পরাগ চৌধুরি মূলত অনুবাদক। বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য অনুবাদ করেছেন বাংলায়। ভীষণ পড়ুয়া মানুষ তিনি। অভিজ্ঞতার ঝুলিও বিশাল বড়। এবার তিনি প্রবেশ করেছেন স্মৃতির অন্দরমহলে। স্মৃতি মানুষের বড় শক্তি। স্মৃতি ছাড়া ইতিহাস হয় না, স্মৃতি ছাড়া সাহিত্যও হয় না। পরাগ চৌধুরির এই স্মৃতিলেখা একই সঙ্গে স্মৃতি ইতিহাস ও সাহিত্য। চমৎকার তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তি, স্মৃতির বয়ান ছাপিয়ে গিয়েছে উপন্যাসের কাঠামোকেও।
শিরি খালার ইশারায় আমি আর পেয়ারা তার পিছু ধরি। কথা ছিল নাশতা শেষে আমরা সড়কের জামতলার মাচায় বসে গল্প করবো। বিশেষ করে আজ সে আমাদের তার একটা গোপন কথা বলবে, যা সে মরে গেলেও অন্য কাউকে বলতে পারবে না । ভাবলাম এটাই হবে আজকের বড় বিনোদন। নিজেদের জন্য শালুক কি হাঁসেদের জন্য শামুক খোঁজা অথবা বড় নানুর আদেশে মরিচ তুলে আনা নাই আজ। প্রবল কৌতূহল গলা পর্যন্ত ঠুসে থাকায় নেহাত অনিচ্ছায় আমরা দুজন পাশের বাড়ির তাহের মামার উঠানে পৌঁছাই।
বাঁদিকে দাওয়ার নিচে অভিমানী লালুভুলু সামনের দুই পায়ের উপর মুখ রেখে গোমড়া মুখে শুয়ে আছে । আমাদের দেখেও দেখে না। অথচ অন্য সময় দেখতে পেলে কাছে এসে মুখের দিকে তাকিয়ে পেন্ডুলামের লেজ নাড়তো। তাকে একটুও পাত্তা না দিয়ে শিরি খালা তাহের মামির কাছে চেয়ে একটা চাটাই এনে মোড়ায় বসা মামার কাছাকাছি বিছিয়ে দেয়। আমরা ধুপ করে বসে পড়লে তাহের মামা এদিকে তাকিয়ে তার ম্লান মুখে আমাদের জন্য একটা প্রশ্রয়ের হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে। মামার মুখোমুখি আরেকটা মোড়ায় লম্বা সাদা দাড়িওলা শুঁটকোমতো একজন অচেনা মানুষ। তার ঠোঁটের কোনার একগোছা দাড়ি পানের রসে লাল। শিরি খালা আমার কানে কানে ফিসফিস করে : কবিরাজ । বুজলি? দুই গ্রামের সেরা। ঐ পাতিল বর্তি নিমপাতা সিদ্ধ কুসুম গরম পানি। তার ভিতর আছে নিমডালের নতুন গুলকাডি। এইডা অহন বাবি নিজে নিজেই বানাইতারে। কবরখানা যাওনের আগের ডোবার কাছে যে নিমগাছ তার ডাইল তার পাতা।
তামাশা দেখতে মামার এঁড়িগেঁড়ি বাচ্চা তিনটা কোত্থেকে যেন কোমরের ঘুনসি বাজাতে বাজাতে আমাদের চাটাইয়ে জায়গা করে বসে পড়লো।সবচেয়ে ছোটটা বসলো শিরি খালার কোলে। এবারে কবিরাজ তার ইন্দ্রজাল শুরু করে । মাটিতে নামানো ঝোলাব্যাগ থেকে জীওনকাঠি বের করার সতর্কতা নিয়ে দুই আঙুলে তুলে আনে ছোট এক ঝকঝকে সোনালি বদনা।
— শিরি খালা এটা কি স্বর্ণ দিয়ে বানানো?’
— আরে ধুর বোকা । পিতল পিতল। রোজ বেইন্নালা তেঁতুল দিয়া মাজলে এইরম সোনার মতন জ্বলজ্বলা রং হয় । — তাহলে গতবছর জাফরান খালার বিয়ের সময় অনেক টাকার সোনার গয়না বানানো নিয়ে এতো ঝগড়া হলো কেন? পিতল দিয়ে বানালেই টাকা কম লাগত না?
