারত’, সেই ভারতের প্রতিনিধি হিসাবে সংস্কৃত এবং তার পরের প্রজন্ম হিসাবে বাংলাকে আবিষ্কারের একটা বড় ভূমিকা আছে। আমাদের প্রধান ভাষাতাত্ত্বিক ও তাঁদের কাজগুলো পরীক্ষা করলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। কলকাতায় গত অর্ধশতকে ভাষা-বিষয়ক তাৎপর্যপূর্ণ কাজের পরিমাণ যে খুব কমে গেছে, তাও পূর্ববর্তী চর্চার ধরন বোঝার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বাটখারা।

 

বাংলাদেশে ভাষাবিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস বেশ খানিকটা আলাদা। লিবারেল জমানায় সাহিত্যের লোকদের একটা উঁচু মর্যাদা সারা দুনিয়াতেই ছিল। সংস্কৃতি বিক্রির প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে লিবারেল আর্টস আর সোস্যাল সাইন্স ঘরানার লোকদের বৃত্তি দিয়ে পড়তে নিয়ে যাওয়ারও একটা রেওয়াজ ছিল। বাংলা বিভাগের লোকদের অনেকেই – যোগ্যতাবলে নিশ্চয়ই – সে সুবিধা নিতে পেরেছেন। কিন্তু বিদেশে গিয়ে পড়ার জন্য বাংলা সাহিত্যের চেয়ে ভাষাবিজ্ঞানের বাজারই ছিল তুলনামূলক ভালো এবং সহজতর। লোক গুনে গুনে দেখতে পারেন, এ তরিকায় আমাদের অনেকেই বিদেশে ভাষাবিজ্ঞান পড়েছেন। তাঁরা পরে দেশে ফিরে ভাষার চর্চা খানিকটা করেছেন বটে, কিন্তু অ্যাকাডেমি না থাকায় কাজকারবার বেশি আগায় নাই। কিন্তু বাংলা বিভাগগুলোতে এ ধরনের ট্রেইন্ড ভাষাবিজ্ঞানী থাকার কারণে ভাষাবিষয়ক কোর্সও তুলনামূলক বেশি ছিল।

 

কথাটা অন্যভাবেও বলা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের, এবং সে সূত্রে অন্য বাংলা বিভাগগুলোরও, সিলেবাস মূলত দুইজনের করা। প্রথমজন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এবং দ্বিতীয়জন মুহম্মদ আবদুল হাই। পূর্বোক্ত কারণেই, কলকাতার এবং ঢাকার, দুজনই ছিলেন ভাষাবিজ্ঞানের মানুষ। তাঁদের প্রতাপের কারণেই বাংলা বিভাগগুলোর সিলেবাসে ভাষাবিজ্ঞানের উপস্থিতিটা, বেশি না হোক, চোখে পড়ার মতো ছিল।

 

কিন্তু এখানকার স্থানীয় অ্যাকাডেমিতে ভাষাবিজ্ঞানের চর্চা হয়েছে, এমন প্রমাণ খুব একটা পাওয়া যায় না। না হওয়ার কারণেই পরের প্রজন্মের শিক্ষকরা ভাষাবিজ্ঞানের লোক হিসাবে গড়ে ওঠেননি। এদিকে নিউ লিবারেল জমানায় কলার লোকদের পাত্তা দেয়ার প্রবণতা সারা দুনিয়াতেই গেছে কমে। বিদেশে বৃত্তির পূর্বোক্ত সুযোগ কমে আসার কারণে বৃত্তি নিয়ে ভাষাবিজ্ঞান পড়তে যাওয়ারও সুযোগ রইল না। ফলে বাংলা বিভাগগুলোতে ভাষাবিজ্ঞানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের সংখ্যা নেমে এল প্রায় শূন্যের কোটায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ এ অবস্থার কোনো পরিবর্তন করতে পারে কি না, তা দেখার জন্য আরো বহুদিন অপেক্ষা করতে হবে বলেই মনে হয়।

 

