চলতি বাস্তবতায় বিভিন্ন রকম ‘তকমা’ পাওয়ার ঝুঁকি ও সম্ভাবনা মাথায় নিয়েই লিখতে বসেছি। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এ লেখা লিখতে বাধ্য করছে। কারণ ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের শেষ নবি, মহানবি হজরত মোহাম্মদ (স.)-কে নিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়েছে এবং তার জবাবে ক্ষুব্ধ হয়েছে মুসলমান অধ্যুষিত রাষ্ট্রসমূহ। এই ক্ষোভ দেখে অনেকে আবার বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন তুলছেন : ক্ষোভপ্রকাশকারীরা কতখানি শুদ্ধাচারের সঙ্গে ধর্ম পালন করেন? কিন্তু ক্ষোভের প্রকাশ অস্বাভাবিক নয়। যেমন টুইন টাউয়ারে হামলার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ অযৌক্তিক নয়; তখন নিশ্চয়ই এ প্রশ্ন তোলা সমীচীন মনে হয় নি যে, তখনকার ক্ষোভপ্রকাশকারীরা কতখানি শুদ্ধাচারী ও নিষ্ঠাবান খ্রিস্টান বা ইহুদি বা মুসলমান বা হিন্দু ছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে নবি, ধর্মগ্রন্থ, দেবতা, পুরোহিত, পোশাক, প্রসাদ, উপসনালয়, মণ্ডপ – প্রতিটিই ধর্মীয় প্রতীক; প্রতিটি প্রতীকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আবেগ ও বিশ্বাসের সুতো। তাই প্রতিবাদ করার জন্য বিশিষ্টভাবে বা চূড়ান্ত আধ্যাত্মিক অর্থে ধর্মপ্রাণ হবার প্রয়োজন পড়ে না।
প্রথমত স্পষ্ট করে নেয়া দরকার যে, হজরত মোহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে ব্যঙ্গ করা কোনোভাবেই যুক্তিসংগত নয়। শুধু হজরত মোহাম্মদ নন, কোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব/ জাতি/ গোষ্ঠী/ লিঙ্গ/ বর্ণের মানুষকেই নিজের মত বা চিন্তা দ্বারা হেয় কিংবা অবনমিত করতে পারি না। অনুভূতিহীন এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাহীন চিন্তার প্রকাশ আর যাই হোক মুক্তচিন্তা হতে পারে না। মুক্তচিন্তা কী? — সেটি অন্য প্রসঙ্গ।
আমি যদি জানি যে, যিশু খ্রিস্ট বা শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে ছবি আঁকা কিংবা রঙ্গব্যঙ্গপূর্ণ মন্তব্য করার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের কাছে পছন্দনীয় বিষয় নয়, তাহলে সে বিষয়ে সতর্ক ও সহনশীল থাকাটাই বরং আমার জন্য যুক্তিশীল নাগরিক দায়িত্ব। কারণ ধর্ম, জাতি, বর্ণ, গোষ্ঠী ইত্যাদি কোনো ব্যক্তি-মানুষের একক-পরিচিতি বা আইডেনটিটি নয়। প্রত্যেকটি পরিচিতি যৌথতার ইঙ্গিত দেয়।
আপনার কালো রঙ ভালো লাগে না বলে, আপনি আপনার কালো বন্ধুকে কখনো কি বলেন : ‘‘কুৎসিৎ। কাইল্যা ভূত?’’ বলেন না কেন? কারণ আপনি জানেন, আপনার বন্ধুটির মন খারাপ হবে। সম্পর্কে ভাটা পড়বে। আপনি কি রাস্তায় যেতে যেতে পেটমোটা, মাঢ়ি উঁচু, দাঁত বের করা লোকটিকে গিয়ে বলেন, ‘‘আপনি তো সুন্দর না, আপনার সঙ্গে আপনার বউরে মানাইতেছে না। আপনার বউরে আমারে দিয়ে দেন।’’ কথিত মুক্তচিন্তার স্বার্থে আপনি তো বলতেই পারেন। বলেন না। কারণ কী? কারণ আর কিছুই না, আপনি সমাজে বাস করার সময় সামাজিক কিছু অলিখিতি চুক্তি, শর্ত, যুক্তি ও প্রথা মেনে চলেন। সম্ভবত সভ্যতা আপনাকে এইসব বিদ্যা দিয়েছে।
