এক-এর উচ্চারণ কী হবে : এক্ নাকি এ্যাক্? বাংলা শব্দের উচ্চারণ নিয়েও নানা রকম সংকট। এ্যা-র উচ্চারণ নিয়ে কথা বলেছেন তারিক মনজুর।
দেশকে নিশ্চয় ‘দ্যাশ’ উচ্চারণ করতে শুনেছেন। এ রকম অসংখ্য শব্দে ‘এ’ ধ্বনি কী অবলীলায় ‘এ্যা’ হয়ে যাচ্ছে। জেল হয়ে যাচ্ছে ‘জ্যাল্’, লেখক হয়ে যাচ্ছে ‘ল্যাখোক্’, মেধাবী হয়ে যাচ্ছে ‘ম্যাধাবি’, পেশা হয়ে যাচ্ছে ‘প্যাশা’, বেতন হয়ে যাচ্ছে ‘ব্যাতন্’… কত উদাহরণ দেব?
‘এ’ বর্ণের উচ্চারণ দুই রকম। কখনো এ-এর মতো; যেমন — একটি, একুশ, এবার, তেল, মেঘ, পথে ইত্যাদি। আবার এ বর্ণের উচ্চারণ কখনো ‘এ্যা’র মতো; যেমন — এক, এগারো, এখন, এমন, একাউন্ট, যেন, যেমন, কেন ইত্যাদি। উচ্চারণ অভিধানে (এমনকি অনেক ব্যাকরণ বইয়ে) ‘এ’ বর্ণের উচ্চারণসূত্র দেয়া আছে। সেখানে লেখা আছে, এ কখন এ্যা হয়ে যায়। কিন্তু মানুষ নিশ্চয় উচ্চারণসূত্র শিখে উচ্চারণ করে না। বরং উচ্চারণ করার সূত্রেই উচ্চারণসূত্র তৈরি হয়।
কখন উচ্চারণ এ হবে, আর কখন এ্যা হবে, এটা নির্ধারণ করা কঠিন বইকি! যেমন, ‘কেনাবেচা’ শব্দের উচ্চারণ কেমন হবে? ক্যানাব্যাচা, ক্যানাবেচা, কেনাবেচা, নাকি কেনাব্যাচা? সূত্র বলে: কিন্ ধাতুর সাথে আ মিলে উচ্চারণ ‘কেনা’ হয়; আর বেচ্ ধাতুর সাথে আ মিলে উচ্চারণ ‘ব্যাচা’ হয়। নিম্নস্বরধ্বনি আ-এর প্রভাবে ই হয়ে যায় এ; আর এ হয়ে যায় এ্যা। শব্দের গঠন আর ধ্বনিসূত্র জেনে নিশ্চয় আমরা কথা বলতে শিখিনি। তাহলে, বানান দেখে উচ্চারণ ঠিক করে নেয়ার সহজ উপায় কী হতে পারে?
বাংলাতে ‘এ’ বর্ণের উচ্চারণ-সমস্যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও নজরে এসেছিল। তিনি সমস্যা কমাতে মাত্রাযুক্ত এ-কার এবং মাত্রাছাড়া এ-কার ব্যবহার করেছেন। মাত্রাযুক্ত এ-কার দিয়ে ‘এ্যা’ এবং মাত্রাছাড়া এ-কার দিয়ে ‘এ’ উচ্চারণ নির্দেশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গান থেকে নমুনা দেখুন:
রবীন্দ্রনাথের অনেক কিছু আমরা গ্রহণ করেছি। কিন্তু দুই রকম এ-কার স্বীকার করিনি। যদিও ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, জেনে না-জেনে আমরা দুই রকম এ-কার ব্যবহার করি — হাতের লেখাতেও, কম্পোজ করার সময়েও। কিন্তু রীতি হিসেবে ঠিক করেছি, শব্দের শুরুতে কখনো আমরা মাত্রাসহ এ-কার দেব না; আর শব্দের ভিতরে সবসময় মাত্রাসহ এ-কার দেব। আমাদের প্রচলিত প্রয়োগের সাথে উচ্চারণের কোনো সম্পর্ক নেই।
বলছিলাম এ বর্ণের উচ্চারণ নিয়ে। গণহারে মানুষের উচ্চারণকে প্রমিত করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব গ্রহণ করা যায়। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাবেও সমস্যা আছে। কারণ, শব্দের ভিতরে ব্যবহৃত হাজার হাজার এ-কার ‘এ’ ধ্বনিকে নির্দেশ করে। ওসব ক্ষেত্রে মাত্রাহীন এ-কার কীভাবে দেয়া সম্ভব? তাছাড়া তিনি তো কারচিহ্নের সমাধান করেছেন; বর্ণ ‘এ’ যখন এ্যা উচ্চারণ হবে, তার সমাধান তো দেননি।
সমাধান খোঁজা যেতে পারে এর সঙ্গে পবিত্র সরকারের একটি চিন্তাকে যোগ করে। পবিত্র সরকার অন্য এক ক্ষেত্রে স্বরধ্বনি এ্যা লেখার জন্য বর্ণের প্রস্তাব করেছেন। আর এর কারচিহ্ন হিসেবে Ɛ চিহ্ন প্রস্তাব করেছেন। এ/এ্যা উচ্চারণ সমস্যার সমাধানে এই দুই নতুন চিহ্নকে গ্রহণ করা যায়। এক, এগারো, এমন ইত্যাদি শব্দ তখন লেখা হবে মাথা-বাঁকা দিয়ে। আর যেন, যেমন, কেন ইত্যাদি শব্দ লেখা হবে শুরুতে Ɛ দিয়ে। এমনকি শব্দের ভিতরেও এভাবে বাঁকা এ-কার ব্যবহার করে এ্যা উচ্চারণ নির্দেশ করা যাবে। আর একুশ, একটি, এবার, তেলে, মেঘ ইত্যাদি শব্দে Ñ যখন উচ্চারণ এ, তখন আগের মতোই প্রচলিত এ এবং কারচিহ্ন দিয়ে লিখতে হবে। এভাবে বর্ণ-সংযোজনের মাধ্যমে এ/এ্যা-র উচ্চারণ-দ্বিধা দূর করা যায়।
একটা বিষয়ে খটকা লাগছে । এখন তো ‘এ্যা’ লেখা হয় না । তার পরিবর্তে ‘অ্যা’এর ব্যবহার দেখছি সর্বত্র; এমনকি রবীন্দ্রনাথও অ্যা-ই ব্যবহার করেছেন
‘এ্যা’ কোথাও ব্যবহৃত হতে খুব একটা দেখা যায় না। বরং ‘অ্যা’-এর ব্যবহারই সর্বত্র।