অন্যমনস্ক দিনগুলি ।। কিস্তি : ১

শুরু হলো নতুন উপন্যাস। এই উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে এই মুহূর্তের গল্প; যে গল্পের ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছি আমরা এবং সমগ্র বাংলাদেশ। চমৎকার ভঙ্গিতে গল্প বলে গেছেন সালাহ উদ্দিন শুভ্র। এই গল্প নিশ্চিতভাবে টেনে নেবে আপনাকে। কারণ আপনিও সম্ভবত জড়িয়ে আছেন এই উপন্যাসের সঙ্গে।

 

ছোট্ট একটা হাঁচি থেকে সব কিছুর শুরু হলো।

 

হাঁচিটা এলো অনেক রাতে। আমি সাধারণত এত রাত জাগি না। খুব নিয়মমাফিক জীবন ছিল আমার এ কয়দিন আগেও। নিয়ম করে সকালে ঘুম থেকে ওঠা, গোসল-নাশতা সেরে অফিসে যাওয়া। অফিস থেকে ফুল বাবুটির মতো সোজা বাসায় চলে আসা। এদিক-সেদিক কোনো দিক ঘাড় না ঘুরিয়ে বউয়ের চোখের দিকে চোখ রাখতে না-পারার সাহস নিয়ে গার্হস্থ্য জীবনটা আমার ভলোই চলছিল। বলতে কি এখনো চলছে। এই মার্চ মাসের উমদা গরমের মধ্যেও ভালোই চলছে। সেখানে একটা ছোট্ট হাঁচি আমার সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের ভেতর চোরা ফাটল হয়ে ঢুকে পড়বে, আর তার ফাঁক দিয়ে অদেখা অনেক কিছু আমার নজরে চলে আসবে — এটা নিজের ভাবনারও অতীত ছিল।

 

আমি ফুয়াদ। একটা লিজিং কোম্পানিতে চাকরি করি। দেখতে অনেকটা কালো, গাট্টাগোট্টা, মাংসল আমার শরীর। মুখ, নাক কিছুটা মোটা ধাঁচের। খুব বেশি বুদ্ধি-বিবেচনা, সুক্ষ্মতা আমার ধাতে নাই। আমি খুব মানি সিকার টাইপ। নিজের সংসারের বাইরে আমার যাতায়াত নাই। নিজেকে নিয়ে খুব একটা ভাবিও না। ইনফ্যাক্ট আমি কী নিয়ে ভাবি তা বলার মতো কিছু না। আমি হয়ত ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে আরো কীভাবে টাকা কামাই করা যায়, বা নতুন কোন প্রজেক্ট খোলা যায়, বাজারে এখন কীসের ব্যবসা ভালো চলছে তার বিষয়ে যতটা ওয়াকিবহাল, এমনকি বউয়ের শাড়ি, গহনা, মেয়ের বড় হওয়া বিষয়েও আমার তেমন ভাবান্তর হয় না। বিষয়টা কাউকে বুঝিয়ে বলাও মুশকিল আমার কাছে।

 

সাধারণত একটা শিক্ষিত বাবা কেমন হয়? অথবা শিক্ষিত জামাই? তারা খুব সাবলীল হয়, অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারে, কোনো একটা বিষয়ে আগ্রহ থাকে তাদের, নিজের কাজের বাইরেও কিছু না কিছু হয়ত তার বলার থাকে। আমার সেসব কিছু নাই। আমি বেশিরভাগ সময় চুপ থাকি বলা যাবে না। অফিসে আমি প্রচুর কথা বলি। বাসায়ও। সমস্যা হলো অফিসে যা বলি বাসায় এসেও আমি সেসব কথাই বেশি বলি। তবে ফোনে। যেহেতু জরুরি, পারিবারিক, সাংসারিক, সামাজিক অনেক বিষয়েই আমি কিছু বলি না, তার মানে আমি আসলে চুপই থাকি বলা যায়। বাসায় এসে কিছুটা ফ্রেশ হতে না হতেই আমার ফোন আসতে শুরু করে। কখনো বসের ফোন, কখনো ক্লায়েন্টর ফোন, ফিল্ড ম্যানেজারের ফোন। গাড়ি নিয়ে দেখা গেল ছুটির দিনেও আমি ময়মনসিংহ, গাজীপুর করে বেড়াচ্ছি। গরুর খবর নিচ্ছি, দুধের দাম জানছি, ল্যান্ডের খবর নিচ্ছি — এসব।