ঔপনিবেশিক শাসকরা আফ্রিকায়, ভারতীয় উপমহাদেশের জনগোষ্ঠীকে বলত ব্ল্যাক নেটিভ। তখন সে কথা শুনতে আফ্রিকান বা ভারতীয়দের ভালো লাগে নি। মনে হয়েছে ঘোরতর আপমান। একইভাবে আপনি যখন কোনো ধর্ম, ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে আক্রমণ করেন ব্যঙ্গ করেন, তখন তার আঘাত লেগে যায় বিপুল সংখ্যক মানুষের মনে। মুক্তচিন্তার নামে আপনি অন্য কোনো গোষ্ঠীর অনুভূতি ও আবেগকে আহত করতে পারেন না।
মুক্তচিন্তার নামে আপনি আসলে যা করেন, তা মুক্তচিন্তা নয়, তা আধিপত্যবাদী চিন্তা; আপনি আপনার চিন্তা দ্বারা অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান; এই নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্জন করার জন্যই আপনি মুক্তচিন্তা ও আধুনিকতার ট্রেডমার্ক ব্যবহার করেন। আপনি নিশ্চয়ই গবেষণা করে বলতে পারেন : ঈশ্বর নেই কিংবা মুসলমানদের নবি ক্ষমতালোভী। কিন্তু আপনি কেন কোন যুক্তি ও পদ্ধতিতে গবেষণা করছেন, তাও আপনার গবেষণা-নৈতিকতার অংশ। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, গবেষণা-নৈতিকতা তো দূরতম ব্যাপার, অতি-প্রচলিত সভ্যতার আলোকেও আপনি বিচার করেন না যে, আপনি কোন কথা কেন, কীভাবে বলছেন? আপনি আপনার প্রতিবেশীকে কীভাবে বিক্ষত করছেন। সত্যিকার অর্থে, আপনি গবেষণাও করছেন না, আপনি মন্তব্য করছেন, ছবি আঁকছেন, খুঁচিয়ে ক্ষত তৈরি করছেন।
সত্যি বলতে কি, এদেশে কথা বলাই মুশকিলের ব্যাপার। আর কথা যদি হয় ধর্মকেন্দ্রিক তাহলে সমস্যার ভাগ থাকে ষোলআনা। আপনি যদি ধর্মকে যুক্তিশীলভাবে দেখতে চান, তাহলে আপনি নাস্তিক, আপনি যদি ধর্মের গুরুত্বকে ইতিবাচকভাবে বুঝতে চান, তাহলে আপনি সেক্যুলার তো ননই, আধুনিক যুগের মানুষই নন; আপনি পড়ে আছে নিবিড় ঘন অন্ধকার মধ্যযুগে, ‘আরণ্যিক নির্বোধের ভ্রান্ত দুঃস্বপনে।’ অথচ ধার্মিক হয়েও আপনি ধর্মকে যুক্তিশীলভাবে ভাবতে পারেন, নাস্তিক হয়েও আপনি ধর্মের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বকে বুঝতে চাইতে পারেন। শুধু তাই নয় আপনি ধর্মকে বুঝতে চাইতে পারেন ধর্মগ্রন্থ ও শ্লোকসমূহের বিদ্যায়তনিক গবেষণা ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে।
কিন্তু আমাদের দেশে খুবই পরস্পর-বৈপরীত্যপূর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে প্রায় সব কিছুর বিচার করা হয়ে থাকে। সাংস্কৃতিক বহুত্বকে অস্বীকার করার প্রবণতা কাজ করে থাকে ব্যাপকভাবে। এক্ষেত্রে ধর্ম সম্ভবত সব চেয়ে এগিয়ে; সে কারণ আপনি হয় নাস্তিক, নয় আস্তিক, হয় সেক্যুলার নয়, ধর্মবাদী। টুপি, সুরা, নামাজ মানেই জঙ্গি। নামাবলি আর সিঁদুর ও চন্দনচর্চিত হয়ে ঘরের বের হলেই আপনি নিষ্ঠাবান হিন্দু; রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক দলের গুপ্ত সদস্য। ঝুঁটি বাঁধা চুল দেখলেই বিধর্মী বাউল অথবা ব্লগার।
