ডিকলোনাইজিং দ্যা মাইন্ড ।। কিস্তি : ৬

সূত্র : কেনিয়ান ওয়ালস্ট্রিট
নগুগি ওয়া থিওঙ্গো সাহিত্য ও রাজনীতির দুনিয়ায় চেনা একটি নাম। তাঁর বিখ্যাত বই Decolonising the Mind: The Politics of Language in African Literature (1986)। ঔপনিবেশিক রাজনীতি, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি বোঝার দারুণ প্রতিনিধি-পুস্তক এই বই। বইটি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করবেন শিবলী নোমান। আজ প্রকাশিত হল বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ের দ্বিতীয় কিস্তি

 

আফ্রিকান থিয়েটারের ভাষা

পাঁচ

কামিরিথু কোন বিচ্যুতি ছিল না। বরং ছিল আফ্রিকান সভ্যতা ও থিয়েটারের ঐতিহ্যের ভেতর ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের প্রয়াস। পূর্বোল্লিখিত সামাজিক শ্রেণিসমূহের সমন্বয়ে গঠিত একটি গ্রামে, কামিরিথু ছিল জাতীয় থিয়েটার প্রসঙ্গে উত্থাপিত প্রশ্নের প্রকৃত উত্তর। থিয়েটার কোন ভবন নয়। মানুষই থিয়েটার তৈরি করে। তাদের জীবনই হলো নাটকের সবচেয়ে জরুরি বিষয়। খোলা জায়গা, ভাষা, বিষয় ও ধরনের জাতীয় ঐতিহ্যের সাথে কামিরিথুই নিজেকে পুনঃসংযুক্ত করেছিল।

 

প্রয়োজনীয়তাই এই বিষয়টিতে জোর দিয়েছিল।

তখন কামিরিথুতে আদতেই একটি খোলা জায়গা ছিল। ১৯৭৭ সালে যুবকেন্দ্রের জন্যে বরাদ্দকৃত চার একর জমিতে মাটির দেয়াল দেয়া চারটি ঘরের একটি ভগ্নদশা স্থাপনা ছিল। এটি ব্যবহৃত হতো বয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচিতে। জমির বাকিটা ছিল ফাঁকা, শুধুই ঘাস। গ্রামের কৃষক ও কর্মীরাই মঞ্চ তৈরি করেছিল। বাঁশ দিয়ে তৈরি একটি অর্ধবৃত্তাকার দেয়ালের সামনে অর্ধবৃত্তাকার মঞ্চ। বাঁশের দেয়ালের পেছনে তিন কক্ষের একটি স্থাপনা যা ব্যবহৃত হতো সংরক্ষণাগার ও পোশাক বদলের স্থান হিসেবে। মিলনায়তন ছিল লম্বা কাঠ দিয়ে তৈরি সিঁড়ির মতো, মঞ্চ ও মিলনায়তন যেন ছিল একে অপরের সম্প্রসারিত অংশ! এর কোন ছাদ ছিল না। এটি ছিল একটি উন্মুক্ত থিয়েটার যার মঞ্চ ও মিলনায়তনের চারপাশে ছিল বিস্তৃত খোলা জায়গা। মিলনায়তন ও মঞ্চে মানুষ ও অভিনেতাদের মাঝে কোন প্রপ্তিবন্ধকতা ছল না। মিলনায়তনের পেছনে ছিল কিছু লম্বা ইউক্যালিপ্টাস জাতীয় গাছ। এসব গাছে বা বাইরের বাঁশের বেড়ার উপর বসে পাখিরাও অভিনয় দেখতে পারতো। অনেক সময় কোন কোন অভিনেতা বুদ্ধি করে নাটকের মাঝে গাছে উঠে গান গাইতো, যা চিত্রনাট্যে থাকতো না। যারা বসে তাদের অভিনয় দেখে শুধু তাদের জন্যেই নয়, বরং তাদের জন্যেও শিল্পীরা অভিনয় করতো যারা তাদের কোন-না-কোনভাবে দেখতে ও শুনতে পারে। অর্থাৎ গ্রামের ১০ হাজার মানুষই ছিল তাদের অডিয়েন্স।

 

প্রয়োজনীয়তা থেকেই ভাষা বিষয়ে একটি খুবই সাধারণ সমাধানের দরকার ছিল। আমাকে ও নগুগি ওয়া মিরিকে একটি নাটকের প্রাথমিক চিত্রনাট্য লিখতে বলা হয়েছিল। পরে এই নাটকের নাম দেয়া হয়েছিল এনগাহিকা এনদিনদা নিজেদের কাছে আমাদের প্রশ্ন ছিল এখানে আমরা কোন ভাষা ব্যবহার করবো?