আমার বক্তব্য হল, আগে ভাষাবিজ্ঞানের লোক থাকা আর এখন না থাকাটাই মূল পার্থক্য। অ্যাকাডেমিক অর্থে চর্চা আগেও তেমন ছিল না, আর এখন তো একেবারেই নাই। যদি ভাষা পড়ানোর লোক না থাকে, তাহলে হাতের পাঁচ হিসাবে বাকি রইল সাহিত্য। স্বভাবতই বাংলা বিভাগের সিলেবাসগুলো বেশ সাহিত্যময় হয়ে উঠল। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে অ্যাকাডেমিক বিবেচনা ও পরিকল্পনার কোনো স্থান নাই। সাধারণভাবে হয়ত এ কথা জারি থাকা জরুরি, বাংলা বিভাগগুলোতে কয়েক দশক আগে তুলনামূলক সক্ষম শিক্ষার্থী এখনকার চেয়ে খানিকটা বেশি ছিল। সেটাই হয়ত বিদেশে বৃত্তি, পড়াশোনা এবং ভাষাবিজ্ঞান হিসাবে অনূদিত হয়েছিল।

 

সহজিয়া: সম্পূরক আরেকটি প্রশ্ন করতে চাই। আপনি নিশ্চয়ই এটাও খেয়াল করেছেন যে, ভাষাশিক্ষা দানের ব্যাপারে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগগুলোতে কোনো কোর্স নেই। দুই একটি ব্যতিক্রম ছাড়া। তাহলে যাঁরা বাংলা পড়ে শিক্ষক হচ্ছেন, তাঁরা কী পড়ে, কী কৌশলে, কী শিক্ষা দেবেন? তাঁদের তো ভাষা শিখন ও শিক্ষাদানের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো পড়ালেখা নেই। এ দিক থেকেও কি বাংলা বিভাগ সীমাবদ্ধ নয়?

মোহাম্মদ আজম : আপনি আমার মনের কথা বলেছেন। গত অনেক বছর ধরে আমি আকারে-ইঙ্গিতে এ কথা প্রচার করে আসছি। আমার বিভাগে অন্তত দুটি সিলেবাস করার সময়ে সিলেবাসকারীদের কাছে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছি। কিন্তু এ কথা শোনানো এত সহজ নয়।

 

কেন নয়? কেন আপনি বুঝতে পারছেন, এবং আমিও, কিন্তু অন্য বেশিরভাগ লোক বুঝতে পারে না? না বোঝার কারণ ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন নয়। ওই যে আমরা একটু আগেই আন্ডারগ্রেড লেভেলে পড়ার কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে বাজারের সম্পর্ক ও পেশার সাথে পাঠের সম্পর্ক বিষয়ে আলাপ করলাম, সমস্যাটা আছে আসলে সেই গোড়ায়। আপনাকে দেখতে হবে আপনার গ্রাজুয়েটরা আদতে কী করে? কেন রাষ্ট্র ভর্তুকি দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কলেজে বাংলা পড়াবে। এর একমাত্র উত্তর, যেমনটা আমরা আগেই বলেছি, সাধারণ শিক্ষায় – মূলত চোদ্দ ক্লাস পর্যন্ত – ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষকতা করা। যদি আপনার মাথায় সেটা থাকে, তাহলে আপনি সিলেবাসে সাহিত্য ও ভাষার [ভাষাবিজ্ঞান নয় সবসময়, যদিও ভাষাবিজ্ঞান অবশ্যই এর অন্তর্ভুক্ত] অনুপাত রক্ষা করবেন। এটা হবে আপনার প্রফেশনাল নৈতিকতা। আপনি আসলে পুরা ব্যাপারটা এভাবে না দেখে বাংলাচর্চাকে এক ধরনের মেকি ছিঁচকাঁদুনে জাতীয়তাবাদের দিক থেকে দ্যাখেন। ফলে বাজারের সাথে সিলেবাসকে সম্পর্কিত না করে আপনি যে অনৈতিক কাজ করছেন, সেটা আড়াল করার একটা মওকা আপনার হাতে থাকে।