 

বাসায় আমার ওয়াইফ রেখা বেশ পরিপাটি। আমি তাকে সমঝে চলি। সে খুব কালচারড মেয়ে। আমি সবসময় ভেবে এসেছি আমার জন্য সে না। আমি হয়ত তার জন্য দুর্ভাগ্য। অথবা কে বলতে পারে, হায়াত-মউত-বিয়ে এই তিনটা আল্লাহর হাতে। তিনি হয়ত কোনো গূঢ় অর্থ রেখে গেছেন আমাদের এই সম্পর্কের ভেতরে। সেটা আমরা বা আমি এখনো আবিষ্কার করতে পারি নাই। হয়ত পারব, বা পারার একটা সুযোগ মিলেও গিয়েছিল এই কয়দিনে। কাজ নাই, ফোন নাই — সারাক্ষণ বাসায় বউয়ের সঙ্গে, মেয়ের সঙ্গে থাকার সুযোগ হয়েছিল। ওদের সঙ্গে টিভি দেখা, ছাদে ঘুরতে যাওয়ার মতো কাজগুলোও আমি করছিলাম। ছাদে ঘুরতে গেলে প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেখা হওয়া, কথা বলা — এসব ভালোই হচ্ছিল। দারুণই কাটছিল দিনগুলো। বিশেষ করে আমার মেয়ে রাফা। তার সে কী হাসি, ছোট্ট কয়েকটা দাঁত ওঠায় মুখের কেমন একটা অদ্ভূত গন্ধ। ভালোই কেটে যাচ্ছিল সবকিছু। এখন আবার শ্যালিকা এসেছে বাসায়। ওর নাম শ্যামলী। বউয়ের তুলনায় বয়স অনেক কম। বেশি বয়সে বাচ্চা পয়দা করেছেন আমার শ্বশুর। শ্বশুর-শুশুড়ি দুজনেই এখনো তাগড়া। ফলনও ভালো তাদের। শ্যামলীসহ পাঁচটা হলো। আমার বউ রেখা বড়জনের পরে জন্ম নিয়েছিল। প্রথমজন ভাই, দ্বিতীয় রেখা, তৃতীয়ে আবার ছেলে, চতুর্থে ছেলে, পঞ্চমে আবার মেয়ে। বেশ বড়সড় পরিবার। আমার সঙ্গে তেমন যোগযোগ হয় না। ছোট শ্যালিকাটা আটকে গেছে বাসায় বেড়াতে এসে। সে এখানে কোথাও ভর্তি হবে ভাবছিল। কিন্তু এখন স্কুল, অ্যাডমিশন সব বন্ধ। কিছুটা গবেট আছে মেয়েটা। বাড়-বাড়ন্ত যদিও ভালো। কিন্তু পরীক্ষা দিয়ে কোথাও টিকল না। ক্লাস সিক্সে ভর্তি হতে এসেছিল ঢাকায়। মনে মনে আমিও ভেবে রেখেছিলাম কোথাও এ লেভেলে ভর্তি করায়ে দেব। কিন্তু তার আগেই সব বন্ধ হয়ে গেল।

 