 

১৯৬০ সালে ছাত্র থাকা অবস্থা থেকে আমি লেখালেখি করি। আমি আমার সকল উপন্যাস ও গল্প এমনকি নাটকও ইংরেজিতে লিখেছি। উগান্ডার স্বাধীনতা উদযাপনের জন্যে লেখা দ্য ব্ল্যাক হারমিট নাটকটি ১৯৬২ সালে উগান্ডা ন্যাশনাল থিয়েটারে পরিবেশন করেছিল মাকারেরে স্টুডেন্টস ড্রামা সোসাইটি। ১৯৬৬ সালে লেখা দিস টাইম টুমরোর বিষয় ছিল পর্যটকদের জন্যে শহরকে পরিষ্কার রাখতে নাইরোবি থেকে শ্রমিক অপসারণ । ১৯৭৬ সালে মিকেরে মুগোর সাথে আমি লিখেছিলাম দ্য ট্রায়াল অব দেদান কিমাথি। প্রকাশিত চিত্রনাট্যের মুখবন্ধে আমরা যা লিখেছিলাম তা আসলে একটি সাহিত্যিক ইশতেহারের সমার্থক ছিল। এতে সাম্রাজ্যবাদ ও শ্রেণিশত্রুদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের লড়াইতে অংশ নেয়ার জন্যে আফ্রিকান লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গির র‌্যাডিকেল পরিবর্তনের ডাক দেয়া হয়েছিল। আমরা একটি বিপ্লবী থিয়েটারের জন্যে ডাক দিয়েছিলাম যার পেছনে আরো কিছু ভাবার বিষয় ছিল। ‘‘সঠিক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে জনগণকে ইতিবাচক, নায়কোচিত ও ইতিহাসের প্রকৃত নির্মাতারূপে” কিভাবে দেখানো যায়? সাধারণ মানুষের পক্ষে থাকে এমন থিয়েটারগুলোকে আমরা ভালো থিয়েটার বলেছিলাম। ‘‘সেগুলো ভুল ও দুর্বলতাগুলোকে আড়াল না করে পূর্ণ মুক্তির জন্যে সংগ্রামে সাধারণ মানুষের দৃঢ়সঙ্কল্পের আহ্বান করে ও সাহস যোগায়।” কিন্তু আমরা কখনো নিজেদের প্রশ্ন করি নি যে কীভাবে এসব বিপ্লবী থিয়েটার বিদেশি ভাষা-প্রশ্নে সাধারণ মানুষের কাছে আহ্বান জানাবে। তাছাড়া ঐ তিনটি নাটক অর্থাৎ দ্য ব্ল্যাক হারমিট, দিস টাইম টুমরোদ্য ট্রায়াল অব দেদান কিমাথি-তে কিছু অবশ্যম্ভাবী সাংঘর্ষিকতা ছিল, যদিও সেগুলো চিত্রনাট্যের চেয়ে মঞ্চেই বেশি দৃশ্যমান হতো। দ্য ব্ল্যাক হারমিট-এর শুরুতেই দেখা যায় একজন কৃষক মাতা টি. এস. এলিয়টকে স্মরণ করিয়ে দেয় এমন কাব্যিক ভাষায় কথা বলছেন। একটি গ্রামীণ এলাকা থেকে তাদের সন্তান দ্য ব্ল্যাক হারমিটকে শহরে খুঁজতে আসা মুরুব্বিদের নিখুঁত ইংরেজিতে কথা বলতে দেখা যায়। একই কাজ করেন দ্য ট্রায়াল অব দেদান কিমাথি নাটকে কিমাথি, যখন তিনি তার গেরিলা বাহিনী অথবা কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির উদ্দেশ্যে আদালতে ভাষণ দেন। এসব ক্ষেত্রে এটি বুঝে নেয়া হতো যে চরিত্রগুলো আদতে আফ্রিকান ভাষাতেই কথা বলছে। কিন্তু এটি আসলে এক ধরনের ভ্রম কারণ তারা আসলে সরাসরি ইংরেজিতেই কথা বলছে ও সে ভাষাতেই গ্রহণ করছে। এছাড়া আরও সাংঘর্ষিকতা রয়েছে। এই চরিত্রগুলো ইংরেজিতে কথা বলে কিন্তু গানের সময় আসলে তারা তাদের নিজেদের ভাষায় গান গায়। অর্থাৎ তারা আসলে আফ্রিকান ভাষা জানে! ইংরেজিতে কথা বলার ভ্রমের মাঝে তারা আফ্রিকান ভাষা ব্যবহার করে যেখানে আফ্রিকান ভাষাটি আসলে ভেঙে পড়েছে। যে ঐতিহাসিক বাস্তবতা থিয়েটারগুলো প্রতিফলিত করতে চায় তার সাথে বাস্তবতা পড়ে যায় সংঘর্ষে। এটি হলো মূলত বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া সেসব পেটি-বুর্জোয়া চরিত্র যারা একই বক্তব্যে বা কথায় খুব স্বাভাবিকভাবে আফ্রিকান ভাষার সাথে ইংরেজির মিশ্রণ ঘটায়।