বাস্তবতা এমন হয়ে উঠেছে যে, আপনি আস্তিক হলে আধুনিক হতে পারবেন না, নাস্তিক হলে ধর্ম নিয়ে ভাবতে পারবেন না। কোন দিকে যাবেন? দুটো রাস্তা খোলা। সাদা অথবা কালো – দুটির ভেতর থেকে একটিকে আপনার বেছে নিতে হবে। অথচ আপনার পছন্দের পথ হতে পারে, রঙিন অথবা ধূসর অথবা মেরুন। এই দুই রাস্তার মোড়েও আপনি দাঁড়িয়ে থাকতে চাইতে পারেন – যার কাছে কোন ধর্ম শ্রেষ্ঠ, মহান, শক্তিশালী — এই তর্কগুলোই শত ভাগ অবান্তর মনে হতে পারে। এমন অনেক না-খাওয়া, ভুখা মানুষ আছে যাদের কাছে এই তর্কের চেয়ে পরের বেলায় পেট কীভাবে ভরবে, সে চিন্তা অত্যন্ত জরুরি।
এমন অনেকেই থাকতে পারেন, যিনি ভাবেন ধর্ম প্রকৃতপক্ষে মানুষের সিভিলাইজেশন প্রক্রিয়ার অংশ। ধর্ম ও ধর্মকেন্দ্রিক সংস্কৃতির সূত্রেই মানুষের সভ্যতাগুলো বিকশিত হয়েছে। তাই ধর্মপালনকারীরা আরণ্যিক নির্বোধ হয়ে আছেন বা ছিলেন ব্যাপারটিকে এমনভাবে নাও ভাবা যেতে পারেন। কোনো বিশিষ্ট ধর্মমতে বিশ্বাসী না হয়েও বিশ্লেষণ করে দেখাতে পারেন সমগ্র বিশ্বে ইসলামের অবদান কী।
ধর্মকে যদি সভ্যকরণ প্রকল্পের অংশ হিসেবে ভাবেন, তাহলে দেখতে পাবেন প্রতিটি অঞ্চলে উদ্ভূত ধর্ম সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজন থেকে জন্মেছে। প্রতিটি ধর্ম আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যকারণের সঙ্গেও প্রয়োজন অনুযায়ী মিশে গিয়েছে। ধর্ম হয়ে উঠেছে শক্তির আধার ও আধেয়। তাই ধর্মে ধর্মে আধিপত্য বিস্তারের ধারণাও তৈরি হয়েছে। আধিপত্য বিস্তারের ধারণা যতো না ধর্মতাত্ত্বিক, তার চেয়ে বেশি সাম্রাজ্যকেন্দ্রিক বা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক। ধর্মতত্ত্ব হয়তো কোনো রাষ্ট্রধর্মের কথা বলে নি, কিন্তু রাষ্ট্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা রাষ্ট্রধর্ম কায়েম করেছেন। ধর্মতত্ত্ব বলে নি দাঙ্গা করো, জবরদস্তি করো, জোর করে ধর্মান্তরিত করো, কিন্তু ধর্মের নাম দিয়ে ওই কাজগুলোই করা হয়েছে আগেভাগে।
গত কয়েক বছরে দেখা গেল নির্বিচারে হত্যা ও জখম। হত্যা করা হলো ব্লগার, লেখককে। ধর্মকেন্দ্রিক ভাষ্যের বিরোধিতাকে ঘিরে এমনকি খুন হয়েছিলেন একজন তাফসিরকারীও। ইসলাম, খিলাফত প্রতিষ্ঠার নামে এসব করা হলো। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নামে এসব করা হলো। কিছু মানুষ ও গোষ্ঠী এই কাজগুলো করল। পুরো বিশ্ব কম্পিত হল। প্রশ্ন হলো : এর দায় কি ধর্মগ্রন্থের? ধর্মতত্ত্বের? বিপুল-সংখ্যক ধর্মীয় গোষ্ঠীর? নাকি ধর্ম যাদের কাছে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষমতার হাতিয়ার? কিংবা ধর্মকে যারা মনে করে ক্ষমতা প্রসারের হাতিয়ার? নাকি ধর্ম ও ধর্মতত্ত্বকে যারা অপব্যাখ্যা করে?
