শুরু হলো নতুন উপন্যাস। এই উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে এই মুহূর্তের গল্প; যে গল্পের ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছি আমরা এবং সমগ্র বাংলাদেশ। চমৎকার ভঙ্গিতে গল্প বলে গেছেন সালাহ উদ্দিন শুভ্র। এই গল্প নিশ্চিতভাবে টেনে নেবে আপনাকে। কারণ আপনিও সম্ভবত জড়িয়ে আছেন এই উপন্যাসের সঙ্গে।
আমার ঘুম ভাঙল অনেক বেলা করে, এগারটারও পরে। এত বেলা পর্যন্ত ঘুমানোর ইতিহাস আমার নাই। জীবনে প্রথম এতক্ষণ ঘুমিয়েছি বললেও অত্যুক্তি হবে না মনে হচ্ছে। আমি সাধারণত সাতটায় উঠি। আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে আমাকে গাড়িতে উঠে অফিসের উদ্দেশে বেরিয়ে যেতে হয়। ছুটির দিনেও ঘুম ভেঙে যায়। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে, পেপার ঘেঁটে সেসব দিনে আমি আবার শুয়ে পড়ি। শুয়ে পড়ে আধো তন্দ্রা-আধো জাগরণে ছুটি উপভোগ করি। আমার ব্যক্তিগত উপভোগ বলতে এটুকুই। তারপর দশটার দিকে একেবারে উঠে পড়ি। ছুটির দিনে কিছু কেনাকাটা, কিছু খাওয়া-দাওয়ায় সময় পার করি বউয়ের সঙ্গে। বাচ্চা তো এল সেদিন।
তার আগে আমাদের দু’জনের সংসারও মোটামুটি ধরাবাঁধার মধ্যেই পার করেছি। তারপর রাফা আসার পর ছুটির দিনগুলোতে বাড়তি মনোরঞ্জন তৈরি হলো। ওর যাবতীয় কার্যক্রম অবলোকন করা, ওকে কোলে নেয়া — এসব ছুটির দিনের সঙ্গে যুক্ত হলো। সবকিছু ভালোই চলছিল। অকস্মাৎ পাওয়া ছুটিতে যত যা ব্যতিক্রম ঘটাতে শুরু করল আরকি। আমি সারারাত প্রায় না ঘুমিয়ে, উদ্বেগ আর সন্দেহবাতিকগ্রস্ত কোনো মানুষের মতো জেগে থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম আর এগারটায় উঠলাম। উঠে কিছুক্ষ হতবিহ্বল ছিলাম। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। নিজেকে অপরাধী মনে করব না, সে বিষয়েও কনফিডেন্স পাচ্ছিলাম না। উঠে হেলতে-দুলতে বাথরুমে ঢুকলাম। ঢুকার পর মনে হলো আমার ব্রাশ, সাবান, পেস্ট — এসব এ বাথরুমে আনা হয়নি। হ্যান্ডওয়াশ, স্যানিটাইজরও সব ওই রুমে রয়ে গেছে। এক জায়গায় শোয়া, আরেক জায়গায় বাথরুম এটা পুরোপুরি স্বস্তি দেয় না। আমার জন্য তো না-ই। বাথরুমে ঢুকে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে আমর ভালো লাগে। ধীরে-সুস্থে মুখ-হাত ধোয়া, সাবান লাগানো, পায়খানা করা — এগুলো আমার অভ্যাস। নিজের বাথরুমে না ফিরলে আমার ঠিকঠাক নিজের বাসায় ফেরা হয় না। এসব অভ্যাস থেকে বের হতে পারলাম না।