 

থিয়েটার ও উপন্যাসে নিজেকে প্রকাশের সাহিত্যিক মাধ্যম হিসেবে ইংরেজির ব্যবহার আমাকে সবসময়ই ভাবিয়েছে, বিঘ্ন ঘটিয়ে। ১৯৬৭ সালে লিডসে এক ছাত্রের নেয়া সাক্ষাৎকার ও আমার বই হোমকামিং (১৯৬৯)-এ আমি এই প্রশ্নের কাছে ফিরে গিয়েছিলাম। তবে আমি এই বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতাম। কামিরিথুতে আসার আগে পর্যন্ত আফ্রিকান ভাষা ব্যবহারের সম্ভাব্যতার এ বিষয়টি আমার কল্পলোকেই শুধু বিদ্যমান ছিল।

 

কামিরিথুই আমাকে গিকুয়ু ভাষার দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল এবং এটি ছিল আমার অতীত, বিশেষত থিয়েটারের সাথে আমার ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক ছেদ’-এর সমার্থক। অডিয়েন্সদের নিয়ে প্রশ্ন থেকে ভাষার পছন্দ বিষয়ে সমস্যার সমাধান হয়েছিল আর ভাষার পছন্দ নিয়ে প্রশ্নের সমাধান করে দিয়েছিল এর অডিয়েন্স। কিন্তু আমাদের গিকুয়ু ভাষা ব্যবহারের সাথে থিয়েটারের অন্যান্য বিষয়াদিরও স¤পর্ক ছিল। যেমন বিষয়, অভিনয় শিল্পী, বাছাই ও মহড়া, অভিনয় ও সংবর্ধনা সকল ক্ষেত্রে, অর্থাৎ একটি ভাষা হিসেবে থিয়েটারের প্রতিটি বিষয় এর সাথে যুক্ত ছিল।

 

এনগাহিকা এনদিনদা একটি নব্য-ঔপনবেশিক সমাজে কৃষকদের প্রোলেতারিয়করণকেই ফুটিয়ে তলে। এতে দেখানো হয়েছিল কিগুন্দু পরিবারের গল্প। তারা ছিল একটি গরিব কৃষক পরিবার যারা তাদের জীবন রক্ষার জন্যে নিজেদের দেড় একর জমিতে কাজ করার পাশাপাশি শ্রমিক হিসেবেও কাজ করতো। তাদের এই দেড় একর জমিও শেষ পর্যন্ত স্থানীয় দালাল জমিদার ও ব্যবসায়ীদের সাহায্যে জাপানি ও ইয়ুরো-আমেরিকান বহুজাতিক শিল্পপতিদের দখলে চলে যায়।

 

কেনিয়ার ইতিহাস ও সমসাময়িক রাজনীতিতে ভূমির প্রশ্ন খুব মৌলিক একটি বিষয়। এটি বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে অন্য যে কোন স্থানে অভিযান, অসম চুক্তি বা জনসংখ্যার একটি অংশের উপর গণহত্যা চালিয়ে তাদের জমি নিয়ে নেয়ার মতোই। এনগাহিকা এনদিনদা নাটকে কেনিয়ার মানুষের ভূমি ও মুিক্তর জন্যে সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছিল। ১৯৫২ সালে কিমাথির নেতৃত্বে কেনিয়া ল্যান্ড অ্যান্ড ফ্রিডম আর্মি, যারা মাও মাও নামেও পরিচিত হয়েছিল এবং কেনিয়ার স্বাধীনতার জন্যে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিল এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা জরুরি অবস্থা জারি করে সকল নাগরিক অধিকার হরণ করেছিল-সেসব ঘটনা নাটকে উঠে এসেছিল। নাটকে আরও ছিল ১৯৬৩ সালের ঘটনা, যখন কেনিয়াত্তার অধীনে KANU আলোচনার মাধ্যমে একটি জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত এবং পাঁচ বছর পরপর জনগণকে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার এনে দিয়েছিল। নাটকটিতে দেখানো হয়েছিল হাজার হাজার কেনিয়ানের মৃত্যুর বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীনতা কিভাবে বেহাত হয়ে গিয়েছে। অন্য কথায়, এই নাটকে দেখানো হয়েছিল কিভাবে একটি ব্রিটিশ স্বার্থরক্ষাকারী উপনিবেশ থেকে কেনিয়া জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের কারণে আরও প্রশস্ত একটি নব্য-উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। একই সাথে এই নাটকে বহুজাতিক কারখানা ও ক্ষেতগুলোতে কাজ করা শ্রমিকদের সমসাময়িক সামাজিক বাস্তবতাও তুলে ধরা হয়েছিল।