এটুকু পড়ার পর আপনি ভাবতে পারেন, আমি মুক্তচিন্তার বিপক্ষে দাঁড়াচ্ছি কিনা? কিংবা আমি মু্ক্তচিন্তার সীমানা টানছি কিনা। স্পষ্ট করেই বলছি, আমি মুক্তচিন্তার ছদ্মবেশে কোনো ব্যক্তি গোষ্ঠী সম্প্রদায় জাতিকে দমন-নিপীড়ন করার বিরুদ্ধে। আমি স্পষ্টভাবেই বলতে চাই, বহুসাংস্কৃতিক বাস্তবতায় ইসলাম, ইহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ইত্যাদি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে আলাদা বা অপর করে বর্ণবাদী আগ্রাসন চালানোর বিরুদ্ধে আমার অবস্থান। এমনকি কেউ যদি ধর্মবিশ্বাসী না হয়, তাতে আমি কোনো আপত্তির কারণ দেখি না। কেউ নাস্তিক হলে মুসলমানরাই বিশেষভাবে ক্ষিপ্ত হবে কেন? তা-ও আমার মোটা মাথার ছোট মস্তিষ্কে প্রবেশ করে না। কেউ নাস্তিক হলে তো মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি সবারই ক্ষিপ্ত হবার কথা। সবাই মিলে কেন কোপাতে যায় না? কোপানোর দায়িত্বটা মুসলমানদের হাতে কে তুলে দিয়েছে?
আপনি হয়তো বলতে পারেন, তাই বলে কি আমরা ঠাট্টা করব না? চিন্তা প্রকাশ করব না? হ্যাঁ, অবশ্যই করব। কিন্তু কাকে নিয়ে করব? কার সঙ্গে করব? নিশ্চয়ই প্রতিটি সমাজ ও সংস্কৃতিতে ঠাট্টা করার বেশ কিছু সীমানা থাকে? নিশ্চয়ই সম্পর্ক, বয়স, যোগাযোগ, অঞ্চল ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে আমরা ঠাট্টা করি। নিশ্চয়ই আমরা কোনো চাকমা জাতির মানুষকে গিয়ে বলব না যে, ‘কী রে ব্যাটা নাক চ্যাপ্টা!’ নিশ্চয়ই চাইব না, কোনো চাকমা কোনো বাঙালিকে বলুক ‘শালা, বাটপাড় বাঙাল’।
অর্থাৎ নানা ধরনের পটভূমি ও পরিপ্রেক্ষিতের ওপর নির্ভর করছে আপনি কী ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন, কোন ভাষিক ও আচরণিক ভঙ্গি অন্যকে আঘাত করবে না। অতি-কথিত এবং অতি-প্রচলিত সভ্যতার প্রয়োজনে আপনি কিন্তু এসব প্রথা মেনে চলেন। যেমন, আপনার শিক্ষককে ক্লাসরুমে বলেন না, ‘শালা কিছু পড়াইতে পারস না ক্যান?’ কিন্তু আপনি হয়তো বাইরে বলেন, লেখেন। এসব প্রথা যদি আপনি মেনে চলেন, তাহলে আপনি সব সময় সভ্যতা নামক একটি ধারণার সেন্সরশিপের ভেতর দিয়ে যান। মুক্তচিন্তা নামক কোনো আইডিয়া আপনাকে থামিয়ে দেয় না।
কিন্তু ধর্মের বেলায় এসে কী যেন ঘটে যায়? মুক্তচিন্তা বলতে বোঝায় নবির ছবি আঁকা, মূর্তিপূজার বিরোধিতা, যিশুর ঈশ্বরপুত্র পরিচয় নিয়ে ছ্যা-ছ্যা-ছ্যা করা! অন্য দিকে আজ যাঁরা নবির ছবি আঁকায় ক্ষুব্ধ, তাঁদেরই কেউ কেউ হয়তো মূর্তিপূজা প্রসঙ্গে, দুর্গাদেবী নিয়ে কুৎসিত মন্তব্য করতে বেজায় ভালোবাসেন। তাহলে কী হলো? আপনি নিজের ধর্ম ও চিন্তা বাদে অন্য কোনো ধর্ম বা চিন্তাকে মোটেও সহ্য করতে পারছেন না। এরই নাম ধর্মীয় অসহনশীলতা। ধর্মের আধ্যাত্মিক দিক আপনাকে হতে বলে হৃদয়পন্থী, কিন্তু আপনি চলে যান হৃদয়ভাঙাপন্থার দিকে। আর তাই দুইয়ে দুইয়ে চার হয় না, দুই দুইয়ে লড়াই বেঁধে বসে।
