পরাগ চৌধুরি মূলত অনুবাদক। বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য অনুবাদ করেছেন বাংলায়। ভীষণ পড়ুয়া মানুষ তিনি। অভিজ্ঞতার ঝুলিও বিশাল বড়। এবার তিনি প্রবেশ করেছেন স্মৃতির অন্দরমহলে। স্মৃতি মানুষের বড় শক্তি। স্মৃতি ছাড়া ইতিহাস হয় না, স্মৃতি ছাড়া সাহিত্যও হয় না। পরাগ চৌধুরির এই স্মৃতিলেখা একই সঙ্গে স্মৃতি ইতিহাস ও সাহিত্য। চমৎকার তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তি, স্মৃতির বয়ান ছাপিয়ে গিয়েছে উপন্যাসের কাঠামোকেও।
মানুষের দীর্ঘ জীবনাভিজ্ঞতার ক্রমে কখনো কখনো কোনো কোনো স্মৃতি মস্তিষ্কের কোষে ঝর্ণায় গড়িয়ে আসা নুড়ি পাথরের মতো আটকে থাকে। তাই কিনা আবার কোনো নির্জন পলে জলতলের ভারহীন একখণ্ড শুষ্ক তৃণ হয়ে ভেসে উঠে মনে পড়িয়ে দেয়।
বড় হয়ে উঠতে উঠতে গরমের ছুটিতে বেশ অনেকবার মায়ের নানাবাড়ি জাঙ্গালিয়া গ্রামে গিয়েছি। ট্রেন থেকে নামার পর থেকেই নানু, শিরি ও পেয়ারা খালাকে দেখতে পাবার আকাঙ্ক্ষায় শরীর মন যেন উদগ্র হয়ে উঠতো। রিক্সায় বসেই দেখতে পেতাম উঠান জুড়ে শুকাতে দেয়া ধান। বাঁশের হাতলের মাথায় লাগানো অর্ধচন্দ্রাকৃতি কাঠখণ্ড দিয়ে ধান মেলে দেয়ার খেলা। আকাশে মেঘ-বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা বুঝে ছোটাছুটি হুড়োহুড়ি করে গুটিয়ে নেয়া ধানের ঢিপি বানানোর প্রতিযোগিতা। উগারের পাশের খালি জায়গায় টাঙানো বাঁশে সারি সারি শিকায় ঝোলানো বিচিত্র সব আচার। বুড়ো হতে থাকা বড় ঘরের পেছনে স্কুলের এসেম্বলিতে দাঁড়ানো ছাত্রদের মতো সারি দিয়ে নট নড়নচরন বুবি গাছের জঙ্গল। অন্ধকার ঘনালেই সেখানে মুরগি চুরির আশায় শেয়াল পণ্ডিতের শুকনো পাতার ওপর ছমছমে আনাগোনা ও হতাশ হয়ে কাঁদাকাটি করে ফিরে যাওয়া। পাশের বাড়ির তাহের মামার ছোট ভাই আউয়াল মামার সুপারি গাছ থেকে পিছলে উঠানে পড়ে যাবার শব্দ।মাটিতে নিথর শুয়ে তার খোলা চোখজোড়ার আকাশপানে ভাবলেশহীন তাকিয়ে থাকা — সব ছায়াছবির মতো চোখের সামনে ভেসে যেতে থাকে।
শুনেছি মায়ের নানা একজন দেওবন্দ পাশ আলেম যিনি তাঁর যৌবনে ঢাকার আহসান মঞ্জিলে ফারসি পড়াতেন। এই জাঁদরেল নানার একজন পালিত জ্বীন ছিল, যে মধ্যরাতে ষাঁড় বাছুরের রূপ ধরে চুপচাপ এসে উঠানে শুয়ে থাকতো। কেউ কেউ বলে সুপুরুষ নানার ভরন্ত যৌবনে সদর থেকে ফিরতি ঘনগহীন এক রাতে তাকে একা পথে পেয়ে উনি বেহেশতি হুরির রূপ ধরে পথের পাশে অবোধ অসহায় ক্রন্দসী হয়ে পথের পাশে বসে ছিলেন। আমার মা নিজের চোখে বাছুরটাকে দেখেছে। নানা নাকি নামাজের