 

কামিরিথুর অনেক কৃষক ও শ্রমিকই গেরিলা দলে থেকে প্রত্যক্ষভাবে কিংবা অন্য কোন উপায়ে পরোক্ষভাবে ভূমি ও মুক্তির জন্যে সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। সংগ্রামের সময় অনেকে বন-জঙ্গল ও পাহাড়ে দিন কাটিয়েছেন, বন্দি থেকেছেন বিনা বিচারে কারাগার ও জেলখানায়। যদিও তাদেরই কেউ কেউ ব্রিটিশ শত্রুদের সহায়তাও করেছিল। কিন্তু অনেকেই চোখের সামনে তাদের বসত বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, বৃটিশদের দ্বারা তাদের মেয়েদের ধর্ষণ, তাদের ভূমি দখল ও আত্মীয়দের মৃত্যু দেখেছেন। উপরন্তু কামিরিথু ছিল উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ঐ নায়কোচিত সংগ্রাম ও এই সংগ্রামের সাথে নব্য-ঔপনিবেশিক বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসেরই একান্ত অংশ। আমাদের নাটকটি সংগ্রামের ঐক্য ও ধারাবাহিকতা ফুটিয়ে তুলে ঐ ইতিহাসকেই উদযাপন করেছিল। এক্ষেত্রে ভাষার পছন্দ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ভাবপ্রকাশের ভাষিক মাধ্যম ও তাদের ইতিহাসের বিষয়াদির মাঝে এখন আর কোন বাধা ছিল না। যেহেতু নাটকটি এমন ভাষাতেই লেখা ছিল যা সবাই বুঝতে পারে, তাই চিত্রনাট্যের যে কোন অংশ নিয়েই সাধারণ মানুষ আলোচনায় যুক্ত হতে পারতো। তারা এর বিষয়, ভাষা, এমনকি ধরন নিয়েও আলোচনা করেছিল। পুরো ব্যপারটি বিশেষত নগুগি ওয়া মিরি, কিমানি গিকাউ ও আমার জন্যে ছিল শিক্ষামূলক। যে শিক্ষা ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। সেই শিক্ষা যা কারখানাগুলো থেকে উঠে এসেছে। সেই শিক্ষা যা তৈরি হয়েছে কৃষি জমি ও ক্ষেতে। আমাদেও এই যে ভাষা শিক্ষা তা যেন হাজার বছর ধরে কৃষকদের অভিভাবকত্বে ছিল। এবং এর মাধ্যমে আফ্রিকান থিয়েটারের একটি নতুন ধরনের উপাদান সম্পর্কে আমরা শিখেছিলাম।

 

নতুন ধরনের এই উপাদানগুলো কী ছিল?
প্রথমত, এতে ছিল গান ও নাচ। বৃষ্টি, জন্ম, দ্বিতীয় জন্ম, খাতনা, বিয়ে, শেষকৃত্য অথবা অন্য যে কোন সাধারণ উদযাপনের ক্ষেত্রেও গান ও নাচ হলো আমাদের একেবারে সাধারণ একটি প্রথা। এমনকি কৃষকদের জন্যে দেয়া নিত্য বক্তৃতার ভেতরেও গানের মাধ্যমে বৈচিত্র্য আনা হয়। এটি হতে পারে মাত্র এক বা দুই লাইন, অথবা একটি ছত্র বা একটি সম্পূর্ণ গান। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই গান ও নাচ শুধুমাত্র আয়োজনের সৌন্দর্য বৃদ্ধিই নয় বরং আলোচনা, পানাহার, প্রথা কিংবা উদযাপনের সাথে একেবারে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত একটি বিষয়।

