বীজ উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে এক তরুণীর তীব্র সংবেদনা; পর্যবেক্ষণশীল চোখ দিয়ে সে দেখেছে নিজের ভেতর ও বাহির। মনিরুল ইসলামের লেখা এই উপন্যাস আপনাকে নিয়ে যাবে সমকালীন জীবনের অন্দরমহলে।
৭
প্রতিদিনকার জ্যামগুলোকে অসহ্য মনে হচ্ছে আজ। ভেতরে ভেতরে তাড়া ফিল করছি। সোয়া নয়টার দিকে পৌঁছতে পারলে ভালো লাগতো। উনাদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া যেতো কিছুটা সময়। জ্যামে আটকে থাকা বিরক্তিকর। ভালো লাগছে না। মাঝে মাঝে এমন কিছু সময় আসে, যখন এমনিতেই, কোনো কারণ ছাড়াই ভালো লাগে না। আজ হয়তো সারাটা দিন এভাবেই যাবে। নিশ্চিত গিয়ে দেখব জেসমিন দি’ আর বিভাস দা’ গল্প করছে। মনে মনে এটাই ভাবছি। উনাদের দুজনকে একসঙ্গে বেশ মানায়। জেসমিন দি’র বিহেভিয়ারটা বেশ ভালো। মাখনের মত মোলায়েম। বেশ চমৎকার মেয়ে উনি। নিঃসেন্দহে উনার হাজবেন্ড একজন লাকি মানুষ। দেখা যাবে আজকে তিনি ঘিয়া-কালার শাড়িটা পরে এসেছেন। প্রথমদিন এই শাড়িটাই পরে এসেছিলেন। চোখ সরাতে পারছিলাম না। কী সুন্দর! সাক্ষাৎ দেবী! এমনও কেউ হয়। প্রতিদিন দেখতে দেখতে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তবু হঠাৎ করে কখনো ঠিকই চমকে যাই।
অফিসের ঘড়িতে নয়টা পঁচিশ বাজছে। শান্তা আপু আর বিভাস দা’। উনাদের দেখে কেন জানি হতাশ হয়ে গেলাম। বুঝতে পারছিলাম না, কী করব! ‘কী অবস্থা, শান্তা আপু! বিভাস দা’!’, বলে উত্তরের অপেক্ষা না-করেই সোজা আমার টেবিলে গিয়ে বসলাম। ব্যাগটা রাখতে রাখেতে এমন ভাব করলাম যেন খুব হাঁপিয়ে গেছি। আসলে তেমন কিছুই না। মেজাজ খারাপ লাগছিলো। যেন এর জন্য দায়ী শান্তা আপু। মেজাজটা খারাপ হলো উনার ওপরেই। অথচ উনার কী দোষ! আসলে একটা ভাবনা যখন মনে গেঁথে যায়, তখন তার অন্যরকম হলে ভালো লাগে না। স্বাভাবিক। বিভাস দা’ খুব অর্ডিনারি ভঙ্গিতেই কথাবার্তা বলছিলেন। শান্তা আপু এই উচ্চস্বরে হাসতেছে, এই মেকি রাগ দেখাচ্ছে। উনার যা স্বভাব। আমি উঠে উনাদের সঙ্গে গিয়ে বসলাম। হাসি হাসি মুখ করে বললাম, ‘আজ কী নিয়ে কথা হচ্ছে আপনাদের?’। শান্তা আপু মনে হল আমার আগমনটা আশা করেনি। উনার মুডটা একটু চেঞ্জ হয়ে গেলো। আমাকে পছন্দ করেন বলেই হয়তো বাঁচা। নয়তো কে জানে, দেখা যেতো কিছু একটা কমেন্ট করে বসেছে। আপুর চোখে-মুখে প্রশ্ন দেখে, বিভাস দা’ই উত্তর দিলেন। ‘আমাদের এই মজলিশে দিয়াকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি।’, বলে হাসলেন।