তো শ্যালিকার সঙ্গেও বেশ ভালোই সময় কাটছিল। নিজের আড় ভাঙছিল যেন একটু একটু করে। ছাদের সময়টাও বেশ ভালো কাটছিল। সেখানে যদিও আগেই পরিচয় ছিল, নতুন করে খাতির হলো রোকন সাহেবের সঙ্গে। ভদ্রলোক বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার। তারও এখন ঘরের বাইরে যাওয়া বন্ধ। সারাদিন ঘরে বসে থাকেন। বিকালে কখনো ছাদে এলে কথা হয়। ভদ্রলোকের আবার কেমন যেন আমার বউয়ের সঙ্গেই আলাপে বেশি আগ্রহ। আমি তাতে কিছু গা করি নাই। কারণ তিনি শিক্ষিত মানুষ, ছাত্র পড়ান — আমার বউয়েরও পড়াশোনার ধাত ভালো। সে এখনো কিছু বইটই পড়ে, গুনগুন করে গান করে। ওর হয়ত রায়হান সাহেবের কথা শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু এটুকুই তো, ছাদেই তো সব — বেশি কিছুর সম্ভাবনা তো এখানে আমার সামনে, সবাই যখন বাড়িতে আছে, রায়হান সাহেবের বউ-বাচ্চাও আছে — সেখানে বিশষ কিছু যে হবে না তা আমার মতো সারাক্ষণ হিসাব করা লোক সহজেই বুঝতে পারে। তা ছাড়া আমি নিজে অভ্যস্ত হতে চাইছিলাম তাদের আলাপে। তারা সমসাময়িক বিষয় নিয়ে খুব কথা বলতে থাকল। প্রথম দিকে আমি তাদের কথা বলায় তাল দিতে পারছিলাম না। পরে আমিও যোগ দিচ্ছিলাম তাদের সঙ্গে। এটা একটা কৌশল। ওদের চোখে চোখে রাখার জন্য ওদের মতো করে না হোক ওরা যা বলে তা নিয়ে কথা বলে যাওয়াটা হলো নিয়ম। না হলে ওদের মধ্যে উপস্থিত থেকেও আমি ওদের বাইরের লোক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

 

জানি না এ কৌশলে আমি কতটা সফল ছিলাম। কারণ আর যাই হোক একজন মানুষের মন পড়ে ফেলা যায় না। মন পড়ে ফেলা গেছি ধরে নিলেও কোনো একটা ডিসিশনে চলে আসা যায় না, ডিসিশনে আসলেও সেটা মুখে প্রকাশ করা যায় না। বা কিছু একটা এক্সিকিউশনের দিকে যাওয়া যায় না সহজে। এগুলোর কতগুলো নিয়ম আছে। আর্থিক খাতে যারা চাকরি করে তাদের এসব কতগুলো বিষয়ে খুব বুঝতে হয়। একটা হলো টাকা নিজের হাতে রাখা। আর ক্লায়েন্টকে কখনো না খেপানো। তাহলে হয়ত দেখা গেল, শুরুতেই সব শেষ। আমার কাছে জীবনের সব চরিত্র একেকজন ক্লায়েন্ট হয়ে যাচ্ছিল। যদি না আমি অযাচিত ছুটি পেয়ে দিনের পর দিন বাসায় বসে থাকতে না পারতাম। তারপরও স্বভাবটা রয়ে যাচ্ছিল আমার মধ্যে। আমার বিদ্যা হলো ক্লায়েন্ট ধরার বিদ্যা। বলতে গেলে আমার পৃথিবী ঘোরে ক্লায়েন্টদের পেছনে। এর বেশি কিছু ভাবার ফুরসত আমার কই! যে কারণে ঘরের বউয়ের অন্য পুরুষের সঙ্গে আলাপের সময়ও আমাকে আমাকে অফিসের বিদ্যাই জাহির করতে হয়।

 

রোকন সাহেব আর আমার বউয়ের বৈকালিক আড্ডাকে যে আমি সন্দেহের চোখে শুরু থেকেই দেখেছি তা না। বউকে আমি ভালোবাসি, সম্মান করি। সে আমার সংসারটাকে আগলে রেখেছে। আমার মেয়েটাকে দিনের পর দিন পেটে ধরেছে। তা ছাড়া তার মতো মেয়ে আমার সঙ্গে শুয়েছে, আমাকে তার ভেতরে নিয়েছে, আমার মা-বাবা পরিবারের লোকজনকে আদর-সমাদর করেছে এর কোনো ঋণই আমার কাছে শোধযোগ্য নয়। আমি সেসব এখনো মানি। এ কয়দিনের অবসরে যদিও আমার এখন মনে হচ্ছে- জীবনের অনেকগুলো চেহারা থাকে। এক চেহারার কারণে আরেক চেহারাকে বাদ দেওয়া যায় না, অস্বীকার করা যায় না। অনেকগুলো চেহারা নিয়েই একজন মানুষ। আমি যেমন অফিস, বাস, বাজার সর্বত্র একই চরিত্র নিয়ে চলছিলাম। ছুটির অবকাশে বুঝলাম একই চরিত্র নিয়ে চলা যায় না। জীবনটা একঘেয়ে হয়ে যায়। বাসার মধ্যে আবার আমার বউ আছে, মেয়ে আছে, মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি আছে। এদের প্রত্যেকের সঙ্গে আমার আলাদা সম্পর্ক। কোনো চেহারাই মিথ্যা নয়, কোনো চেহারাই অস্বীকার করার কিছু নাই, আবার তারা আলাদা আলাদা। নিজেকে যে আমি যেমন সর্বত্র এক ভাবতাম- সেই ভুল ভেঙে গেছে। এটা হলো এবারের আচমকা ছুটির প্রথম বুঝ।