যাই হোক সাবান দিয়ে হাত আর মুখ ধুলাম। শরীর খুব ধীর হয়ে গেছে। চাঙা ভাবটা নাই। মনে হচ্ছে সত্যি সত্যিই করোনা ধরে গেছে। কিন্তু এ সন্দেহের কথা আগেভাগে প্রকাশ করা যাবে না। বললে অযথা টেনশন করবে। নিজেকে আরেকটু পরীক্ষার পর রেখাকে জানানো যাবে। তার আগে কিছুটা সাবধানে থাকব — এরকম মনস্থির করে খাবার রুমে গেলাম। আমি বসার আগেই নাশতা রেডি। পরোটা আর সবজি, সঙ্গে ডিম। খেয়ে উঠে চা নিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকলাম। তখনই মনে হলো আমি হয়ত কিছু অস্বাভাবিক আচরণ করছি। ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই আমার যাওয়ার কথা ছিল মেয়ের কাছে। কিন্তু আমি যাইনি। ব্যাপারটা রেখার চোখে পড়তে পারে। এত বেলা করে ঘুম থেকে ওঠাটা সে স্বাভাবিকভাবে না-ও নিতে পারে। তারওপর আমি কোনো কথা বলছি না, ধীর হয়ে গেছি। কে জানে? চায়ের কাপ নিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকে দেখলাম শ্যালিকা বসে আছে চুপচাপ। আমি জানতে চাইলাম তার বোনঝি কোথায়? সে বলল ঘুমাচ্ছে।
‘এ সময়ে তো ও ঘুমায় না, ঘুমাচ্ছে কেন?’
‘কে জানে, কাল রাতে ঘুম হয় নাই তো। আপা অনেকক্ষণ পায়ের ওপর রাখল। মনে হয় আপনি ছিলেন না সে জন্য। আচ্ছা দুলাভাই আপনি ওই রুমে ঘুমালেন কেন?’
‘তোমার জন্য তুমি একা থাক, যদি ভয় পাও।’
‘আমি মোটেও ভয় পাই না। আপনি আমাকে পুরা বাসায় একা রেখে যান, দেখবেন আমি মোটেও ভয় পাচ্ছি না। জানেন আমাকে বাসায় রেখে মা-বাবারা এখানে-সেখানে চলে যায়। আমি সেই রাত পর্যন্ত থাকি।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ! এটা তো অনেকবরাই ঘটেছে। অবশ্য আমি কখনো একা ঘুমাই নাই। আচ্ছা দুলাভাই আপনি কি ভীতু? আপা বলতেছিল আপনি নাকি ভয় পান? হা হা, এত বড় মানুষ কী ভয় পায়?’
শ্যালিকাটা আমার বেশি কথা বলে। শুনতে ভালোও লাগে। এখনো শৈশব লেগে আছে মেয়েটার মুখে। কয়দিন পর হয়ত কথা বলা কমিয়ে দেবে, লজ্জায় সামনে আসতে চাইবে না। অথবা খুব বাকপটু হবে, কট কট করে তর্ক করবে। কে জানে! এখনকার মতো আর থাকবে না — এটা নিশ্চিত। অথবা আমার অভিভাবকসুলভ চোখে তার ভবিষ্যৎ বিচার করতে পেরে কিছুটা পুলক অনুভব করি। খুব স্নেহমাখা মুখে হাসি দেই। আবার কিছু বলে কি না সে জন্য যথেষ্ট প্রশ্রয় দেই। বলুক, এটাই তো বলবার বয়স। যা খুশি বলার, জানতে চাওয়া। পরে আর তেমন বলতে পারবে না। এরমধ্যে রেখা চলে আসে। রেখার সামনে মেয়েটা কী কিছুটা সংকুচিত হয়? হয়ত হয়।