 

এনগাহিকা এনদিনদা নাটকেও অভিনয় শিল্পীদের চারিত্রিক গঠন ও চালচলনের সাথে আমরা গান ও নাচকে যুক্ত করতে চেষ্টা করেছিলাম। নাটকে যা হয়ে গিয়েছে ও যা আসছে তার মাঝে স¤পর্ক তৈরির জন্যে গানগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল। নাটকের সংলাপ ও অন্যান্য বিষয়ের ভেতর এক ধরনের ধারাবাহিকতা হিসেবে গানগুলো রাখা হয়েছিল। এক্ষেত্রে আমি একটি দীর্ঘ সিকোয়েন্সের উদাহরণ দিতে চাই যেখানে বেশ কিছু গান ও নাচের উপরই এর বিভিন্ন ক্রিয়া ও গতিময়তা নির্ভরশীল ছিল।

 

এটি শুরু হয় কিওই ও তার স্ত্রী জাজেবেলকে গ্রহণ করার জন্যে কিগুন্দা ও তার স্ত্রী ওয়াংগেচির প্রস্তুতি গ্রহণের দৃশ্য দিয়ে। কিগুন্দা ও ওয়াংগেচি একটি কৃষক পরিবার। কিওই ও জাজেবেল একটি ধনী জমিদার পরিবারের সদস্য যাদের চার্চ, ব্যাংক ও শিল্পকারখানার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। কিগুন্দা কিওই-এর জন্যে কাজ করে। কিন্তু এবারই প্রথমবারের মতো কিওই কিগুন্দার বাড়িতে আসছে। আর কিগুন্দা ও ওয়াংগেচি চেষ্টাও করছে এই ভ্রমণের কারণ বের করতে। কেন একজন জমিদার তাদেও বাড়িতে ঘুরতে আসবে? হঠাৎ করেই ওয়াংগেচির মনে হলো যে কিওইরা আসছে কিগুন্দার মেয়ে গাথোনি ও কিওই-এর ছেলে জন মুহুন্নির বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে। মুহুন্নি আর গাথোনি কিছুদিন ধরে একসাথে ঘুরছে। এই মনে হওয়াটি এতই অস্বাভাবিক যে কিগুন্দা বলে উঠলো :

কিগুন্দা: ওহে নারী!
তোমরা সারাক্ষণ বিয়ের কথাই ভাবো!

 

ওয়াংগেচি: কেন নয়?
এই সময়টা আমাদের সময়ের মতো নয়।
এখন বলা হয় ভালোবাসা কাউকে ভয় পায় না।
তুমি কি দেখতে পাও না,
যে তোমার মেয়ে খুবই সুন্দর?
সে ঠিক তেমনই দেখতে যেমনটা ছিলাম আমি? নিখুঁত সুন্দর!

 

কিগুন্দা: (রাবারের জুতোর সাথে যুদ্ধ থামিয়ে)
তুমি? আর নিখুঁত সুন্দর?

 

ওয়াংগেচি: হ্যা। আমি।

 

কিগুন্দা: তুমি কি জানো না যে আমার আসলে তোমার প্রতি করুণা হয়েছিল?

 

ওয়াংগেচি: তুমি, যে কিনা সারাক্ষণ আমার পিছনে ঘুরতে?
সকালে,
সন্ধ্যায়,
যখন আমি নদী থেকে বাড়িতে ফিরতাম,
যখন আমি বাজার থেকে বাড়িতে ফিরতাম,
অথবা যখন আমি সেটেলারদের খামার থেকে বাড়িতে ফিরতাম?
তুমি কি ভুলে গেছো কিভাবে তুমি আমার কাছে কাকুতি করতে,
আর বলতে তুমি জীবনে কখনোই এমন সৌন্দর্য দেখো নি?