 

দ্বিতীয় যে চমকটা পেলাম, সেটা হলো আয়নায় আমি নিজেকে দেখলাম। সম্পূর্ণ আমাকে দেখলাম। নগ্নভাবে এবং অকপটে। তখন মনে হলো, আমি নিজেকে কখনো দেখি নাই। দেখি নাই বলতে তাকাই নাই। নিজের দিকে নিজের তাকায়া থাকার মধ্যে যে নিজেরে আবিষ্কারের একটা ব্যাপার আছে তা আমার জানা ছিল না। আগে নিজেরে কখনো আমি দেখি নাই তা না, কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ নিজেরে দেখা না। এমন হঠাৎ পাওয়া ছুটির অবসরে, একদিন দুপুলে গোসল করতে গিয়ে নিজেরে যে আমি দেখলাম, তা প্রতিদিন অফিস যাওয়ার সময় ক্লিন শেভড হয়ে টাইয়ের নট বাঁধা বা শার্ট-টার্ট এসব ইন করে কেতাদুরস্ত হয়ে বাসা থেকে বের হওয়া সময় ততটা নিজেরে আমি কখনো দেখি নাই। বা বসের ঝারি খাওয়ার পর অফিসের ওয়াশরুমের আয়নায় অপমানিত নিজের চেহারা দেখা বা কোনো ক্লায়েন্টরে জিতে নেয়ার পর নিজের চালাকিতে, বুদ্ধিতে, বিদ্যায় খুশি হয়ে নিজেরে দেখার মতো করে এ দেখা না। এ হলো নির্জলা নিজেরে দেখা।

 

আমার একটা ভুঁড়ি হয়েছে। কালো কালো হাতে পশম আছে। ঠোঁটগুলো মোটা। ততোধিক কালো শিশ্ন। নিজের এ অঙ্গটার দিকে তেমন তাকানো হয় নাই আমার কখনো। বউয়ের সঙ্গে সব সঙ্গম হয়েছে রাতে। দুজন দুজনকে না দেখে না দেখেই। নগ্ন হওয়ায় যে লজ্জার কিছু নাই তা আমি বুঝলাম। আরো মনে করতে পারলাম নিজের শৈশব, কৈশোর। বেশি মনে আসল না যৌবনটা। মাঝখানের জার্নিটা যেন কুমিল্লা থেকে ঢাকাায় আসার মতো একটা বাপার। টিকিট কাটো, ব্যাগ গুছাও, সময় মতো স্টেশনে আসো, ট্রেনে ওঠো। অনেক হৈচৈ, অনেক মাথা, অনেক ঘটনার মধ্যে অস্তিত্ব লুকায়ে একপাশে কোনোরকমে দাঁড়ায়ে থাকার- মতো করে চলে গেল যৌবনটা। অনেক দিন পর নিজের ন্যাঙটা শরীর আয়নায় দেখতে দেখতে মনে পড়তে থাকল সেসব অর্বাচীন দিনগুলোর কথা। কেমন বোকা বোকা অসহায়, ভীষণরকম অপটু ছিলাম। গামছায় চিড়া-মুড়ি বেঁধে এনে ট্রেনে ওঠার মতো। সিট পেলে ভালো, না পেলে ঠাসাঠাসি করা মানুষের মাংসের দলার মধ্যে ঠেলেঠুলে নিজেরে ঢুকায়ে নাও। তারপর ঢাকায় এসে কমলাপুর স্টেশনের সাগরে নিজেরে কেমন তৃণ মনে হতো। গেট পার হয়ে রিকশা, পায়ে হাঁটা তারপর বাস। বেবিটেক্সিতে কতদিন আর চড়া হইছিল? খুব কম। অথচ আমার এখন টয়োটা জি করলা গাড়ি আছে। নিজে চালাতে পারি, ড্রাইভারও আছে। যদিও গাড়ি অফিসের। তারপরও নিজের মতো করে তো ব্যবহার করা যায়।