জেসমিন দি’ এলেন। ঘিয়া-কালার শাড়িটা তিনি পরেননি। সালোয়ার কামিজ পরে এসেছেন। টিয়া-কালার জমিনে লালের কাজ। বরাবরের মত দুর্দান্ত লাগছে তাকে। ‘তোমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে, জেসমিন।’ বিভাস দা’ তাহলে এমন কথাও বলেন! উনি আবার জেসমিন দি’কে পছন্দ-টছন্দ করেন নাতো! বিবাহিতা হয়েছে তো কি হয়েছে, একটু মজা নিলেন, হতে পারে পরকীয়া। কী যে আমি ভাবি! উনি মোটেই এ-রকম স্বভাবের না। এটাও তো আবার ঠিক, কে জানে কার মনে কী আছে! দূর থেকে কাউকে বিচার করাটা আসলেই কঠিন। জেসমিন দি’ খুশিতে ডগমগ হয়ে গেলেন। বাবরার ‘থ্যাঙ্কিউ, থ্যাঙ্কিউ’ বলতে লাগলেন। শান্তা আপু চোখেমুখে আপসেট ভাবটা লুকাতে পারলেন না। এবার সত্যিই খটকা লাগল আমার, বিভাস দা’র প্রতি উনি আবার ফ্রিক না তো! কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব! এ তো দেখি সব অদ্ভুত বিষয়াশয়। নাকি আমার মাথাটাই গেছে পুরোপুরি।
যথারীতি পেট বের করে শাড়ি পরেছেন শান্তা আপু। উনার শাড়ি পরাটা সুন্দর হয়। সবাই শাড়ি পরতে পারে না। তালগোল পাকিয়ে ফেলে। শাড়িতে উনাকে মানায়ও বেশ। পাশ থেকে পুরো পেটটাই দেখা যাচ্ছে। ফর্সা-সুন্দর। মাঝখানে ফুটে আছে এক অনবদ্য গোলাপ। শাড়ি পরলে জেসমিন দি’রও পেট দেখা যায়। কেন জানি তারটা এত চোখে পড়ে না। তার সমস্ত সৌন্দর্য যেন মুখে। তার মুখম-লেই কোলাহল করে সমগ্র শরীর। শরীরের তাবৎ সৌন্দর্য। শান্তা আপুর ক্ষেত্রে পুরোই উল্টোটা। খুবই গড়পড়তা চেহারা তার। কিন্তু ফর্সা, সুগঠিত ও মেদবহুল। যতটুকু মেদ মানানসই। যা সৌন্দর্যকে আরও পুষ্ট ও আকাক্সিক্ষত করে তোলে। একেবারে জানান দেয়া শরীর তার।
সাড়ে এগারোটার দিকে পাঁচ মিনিটের একটা চা-বিরতি থাকে। গরমপানিতে একটা টি-ব্যাগ। মন চাইলে কেউ চিনি নেয়। কেউ নেয় না। অধিকাংশই নেয় না। আমি নেই। চিনি ছাড়া চা আমার একদম অসহ্য। ইয়াকুব স্যার আর গণি স্যারের সঙ্গে দেখা হল। বললেন, ‘ইয়াং লেডি, কেমন চলছে দিনকাল?’ উনাদেরকে সেদিন স্বপ্নে দেখেছি। স্বপ্নের কথাটা উনাদেরকে গিয়ে বললে কেমন হয়! কী উত্তর দেবেন! ভাবতেই মজা লাগল বিষয়টা।
মোজাম্মেল আবার আগের মুডে। পাটোয়ারীর গোষ্ঠী উদ্ধার চলছে। শালার জন্য তার লাইফ শেষ। আস্ত একটা হারামজাদা। অমানুষ। কুত্তার মত ব্যবহার। পারলে সে আজকেই চাকরি ছেড়ে দেয়। পরিচিত এক মাস্তান বন্ধু আছে তার, তাকে দিয়ে পাটোয়ারীকে সে পেটাবে। তার কি সাধে দেরি হয়েছে! জ্যামে আটকা পড়েছিল সে। অফিসে তো সে উড়ে উড়ে আসে না। একবার পুলিশ-ক্যাডারে হোক, শালার দুই নম্বর গাইড বইয়ের ব্যবসা সে খাবে।