 

সাধারণভাবে বাংলা বিভাগগুলোর সিলেবাসে সাহিত্যের প্রাধান্যের একটা প্রাথমিক কারণ আমরা আগেই আলোচনা করেছি। ভাষাবিজ্ঞান বা সাধারণভাবে ভাষা-আলোচনায় কোনো দখল না থাকায় আমাদের শিক্ষকগণ সিলেবাস করার সময়ে ভাষার ব্যাপারটা খানিকটা চেপে যান। কিন্তু প্রশ্ন উঠবে, সাহিত্যও কি পড়া হচ্ছে? অর্থাৎ, সাহিত্যপাঠে স্কিল হাসিল করার জন্য যে ধরনের সিলেবাস ও পাঠপদ্ধতি থাকা জরুরি, তাও কি আছে? আমার ধারণা, এ প্রশ্নের উত্তরে উঁকি মারলে আপনি সমস্যার গোড়ায় যেতে সুবিধা পাবেন।

 

বাংলা বিভাগগুলোতে সাহিত্য পড়ানো হয় মূলত ইমপ্রেশনধর্মী কায়দায়, অর্থাৎ, আমার কী মনে হল – এ কায়দায়। আমি মাঝে-মধ্যেই আমার ছাত্রছাত্রীদের বলি, একটা উপন্যাস পড়ে তোমার যা মনে হয়, আর বিজ্ঞানে পড়ুয়া কোনো তুখোড় শিক্ষার্থীর [সাহিত্যের বইপুস্তক কিছু পড়েন, এমন অনেকে নিশ্চয়ই আছেন ওই পাড়ায়] যা মনে হয়, এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য কিভাবে রচিত হবে? এটা কি খুবই সম্ভব নয় যে, কোনো একটা উপন্যাস বা নাটক অন্য অনেকেই তোমার চেয়ে ‘ভালোভাবে’ পাঠ করতে পারবে? তাহলে তুমি চার/পাঁচ বছর কোন ঘোড়ার ঘাস কাটলে? আর তোমার পেছনে রাষ্ট্রের টাকাটাই বা কেন ঢালা হল?

 

এ সংকট সুরাহার একমাত্র উপায়, সাহিত্যপাঠকে পরিভাষা-ইতিহাস-তত্ত্ব-পাঠপদ্ধতি-সাহিত্যিক ভাষা ইত্যাদি স্কিলে পরিণত করা। একমাত্র এ স্কিলই অন্যদের ইম্প্রেশনধর্মী পাঠ থেকে আপনাকে আলাদা করতে পারবে। কিন্তু তারচেয়ে বড় কথা, এর মধ্য দিয়েই কেবল আপনি ওই স্কিলসম্পন্ন গ্রাজুয়েট তৈরি করতে পারবেন, যারা শিক্ষক হিসাবে সাধারণ শিক্ষার শিক্ষার্থীদের ‘সাহিত্যপাঠ’ শেখাতে পারবে। এটাই আসলে আপনার সাবজেক্টের ন্যায্যতা। আমার বলার কথাটা হল, আমাদের বাংলা বিভাগগুলো-যে সাহিত্য বেশি করে পড়ায়, তার পেছনে কোনো অ্যাকাডেমিক লজিক নাই। প্রাথমিক কারণটা হল, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা ‘সাহিত্যে’র লোক। কিন্তু ওই সাহিত্যও ‘ব্যক্তিগত অভিমত’মাত্র। সবচেয়ে ভালো শিক্ষক যারা, তারা অন্যদের ‘মত’ও উদ্ধৃত করেন – এই যা। পুরো ব্যাপারটাকে স্কিলের দিক থেকে দেখলেই বোঝা যেত, সাহিত্যের স্কিল আর ভাষার স্কিল খুব দূরবর্তী কিছু নয়। সেক্ষেত্রে ভাষাশিক্ষার জন্য উপযোগী সিলেবাসও ধীরে ধীরে বিকশিত হত।

 