মেয়েলি ব্যাপারগুলো রেখার মধ্য দিয়ে সে রপ্ত করতে চায়। রেখার অভিভাবকত্বের স্বীকৃতি দিতে চায়। রেখার কারণেই তো তার এখানে থাকা। রেখার অভিভাকত্ব মেনে নেয়া তার এখানে থাকার নিশ্চয়তা। অথবা আমাদের মতো মানুষদের সংসাদের এটা একটা গিভ অ্যান্ড টেক সম্পর্ক। তুমি আমার বশ্যতা স্বীকার করো, আমি তোমার নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করব? এগুলো হয়ত মানুষের স্বভাবজাত বা মেয়েদের। আমি আগে কখনো এসব ভাবি নাই। এখন কেন যেন ভাবনাগুলা মাথায় চলে আসছে। শ্যালিকা রেখার সামনে একরকম আর আমার সঙ্গে অন্যরকম — এরকম আলাদা আলাদা আচরণ করি কিনা ভাবিনাই। এখন ভাবতে হবে।
করোনার ভয়ে আজ আমি শ্যালিকার কাছ থেকে আমি দূরে আছি। অন্য সময় অবশ্য আমার গা ঘেঁষেই বসেছে সে। আমিও তার কাছাকাছি থাকতে ইতস্তত করিনি। এখন যেহেতু আমি সন্দেহ করছি আমার করোনা হয়েছে, তাই ইচ্ছে করেই সোফায় বসেছি। নইলে ডিভানে হেলান দিয়ে তার সঙ্গেই হয়ত বসতাম। নিজের আপন মানুষের গা ঘেঁষে বসার মধ্যে একটা নির্ভরতা আছে। স্নেহ আছে।
রেখা এসে জানতে চাইল কী খাব দুপুরে। আমি বললাম, ‘কী খাওয়া যায় বল তো?’ রেখা হাসল, বলল, ‘আমার মনে হয় কচুুর লতি, করলা ভর্তা আর রুই মাছ খাওয়া যায়? তুমি কি ডাল খাবে, করোনায় ডাক্তাররা বলেছে ডাল খেতে, ডাল খেলে প্রোটিন বাড়ে’
আমি বললাম, ‘ডাল, রাতে খাওয়া যায়, এখন রুই মাছ, করলা, কচুরলতি ঠিক আছে।’
রেখা ওর বোনের সামনে গিয়ে বসল। একটা সালোয়ার পড়েছে। মা হওয়ার পর শরীর কিছুটা ভারি হয়েছে তার। উঠতে বসতে কিছুটা শ্লথ হয়েছে। শ্যামলীর চুলে বিলি কাটতে থাকল। স্কুলে ভর্তি হতে না পারলেও ওর জন্য রেখা বই কিনে এনেছে। সেগুলো সারাক্ষণ হাতে নিয়ে রাখে। কখনো পড়ে, কখনো পড়ে না। ওরলেখাপড়ার এখন চাপ নাই। রেখা ওকে চাপ দিচ্ছে আদব-কায়দা শিখতে। হয়ত সে কারণে মেয়েটা রেখাকে দেখলে কিছুটা তটস্থ হয়। ফোয়ারা ঘুমায়নি কেন জানতে চাইলাম।
‘তেমন কিছু না। রাতে হয়ত ঘুম আসছিল না। তোমার তো ঘুম হয় নাই মনে হয়। এত রাত পর্যন্ত তো তুমি জাগ না।’
‘না হইছে। এখন তো কাজ-টাজ নাই শরীর অলস বসে থাকে। হয়ত সে জন্য।’