 

সেই যে আসলাম কুমিল্লা থেকে ঢাকায়, এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নিজের শরীরের দিকে যেন আমার এই প্রথম নিজের তাকানো। নিজেকে দেখতে দেখতে মনে হলো এ শরীরের ভেতর একটা ইঞ্জিন আছে। বাইরের এখনকার ফুয়াদের ভেতরে আগের সেই আলাভোলা, গ্রাম্য, অসহায় আর নাজুক ফুয়াদটা আছে। সে বিস্মৃত, সে গোপনে চলে গেছে। কিন্তু সে ইঞ্জিনের মতো শরীরের ভেতরে রয়ে গেছে। এখনকার চলা-ফেরা, নড়াচড়া, আয়-উন্নতির পেছনে আগের সেই ফুয়াদেরই কলকবজা- এ হলো আমার দ্বিতীয় বিস্ময়ের সন্ধান পাওয়া।

 

তবে এসব নতুন নতুন আবিষ্কার, কায়িক পরিশ্রম না করার অবকাশ, মানসিক শ্রান্তি, অখণ্ড অবসর, টেনশনলেস দিনগুলোর ছন্দপতন ঘটল। সময় এরপর আর তেমন নিরীহ, নন সাসপেনসিভ থাকল না। হঠাৎ একটা হাঁচি ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দিল। হাঁচি-কাশির জন্য সময়টাও খারাপ ছিল। যে কারণে আমি একটু ভয়ও পেয়ে গেলাম। দিনকয় আগে একটু বাইরে গিয়েছিলাম। জরুরি টাকা তোলা আর এটা-সেটা কিনতে। কিছুক্ষণ বাইরে ছিলাম। তারপর ফিরে এসে গোসল-টোসল সবই সেরেছি। কিন্তু মনের মধ্যে একটা ভয় থেকে গিয়েছিল যে আমিও বোধহয় ইফেকটেড হব। সাধারণত চার-পাঁচ দিনেই বুঝা যায় যে কেউ করোনা মহামারিতে ইফেকটেড হবে কি হবে না। আজ বোধহয় চতুর্থ রাত। এবং আজই এমন একটা হাঁচি আমার মনে ভয় ধরিয়ে দিল। আমি ঘুম থেকে উঠে পড়লাম।

 

এখন আমি একা ঘুমাই। আমার ঘরে বউ, বাচ্চা আর শ্যালিকা ঘুমায়। যদিও যতদিন অফিস ছিল আমি বউয়ের সঙ্গেই শুতাম। কিন্তু ছুটি পাওয়ার পর আমার মনে হলো এই এক ঘরেই দিন পার করে দেব? তারচেয়ে আমি ওই গেস্ট রুমেই একা ঘুমাই। মনে মনে আমার একটা ফ্যান্টাসি ছিল ঢাকা শহরে রাতে হোটেলে ঘুমাব, বা অন্য কোথাও। সেটা কখনো হয়নি। হঠাৎ সে বাপারটাই মাথায় আসল আবার। অননোউন অরিয়েন্টেশনে ঘুমানোর মধ্যে কিছুটা যাকে বলে অনসার্টেইনিটি আছে। সেটা আমি পেতে চাইছিলাম। ইনট্রুডারের মতো অচেনা তোষক-বালিশে রাত কাটানো, বাথরুমের আয়নায় মুখ দেখা — এটা খামখেয়ালির মধ্যে পড়ে হয়ত। বা অলস মস্তিষ্কের কারবার, সে কত কিছুই তো করে! মস্তিষ্ক তো সবসময় কিছু না কিছু একটা ভাবতে চায় — এরকম।
সুযোগটা করে দিয়েছিল শ্যামলী। সে হঠাৎ বলতে থাকল তার একা ঘুমাতে ভয় লাগছে। আর ওই রুমে অনেক শব্দ হয়, তার ঘুম আসতে চায় না। মায়ের সঙ্গে শুয়ে শুয়ে অভ্যাস। তারপর আমিই প্রস্তাবটা দিলাম।
আমার মতো নিরেট একটা লোকের এমন প্রস্তাবে বউ কিছুটা অবাকই হয়েছিল। সে বলল, ‘তুমি ওখানে ঘুমাবে কেন, শ্যামলী ভয় পাচ্ছে আমি না হয় গিয়ে ঘুমাই। তুমি তো কখনো একা শুয়েছ দেখি নাই, পরে যদি ঘুম-টুম না আসে?’
আমি বললাম, ‘দেখিই না, ঘুম আসারই বা কী দরকার এত? এখন কি আর অফিস আছে? তুমি ঘুমালে রাফা আছে, ওই খাটটা ছোট হয়ে যাবে তোমাদের জন্য।’
বউ শুনে হা হা হাসল। বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমি দেখছি কী কী লাগে?’