এ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমাদের স্কুল-কলেজে বাংলা পঠন-পাঠনের অবস্থা হয়েছে শোচনীয়। আমি আগেই ইঙ্গিত দিয়েছি, চোদ্দ ক্লাস পর্যন্ত প্রায় সারা দুনিয়ায় ভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হয় মুখ্যত ‘লিখিত’ ভাষায় স্কিলফুল নাগরিক তৈরির জন্য, আর সাহিত্যপাঠের সাধারণ কলাকৌশল শিখানোর জন্য। আপনি অচেতনভাবে যে মৌখিক বাংলা রপ্ত করেন, সচেতনভাবে সেটা ব্যবহার করতে পারার জন্যই এ প্রক্রিয়া দরকার। ওই অর্জিত লিখিত ভাষাটাই আপনি ব্যবহার করবেন অন্য যে কোনো বিষয় পড়ার জন্য। পুরো ব্যাপারটা জনগোষ্ঠীকে ‘নাগরিক’ হিসাবে গড়ে তোলার বৃহৎ প্রকল্পের সাথে যুক্ত। কিন্তু আপনি ক্লাসগুলোতে ব্যাকরণকে বানিয়ে রেখেছেন বিভীষিকা, আর সাহিত্যপাঠকে বানিয়েছেন ‘মজা’। শিক্ষার্থীরা বাংলার ক্লাস করে ‘মজা’ করার জন্য। ঢাকা কলেজের বিখ্যাত বাংলার অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এবং নটরডেম কলেজের অধ্যাপক মুখতার আহমেদের জনপ্রিয়তার কারণ, তাঁদের পাঠদানপদ্ধতি এবং তৎপরতার খবর নিলে আপনি আমার কথার সত্যতা উপলব্ধি করবেন। যেখানে বাংলা বিভাগগুলোর কর্মকাণ্ড হয়ে উঠতে পারত সবচেয়ে জরুরি এবং সম্মানজনক কর্মকাণ্ড, সেখানে আপনি পুরো ব্যাপারটাকে প্রায় ভাঁড়ামিতে পর্যবসিত হতে দিয়েছেন।

 

এর করুণ পরিণতি আপনি দেখবেন আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বত্র। পত্রিকা অফিসে, বইয়ের আখড়ায়, অফিসের চিঠির ড্রাফটে, এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাংলা রচনায়। শিক্ষার সাথে জনগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক এবং বাস্তব সম্পর্কের একটা গবেষণা আপনি এই অভিজ্ঞতা থেকে করতে পারবেন। সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বাংলা চালুর জন্য এ বাস্তবতা পরোক্ষ কিন্তু অত্যন্ত গভীর প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছে।

 

এখানে বলে রাখা দরকার, যে অন্ধকার ছবি আমি আঁকলাম, সেটা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সামগ্রিক পশ্চাৎপদতা এবং পরিকল্পনাহীনতার বাইরের কিছু নয়। আর তাছাড়া যা কিছু বাংলাময়, যেমন, বাংলা মদ, বাংলা সাবান, বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ ইত্যাদি, তার প্রতি জনগোষ্ঠীর কারণ-অকারণ বিরাগ তো আছেই। কিন্তু বাংলা বিভাগগুলো এক্ষেত্রে তুলনামূলক কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ রাখে। সে ধরনের কোনো উদ্যোগ দূরের কথা, চিন্তা-ভাবনাও আমার নজরে পড়ে নাই।

সহজিয়া: আরেকটি বিষয় নিশ্চয়ই আপনি খেয়াল করেছেন, প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য বিষয়ক সমালোচনা-গবেষণার সংখ্যা খুবই কম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এধরনের বিষয়নির্ভর গবেষণাকে নিরুৎসাহিত করতে দেখা যায়। এমনকি নন-অ্যাকাডেমিক পরিসরেও, ধরা যাক, সাহিত্য সাময়িকী বা পত্রিকাগুলোতে প্রাচীন সাহিত্য সম্পর্কে নীরবতা পালন করা হয়ে থাকে। এর কারণ কী বলে মনে হয় আপনার?