নিজের বউয়ের শরীরে আমি চোরা চোখ বুলাই। কী জন্য রোকন সাহেব আমার বউয়ের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে বুঝতে চেষ্টা করি। যখন বিয়ে হয়ছিল তখন রেখার শরীর ছিল পাতলা। বিয়ের রাতে আমাদের কিছুই হয়নি। আমি অনেক বস্তা কাজ সেরে ঘরে ঢুকে দেখি রেখা ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়েছে। প্রায়ান্ধকার ঘরের বিছানায় মেয়েলি দ হয়ে সে শুয়ে আছে। আমি কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমার মনে হয়নি ওকে স্পর্শ করি বা ওর সঙ্গে কিছু করার ইচ্ছাও হয়নি। আমি নিজের জীবনে কাউকে পেয়েছি এই উপলব্ধির একটা পুলক আছে। সেই পুলক নিয়ে আমিও শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম নিজের নিঃসঙ্গ জীবনের কথা। দীর্ঘ সময় একা পথ পাড়ি দিয়েছি। অনেক বিছানায় ঘুমিয়েছি। অনেক ছাদের নিচে দিন আর রাত কাটিয়েছি। কত জায়গায় গিয়েছি, অজস্র মনুষের সঙ্গে মিশেছি। আশ্চর্যের বিষয় ছিল আমি ভার্জিন ছিলাম। আর বউ ভার্জিন ছিল কিনা আমি জানি না। বিষয়টা মাথায়ও তখন আসে নাই। সেক্সের প্রতি আমার যে অদম্য বাসনা ছিল বিয়ের রাতে যেন তার সব মিইয়ে গেল। নতুন বউয়ের পাশে শুয়ে শুয়ে আমি যেন সেই রাতে পেয়ারার সুবাস পেলাম। বারবার সেটা নাকে এসে লাগল। আমি তার দিকে কিছুটা ঝুঁকে, নাকটা ঠিক তার ঘাড় আর মাথার কাছটায় নিয়ে গন্ধ শুঁকতে লাগলাম। সেই রাতে নতুন বউয়ের শরীরের গন্ধে আমি বুঁদ হয়ে গেলাম। যেন মনে হলো আমি কোথায়ও ডুবে যাচ্ছি। গহিন কোখাও আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছি। তারপর ঘুম চলে আসল।
আমাদের বিয়ে হয়েছিল কুমিল্লায়। সে রাতেই একটা মাইক্রোতে চেপে ঢাকায় আমার ভাড়া বাসায় ফিরে এসেছিলাম। ফকিরেরপুলে নতুন বাসা নিয়েছি তখন। বিয়ে করব বলেই আলাদা বাসা ভাড়া নেয়া। তখন আমি একটা বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। ক্ষুদ্র ঋণের কারবার। যা বেতন পেতাম খারাপ ছিল না। বিয়ে করব বলে বাসা ভাড়া নেয়া। টানা কয়েক দিনের পরিশ্রমের পর বিয়ের রাতে আমিও খুব ক্লান্ত ছিলাম। ফলে ঘুম চলে আসল। ছোট বাসায় তখন আমি, নতুন বউ, আমার মা, বোন আর বউয়ের ভাই ছিল। প্রথম কয়েকদিন সংসার বিষয়টা বুঝে উঠতে পারি নাই। ফলে বিছানায় কিছু আর হয়ে ওঠেনি আমাদের মধ্যে। কে শুরুতে লজ্জা ভাঙবে সেটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আর এ কাজে অনুঘটক হয়ে কাজ করল আমার এক কলিগ।