জন্য উঠে হাঁকডাক করে তাকে বাড়ি ফেরার আদেশ দিলে নেহাত অনিচ্ছায় গতর তুলে মসজিদের পেছনের জঙ্গলে ঢুকেই সে হাওয়া হয়ে মিলিয়ে যেত। তখন বিশ্বাসের কাল। এ নিয়ে কখনো কেউ প্রশ্ন করেনি। করার কথা ভাবেওনি। মায়ের নানা ছিলেন ভয়াবহ রকমের রাশভারি ও পণ্ডিত মানুষ । আমার ঐ বাড়িতে যাতায়াত শুরুর অনেক পূর্বেই তিনি গতায়ু। মায়ের নানার মৃত্যুর পর পরই রূপধারী বাছুরটিকেও আর দেখা যায়নি।
আমি দেখেছি পাতকুয়োর পাশের মেওয়া গাছের উপর দিয়ে হালকা আলোর আভা ভেসে যাচ্ছে । ঐ দেখে সবাই ভয়ে ঘরে ঢুকে পড়লে আমিও তাই করতাম । কিন্তু ভয়ে নয় মুরুব্বিদের তাড়নায় । আমি ঢাকায় থাকি । অনেক প্রশ্ন করি । আমি নাকি সমবয়সীদের সবার আগে অদ্ভুত অদ্ভূত সব প্রশ্ন করি। খুব সকালে নানুর একটা কোরান শেখানোর ক্লাস হতো। মায়ের লক্ষ্য ছিল গরমের ছুটিতে আমি যেন তা ঠিকমতো হাসিল করি।একদিন কোরান শিক্ষার মাঝামাঝি সময়ে দূর থকে হেলিকপ্টার আসার আওয়াজ পাওয়া গেল। তখন রেহাল ছেড়ে সবাই একযোগে উঠে পড়ে। নানু হাসতে হাসতে উঠে দাওয়ায় মাটির হাড়িতে ঢেকে রাখা আধার থেকে খানিকটা নিয়ে পোলো দিয়ে আটকে রাখা এক ডজন বাচ্চাসহ মা মুরগিকে খেতে দেয়। মাথার উপরে হেলিকপ্টারের বিকট আওয়াজে মুরগি তখন দুই পাখার নিচে বাচ্চা সামলে গলা বাড়িয়ে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করে। ততক্ষণে আমার সঙ্গীরা বার বাড়ির বাঁধানো কুয়োতলা মাড়িয়ে হুড়মুড়িয়ে দৌড়োয় পুকুর পাড়ে এক নজর উড়োজাহাজ দেখার আশায়। আমি তখন একা আসন আঁকড়ে বসে থাকি। ঢাকার আকাশে ঐ বস্তু প্রায়ই দেখা যায় । একটু পরেই হাওয়াই জাহাজ দেখার আনন্দ উত্তেজনা নিয়ে কলকল করতে করতে সবাই ফিরে আসে। নানুর পাঠদানের আসর নতুন করে শুরু হয় । তবে ভোররাতের দিকে ঘুম ভাঙলে মাঝে মাঝেই পাড়ার শেষ মাথা থেকে ধর ধর আওয়াজ আসে । একটু পরেই
পাশের বাড়ির তাহের মামার আনারস বাগানে গলা চেপে ধরা মুরগির কঁ কঁ আর্তনাদ শোনা যায় । পরদিন নানুর নির্দেশে আনারস আনতে গিয়ে স্তূপ করা মুরগির পালক দেখে শিরি ও পেয়ারা খালা মুক্তাদের বাড়ির হারানো মুরগির রহস্য উদ্ধার করে। একদিন ভোররাতে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাবার মতো এক অদ্ভুত আওয়াজে মস্ত খাটের প্রায় সবাই আমরা ঘুম ভেঙ উঠে পড়ি । এবারে আমার নানু ঝপ করে উঠে অতি ক্ষীপ্রতায় দরজা আটকানোর লাঠি হাতে বীরদর্পে উঠানে নেমে যায় । সঙ্গে সঙ্গে পাশের বাড়ির তাহের মামা দাওয়ার চালে সমানে বাঁশ পেটায় আর হল্লা করতে থাকে । আরো অনেকের