বিখ্যাত ফরাসি পত্রিকা শার্লি এবদো যা করেছে – তা মূলত ইসলামের প্রতি ইউরোপের গড় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যঙ্গরূপ মাত্র। ঠাট্টা কেবল ঠাট্টা নয়। প্রতিটি ঠাট্টার পেছনে লুকিয়ে থাকে গভীর রাজনীতি। বহু বছর ধরেই মধ্যপ্রাচ্য উত্তপ্ত। বিশ্বে বিশেষ করে মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোই কোনো-না-কোনোভাবে সংঘাতে লিপ্ত, গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত; ইউরো-মার্কিন রাজনৈতিক ও সামরিক তৎপরতায় ভেঙে চৌচির আরববিশ্ব। আবার অন্য দিকে খিলাফত প্রতিষ্ঠা, সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে সংঘটিত র্যাডিক্যাল ইসলামের জঙ্গি চেহারাও প্রকাশিত — বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে তার তৎপরতা ছিল বা আছে। সামগ্রিকভাবে উভয় পক্ষীয় প্রচারণা ও কর্মকাণ্ডে ইসলাম ও মুসলমান হয়ে উঠেছে ‘ভয়ের প্রতীক’। ইউরো-আমেরিকান ক্ষমতাসীন শক্তিগুলো বারবার ইসলামকে নেতিবাচকভাবে পরিবেশন করে চলেছে। মধ্যপ্রাচ্যের ইসলাম ও মুসলমানপ্রধান রাষ্ট্রগুলোর রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতিতে মার্কিন আধিপত্য সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করেছে।
ইসলাম যেন এক ফোবিয়ার নাম। ইসলামফোবিয়া নামে একটি শব্দই তৈরি হয়েছে সাম্প্রতিক বিশ্বে। ভেবে নেয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়া হচ্ছে যে, ইসলাম মানে খারাপ, আক্রমণাত্মক, জঙ্গি, হামলাকারী, সন্ত্রাসী। মার্কিন চলচ্চিত্রে সমাজতন্ত্র ও ইসলামকে এইভাবে উপস্থাপনার সূত্রে ‘অপর’ করে তোলা হয়েছে। অপর হিসেবে তৈরি করার প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা হয়েছে গণমাধ্যমকে। ইসলাম ও মুসলাম সম্পর্কে এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতপক্ষে বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। খোদ ইউরো-আমেরিকান বিদ্যায়তনে সম্পন্ন গবেষণা বলেছে, এই দৃষ্টিভঙ্গি কাঠামোবদ্ধ বর্ণবাদ, নব্য-বর্ণবাদ ইত্যাদি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ ও মুসলমানবিদ্বেষ কী প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে! মুসলমানদের ‘মডারেট মুসলমান’ হতে বলা, হিজাব-টুপি-বোরখা ইত্যাদি পোশাককে প্রগতির পরিপন্থী হিসেবে বিবেচনা করা, দাড়িকে সন্দেহের চোখে দেখা প্রভৃতি মুসলমানদের প্রতিষ্ঠিত করেছে ‘আজব চিড়িয়া’ হিসেবে। পাশ্চাত্যের এই উপস্থাপনা ভবিষ্যত বিশ্বের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। মুসলমান রাষ্ট্রসমূহের ক্ষোভকে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মানদণ্ডে বিচার