৬
পাঁচটার দিকে অফিস টাইম শেষ। খুব কাজের চাপ পড়লেও ছয়টা-সাড়ে ছয়টার এদিক ওদিক হয় না। এমন দিন বছরে পাঁচ-সাতদিনই আসে যে অফিস শেষ হতে হতে আটটা-সাড়ে আটটা বেজে যায়। চাইলে বাসায় আরও আগেই ফেরা যায়। কিন্তু অফিস শেষ হলে কিছুক্ষণ এলোমেলো সময় কাটাতে ভালো লাগে। অফিসের পেইনটা একদম ভুলে যাওয়া যায়। মোজাম্মেলকে আজ খুব আপন লাগছিল। শোভনের সঙ্গে তার কত পার্থক্য। শোভন চুপচাপ। মুখে সবসময় একটা গাম্ভীর্যের ভাব ঝুলিয়ে রাখত। দেখেই বোঝা যেত ভালো ছাত্র। রেজাল্ট ভালো ছিল তার। বেসরকারি একটা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার সে। আর মোজাম্মেল চটপটে। সবসময় মজা-মাস্তিতে থাকে। মানুষকে সবসময় হাসানোর ধান্দা তার। পারলে নিজেকে পঁচিয়ে হলেও লোক হাসাবে। এই তার কাজ। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আবার সে খুব সিরিয়াস। অনেককিছুই বোঝে। খুব ভালো সম্পর্ক মেইনটেইন করতে পারে। মেয়েদের প্রতি তার সম্মানবোধ আছে। তার এই মেয়েদের সম্মান করার বিষয়টাই আমাকে মুগ্ধ করে। শোভন যখন-তখন এর তার নামে বাজে কথা বলতো। আমি ভাবতাম, আসলেই ঐ মেয়েগুলোর বোধ হয় সমস্যা আছে। কিন্তু কারো সমস্যাকে সমস্যা বলাটাও যে একটা সমস্যা এটা আমি বুঝতাম না।
ইমরানের কথা বলছিলো মোজাম্মেল। ইমরান নাকি আমাকে পছন্দ করে। আমি একটু অবাকই হলাম। সত্যিই অবাক হয়েছি শুনে। সম্ভবত আমার চেয়ে ও ছোটো হবে। দেখে তাই মনে হয়। এই দুই-তিন মাসে ওকে আমার স্রেফ বেশি-বোঝা-টাইপের একটা ছেলে মনে হয়েছে। মানুষ চেনার ক্ষেত্রে ইদানিং আর নিজের ওপরে ভরসা পাই না। আমার তো বিভাস দা’কেও অসহ্য লাগতো। অথচ উনাকে তো বলতে গেলে প্রায় সবাই পছন্দ করে। আমার কাছেও তো আজ ভালই লাগলো। কিন্তু এতো কাছাকাছি থেকেও সামান্য একটু ভালো মনে হওয়ার জন্য ছয়মাস আসলেই খুব বেশি সময়। অবশ্য প্রথমদিকে আমি কারো সঙ্গেই মেলাতে পারছিলাম না। আর বিভাস দা’ খুব চুপচাপ একজন মানুষ।
মোজাম্মেলের কথা শুনে মনে হলো, এই পছন্দ মানে হালকা পছন্দ না। ভালোবাসা-টাইপ কিছু একটা। কেউ একজন আমাকে পছন্দ করে, কিন্তু তার প্রতি আমার কোনো ফিলিংস নেই, এই বোধটা বেশ আনন্দের। একটা ঝরঝরা ভাব আছে এতে। বাসে ঝিমাতে ঝিমাতে খুব উপভোগ করলাম বিষয়টা।
বাসায় ঢুকতেই গা-টা ছেড়ে দেয়। এতো ক্লান্তি যে কোত্থেকে ছুটে আসে! বাইরে থাকতে বোঝা যায় না। রুমে ঢুকেই সব কাপড়-চোপড় খুলে ফেললাম। আহ্ শান্তি। শোঁ শোঁ করে ফ্যানটা ঘুরছে মাথার উপর। নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিতে এতো ভালো লাগে। ঘুম এসে যায়।
গায়ে পানি ঢালতে খুব আরাম লাগছে। আসলেই শুকিয়ে গেছি। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। তিন-চার বছরে ওজন বেড়েছিল ভালোই। এখন বলা উচিত পারফেক্ট। চুলে ধুলাবালি লেগে খুবই বাজে অবস্থা। মুখে তো ধুলার একটা স্তরই পড়ে যায়। গোসল করার পর খুব ফ্রেশ লাগে। ঢিলেঢালা ধোয়া-পরিচ্ছন্ন পোশাকে সত্যিই দুর্দান্ত লাগে নিজেকে। হঠাৎ ইমরানের কথা মনে হলো। সে যদি কখনো এই বেশে আমাকে দেখতো! নিশ্চয়ই ভালো লাগতো তার।
