ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় হাতে বোনা বস্ত্রের মধ্যে জামদানির স্থান শীর্ষে। ঐতিহ্য ও আভিজাত্যে যার জুড়ি মেলা ভার। উত্তর-আধুনিকতার এই যুগে প্রাচীনত্ব বজায় রেখেও ফ্যাশনপ্রেমীদের প্রিয় জামদানি শাড়ি।
বিখ্যাত মসলিনের উত্তরসূরি হিসেবে আবির্ভাব ঘটে জামদানি বস্ত্রের। মসলিনের খ্যাতি তার সূক্ষ্ম বুননের কারণে। আর নকশাদার বস্ত্র মসলিনের ওপর জ্যামিতিক বুটিদার কারুকাজ যার নকশায় অনন্য ধরন, একে আমরা জামদানি শাড়ি বলে থাকি – যা আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
নামকরণ
জামদানির নামকরণ নিয়ে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত। অনেকের মতে জামদানি শব্দটি ফারসি ভাষা থেকে এসেছে। ফারসি জামা অর্থ কাপড় এবং দানা অর্থ বুটি। সে দিক থেকে জামদানি অর্থ বুটিদার কাপড়। আরেক মতে, ফারসিতে জাম অর্থ উৎকৃষ্ট মদ এবং দানি অর্থ পেয়ালা। জাম পরিবেশনকারী ইরানি সাকির পরনের মসলিন থেকে জামদানি নাম তৈরি হয়েছে। অনেকের মতে মুসলমানরাই ভারতীয় উপমহাদেশে জামাদানি শাড়ির প্রচলন করেছিলেন। তবে বাংলার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীক জামদানি শাড়ি পুরোপুরি মোগল বা পারসিক ঐতিহ্যের অনুসরণ তো করেই নি, বরং দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে অন্যান্য সংস্কৃতির মেলবন্ধনে হয়ে উঠেছে এক অনবদ্য সৃষ্টি।
ইতিহাস
সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলার বদ্বীপ তুলার চাষ ও উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল। বিখ্যাত ঢাকাকেই জামদানির আদি নিবাস ভাবা হয়। অনুমান করা হয় মসলিনের ছত্রিশটি ভিন্ন ভিন্ন পণ্যের মধ্যে জামদানি শ্রেষ্ঠ। জামদানির প্রাচীনত্ব ও বিবর্তনের ইতিহাস খুবই বৈচিত্র্যময়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে মসলিনের উল্লেখ আছে। নবম দশকে আরব ভূগোলবিদ সুলায়মান, চৌদ্দ শতকে ইবনে বতুতা, পনের শতকে কিছু চিনা লেখক, ষোল শতকে মোগল সাম্রাজ্যের লেখক আবুল ফজল বাংলাদেশের মসলিনের অনেক প্রশংসা করেছেন। পাতলা ও ফুলেল কাপড় শহর (ঢাকা) ও দেশের সর্বত্র তাঁতিরা তৈরি করে। (টেইলর ১৮৫১ : ৮)। ক্লাসিক্যাল মসলিন যুগ ও মধ্যযুগীয় জামদানির যুগের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম লাইন আছে।
মোগলরা আসার আগেই জামদানির উদ্ভব হয়েছে। মসলিনে নকশা করে তৈরি হত জামদানি কাপড়। ঢাকা জেলার সোনারগাঁও, ধামরাই, তিতাবাড়ি, বাজিতপুর, জঙ্গলবাড়ি প্রভৃতি এলাকা মসলিনের জন্য সুবিখ্যাত ছিল। আর জামদানি বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আর্মেনিয়ান, ইরানি, মোগল, পাঠান প্রভৃতি বণিকেরা। মোগল আমলে জামদানির ব্যাপক চাহিদার জন্য ‘দারোগা-ই-মলমল’ পদবির উচ্চ পর্যায়ের রাজ কর্মচারি নিযুক্ত ছিল।