আমি হাসতে হাসতে মরি। সে-ও হাসে। ও কি আমাকে হাসানোর জন্যই এসব বলে! কত সরল একটা ছেলে সে! তার দোষগুলোও যেন দোষ নয়। তার জন্য মায়া লাগে আমার। তার ঠোঁটের কোণায় থুতু জমেছে। আজকে আর খারাপ লাগছে না বিষয়টা। না, এখন আর নেই। রাস্তায় বেশ জ্যাম। মোড় পর্যন্ত এই অংশটায় দিনের চব্বিশ ঘণ্টাই যেন জ্যাম থাকে। ভিড়ের ভেতর দিয়ে আমরা হাঁটছি। মোজাম্মেল সামনে। আমি তার পেছনে। তার শরীর থেকে ঘাম আর পারফিউম মেশানো একটা পুরুষালি গন্ধ আসছে। ভালো লাগছে। তার এই গন্ধটা আমার চেনা।
ইডেনের সামনে জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে কাপলরা। কাপলদের দেখলে আমার কেমন ভয় লাগে। মনে হয়, তাদের সম্পর্ক টিকবে না। ছেলেটা স্রেফ সেক্সুয়ালি ইউজ করবে মেয়েটাকে। তারপর সামান্য ছুতা পেলেই ঝগড়ার পর ঝগড়া শুরু করবে ছেলেটা। তারপর একদিন ছেলেটাই বলবে, ‘এভাবে হয় না আসলে। বাসা থেকে পাত্রী দেখছে। বাসায় আমি নতুন করে ঝামেলা তৈরি করতে চাই না। যা মনে হচ্ছে, আমাদের আসলে একসঙ্গে থাকা সম্ভব না।’ ব্যাস, চুকে গেলো সব। তারপর ব্লিচিং পাউডার দিয়ে একটা ওয়াশ দিয়ে, যে যার মতো নতুন পোষাকে পথে বেরোবে আবার!
‘এই মাসের কারেন্ট-অ্যাফেয়ার্সটা কেনা হয় নাই, একটু ঐদিকে যাবো। তুমি যাবা?’ মোজাম্মেলকে জিজ্ঞাসা করলাম। ‘আচ্ছা, চলো।’ ওর এক ফ্রেন্ড আসবে। এদিকেই নাকি আসতে বলেছে।
সবসময়ই এখানে ভিড় থাকে। রাজ্যের মানুষ যেন শুধু বই-ই কেনে। আসলে জায়গাটাই খুব সংকীর্ণ। এরমধ্যে কত রকমের দোকানপাট। ফুটপাতে পা রাখার জায়গা নেই। সব হকারদের দখলে। তুলনামূলক ফাঁকা দেখে একটা দোকানে গেলাম। দোকান বলতে, ফুটপাতে ছোটোখাটো একটা জলচৌকির ওপর গাদাগাদি করে রাখা বইপত্র। সামনে ভালো করে একটু দাঁড়ানোর জায়গাও অবশিষ্ট নেই। আমার কপিটার দামও মোজাম্মেল দিয়ে দিল। আমি তো কোনোভাবেই দিতে দিব না। এ-নিয়ে ও আর কথাই বাড়ালো না। ‘তাহলে চলো, তোমাকে আজকে খাওয়াবো। কী খাবে? চলো, তেহারি খাওয়াবো তোমাকে।’ যদিও আমার মোটেই তেহারি খেতে ইচ্ছা করছিলো না। তেহারি খেলে অ্যাসিডিটির প্রবলেম হয়। তেহারি না হোক, কিছু একটা তো খাওয়া যাবে।
‘তেহারি খেলে গ্যাস হয়।’
এমনিই ফুটপাত ধরে অযথা কিছুক্ষণ হাঁটলাম। জিলাপির দোকানটার কাছাকাছি চলে এসেছি আমরা। হেঁটে বইটই দেখতে আমার ভালো লাগে। যদিও খুব একটা কেনা হয় না। ‘আর কিছু কিনবা?’ মোজাম্মেল জিজ্ঞাসা করলো। ‘না, কিনবো না! এই, জিলাপি খাবা?’
‘জিলাপি-টিলাপি এখন খাবো না। তুমি চাইলে খাইতে পারো!’