করতে হবে। এনলাইটেনমেন্ট, আধুনিকতা ইত্যাদির দাড়িপাল্লা দিয়ে এই ক্ষোভকে মাপা যাবে না। ইসলাম অথবা কোনো ধর্ম মানেই অনগ্রসর, অপ্রগতিশীল ইত্যাদি বাইনারি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। আধুনিকতা নিজেই যখন প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি, সেই পোকায় খাওয়া আধুনিকতা দিয়ে ধর্মকে বোঝা যাবে না। ধর্মকে বুঝতে চাইলে অবশ্যই গভীর সমাজতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ দরকার।
যাই হোক, সরল কথায় বুঝি ধর্ম একটি বিশ্বাসব্যবস্থা, একটি সাংস্কৃতিক প্রকাশ, একটি বিশ্বাসকাঠামো। ধর্মকে প্রাচীন বিষয়বস্তু বলে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। কারণ আপনি প্রতিনিয়ত বাস করেন ধর্ম ও ধর্মকেন্দ্রিক সংস্কৃতির ভেতর। তাই নবির ছবি আঁকার প্রতিক্রিয়া দেখে চমকানোর কোনো কারণ নেই। মুসলমানেরা নবির ছবিকে কল্পনা, স্মৃতি, সত্তা দিয়ে নানাভাবে মনের গহন অন্দরে ভাবে; কিন্তু কখনো তাঁকে আঁকে না। তাঁদের বিশ্বাসকে সম্মান করা বিশ্বনাগরিক হিসেবে আপনার দায়িত্ব। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি গোষ্ঠী-সম্প্রদায়কে সহনশীলভাবে সহাবস্থান করতে হবে। বহুসংস্কৃতি, ধর্ম, জাতি, বর্ণের বিশ্বে বৈচিত্র্যকে আপনার মেনে নিতেই হবে; কোনো ছকে বাঁধা ‘‘স্টেরিওটাইপিং প্রসেসে’’র ভেতর দিয়ে বিশ্বকে দেখলে আপনি আপনার রঙিন চমশার মতো এক রঙা দুনিয়াই কেবল দেখবেন, কিন্তু রঙিন চশমার পর্দা সরালে দেখতে পাবেন বৈচিত্র্য আর বৈচিত্র্য। বৈচিত্র্যকে যত দিন আপনি সম্মান করতে পারবেন না, ততো দিন আপনি নিজে সম্মান পেতে পারেন না।
খুবই ভালো লাগলো। অত্যন্ত যুক্তিসিদ্ধ, চিন্তাশীল এবং নিরীক্ষাধর্মী লেখা।
ধর্ম কেন্দ্রিক কটাক্ষ একটি প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ মুক্তিচিন্তার প্রতীকী পরিচায়ক মনে করেন। আর বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব নিয়ে বিরূপ সমালোচনা কম হলে ইসলামের ক্ষেত্রে আলোচিত বেশি হয়। কারণ সম্ভবত আমাদের নিরাকার ঈশ্বর ও তাঁর প্রতিনিধিবৃন্দের প্রতিকৃতি করা নিষিদ্ধ বলে।
অসাধারণ বিশ্লেষণী লেখ।
চমৎকার লেখা। যুক্তির সৌন্দর্য আছে। অনেক বিষয় মনের মধ্যে খটকা ছিলো আপনি তা মুছে দিলেন। ধন্যবাদ।
সময় উপয়োপযোগী বিশ্লেষণ। কেবল তাই নয়। এখানে সত্যের চেহারাটা ফুটে উঠেছে। আসি যাকে ভালোবাসি, সবাইকে তা বাসতে হবে এবং এমনটি না হলে কোন্দল চলবে-এরকমটি একেবারেই অশোভন। অন্যপক্ষে, অপরের ভালোবাসাকে নিয়ে অরুচকর কিছু করতে হবে, তা করাটাও মুর্খামী এবং সভ্যতার বিপরীত। শুধু তাইই নয়, তা এক ধরনের বিকৃতি। খুবই চমৎকার হয়েছে লেখাটি।
ন্যায্য বয়ান।
পড়ে আরামবোধ হল।
চিন্তার ন্যায্যতা, স্বভাবের ন্যায্যতা ছাড়া পৃথিবীতে শান্তি আসবে না।