সে সময় প্রায় এক লক্ষ টাকা মূল্যের মলমল খাস মোগল দরবারে রপ্তানি করা হত। বর্তমানে শীতলক্ষা তীরের রূপগঞ্জ ও নোয়াপাড়া জামদানির মূল কেন্দ্র। সোনারগাঁও, ফরিদপুর ও ভৈরবের কিছু কিছু গ্রামেও জামদানি বয়নের কাজ হয়।
উনিশ শতকের শেষের দিকে কিংবা বিশ শতকের শুরুর দিকে নবাব স্যার সলিমুল্লাহর পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হয় রঙিন জামদানি। এ তথ্য দিয়েছেন হাকিম হাবিবুল রহমানের। সাদা জমিনের জামদানি নকশা রঙিন করার পেছনের এ মানুষটির অবদান অবাক করার মতোই।
মোগল আমলের সম্প্রসারিত জামদানি শিল্প ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরু হওয়ার সাথেই বিলুপ্তির মুখে পড়ে। নীলচাষে বাধ্য করা হয় বাঙালি বয়নশিল্পীদের। এভাবেই জামদানি হারাতে থাকে তার জৌলুস।
শাড়ির কত নাম
আমাদের লোকসাহিত্যে পাওয়া হরেক শাড়ির বাহারি নাম প্রমাণ দেয় যে, আমাদের শাড়ি আমাদের প্রাচীন তাঁতশিল্পীদের মায়ায় তৈরি হতো। কবি জসীম উদ্দীন তাঁর ‘পূর্ববঙ্গের নক্সীকাঁথা ও শাড়ি’ প্রবন্ধে তার সংগৃহীত কিছু শাড়ির নাম তুলে ধরেছেন : কালপিন, কাঙ্গনীগরদ, জলেভাসা, একপাছুন্না, জামদানী, জামের শাড়ি, সোনাঝুরি, কলমিলতা, নকশীঝুরি। বোঝা যাচ্ছে, জামদানি শাড়ির রয়েছে সাংস্কৃতিক গুরুত্ব। জামদানি শাড়ি বিখ্যাত তার অতুলনীয় নকশা আর মিহি বুননের জন্য। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে এর বয়নশিল্প। বাঙালি নারীর আভিজাত্য ও রুচিশীলতার মাপকাঠিতে জামদানি শাড়ির অবস্থান নিঃসন্দেহে প্রথম সারির।
জামদানির গৌরবময় ইতিহাস এর আভিজাত্যে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। অন্যান্য লোকশিল্পের মতই জামদানির নকশায়ও ঘটেছে সংযোজন ও বিয়োজন। পরিবর্তনের ভেতর দিয়েই এসেছে আজকের একুশ শতকের জামদানি।
প্রখ্যাত লোকতত্ত্ববিদ মোহাম্মদ সাইদুর তাঁর বইয়ে বলেছেন, ‘জামদানির প্রতিটি নকশার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের প্রকৃতি, পরিবেশ, জীবজগৎ ও বৃক্ষলতাযুক্ত নকশার প্রাধান্য অর্থাৎ তাঁতী বা তাঁতশিল্পী (আমি তাঁতশিল্পী বলাটা বেশি যথার্থ মনে করি।) বস্ত্র বয়ন করতে গিয়ে তার চারপাশে যে দৃশ্য দেখেছেন, বয়নে তিনি তারই প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন।’
নকশা
জামদানির বিশিষ্টতা কেবল ফুলময়তাই নয়। এর নকশায় মিহি বুনন, জ্যামিতিক মোটিফ একে দৃষ্টিনন্দন করেছে। জামদানি নকশার উৎস নিয়ে কারো কারো মত, ইরান, ইরাক ও তুরস্কের কার্পেট ও লৌকিক নকশার প্রভাব আছে। আবার কেউ কেউ বিশেষভাবে চাকমা জনগোষ্ঠীর নকশার সঙ্গেও মিল পেয়েছেন। এসব মতা লক্ষ করে জামাদানী গ্রন্থের লেখক মোহাম্মদ সাইদুর জানাচ্ছেন, ‘দেশকালগত ভাবে একক কোনো প্রভাব থেকে জামদানী নকশার উদ্ভব হয় নি। বরং এতে কালে কালে এসে মিশেছে বিভিন্ন উপজাতীয় প্রভাব, হিন্দু বৌদ্ধ প্রভাব, মুসলিম প্রভাব, ব্রিটিশ প্রভাব, পাকিস্তানি ও বর্তমানের বাংলাদেশি প্রভাব। সুতরাং এটি বিভিন্ন প্রভাবের মিশ্রিত রূপ আর লৌকিক ধারানুযায়ী এসব প্রভাব মিলেমিশে একাকার হয়ে জন্ম নিয়েছে জামদানি নকশার।’’ অর্থাৎ কালের বিবর্তনে এ সমস্ত নকশারও স্থায়ীকরণ ঘটেছে বলে ধরে নেয়া যায়। একদিনে নয় দীর্ঘকালীন রূপান্তরের ফল আজকের জামদানি।