মোহাম্মদ আজম: প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য-বিষয়ক সমালোচনা ও গবেষণার অত্যল্পতার প্রধান কারণ ‘আধুনিকতা’ নিয়ে আমাদের অর্বাচীন কাঙালপনা। আমাদের কলোনিয়াল আধুনিকতা উনিশ শতকীয় পশ্চিমায়ন ও উপনিবেশায়নকে ‘রেনেসাঁ’ ও ‘আধুনিকতা’ নামে চিনতে শিখিয়েছে। পুরো প্রক্রিয়ার জন্য আগের জমানাকে গৌণ করে দেখা জরুরি। বস্তুত এই অন্ধকার কাউকে ভেবেচিন্তে বের করতে হয়নি। রেনেসাঁর আলো বাই ডিফল্ট আগের অন্ধকার দাবি করে, বা বানিয়ে নেয়। আর আগের অন্ধকার এবং পরের আলোরূপী আধুনিকতা কলোনিয়াল শাসনের ন্যায্যতার জন্য জরুরি ছিল। কে আর সাধ করে অন্ধকারে যেতে চায়? মধ্যযুগের গবেষণা কম হওয়ার দ্বিতীয় কারণ বিশেষজ্ঞতার অভাব। অ্যাকাডেমিক চর্চা ও উৎপাদনের পরিমণ্ডল সক্রিয় না থাকলে বিশেষজ্ঞতা আসবে কোত্থেকে? গল্প-উপন্যাস-কবিতা নিয়ে ইম্প্রেশনধর্মী লেখা দিয়ে যদি বহাল তবিয়তে সারভাইভ করা যায়, তাহলে এত ঝক্কি পোহাতে যাবে কে?

 

কিন্তু এটুকু বললে মোটেই এ আলাপের কোনো সুরাহা হবে না। কারণ, উনিশ শতকের শেষাংশে ও বিশ শতকে কলকাতায় প্রাচীন ও মধ্যযুগ নিয়ে বেশ ঈর্ষণীয় কাজ হয়েছে। আর আমাদের এই গরিব অ্যাকাডেমির বাংলাদেশেও গত শতকের আশি-নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত। প্রশ্ন হল, যদি অন্ধকার হিসাবেই গণ্য হবে, তাহলে এত বিশেষজ্ঞতা, এত আগ্রহ কোত্থেকে কিভাবে এল। এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আপনাকে উনিশ শতকের শেষাংশে প্রাচ্যবাদী চর্চার নতুন ধারার খোঁজ নিতে হবে, যেখানে ভার্নাকুলারের মধ্য দিয়ে জনজীবনের ‘প্রকৃত’ খোঁজখবর নেয়ার একটা জরুরত তৈরি হয়েছিল, আর তারই অংশ হিসাবে কলকাতায় পুরনো ও সমকালীন জীবনচর্চার এক বর্ণাঢ্য সংগ্রহ তৈরি হয়ে উঠেছিল। প্রাচ্যবিদ্যচর্চার প্রধান কেন্দ্রগুলোতে এখানকার চর্চার যে বেশ কদর ছিল, তার প্রমাণ একটু খোঁজখবর নিলেই মিলবে। আর পুরো চর্চার গভীরতা-বিস্তার-সাফল্যের খোঁজ পাবার জন্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আর দীনেশ সেনের কাজ ও কার্যপ্রণালির দিকে নজর রাখাই যথেষ্ট হবে।

 