 

এরপর সে দেখলাম রুমের চাদর, বালিশ আরো কী কী সব ঠিক করে দিল। শ্যালিকার কাপড়-চোপড় সব নিয়ে গেল। আমাদের ছোট বাসাটায় মাস্টার বেডসহ দুইটা বেড রুম। দুই বেডই এটাচড বাথরুমের। তাদের মাঝখানে ড্রয়িং আর ডায়নিং। রান্নাঘর আছে। বারান্দা আছে দুই বেডের সঙ্গে দুইটা। ইস্কাটনের ছোট্ট বাসাটার কিস্তি এখনো তিনটা বাকি। আগামী তিন মাসেই শোধ হয়ে যাবে। খুব কম সময়ে কিস্তি শোধ হয়ে গেছে বলতে হয়। তবে তার পেছনেও আমার ব্যবসায়িক বুদ্ধি কাজ করেছে। কিছুটা কম দামে, আর নিয়মবহির্ভূত কিস্তির সুবিধা নিয়ে আমি ফ্ল্যাটটা কিনেছি। লোকেশনটা বেশ চমৎকার বলতে হয়। যদিও বাসাটা ছোট। কিন্তু তখন এ সুযোগ আমি হাতছাড়া করতে চাই নাই। পরে আবার একটা ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ আমার হবে কি না জানি না। যে কারণে এ ক্লায়েন্ট বিদেশ চলে যাওয়ার আগে তার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমি কম দামেই ফ্ল্যাটটা কিনে নেই। তবে দানে দানে সমান দান ছিল সেটা। ওই লোক তার এক আত্মীয়কে ঠকিয়ছিল, অনেক টাকা মেরে দিয়েছিল তার। অনেক দিন ধরে প্ল্যান করে করে সে ঠকিয়েছিল তাকে। এর মধ্যে পাসপোর্ট করা, ভিসা করা এসব কাজ সেরে ফেলেছিল। ঠিক যেন টান টান উত্তেজনার কোনো সিনেমা। বিমানের চাকা শূন্যে উঠল আর তার আত্মীয় জানতে পারল কী সর্বনাশ হয়েছে। আর আমি অপর আরেক দৃশ্যে তার কম দামে বিক্রি করে দেওয়া ফ্ল্যাটের ইন্টেরিয়র বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম।

 