তার সঙ্গে কথায় কথায় কথা উঠলে বলেছিল, ‘কী বলেন, ফুয়াদ ভাই একবারও না! আমি জানেন ছয়বার করেছি। গ্রামের ছেলে ছিলাম তো। ফ্রেশ খেয়েছি, দৌড়া দৌড়ি করেছি, আর হাতের ব্যবহারও আমার ছিল না। বিয়ের প্রথম রাতেই বউকে তুলে নিলাম। সে তো তার বান্ধবীদের বলে দিল ফোন করে। বান্ধবীরাও নাকি তারিফ করল খুব’।
তার কথা শুনে আমার হাসি আসল। কিছুক্ষণ পর সেই কলিগ নিচে নেমে গেল। সেদিন আর কথা হলো না। বাসায় ফেরার সময় সে এক পাকেট কনডম ধরিয়ে দিল। বলল, ‘যান কাজে নেমে পড়ুন।’ যদিও সেদিনও কাজে নামা হয়নি। হলো বৃহস্পতিবার রাতে। বাসা থেকে সবাই যাওয়ার পর। খালি বাসায় সেদিন যেন আগে থেকেই আমাদের দু’জনের মনে উত্তেজনা খেলা করতে শুরু করল। অযথা হাসি আর ঢলে ঢলে পড়া, দু’জন দু’জনের গা ঘেঁষাঘেঁষি করার মধ্যে নিজেরা নিজের খোলস খুলতে লাগলাম। যদিও ছয়বার হয়নি আমাদের দু’বার হয়েছে। প্রথম বারে কী হলো কিছুই ঠিক বুঝে উঠতে পারি নাই। দ্বিতীয় বারের উত্তেজনায় কাবু হয়ে গেলাম দু’জনেই।
এরপর চার বছর চলে গেল। সেই রেখা আর এ রেখায় খুব তফাত রয়েছে তা না। সে বরাবরই তার মতো থাকে। আমার সঙ্গে হাসি, প্রেম, সংসার সবই চলছে। কিন্তু কখনো এমন একটানা তার সঙ্গে থাকা হয় নাই। পরপুরুষের সঙ্গে তার কথা বলা দীর্ঘক্ষণ এত কাছ থেকে দেখা হয় নাই, রাতে সে কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলে শরীর দুলিয়ে হাসতে পারে তা ধারণাতে আসে নাই। যে কারণে এ রেখাকে আমার নতুন মনে হতে শুরু করল। আগের চেয়ে আরো আকর্ষণীয় আর পরিপাটি মনে হলো তাকে। আগের সেই আড়ষ্টতা নাই। নিজের শরীরকে যেন সে চেনে। অন্যের কাছে উপস্থাপনের বিষয়েও রেখা এখন সজাগ।
একটু পর রেখা উঠে চল গেল ড্রয়িং রুম থেকে। আমি চুপচাপ বসেই থাকলাম। জ্বর আসছে কিনা বোঝার চেষ্টা করলাম। লম্বা লম্বা শ্বাস নিলাম। শ্যামলী নিজের দুই হাত দিয়ে কিছু একটা খেলা খেলছিল। আমি এক ফাঁকে উঠে রাফা ঘুমাচ্ছে কিনা দূর থেকে দেখে আসলাম। রান্না ঘর থেকে মসলা ভাজার একটা ঘ্রাণ আসছে। মেয়েটা জেগে থাকলে ঘরে অনেকরকম শব্দ হয়, কথা হয়। নইলে মাঝে মাঝে চুপ হয়ে থাকে সারাটা ঘর। আবার গিয়ে বসলাম ড্রয়িং রুমে। একটু পর রেখা আসল। হাতে তার সেই ডায়রিটা। আমাকে দেখিয়ে জানতে চাইল এটা কার।
আমি তাকিয়ে থাকলাম। যেন এই প্রথমবার দেখছি, এমন একটা ভাব দেখালাম। বললাম, আমি তো জানি না। কোথায় পেলে?