এ চর্চাই প্রায় সমকালে এবং বিশেষত একটু পরের ধাপে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে যু্ক্ত হয়ে যায়। জাতীয়তাবাদটি ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদ; অন্তত অসহযোগ আন্দোলনের আগে পর্যন্ত কলকাতায় তার চর্চার ধরনে ‘বাঙালি’ পরিচয় নির্মাণের ধারা বেশ প্রবল ছিল; আর বাঙালি ও হিন্দু কথাটা সে চর্চায় সমার্থক বা প্রায় সমার্থক ছিল – এ তিন সূত্র মনে রাখলে আপনি সে সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর পটভূমি বুঝতে পারবেন। নীহাররঞ্জন রায় ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদিপর্ব’ নাম দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে শুধু হিন্দু জনগোষ্ঠীর ভিত্তিতে যে মশহুর কেতাব প্রণয়ন করেছিলেন, তা ছিল এ সময়ের চর্চারই এক বিলম্বিত বহিঃপ্রকাশ। এসব কথা মনে রাখলে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন, সুকুমার সেনের সুবৃহৎ ইতিহাস বইয়ে মধ্যযুগের মুসলমান লেখকদের জায়গা হয় নাই বলে আমরা যে হাহাকার করেছি, তা চূড়ান্ত রকমের বেওকুফি। আমরা বোঝার চেষ্টা না করলেও সুকুমার সেন বা কলকাতার বিদ্বৎসমাজ জানতেন, তিনি ঠিক কাজটিই করেছিলেন। তাই পরে ইসলামী সাহিত্য নামক চটি বের করলেও মূল বইয়ে তার ঠাঁই হয় নাই।

 

কথাটা আমাকে একটু বিস্তারিত বলতে হল, কারণ, কলকাতায় প্রাচীন ও মধ্যযুগ নিয়ে যে চর্চা হল, তার মান ও পরিমাণ দুই-ই সমীহযোগ্য। আমরা যদি মনে রাখি যে, এ চর্চার অ্যাকাডেমিক পটভূমি ছিল প্রাচ্যবিদ্যার মতো বিশ্বজনীন কিন্তু কলোনাইজড অ্যাকাডেমি, আর মূল অনুপ্রেরণা ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাংস্কৃতিক পটভূমি, আর এ দুয়ের মধ্যে আবশ্যিক কোনো বিরোধ ছিল না, তাহলেই আমরা পরবর্তীকালের ঢাকার চর্চার সাথে এর সাদৃশ্য ও ফারাক বুঝতে পারব। এ-ও বুঝব, সেখানকার প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কেতাবে কেন ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, জাতীয়তাবাদ এক বিরোধহীন যৌথ আবেগে প্রতিফলিত হয়েছে। এরকম একটি আবেগের বশেই ঢাকায়ও প্রাচীন ও মধ্যযুগ নিয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণের এবং গুণের কাজ হয়েছে।

 

এ কাজের প্রথম ওস্তাদ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রাচ্যবাদী ঘরানার পণ্ডিত। একই সাথে সাচ্চা মুসলমান ও আবেগি বাঙালি। অন্য গুণী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মুসলমান বাঙালি হতে চেয়েছেন কাজে ও কথায়। এর সাথে আহমদ শরীফের প্রায় অ-মানবিক শ্রম ও প্রতিভা যোগ করলেই বুঝতে পারবেন, পাকিস্তান আমলে নিখাদ মুসলমানি প্রেরণায় কিভাবে এত বিপুল কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। প্রেরণাটা কলকাতা থেকেই পাওয়া, তবে একেবারেই বিপরীতমুখী। ওখানকার কাজে মুসলমানরা বাদ পড়েছিল। এঁরা চেয়েছেন সেই খাদ ভরাট করতে। শুধু এ ধারায় নয়। ঢাকা তথা বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ কাজ তো হয়েছে সাকুল্যে বাংলা ও ইতিহাসে। এই কাজগুলোর তালিকা প্রণয়ন করলেই দেখবেন, কলকাতার অনুকরণে কিন্তু বিপরীত প্রেরণায় খাঁটি মুসলমানি পরিচয়ে মোট কাজের চোদ্দ আনা সম্পন্ন হয়েছে। পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবল উত্থানের প্রেক্ষাপটে ওই ধারা তার মাহাত্ম্য হারায়। সেটা মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু মুশকিল হয়েছে দুই জায়গায়। এক. যে স্কিল অর্জিত হয়েছিল, অ্যাকাডেমি সজীব থাকলে আরো কিছু কাজ হত। কিন্তু অ্যাকাডেমিই তো নাই। তার আবার সজীব-নির্জীব! দুই. কোমরে যথেষ্ট জোর না থাকায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী প্রেরণা আমাদের নিজেদের দিকে নজর দিতে না দিয়ে নিয়ে ফেলল কলকাতার করকমলে। তাতে আমার আপত্তি নাই। সংস্কৃতি উৎপাদন করতে পারি না বলে, সংস্কৃতির ক্ষুধা কি মেটাব না? সমস্যা হল, কলকাতার অ্যাকাডেমির যে পরিচয় আমি একটু আগে দিলাম, তাতে ঢাকার মুসলমানের পোলা-মাইয়ার তো দূরের কথা, হিন্দুর পোলা-মাইয়ারাও কোনো প্রকার সারগর্ভ অবদান রাখতে পারবে না। ওটা কলকাতার ইতিহাস-ভূগোল-ধর্ম-সংস্কৃতি তথা সামগ্রিক অস্তিত্বের নাড়িতে বাঁধা। ফলে আমাদের এখানে মধ্যযুগ নিয়ে কাজ করার কোনো অনুপ্রেরণাই রইল না। সবাই দিব্যি আধুনিকতা নামক কলোনিয়াল ধর্মের ইমানদার হয়ে উঠল।