‘না, না। তুমি না-খাইলে আমারও ইচ্ছা নাই।’
‘তাহলে চলো।’
আমি বললাম, ‘কোথায়? আগে বলো, কী খাবে?’ বললো, ‘চলো, চা খাওয়াবে।’
ভাইব্রেশনের একটা গাঁও গাঁও আওয়াজ হচ্ছিল। সঙ্গে রিংটোন।
‘তোমার বোধ হয় ফোন এসেছে।’ ও বললো, ‘হ্যাঁ তাইতো।’
‘শোন্! ফ্রেন্ডসের পাশের রাস্তাটা আছে না, ঐদিকটায় আছি। আয়। কাছাকাছি আইসা ফোন দিস।’
ডানপাশে সব খাবারের দোকানগুলো। ডাকাডাকি করছে। ‘মজার ব্যাপার কি জানো, ফোন না এলেও কখনো কখনো মনে হয় ভাইব্রেশন হচ্ছে। রিংটোন বাজছে। ফোন বের করে দেখি, না কিছু না। অদ্ভুত না?’ খুব সিরিয়াস মুডে বললো মোজাম্মেল। যেন এই বিষয়টা নিয়ে শীঘ্রই আমাদেরকে একটা মীমাংসায় পৌঁছতে হবে।
যে বিল্ডিংটাতে ফ্রেন্ডস-বুক-কর্নার তার পাশের রাস্তাটা ধরে এগোচ্ছি। এই দিকটা কমপারেটিভলি ফাঁকা। বেশ খানিকটা এগোলে চায়ের দোকান আছে কয়েকটা। তবে জায়গাটা বেশ নোংরা। পাশেই একটা ভাতের হোটেল। হোটেলের উচ্ছিষ্ট খাবার-টাবার রাস্তায়ই ফেলে। কয়েকটা কুকুর দেখেছি সবসময় ব্যস্ত থাকে ওগুলো নিয়ে। ঐদিকটায় কখনো যাইনি। দূর থেকেই দেখা। রাস্তাটা যেন কেমন!
‘বিভাস দা’কে দেখেছো, ঐ যে।’ চোখের ইশারায় দেখালো মোজাম্মেল। খুবই অপরিচিত লাগছে তাকে। বাইরে কখনো এভাবে দেখা হয়নি তার সঙ্গে। একদিন সবাই মিলে নিচে চা-খেতে নেমেছিলাম এই পর্যন্তই। চেনা গণ্ডীর বাইরে মানুষকে কেমন অপরিচিতের মত লাগে।
উত্তরার একটা শো-রুমে আমি প্রায়ই যাই। সেখানকার সেলসম্যানরাও বেশ পরিচিত। একদিন তাদেরই একজনকে রাস্তায় দেখে চিনতে পারছিলাম না। অথচ খুব চেনাচেনা লাগছিল। কিন্তু কীভাবে চেনা, কোনোভাবেই তা মনে পড়ছিল না। আবার সেই শো-রুমে গিয়েই কেবল তাকে চিনতে পেরেছিলাম।
‘উনাকে তো চেনাই যাচ্ছে না।’ রাস্তাটা ছোট। খুব বেশি প্রশস্ত নয়। মাঝখান দিয়ে লোকজন চলাচল করছে। বিপরীত পাশ থেকে ডাকলো মোজাম্মেল, ‘আরে! বিভাস দা! কোনদিক দিয়ে এলেন! আমরা তো হেঁটেই এলাম। আপনাকে দেখলাম কই!’ তাকালেন পেছন ফিরে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হল উনার। মোজাম্মেল ছিল আমার বাঁ-পাশে।
রাস্তাটায় একেবারে ঢোকার মুখেই, বাঁ-পাশের ফুটপাতে, দেয়াল ঘেঁষে একটা বইয়ের দোকান। কাঠের একটা তাকে বইগুলো সাজানো। তাকের সঙ্গে সংযুক্ত জলচৌকিটাতেও বইয়ের গাদি। ছেলেটাকে ফুটপাতে দাঁড়িয়েই বিক্রি করতে হয়। অস্থায়ী দোকান। সপ্তাহে যেদিন নীলক্ষেত বন্ধ থাকে, সেদিন ফাঁকা পড়ে থাকে জায়গাটা। নীল পলিথিনে মোড়ানো থাকে। খুব মনোযোগ দিয়ে বই দেখছিলেন বিভাস দা’। ‘দিয়া আজ চা-খাওয়াবে! চলেন।’, মোজাম্মেল বললো। আমিও উনার দিকে তাকালাম। উনার সুন্দর চোখগুলোতে নজর পড়ল। ছেলেদের চোখও যে এত সুন্দর হয়! শোভনের ছিল বিড়ালের মত চোখ। অনেকের বিড়ালচোখ পছন্দ। আমার পছন্দ না। চোখ হবে কালো। ঘন কালো। অতল দীঘির মত। বাবার চোখগুলো খুব কালো। এত এত মানুষের এই ভিড়বাট্টা বিভাস দা’র সুন্দর চোখদুটোকে মোটেই সমীহ করছে না।
‘আপনিও চলেন, আপনি থাকলে আরও ভালো লাগবে।’ আমি এ-ও ভাবছিলাম, উনি যেন আবার মনে না করেন, উনার থেকে আমরা আড়াল চাইছি। ‘আমি বলি কি, যেহেতু আপনাদের সঙ্গে নতুন করে দেখা হয়ে গেল, এই উপলক্ষে আজ আমিই চা খাওয়াই! অবশ্য, দিয়া যদি অনুমতি দেন, তবে!’, বিভাস দা’ এমন নাটকীয়ভাবে বললেন যে আমাকে হাসতে হলো। ভদ্রতা করেই হাসলাম। বললাম, ‘এত সুন্দর করে বললে কি আর আপত্তি করা যায়!’