কথা শোনা গেলেও কিছুই বোঝা যায় না। ভয় পেয়ে সমবয়সীরা ঘুম ছেড়ে থুম ধরে অধীর হয়ে বসে থাকি ভোরের প্রথমচ্ছটার অপেক্ষায়। সময় আজ এতো ভারী কেন? আমারা কজন আজ তাকে প্রাণান্ত ঠেলেও সামনে এগিয়ে নিতে পারি না। উঠানের ঐ প্রান্ত থেকে নানুর কাউকে সান্ত্বনা দেবার আহ্লাদী স্বর ভেসে আসে। একসময় খটর মটর করে বৌলওয়ালা কাঠের খড়ম পায়ে নানুর বড় ভাইয়ের বাড়ির বাইরে যাবার আওয়াজ পাই। শিরি খালা শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরে।
আজানের প্রথম ধ্বনি শোনার সঙ্গে সঙ্গে শিরি খালা একদিকে পেয়ারা খালা আরেক দিকে আমার হাত টেনে ধরে হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়ল উঠানে। শয়তান তার অন্ধকার গুহায় ঢুকে পড়েছে। আর তাই ধলপহরের অর্ধস্ফুট আভার উদ্ভাস দিগন্তরেখায় পদ্মের মতো দল মেলতে লেগেছে। বাড়ি থেকে বেরুতে যাবার পথের ডানপাশে দাঁড়িয়ে অন্দরবৈঠকঘর আর বাঁ পাশে আদ্যিকালের থুত্থুরে এক কমলাফুলি ডালিম গাছ। এ গাছ কোন মরশুমে ফুল ফল দেবে তা তার মেজাজমর্জির উপর নির্ভর করে। বেশ কয়েক বছর ধরে এ বাড়িতে আসি বলে ওর মিঠা এবং নরম ফল খাবার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তারই নিচে মুক্তাগাছের ছালে তৈরি নামাজের চাটি বিছিয়ে নানু আসনপিঁড়ি হয়ে বসা। কোলের উপর সামনের পায়ে শাড়ি ছিঁড়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা একটা সাদাকালো ছাগশিশু মাথা এলিয়ে শুয়ে। গায়ের সাদা অংশে একটু একটু লালের ছোপ। চোখ বন্ধ নানু একমনে কোরাণের আয়াত পড়ে ঝুঁকে ওর গায়ে ফুঁ দিচ্ছে মাঝে মাঝে । যেভাবে আমার গলায় মাছের কাঁটা ফুটলে আঙুল বুলিয়ে ফুঁ দেয় তেমনি। অবশ্য বাহলুল মামা একবার তেমন বিপদে তৎক্ষণাৎ কাঁটা খাওয়ায় ব্যাস্ত চার বিড়ালের একটাকে খপাৎ করে ধরে এনে বলেছিলো: ওর পায়ে ধরলে কাঁডা এর মুখে যাইবো। দিশাবিশা না পেয়ে রেগে গর্জাতে থাকা বিড়ালের পা চেপে ধরেছিলাম। নানুর সুরা পাঠের দৌলতে না বিড়ালের করুণায় একটু পরে গলার কাঁটা উধাও।
আমার নানুর বুড়ো আঙুল সাদাকালোর পেটের ওপর নড়াচড়া করে । শিয়াল বোধহয় এই ঠ্যাংখান কামড়ে তাকে টেনে নেয়ার চেষ্টা করেছিল। বেচারা ভয়ে এখনো হঠাৎ হঠাৎ কেঁপে উঠছে। এখানে দেখার কিছু নেই । শিরি খালা আমাদের টেনে নিয়ে যায় বড় ঘরের দাওয়ায় । ওখানে বাঁদিকের বাড়তি অংশে আছে ছাগলের ঘর। দরজা খোলা। কাল কি ভুলে তালা দেয়া হয়নি? শিরি খালার টানে দাওয়ার ওপাশে গিয়ে দেখি এক নিপুণ সুড়ঙ্গ । ওহ্হো। ভোররাতে শিয়াল মামার কীর্তি। গত