 

আমার এ কথা যে কথার কথা নয়, সে মর্মে একটি মাত্র উদাহরণ দেব। অধ্যাপক মুহম্মদ শাহজাহান মিয়া পুরানা সিলসিলায় পাণ্ডুলিপি পাঠ ও সম্পাদনার কাজ শিখেছিলেন। এ কাজে তাঁর পারঙ্গমতা ঢাকা শুধু নয়, বাংলাভাষীদের মধ্যেই বিরল ধরনের। কাজও করেছেন প্রচুর। অথচ, আপনি তাঁর কোনো সামাজিক প্রতিপত্তিই দেখবেন না। আপনি বলতে পারেন, প্রতিপত্তি অর্জনের জন্য আরো অনেক কিছু লাগে। তথাস্তু। কিন্তু তাঁর বইগুলা তো বাংলা একাডেমি বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা থেকে বেরোবার কথা। অর্ধেকের বেশি বই বেরিয়েছে অখ্যাত-অজ্ঞাত প্রকাশনা থেকে। আমার জানামতে বাংলা একাডেমি বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার – যেখানে বহু পাণ্ডুলিপি পাঠোদ্ধারের জন্য বসে আছে – তাঁকে ‘ব্যবহারে’র কোনো প্রয়োজন বোধ করেনি। একটা বিদ্যার কনজুমার এন্ডের যদি এ অবস্থা হয়, প্রোডাকশন এন্ডে জিনিস আসবে কোত্থেকে।

 

তবে, এ পরিস্থিতি বদলানোর কাল সমাগত। নতুন দৃষ্টিভঙ্গির যে ছিটেফোঁটা এই গরিব ঢাকায় এসে পৌঁছায়, তার বদৌলতেই উনিশ শতককে পর্যালোচনামূলক দৃষ্টিতে দেখা এখন সম্ভব। তাতে উনিশ শতকে বরাদ্দ করা আলোর একাংশ সতের-আঠার শতকের দিকে এমনিতেই পড়তে পারে – কোনো জাতীয়তাবাদী বা সম্প্রদায়গত [সাম্প্রদায়িক নয়] জোশের দরকার নাই। ইদানীং সাইমন জাকারিয়া ‘ভাবনগর’ নামের পত্রিকায় দুনিয়ার নানান জায়গার – এবং এখানকারও – বহু গবেষকের মধ্যযুগ নিয়ে করা নতুন ঘরানার কাজ হাজির করেছেন। এ ধরনের কাজগুলো আমাদের মৃতপ্রায় অ্যাকাডেমিকে চোখ মেলে তাকাতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে বলে ভরসা করি।

আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব।         

1 COMMENT

  1. রাষ্ট্রের টনক নড়ুক। ব্যক্তির সুবিধার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় না হোক।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here