চা খেতে ভালো লাগে না আমার। এমনিতেই খাওয়া হয়। এক ধরনের সামাজিকতা রক্ষা। কনডেন্স মিল্কের চা হলে, চিনি নেই না। নয়তো মিষ্টির চোটে অখাদ্য হয়ে যায়। আমি দুধ-চা নিলাম। বিভাস দা’ও দুধ-চা নিলেন। মোজাম্মেল লাল চা। চিনি না-নেওয়াতে ভালোই লাগছে। ভেবেছি, বিভাস দা’ সিগারেট নেবে। তার ঠোঁটগুলো কালো। সিগারেট খেলে নাকি ঠোঁট কালো হয়। বরং আমাকে অবাক করে দিয়ে মোজাম্মেল সিগারেট ধরালো। মুখ ফুটে প্রায় বেরিয়েই আসছিলো, ‘তুমি সিগারেট খাও!’ বললাম না। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, ‘আমার এক ফ্রেন্ড আসতেছে বিভাস দা’। চা-টা শেষ করেই আমি বিদায় নেবো।’
‘দিয়া তোমার কোনো কাজ আছে!’, মোজাম্মেল জিজ্ঞাসা করল।
‘একটু বইটই দেখব, এই আরকি।’ আসলে বিভাস দা’র সামনে এভাবে দুজনেই একসঙ্গে বিদায় নেওয়াটা আমার কাছে জুৎসই মনে হচ্ছিল না। আমি চাচ্ছিলাম বিষয়টা যেন এমন দাঁড়ায় যে, আমি আর মোজাম্মেল একই দিকে আসছিলাম, তাই একসঙ্গে আসা। এর বেশি কিছু নয়। ঘটনা তো আসলে তাই!
মোজাম্মেলের ফোন বেজে ওঠল। ব্যস্ততা দেখা দিলো ওর মধ্যে। ঝটপট কয়েকচুমুক খেয়ে বাকিটা ফেলে দিল রাস্তায়। ‘ওকে দিয়া! বিভাস দা’ আছে। তাহলে থাকো। কাল দেখা হচ্ছে। আমি গেলাম’। এত দ্রুত সব ঘটে গেল যে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি আর বিভাস দা’। একটা উদ্ভট জায়গায় দু’জনে দাঁড়িয়ে আছি। চা খাচ্ছি।
দোকানটা রাস্তার ডান পাশে। বাঁ-পাশের দেয়াল ঘেঁষে পরিষ্কার একটা জায়গা দেখে দাঁড়িয়েছি আমরা। চা শেষ। দাঁড়িয়ে আছি চুপচাপ। কী বলবো তাকে! তার সঙ্গে আমার কী কথা থাকতে পারে! আমি অপেক্ষা করছিলাম তার চা-টা কখন শেষ হয়।
‘বিভাস দা’, চলেন অন্য কোথাও দাঁড়াই। এখানে কেমন ভালো লাগছে না।’ তিনি হাসলেন। তাকালেন আমার দিকে। মুখের দিকে না-তাকিয়ে তিনি কথা বলেন না। এমনভাবে তাকান, একটু কেমন কেমন লাগে। তার অভ্যাস চোখে চোখ রেখে কথা বলা। এটা আগেই খেয়াল করেছি।
‘আপনি যা ভাবছেন, আসলে তা না। এটা আমার পরিচিত জায়গা। তবে আপনি যেহেতু চাইছেন, চলেন।’ জায়গাটার ব্যাপারে আমি তো তাকে কিছু বলিনি। তাহলে আমি যা ভাবছি মানে! অবশ্য বিরক্তিভাবটা হয়তো হাবেভাবে প্রকাশ হয়েই যায়।
বিভাস দা’ বিল দিয়ে এলেন। খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, ‘আসলে আপনার কাছে আমার সরি বলার আছে।’ সব কথাই উনি খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলেন। আমি বুঝলাম না। এখানে আবার সরিটরি আসছে কোত্থেকে! বললাম, ‘কেন! সরি বলবেন কেন! সরি বলার তো কিছু দেখছি না!’