রেখা জানাল সে ঘরটা গোছাতে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে পেয়েছে। সে ভাবছিল ড্রয়ারটা খালি করে দেবে যদি কিছু দরকারি কাগজ বা অন্য কিছু আমি সে ড্রয়ারে রাখি। তখনই পেল ডায়রিটা। রেখা বলল ‘এখানে তো কিছু লেখা নাই। আমার মনে হয় কি জানো, আমাদের বিয়েতে কেউ উপহার দিছিল। আমি যতদূর আন্দাজ করতে পারি এটা আমাদেরই বিয়ের উপহার। তোমার বন্ধু-টন্ধু কেউ দিছে নাকি দেখ।’
আমার বন্ধু! আমার কোনো বন্ধু আমাকে ডায়েরি উপহার দেবে কেন? আমি কি ডায়েরি লেখার লোক? লেখালেখি আমি কখনো করি নাই। ভাবিও নাই কিছু কখনো লেখব। আমাকে লেখা নিয়ে তো বলত শুধু একজন। সে জানত আমি লেখার লোক না, তারপরও বলত লেখতে। সে ছিল জলি। ওই সাংঘাতিক মেয়েটা। ডায়রিটা টেবিলে রেখে রেখা চলে গেছে।
মেয়েটা কাঁদছে মনে হয়। শ্যামলী মনযোগ দিয়ে বইয়ে কিছু একটা পড়ছে। আমার মাথায় ততক্ষণে ঢুকে পড়েছে জলি। মেয়েটা এখন কোথায়? এমন একটা ডেয়ারিং মেয়ে হারিয়ে গেল। সে আমার বিয়েতে এসেছিল। আমার বিয়েতে তার আসাটা আমাকে শুধু একটা টিপ্পনি কাটার জন্য ছিল না তার ডেসপেরেটনেস দেখানোর জন্য ছিল, নাকি আসলেই এটা আমার প্রতি তার পিটিনেস, অথবা ভালোলাগা, দায় শোধ, আর না হয় অন্য কিছু। আমার কখনো মাথায় আটে নাই। ভাবার দরকার হয় নাই। ছাত্রজীবনে অনেক কিছু ঘটবে যা পরবর্তী জীবনে একদমই মনে রাখার কোনো কারণ থাকবে না — জলির ব্যাপারটা এরকমই আমি মানিয়ে নিতে চেয়েছি। ওকে নিয়ে আমার ভাবার তেমন দরকার পড়ে নাই। অথবা আমি যদি এতটা বৈষয়িক না হতাম, কিছুটা সেলফ পিটি টাইপ লোক হতাম, তাহলে হয়ত জলিকে নিয়ে ভাবতাম। আমি তো তেমন লোক না নিজেকে নিয়ে দুঃখবোধ নাই আমার। গিল্টি নাই।
আমি বৈষয়িক মানুষ। আগের মতোই আছি। জলির সঙ্গেও যেমন ছিলাম। কিছুটা ভীতু, লাজুক — নিজেকে অপ্রস্তুত ভাবতে অভ্যস্ত একটা লোক। এখন যদিও সেটা নাই। নিজেকে সবসময় প্রস্তুতই রাখি। তারপরও বলা যায় না। দীর্ঘ জীবনের অভ্যাস আসলে কোথাও না কোথাও কিছু না কিছু থেকে যায়। সেটা আমি বুঝতে পারি ছাদে ওই রোকন লোকটার সঙ্গে মিশতে গেলে। সে যতটা বাকপটু, গপ্পবাজ, চামবাজ টাইপ — আমি মোটেও তেমন না। ফলে তার সামনে আমি অনেকটা অকেজো হয়ে যাই। আর মেয়েদের সঙ্গে কথা বলাটাও আমি একদমই পারি না।
চা খাওয়া শেষ হলেও কাপটা হাতে ধরে রেখে আমি বসে থাকে। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আর কোনো লক্ষণ আমার মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। ওই একটা হাঁচির পর শরীরে কিছুটা অবসাদ এখনও লেগে আছে মাত্র। নাহলে আপাতত কোনো লক্ষণ নাই। তারপরও সতর্ক থাকতে হবে। মেয়েটাকে কোলে নেয়া যাবে না বিষয়টা পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া ছাড়া। রেখা রাফাকে কোলে নিয়ে দোলাতে দোলাতে ড্রয়িং রুমে নিয়ে এলেও আমি তাকে কোলে নেই না। আমি সিগারেট খাব বলে ওই রুমটায় চলে যাই। তবে ডায়েরিটা রেখেই যাই। আমার মনে হয় ডায়েরিটা এখানেই থাক। বেশি আগ্রহ দেখানো যাবে না। মনের মধ্যে রাখা জিনিস সহসাই প্রকাশ করতে হয় না। এটা হলো নরম অব সিভিলাইজেশন — জলি বলেছিল আমাকে।
পড়ুন ।। কিস্তি : ১ ।। ক্লিক করুন নিচের লিংকে