মা আজ মিষ্টিকুমড়া ভাজি করেছে। ছোটোবেলা মিষ্টিকুমড়া খেতে চাইতাম না। এখন ভালোই লাগে। কালিজিরা দিয়ে থকথকে করে রান্না করে মা। ডাল। ডাল বাবার পছন্দ। ডাল ছাড়া তার খাওয়া হয় না। বেগুন-আলু দিয়ে চিংড়ির শুটকি রান্না করেছে দাদি।
‘সারাদিন তো তোমার যাওয়া-আসাতেই যাইতাছে। পড়াশুনা তো মনে হয় হচ্ছে না। চাকরি করবা, নাকি বাদ দিয়া বিসিএসের জন্যে পড়বা কিছুদিন?’, বাবা বললো। খাচ্ছি। মুখে ভাত। একটু সময় নিয়ে উত্তর দিলাম, ‘চাকরি ছাইড়া দেওয়া কি ঠিক হবে! চাকরি ছাড়লেই যে বিসিএস হবে তার নিশ্চয়তা কি! এরচে বরং চলুক। বিসিএসও দেই। দেহা যাক, কী হয়!’ বাবা চুপ করে গেলেন। বললেন, ‘অসুবিদা হইলে কইয়ো। কষ্ট কইরা চাকরি করার দরকার নাই।’ কোনো জবাবের অপেক্ষা না-করেই ভিন্ন প্রসঙ্গ তুললেন বাবা। ‘আব্বারে নাকি স্বপ্নে দেকছো! মা কইলো। ময়মুরুব্বিদের স্বপ্ন দেখলে এতিম খাওয়ানো ভালো। নফল নামায পইড়ো।’ এগুলো দাদির কাজ। স্বপ্ন দেখেছি, এখন এতিম খাওয়াতে হবে। নফল নামাজ পড়তে হবে।
এমনিতে নামাজ পড়া হয় না। নামাজ পড়ি শবে বরাতের রাতে। দাদি বলে, নামাজের রাইত। আত্মীয়স্বজন কেউ মারা গেলে কয়েকদিন নামাজ পড়া হয়। নামাজ পড়ে দোয়া করি মৃত আত্মীয়ের জন্য। তখন সবার জন্যই দোয়া করি। দাদা-দাদির জন্য, বাবা-মার জন্য। পরশুদিন শুক্রবার। কাল বৃহস্পতিবার। বৃহস্পতিবারের রাতটা খুব ভালো লাগে। কী শান্তি! ভোরে ওঠার বালাই নেই।
অনেক আগেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল ইমরান। চোখে পড়েনি। প্রচুর রিকোয়েস্ট আসে। এতোসব রিকোয়েস্টের ভিড়ে হয়তো খেয়াল করিনি। অবশ্য এমনিতেও বুঝতে পারতাম না। কোনো একটা রাতের দৃশ্য প্রোফাইল পিক দিয়ে রেখেছে। ঢুকেই দেখি নোটিফিকেশনে তুলকালাম অবস্থা। প্রোফাইলের নাম ‘ইমরান অনলি’। মাথায় যদিও ইমরানের নামটাই প্রথমে এসেছে। ঢুকলাম ‘ইমরান অনলি’র ওয়ালে। আমাদের ইমরানই সে। রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট না করলেও নাকি ফলো করা যায়। এই সুযোগে আমার সব ছবিতে লাইক দিয়ে রেখেছে। তার সব ছবি দেখি পাবলিক করা। বাসার ছবি। বন্ধু-বান্ধবের ছবি। ইমরানের বাবা-মার ছবি। ইমরানের ছোটোবেলার ছবিও দেখলাম আছে। ইমরানের ভাই-বোনদের ছবি।নিম্ন-মধ্যবিত্ত একটা পরিবার ইমরানদের। ছবিতে মানুষগুলোর চেহারা খুব সাধারণ।
ইমরানদের গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জে। ছবিগুলো বোধ হয় হবিগঞ্জেই তোলা। কতগুলো বয়স্ক মানুষের সঙ্গে দেখি পোজ দিয়ে আছে কয়েকটা ছবিতে। কোনো একটা চায়ের দোকানে। এটাই মনে হয়, হবিগঞ্জ শহর। কিছু ছবি জাহাঙ্গীরনগরে তোলা। হয়তো তার ব্যাচমেটদের সঙ্গে। শোভনের সঙ্গে কয়েকবার জাহাঙ্গীরনগরে গিয়েছিলাম। ঘুরতে। তার এক বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। কি