‘সহকর্মী হিসেবে আপনাকে আমার সরি বলার আছে। এটা আসলে আমার আচরণগত ঘাটতিগুলোর জন্যই।’ আমি তার কথা বুঝলাম না। কী বলবো, এটাও বুঝতে না-পেরে চুপ করে রইলাম। বললেন, ‘এই দিনটার জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম।’ এবার আমি না-হেসে পারলাম না। বললাম, ‘আপনি অপেক্ষা করলেন কোথায়! আমরাই তো এলাম।’ হা হা করে হাসলেন। বাচ্চারা যেমন হঠাৎ মজা পেলে হাসে, ঠিক তেমন একটা হাসি।
‘একটা ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন আপনি। এমনটাই মনে হয়েছিল আমার। ইচ্ছা করছিল, আপনার সঙ্গে কথা বলি একদিন। শুনি আপনার কথা। মানুষ সেই সময় নিজের কথা বলতে চায়। কথা বলার জন্য সঙ্গী খোঁজে। কিন্তু নির্ভরযোগ্য মানুষ পাওয়া সহজ কথা না। খুব ইচ্ছা করছিল, কথা বলি আপনার সঙ্গে। সংকটকে চেনা গেলে তার অর্ধেক সমাধান হয়ে যায়।’, বলে মৃদু হাসলেন। বললেন, ‘ভাবলাম, তাহলে হয়তো সময় আসেনি। এরপর থেকে উপযুক্ত সময়ের জন্যই অপেক্ষা করছি। বলতে পারেন, এই দিনটির জন্য।’ আমার মুখের দিকে তিনি তাকিয়ে থাকলেন। হয়তো উত্তরের অপেক্ষা করছেন। আমি কী বলবো, কিছুই বুঝতে পারছি না। তার কথার আগামাথা কিছুই বুঝলাম না। বললাম, ‘দেখুন, আপনার কথার আগামাথা আমি কিছুই বুঝতেছি না। আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করলেন কোথায়? আর অপেক্ষা যদি করেনই, তা কি সরি বলার জন্য? আর আপনি আমাকে সরিই বা বলবেন কেন?’ বললাম, ‘কিছু মনে করবেন না। আমি এভাবে হেঁয়ালি করে কথা বলা পছন্দ করি না। আপনার যদি কিছু বলার থাকে, আপনি আমাকে সরাসরিই বলতে পারেন। আমি কিছু মনে করবো না।’ একটু কড়াভাবেই বলে ফেললাম। কেন জানি তাকে আমার ভয় লাগছিলো। এরকম অপরিচিত কালো একজন মানুষের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমি কথা বলছি, পুরো বিষয়টাই আমার কাছে তখন অদ্ভুত ঠেকছিলো। কোনোভাবেই তার কথার খেই ধরতে পারছিলাম না।
ভেতরে ভেতরে আমি বেশ উদ্বিগ্ন। কণ্ঠে কি কড়াভাবটা প্রকাশ পেয়ে গেছে! তিনি যদি কিছু মনে করেন! এভাবে, এই সময়, তাকে কি ক্ষেপানো ঠিক হলো! এভাবে না বললেও পারতাম। সবচেয়ে ভালো হত চুপ করে সায় দিয়ে যাওয়া। একটু খারাপই লাগছে। ভয় আর অস্বস্তি মিশ্রিত খারাপ। সচরাচর কারো সঙ্গে এভাবে আমি কথা বলি না। আসলে মোজাম্মেলের সঙ্গে না-যাওয়াটাই ভুল হয়েছে। কে কী মনে করলো তা নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কী আছে! মনে করলে করলো। মোজাম্মেলের সঙ্গে আমার অ্যাফেয়ার থাকলে আছে। তাতে কার কী সমস্যা!