জামদানি শব্দটি উচ্চারণ না করে এখনও অনেকে ঢাকাই জামদানি বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এখন হয়তো আমরা জামদানি শোনামাত্রই শাড়িকে বুঝি। তবে এক সময় জামদানি দিয়ে নকশা করা ওড়না, কুর্তা, পাগড়ি, রুমাল, পর্দা এসবও তৈরি হত। ১৭০০ শতাব্দীর দিকে জামদানি দিয়ে নকশাওয়ালা শেরওয়ানির দারুণ প্রচলন ছিল। এছাড়া মোগল নেপালের আঞ্চলিক পোশাক রাঙার জন্যও জামদানি কাপড় ব্যবহার করা হত।
বাংশ পরম্পরায় জামদানি বয়নশিল্পীরা তাদের পেশার সঙ্গে যুক্ত। এটি বাংলাদেশের সমৃদ্ধ বয়ন উত্তরাধিকারের এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত। দুইজন তাঁতি কাপড় বোনে। ডান পাশে বসেন ওস্তাদ আর বামপাশে অপেক্ষাকৃত কম দক্ষ সাগরেদ।
মূলত পাড় ও জমিন – এই দুই ভাগে জামদানির নকশাকে ভাগ করা যায়। নকশার ওপর ভিত্তি করে জামদানির আছে ভিন্ন ভিন্ন নাম। সাধারণত পাড়ের নকশার নামেই নামকরণ হয় শাড়ির। যেমন : কলকাপেড়ে শাড়ি, মালঞ্চপাড় শাড়ি। যেকোনো পাড়ের নকশাকে দৃষ্টিনন্দন করে তোলে একটি মূল মোটিফ। যেটিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে পাড়ের নকশা। আর একেকটি মোটিফের সঙ্গে থাকে আনুষঙ্গিক ছোট নকশা। যেগুলো ছাড়া জামদানি শাড়ির নকশায় সামঞ্জস্য আসে না। আগে থেকে আঁকা নয়, জামদানি তাঁতিরা নিজেদের স্মৃতিশক্তি আর মননকে কাজে লাগিয়েই তৈরি করেন বৈচিত্র্যময় একেকটি শাড়ি।
জামদানির নকশায় তিনটি আদি ধরন রয়েছে; এগুলো হচ্ছে : জাল, বুটি ও তেরছি। এছাড়া ঢেউ আকৃতির কিছু নকশা করা হয় জমিনে। যেকোনা নকশাকে জলের ঢেউয়ের মতো তরঙ্গায়িত করে তৈরি করলেই সেটি ঢেউ নামে পরিচিতি পায়। সাধারণত পাড়ের নকশা আঁচলের নকশা হিসেবে বয়ন করা হয়। পাড়, নকশা ও আঁচল নিয়েই জামদানির ব্যবহার আজও বিরাজমান। জামদানি শাড়ি সাধারণত চার ধরনের হয় : ১. ফুল সিল্ক, ২. হাফ সিল্ক, ৩. ফুল কটন, ৪. নাইলন। তেরছা, বুটিদার, ঝালর, পান্না হাজার, ফুলওয়ার, তোরাদার বিচিত্র নকশা ও বিচিত্র নামের জামদানি শাড়ি।
নকশার ঐশ্বর্য, তাঁতিদের দক্ষতা ও কাঁচামালের সহজলভ্যতার কারণে জামদানি খাঁটি বাংলাদেশি পণ্য হিসেবে বিকশিত হয়েছে। জামাদানিকে অথবা মসলিনকে ভারতীয় কারিগরদের সেরা শিল্পকর্ম হিসেবে গণ্য করা হয় এর চমৎকার, নিখুঁত ও সুকৌশলী বয়নের জন্য। নকশার জটিলতা, ঘন ও বেশি কাজ ভেদে জামদানির দামে রয়েছে রকমফের। বারোশো থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত হয় এর দাম।
নকশা ও পাড়