সেগুলো মনে পড়লে আবার জাবর কাটি এ বেকার সময়ে। মানুষের কিছু গরুস্বভাব আছে মনে হয়। এর একটা এই স্মৃতির জাবর কাটা। একই কথা বার বার বার বার ভাবতে ভালো লাগে। মাঝে মাঝে অলস, বোধশূন্য, ঝিম মারা একটা ভাব চলে আসে। তখন হয়ত বসে থাকি তো বসেই থাকি, দাঁড়িয়ে থাকি তো দাঁড়িয়েই থাকি। যেমন রাতে সেদিন গেস্ট রুমে ঘুমাব বলে রুমে ঢুুুকে দাঁড়িয়েই ছিলাম অনেকক্ষণ। তারপর লাইট অফ করে শুয়ে পড়লেও ঘুম আসছিল না। এপাশ-ওপাশ কতক্ষণ করার পর উঠে গেলাম। অন্ধকার রুমের জানলার ফাঁক গলে কোত্থেকে যেন আলো আসছিল। এই রুমের বারান্দাটা কিছুটা ছোট। বরান্দা আশপাশের সব বিল্ডিংয়ের পেছন দেখা যায়। দুই ভবনের ফাঁক গলে দূরে রাস্তা দেখা যায়। আলোও জ্বলছে আশপাশে কোনো বাথরুমে বা রান্না ঘরে। সিকিউরিটি লাইটও জ¦লছে লাগোয়া ভবনের। বারান্দার দরজা খুলে ভাবাবেগ জাগানোর মতো পরিবেশ নেই। উঠে হিসি করে বেসিনে একটু হাত ধুয়ে, নিজের রাত জাগা লাল লাল চোখ দেখে আবার রুমে আসলাম। তখনই মনে হলো এ ঘরে একটা ডিমলাইট আছে। কোন ঘরে কী আছে আসলে সবই আমার জানা। তারপরও নিজের ঘরে নিজেকে আগন্তুক মনে হলো। হাসি পেল। হাসলামও প্রায় শব্দ করে। ডিমলাইট জ্বালালাম। একটা ড্রেসিং টেবিল আছে এ ঘরে। আমাদের বিয়ের সময় পাওয়া। কিন্তু এটা রেখার পছন্দ হচ্ছিল না। সে নিজে ডিজাইন খুঁজে বের করে মিরপুর গিয়ে আর্টিস্টি থেকে একটা ড্রেসিং টেবিল বানিয়ে এনেছিল। যে কারণে বিয়ের উপহার ড্রেসিং টেবিলটা এখানেই পড়ে আছে। কখনো কেউ আসলে হয়ত ইউজ করে।

 

অনেক দিন পর বলতে গেলে বা এ প্রথমই আমি বিয়ের উপহারটাকে ভালো করে দেখতে লাগলাম। অটবি থেকে কেনা। তেতুল বিচির রং। খুব সিম্পল একটা ড্রেসিং টেবিল। এটা রেখাদের বাবা বা মায়ের বাড়ির দিকের কেউ দিয়েছিল। সিম্পল হলেও দেখতে ভালো লাগে। প্রায় নিতম্ব পর্যন্ত লম্বা আয়না। দুপাশে দুটো ড্রয়ার। আয়নার সামনে ছোট্ট একটা তাক। কেমন যেন থেবড়ে বসে থাকা কোনো লম্বা শরীরের মানুষের মতো ড্রেসিং টেবিলটা। বাম দিকের ড্রয়ার খুললাম। কিছু নেই খালি। একটা তেলাপোকা দৌড়ে চলে গেল। ডান দিকের ড্রয়ারে খুব সুন্দর একটা ডায়েরি পেলাম। একটা বাকসের ভেতর চামড়ার মতো মলাটে বাঁধানো ডায়েরি। শাড়ির বাকসগুলো যেমন হয় সেরকম বাকসের ভেতর কাঁচা হলুদ রঙের ডায়েরিটা। ভেতরে সব পৃষ্ঠা ফাঁকা। একটা পেজ মার্কার ফিতা আছে সোনালি। খুব সুন্দর আর ভারি ডায়েরিটা। এটা এখানে কীভাবে এল, কার ডায়েরি কিছুতে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আনমনে ডায়েরিটা রেখে দিলাম ড্রয়ারে আবার। একটা সিগারেটের তৃষ্ণা জেগেছে খুব। বারান্দায় গিয়ে খাওয়ার কথা ভাবলাম। সিগারেটের টান অদম্য। যেকোনো পরিবেশ-পরিস্থিতিকে কনসিডার করে সিগারেট খেতেই হয়। আর রাত হয়ে গেছে, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, বারান্দায় সিগারেট খেলে কোনো সমস্যাই যেখানে নেই — সেখানে সিগারেট তো আমি ধরাবই।

 

একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে টানতে লাগলাম। সিগারেট আর মুখের সম্পর্কটা যখন যুতসই হয় তখন তা টানতে খুব মজা লাগে। ভেজা ভেজা মুখে সিগারেট টানতে ভালো লাগে না, জ্বর জ্বর মুখে সিগারেট টানতে ভালো লাগে না, সর্দি হলে লাগে না, কিছু একটা মাথার মধ্যে আছে, কী সেটা যদি বুঝতে না পারি তখনও সিগারেট টানলাম কি টানলাম না সেটা বুঝে উঠতে পারি না। নির্ভার হয়ে, যে জিনিসটা আমি কিছুটা বুঝেছি, আরো বুঝার বাকি আছে — এরকম সিচুয়েশনগুলোতে সিগারেট টেনে মজা পাই। এখন মুখটা শুকিয়ে থাকলেও কী যেন বুঝে উঠতে পারছি নার অস্বস্তিটা রয়ে গেল। ফলে সিগারেটের সঙ্গে আমার তখন সম্পর্কটা আবছা হয়ে আসছিল। কিছুটা টেনে বারান্দা দিয়ে ফেলে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। রাত কয়টা বাজল তাও দেখতে ইচ্ছা করছিল না। মোবাইলও বন্ধ করে চার্জে দিয়ে রেখেছিলাম। শ্যালিকাটা সারাক্ষণ মোবাইল দেখে। আমি ফেইসবুকে ঢুকি, কিছু খবর-টবর দেখি। মেইল খুলি, হোয়াটস অ্যাপ, লিংকডইন — এসব কাজেও মোবাইলের কিছু ব্যবহার হয়। যদিও ছুটির শুরুর দিকে যতটা হতো এখন আর ততটা হচ্ছে না। তারপরও চার্জ শেষ হয়ে যায়। রাতে ফুল চার্জ দিয়ে না রাখলে সকালে একটু পরপরই চার্জ শেষ হয়ে যায়। আর মোবাইলে চার্জ কমে যাওয়াটাও একটা টেনশন হয়ে ওঠে তখন। কিছুদিন এ পরিস্থিতিতে পড়ার পর রাতে এখন চার্জে দিয়ে ঘুমাই।

 

আজ ফোন চার্জে ছিল না বলে সময় দেখার পরিশ্রম আর করতে চাই নাই। অথবা কিছুটা উদাসিনতা আমাকে পেয়ে বসেছিল। কোনো একটা চিন্তা যেন মাথায় ঢুকেছে। জানলা বন্ধ করতেও ভুলে গিয়েছিলাম। তারপর আবছা তন্দ্রামতো এল আর হাঁচিটাও এল। হাঁচিটায় ভয় পেয়ে গেলাম। উঠে গিয়ে নিজেকে একটু পরখ করে নিতে চাইলাম। হাঁটতে হাঁটতে বউয়ের রুমের দিকে গেলাম। দরজা ভেজানোই ছিল। আমি চাই নাই তাদের কারো ঘুম ভাঙাতে। মানুষকে ঘুমাতে দেখলে আমার ভালো লাগে। রাতে উঠে আমি যখন হলে থাকতাম, তখন এরকম বারন্দায় হাঁটতাম। শুনশান রাত আমার ভালো লাগত। আজ সেরকম কিছু না, ঘুম থেকে উঠে হেঁটে এসেছিলাম আসলে ভয় থেকে। বউকে ব্যাপারটা বলতাম যে, দেখ আমার তো একটা হাঁচি আসল। কিন্তু রুমে ঢুকে দেখলাম বউ ঘুমায়নি। মোবাইলের আলো জ্বলছে, কানে তার হেডফোন। মনে হলো সে কারো সঙ্গে কথা বলছে, আর হাসছে। হাসতে হাসতে মুখ চাপা দিচ্ছে। হাসির গমকে তার শরীর কাঁপছে। আমি খুব অবাক হলাম। এত রাত পর্যন্ত তো রেখা কখনো জাগে না। আজ আমি একদিন তার থেকে আলাদা শুলাম বলে সে জেগে থাকল! জেগে থাকলে তো একবার আমার কাছে সে আসতে পারত। দেখে যেতে পারত আমি কী করছি। এতই মশগুল সে ফোনে যে তার মনেও হয়নি আমি একা নতুন একটা রুমে ঘুমাচ্ছি! খুব সন্দেহ জাগল মনে। সন্দেহ জাগার কারণগুলোও একটা একটা যেন আমার মনে পড়তে লাগল। সেই রাতে আমার ভেতর জন্ম নিল আরেকটা চোখ। সেটা হলো সন্দেহের চোখ। আমি করোনায় আক্রান্ত হতে যাচ্ছি, বউকে ওই অবস্থায় দেখার পর সেই সন্দেহটা আরো জোরদার হলো আমার ভেতর।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here