বিভাস দা’ স্বাভাবিক। মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখেমুখে কোনো পরিবর্তন নেই। বললেন, ‘আমি আসলে এই কারণে দুঃখিত, আমার মনে হয়েছে, আমি হয়তো বে-খেয়ালে আপনার সঙ্গে কোনো ভুল আচরণ করেছি। কীভাবে বুঝলাম? আপনার চোখেমুখে আমার প্রতি একটা বিরক্তিভাব দেখেছি আমি।’ হাসলেন। ‘দিয়া, আমি আপনার জন্য ক্ষতিকর নই। এতটুকু আস্থা আপনি আমাকে করতে পারেন। মানুষ তাকেই অপছন্দ করে যাকে সে বুঝতে পারে না। যাকে সে নিজের জন্য ক্ষতিকর মনে করে। জগতের এই-ই নিয়ম। কোনো প্রাণি ঠিক তখনই আক্রমণ করে, যখন সে হুমকি অনুভব করে।’ কথা চালিয়েই গেলেন। তার শান্তশিষ্ট কথাবার্তা শুনে আমার আরও অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। বুঝলাম না, কী বলবো। তার কোনো কথাই আমার কমন পড়ছে না। বললাম, ‘কে বললো, আপনাকে আমি অপছন্দ করি?’ তিনি যেন আমার কথা শুনতেই পাননি। এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না। চুপ করে গেলেন।
কয়টা বাজতে চললো! ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করব, এমন সময় উনিই বললেন, ‘কয়টায় ফিরতে হবে আপনাকে?’ তার মুখে প্রশান্ত হাসি। যেন যা বলতে চান, বলে ফেলেছেন সব। ‘সচরাচর আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে ফিরি।’ আমি বললাম। এমন বিষাদমাখা পরিবেশ সৃষ্টি হবে ভাবিনি। সকালেই তাদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার জন্য তাড়া বোধ করছিলাম। অথচ ভেতরে এখন কথা নেই। একদম ফাঁকা হয়ে আছে সব।
সবকিছু নতুনভাবে শুরু করার জন্য বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর একটু কেশে নিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনাদের বাসা কোথায়, বিভাস দা’?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘আপনি কি সত্যিই জানতে চান, দিয়া?’ এটা কী ধরনের জবাব! আমি আরও অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মেজাজটাও খারাপ হলো। কি ধরনের প্রশ্ন এটা! যদি না-জানতে চাই, তাহলে জিজ্ঞাসা করলাম কেন! ‘আপনি কি সবার সঙ্গে এভাবেই কথা বলেন?’ হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিলাম আমরা। তিনি থেমে তাকালেন আমার দিকে। আবারও বাচ্চাদের মত হাসলেন। বললেন, ‘আপনার প্রশ্ন আমি বুঝতে পেরেছি। আসলে প্রত্যেকটা মানুষেরই নিজস্ব কিছু পরিভাষা থাকে। সেই পরিভাষাগুলো আমরা বুঝি না বলেই পরস্পরকে ভুল বুঝি। তবে আপনাকে আমি কথা দিতে পারি, কিছুদিন কথা হলেই, আমাদের মধ্যে এই সমস্যাটা আর থাকবে না।’ তিনি চুপ করে গেলেন।
‘আজ তাহলে চলি। কাল দেখা হবে।’, এই বলে আমি বিদায় নিতে চাইলাম। তখন মনে পড়লো, কাল দেখা হবে না। কারণ, কাল শুক্রবার। ঠিক এই জায়গাটাতেই, বইয়ের দোকানটার সামনে, দেখা হয়েছিল উনার সঙ্গে। আর এখানে এসেই মনে হল বিদায় নেওয়ার কথা। ‘কিন্তু আপনার চোখ তো বলছে, বাস পর্যন্ত এগিয়ে দিলেই খুশি হবেন। বলেন, কোনটা করবো?’ বললেন বিভাস দা’।
‘আপনার আসতে হবে না। বিদায়। দেখা হবে।’