জামদানি শাড়ির নকশা আর পাড়ের আলাদা নামের বিষয়টি খুবই চমকপ্রদ। জনপ্রিয় নকশার কয়েকটি নাম : কলার ফানা, করলা জাল, কলমি লতা, জুঁই ফুল বুটি, শাপলা ফুল, শামুক তেছড়ি, ময়ূরপঙ্খি, সন্দেশ ফুল, কচুপাতা তেছড়ি, তারাফুল, গোলাপ ফুল, বেলি ফুল, ঝুমকা ফুল, চালতা ফুল, পুঁই লতা, প্রজাপতি বুটি।
জনপ্রিয় কিছু পাড়ের নাম : বাদুড় পাখি পাড়, মিহি পাড়, কাউয়্যার ঠ্যাং পাড়, শালগম পাড়, কলকা পাড়, আঙুলফুল পাড়, কাচি পাড়। এমন বিচিত্র নামধারী জামদানি যুগে যুগে বাঙালির বয়নশিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে, বিশ্বের দরবারে তৈরি করেছে নন্দিত অবস্থান।
অভিজাত জামদানি শাড়ির যত্নেও রয়েছে বিশেষ কিছু নিয়ম। শৌখিন শাড়ি জামদানির যত্নে একে ভাঁজ পরিবর্তন করে রোলারে পেঁচিয়ে রাখলে অনেক দিন পর্যন্ত ভালো থাকবে। পাখার বাতাসে বাতাসে, রোদে শুকিয়ে নিলেও শাড়ি টেকসই হবে। পানি নয়, বরং ড্রাইওয়াশে জামদানি শাড়ি পরিস্কার করা উচিত। তাছাড়া অনেকদিন ব্যবহারে শাড়ি নরম হয়ে গেলে ভালো কারিগর বা তাঁতির কাছে নিয়ে গেলে ১৪-১৫ দিনের ভেতর ৪০০-৫০০ টাকার বিনিময়ে তাঁরা শাড়িটি কাঁটা করে দেবেন। এতে করে প্রিয় শাড়িটি আরও কিছু দিন ভালো থাকবে।
বর্তমানে আগের মত মাথা খাটিয়ে নতুন নকশার জামদানি তৈরি করতে অনেকে তাগিদ বোধ করেন না। এর পেছনে কারণ হিসেবে রয়েছে ন্যায্য মজুরির অভাব। প্রবীণ তাঁতিরা তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মকে এ পেশায় নিয়ে আসতে আগ্রহী নন। এভাবে জামদানি শিল্পও হয়তো হারিয়ে যেতে পারে কালের অতল গহ্বরে; তবে বড় কর্পোরেট হাউজগুলোর কারও কারও রয়েছে পুরনো নকশার সমৃদ্ধ সংগ্রহ। তাছাড়া সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
চিরায়ত সুন্দর
আভিজাত্য নিয়ে আজও টিকে আছে। যদিও জামদানির অনেক নকশাই বিলুপ্ত। তবুও একে বাঁচিয়ে রাখতে সাবেকি ফ্যাশনের অনুসরণেই জামদানি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে কুর্তি, পাঞ্জাবিসহ বিভিন্ন ধরনের পোশাকে। বর্ণাঢ্য ও রাজসিক জামদানির নকশা প্রণয়নের কাজে এখন প্রবেশ করেছে বিশাল কর্পোরেট পুঁজি। আর তাঁতিরা তাদের বিশেষ গুণের বদৌলতে এখনও তৈরি করে যাচ্ছেন ঐতিহাসিক এই নিদর্শন। জামদানির এই অতুলনীয় বয়নকৌশলই এটিকে ইউনেস্কো কর্তৃক একটি অনন্যসাধারণ নির্বস্তুক সংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে।
ফুলেল অনন্যসাধারণ নকশার জামদানি শাড়ির আভিজাত্য চিরন্তন। নতুন ফ্যাশন, নতুন স্টাইল যার স্থান এতটুকুও নড়াতে পারে নি। আমাদের এ ঐতিহ্যকে ধারণ করে একে সংরক্ষণ করাও আমাদেরই দায়িত্ব। আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল প্রতিনিধি জামদানি। তাঁতিদের হাতে বোনা জামদানির কদর এবং ঐতিহাসিক মূল্যও তাই অনেক। অভিজাত ও রাজসিক জামদানি শিল্পের মাধ্যমে এভাবেই বাঙালির গৌরবের জায়গা চির অম্লান হয়ে থাকুক।