— পরে বুজায় বলবো । এখন দেখ তামাশা। ইয়াকুব বাই কয় এইতা চিকিসসা ঢাকায় হয় না। চুপ মাইররা দেক।
কবিরাজ নিচু গলায় মামার সাথে কিছু একটা বলতে বলতে ছোট ঝকঝকে বদনাটা পাতিলে ডুবিয়ে পানি ভরে নল দিয়ে হাতের পিঠে ঢেলে তাপ দেখে নেয়। মামা তার বাঁ পায়ের লুঙ্গি সরিয়ে হাঁটু উদাম করে সটান পা মেলে দেয়। হাঁটুর বাঁদিক ধরে সাদামতো কি যেন একটা দেখা যায় । ওটার মাথা ধরে কবিরাজ খুব সাবধানে কিন্তু এক ঝটকায় তুলে নিলে মুখে আওয়াজ না করলেও কেঁপে ওঠে মামা। জিনিসটা দেখতে মনে হয় যেন মাঝ বরাবর কাটা ডাংগুলির গুলি। ওটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখে কবিরাজ উঠে দাঁড়িয়ে দূরের আনারস বাগানের দিকে তাক করে ছুঁড়ে মারে। তারপর বদনাটা নাক বরাবর তুলে ধরে সরু নালি দিয়ে মামার হাঁটুতে পানি ঢালতে থাকে । মামার হাঁটুর ছোট গর্ত থেকে পানির সঙ্গে বেরিয়ে আসে সাদা সাদা পুঁজ। বাতের ব্যথার ঘন রস। চার বদনা গরম পানি ঢালার পর কবিরাজের ঝোলাব্যাগ থেকে বেরোয় পরিষ্কার দুই টুকরা লম্বা করে ছেঁড়া ধপধপে সাদা নরম কাপড় । একটা কাপড় হাঁটুর গর্তে সাদা খাটো নিমকাঠি দিয়ে টিপে টিপে ঢুকিয়ে ভেতরে জমে থাকা পানি তুলে এনে মামার হাতে ধরা ফুলতোলা পাখা দিয়ে বাতাস করে তা গর্তটা শুকানো হলো। এরপর ঝোলাব্যাগ থেকে বেরোলো একটা ঢাকনাওলা চিনেমাটির বোয়াম। তার ভেতর একটা রুপা দিয়ে স্বর্ণকারের যত্নে বনানো ছোট্ট ডাঁটির সাদা একটা সুন্দর চামচ।
অন্য কোনো ধাতু দিয়ে বানানো লম্বা ডাঁটির এমনি একটা চামচ দিয়ে ছোট মামাকে আড়ালে নস্যি নিতে দেখেছি। কবিরাজ পরম মমতায় বোয়াম থেকে তিন চামচ মহামূল্যবান কিছু সাদাটে গুঁড়া বের করে হাঁটুর গর্তে সাবধানে ঢেলে দেয়। মামা চোখ বন্ধ করে শক্ত কঠিন মুখ করে গুঁড়াটার কামড় সহ্য করতে থাকে। একটু অপেক্ষা করে কবিরাজ পাতিলে হাত ঢুকিয়ে নতুন সেদ্ধ গুলিটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আস্তে আস্তে গর্তটায় ঢুকিয়ে দিতে থাকলে এইবারে মামা ব্যথায় নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। এবারে কবিরাজ বাকি সাদা কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে গুলিঠাসা হাঁটুটা সযত্নে বেঁধে দেয়। তারপর নিজের জিনিসপত্র গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
তামাশা শেষ । উঠতে উঠতে শিরি খালা বলে : চল বার বাড়ির সামনে সাতচাড়া খেলি।
— না, সড়কের জামতলা যাওয়ার কথা না?
— সেইটা কাইল। আইজ সাতচাড়া ।
পেয়ারার গাঁইগুঁইতে কাজ হবে না দেখে চুপ করে থাকি। ঠিক আছে গোপন কথা না হয় কাল শোনা যাবে। আজ সাতচাড়া। যেতে যেতে বেড়ার পাশ থেকে সদ্যগজানো নরম লালচে পাতার কয়েকটা আমের আঁটি তুলে নেয় শিরি খালা।
পড়ুন ।। কিস্তি : ১ ।। ক্লিক করুন নিচের লিংকে