 

কিগুন্দা: (অতীতে ফিরে গিয়ে)
সেটা ছল জরুরি অবস্থার অনেক আগের কথা।
তোমার পা ছিল চকচকে উজ্জ্বল,
তোমার চেহারা ছিল রাতের স্পষ্ট চাঁদের মতো জ্বলজ্বলে,
তোমার চোখ যেন ছিল স্বর্গের তারা।
তোমার দাঁত যেন ছিল সবসময় দুধে ধোয়া।
তোমার কন্ঠস্বর ছিল মূল্যবান বাদ্যের মতো।
তোমার স্তন ছিল ভরাট আর সবচেয়ে তীক্ষ্ণ কাঁটাটি যেন।
যখন তুমি হাটতে তখন তাতে সুন্দর সুর উঠতো।

 

ওয়াংগেচি: (সেও সম্মোহিত হয়ে পড়ে তাদের অতীত যৌবনে)
সেসব দিনে
আমরা নাচতাম কিনিনি বনে।

 

কিগুন্দা: একটি নাচ যার পেছনে খরচ মাত্র ২৫ পয়সা।

 

ওয়াংগেচি: সেসব দিনে এনদেইয়া থেকে গিথুগা পর্যন্ত একটা মেয়েও ছিল না
যে তোমার সাথে নাচতে চাইতো না।

 

কিগুন্দা: তুমিও তোমার স্কার্ট দোলাতে
যতক্ষণ না গিটারবাদক তার গিটারের তার ছিঁড়ে ফেলতো।
এবং যতক্ষণ না গিটার সেই সুর তুলতো
যাতে পুরো বন হয়ে যেত নিশ্চুপ,
যেন গাছগুলোও তা শুনছে…
এসময় গিটার ও অন্যান্য যন্ত্র বেজে উঠবে যন তা কিগুন্দা ও ওয়াংগেচির স্মৃতিতে বাজছে। কিগুন্দা ও ওয়াংগেচি নাচতে শুরু করে। এরপর তারা যোগ দেয় গিটার ও অন্যান্য যন্ত্রবাদক এবং নৃত্যশিল্পীদের সাথে। তারা নাচতে থাকে, আর তাদের ভেতর কিগুন্দা ও ওয়াংগেচির মুখে শোনা যায়,
নায়াংগুইচু চলো স্কার্ট দোলাই
নায়াংগুইচু চলো স্কার্ট দোলাই
বোন, একে ঝাঁকাও আর এর থেকে মূল্যবান বস্তু তৈরি করো।
বোন, একে ঝাঁকাও আর এর থেকে মূল্যবান বস্তু তৈরি করো।
নায়াংগুইচু এক পায়ে নাচে
নায়াংগুইচু এক পায়ে নাচে
অন্যটি তার শরীরকে তুষ্ট করে।
অন্যটি তার শরীরকে তুষ্ট করে।
ওয়াংগেচি একজন সুন্দরী
ওয়াংগেচি একজন সুন্দরী
সরু ও সোজা ইউক্যালিপ্টাসের মতো তার দেহ।
সরু ও সোজা ইউক্যালিপ্টাসের মতো তার দেহ।
ওয়াংগেচি হলো ছোট্ট কুমারি
ওয়াংগেচি হলো ছোট্ট কুমারি
যখন তাকে দেখি তখন পা থেমে যায়।
যখন তাকে দেখি তখন পা থেমে যায়।
ওয়াংগেচি, চলো ফলের বাগান চাষ করি
ওয়াংগেচি, চলো ফলের বাগান চাষ করি
এই বাগানের মালিক কিগুন্দা ওয়া গাথোনি।
এই বাগানের মালিক কিগুন্দা ওয়া গাথোনি।
ওয়াংগেচি, আমাদের মা, আমরা এখন প্রত্যাখ্যান করছি
ওয়াংগেচি, আমাদের মা, আমরা এখন প্রত্যাখ্যান করছি
আমাদের ঘরে আমাদেরই দাস হওয়া,
আমাদের ঘরে আমাদেরই দাস হওয়া।

 

সূত্র ও টীকা

৫. আমার যখন ইচ্ছে তখন বিয়ে করবো — অনুবাদক

৬. তুলনা করা যেতে পারে ওলে সোয়িংকার দ্য লায়ন অ্যান্ড স্য জুয়েল-এর শর্টার অক্সফোর্ড ডিকশনারি থেকে গালি বলা বিদ্যালয় শিক্ষক লাকুনলে ও ইয়োরুবা ভাষায় কথা বলে এমন ধরে নেয়া অশিক্ষিত গ্রামীণ নারী সিদির কথোপকথন। লাকুনলে আসলে কোন ভাষায় কথা বলে? ইয়োরুবা না ইংরেজি? আর সিদি? নিশ্চিতভাবেই চিত্রনাট্যে তারা উভয়েই কথা বলে ইংরেজিতে — লেখক

(চলবে)

 

দ্বিতীয় অধ্যায় ।। প্রথম কিস্তি ।। ক্লিক করুন নিচের লিংকে ।।

ডিকলোনাইজিং দ্যা মাইন্ড ।। কিস্তি : ৫

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here