জানি নাম – ভুলে গেছি। অনেক ছবিতেই দেখি কোনো ক্যাপশন নেই। কয়েকটা ছবির ক্যাপশন আবার চমৎকার। বাবা-মা-ভাইবোনদের একটা গ্রুপ ছবির ক্যাপশন, দ্য ফ্যামিলি। মার্কসের একটা পোস্টার পোস্ট দিয়েছিল। Proletarians Have Nothing to Loss But Their Chains বইয়ের ছবি দিয়ে নিচে সেই বই সম্পর্কে মন্তব্য। ইউনিভার্সিটির টিচারদের নিয়ে সমালোচনার পর সমালোচনা। আর সমসাময়িক ইস্যু নিয়ে জ্বালাময়ী সব স্ট্যাটাস।
অনেকক্ষণ কেটে গেল ইমরানের ওয়ালে। বাস্তবে সে যেমন, ফেসবুকেও সেই একই অবস্থা। তার কিছু কমন টপিক আছে। অফিসেও দেখি চান্স পেলেই ঐসব নিয়েই বকবক করে। ইমরান টাইপের ছেলেদের জন্য আমার খুব খারাপ লাগে। এরা হয়তো মেধাবী, ঠিক আছে, কিন্তু লাইফে তারা দুঃখী হয়। এরা হল ব্যর্থ নায়ক। তার প্রতি বরং মায়াই হলো আমার। তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আমি অ্যাকসেপ্ট করলাম। এক-ধরণের আশঙ্কা হলো, এই অ্যাকসেপ্ট করাটাকে না সে আবার তার প্রতি আমার ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে ধরে নেয়। আসলে এই ধরনের আদর্শবাদী ছেলেদের প্রতি আমার শুভকামনা ঠিক আছে, কিন্তু পথ চলার সাহস নেই।
মোজাম্মেলকে আজ অন্যান্য দিনের চেয়ে সুন্দর লাগছিলো। সে আসলে সুদর্শন। যে-কোনো বিচারে। টিপিক্যাল সুন্দর। ফর্সা, মানানসই হাইট, পেটা শরীর। তার দৈহিক সৌন্দর্যেরও একটাই খুঁত। টানা কথা বললে ঠোঁটের কোণায় থুতু জমে। আমার ঘেন্না লাগে। মোজাম্মেলের ক্ষেত্রে ঘেন্না না লাগলেও, আমার ভালো লাগে না। তখন আমার চোখ শুধু তার ঐ থুতুর দিকে যায়। শুয়ে শুয়ে অনেকদিন ভেবেছি, মোজাম্মেলের সঙ্গে যদি আমার অ্যাফেয়ার হয়ে যায়, কেমন হবে! কেমন লাগবে তাকে চুমু খেতে! ফিল করার চেষ্টা করতাম। তখন তার থুতুর কথা মনে হতো। শোভনকে চুমু খাওয়ার অনভূতিতে বদলে যেতো সব।
ইমরানের সঙ্গে আমার যাবে না। তার প্রতি মন সায় দিচ্ছে না আমার। এছাড়া ও আমার ছোটো। জলীর সঙ্গে যদি মোজাম্মেলের অ্যাফেয়ারটা না-টেকে, ও কি আমাকে অফার করতে পারে? যদি করে, আমার কি রাজি না-হয়ে উপায় আছে! আমার ভাবনা এগোয় না। আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে শোভন। আমার সমস্ত আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করে দিয়েছে সে। তার স্মৃতি আমি ভুলে যেতে চাই। কিন্তু পারি না। সে আমার এমন ক্ষতি করেছে, যা পূরণ করার সাধ্য তার নেই। তার নাম শুনলে আমার বমি আসে এখন। এখন আমার একমাত্র চাওয়া এটাই, তাকে ভুলে যাওয়া। এ-ও আমি অনেকদিন ভেবেছি। শোভন যদি ফিরে আসে। যদি বলে, এগুলো সব ফান। আমি শুধু তোমার। ভেতর থেকে আমার তখন কুৎসিৎ একটা হাসি বেরিয়ে আসে। তার প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা নেই আমার। বরং তীব্র ঘৃণা আছে। এই ঘৃণাই এখন চেপে আছে আমার জীবনে। নিজেরই ঘৃণার বিষে জ্বলে যাচ্ছি আমি। আর বয়ে বেড়াচ্ছি তার যত ছোবলের চিহ্ন।
(চলবে)