সপ্তাহে মুরগি চুরির সাফল্যগৌরবে উনি আরো বড় শিকার ধরার আশায় আজ এই বাড়িতে তশরিফ এনেছিলেন। ভাগ্যিস লোকজনে জানতে পেরেছিলো। তাহের মামার টিনের চালা পেটানোর বিকট শব্দের দড়াম দড়াম শুনে ব্যাটা শিয়াল শিকার ফেলেই ভাগাতানি। বড় নানা এর মধ্যেই মেরামতির সরঞ্জাম গর্তের পাশে জমা করে বেঁধে রাখা মা ছাগলের দড়ি খুলে নামাজের ওয়াক্ত ধরতে মসজিদমুখী এগিয়ে গেল। আজকের ভোররাত হুল্লোড় রহস্যের কিনারা হলো। আমারা তিনজন রুটিন মাফিক সকালের কৃত্য ও অজু সারতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ি। সূর্য অনেক দূর এগিয়েছে।
নিত্যকার কোরানপাঠের পুণ্যার্জনের পর দাওয়ায় চাটি বিছিয়ে ডিমখিচুরির নাশতা। তখন নানু মাথা তুলে চিঁ চিঁ করতে থাকা সাদাকালো কোলে নিয়েই আমাদের পাশে বসলো। সবার পাতে আচার দেয়া শেষ হতে না হতেই পাশের বাড়ির পোষা কুকুর লালুভুলু রোজকার মতো উবু হয়ে দাওয়ার নিচে দাওয়াতি মেহমানের মর্যাদায় কুকুরবসা হয়। ভিখারির মতো সবার মুখের দিকে তাকাতে থাকে একটু করুণা পাবার আশায়। রোজই আমারা কেউ না কেউ ওর সানকিতে কিছু খাবার তুলে দেই। আজ নানু আমাদের মানা করে লালুভুলুর উপর চোটপাট শুরু করলো। আমরা পাতের উপর হাত রেখে মুখ হাঁ করে তাই গিলতে থাকি : এই রে বেশরম লালু। তোর কতো বর কইলজা যে খানা খাইতে আইছস? লজ্জা নাই? কাইল রাইতে পন্ডিতেরে শিং খুরতে দিয়া নাকে ঘানির তেল দিয়া ঘুমাইলি, না বাতেনের লগে মাছ ধরতে গেছিলি? আর এখন আইছিস বকশিশ নিতে? চোখ নামা। চোখ নামা কইলাম। মাইর খাওয়ার আগে যা এইখান থাইকা। আইজ সারাদিন তোর ছায়াও দেখতে চাই না ।
কী আশ্চর্য! অভুক্ত লালু নানুর কথামতো চোখ নামিয়ে বকাবকি শুনে বাধ্য ছাত্রের মতো নিঃশব্দে তাহের মামার রান্না ঘরের দিকে হাঁটা ধরলো। তাইতো গতরাতে সে ছিলো কোথায়? বড় নানু আঁচলে মুখ ঢেকে আউয়াল মামাকে আরো এক হাতা খিচুড়ি দিতে দিতে বলে: আরে লালু তো আমারে কইলো মুক্তা মিহিরের বাড়ি গেছিলো বৌ দেখতে। বিয়া করনের মতি হইছে। চাটাইয়ে বসা আমরা পাঁচজন হি হি হি হি করে উঠি।
এমন সময় তাহের মামার উঠানে কার যেন হাঁক শোনা যায় : তাহের বাই । কর্পুর আর গামছা লইয়া উডানে আউয়াইন। বাবি গুল আর গরম পানি করছুইন? ব্যান্ডিজ? আমারে একটা পান দেইনজে। বেইন্নালা তরাতরি উদমপুর যাওন লগছে। পান খাওনের সময় আছিল না। বুজ্জুইন?
তাহের মামি শাড়িতে তার কলসিবাঁধা পেটখানা যথাসম্ভব আড়াল করে ঘোমটায় মুখ ঢেকে নিঃশব্দে কৃত্য করে যায়। তাহের মামা নিজহাতে বানানো কারুকার্যময় লাঠিখানায় ভর করে উঠানে নেমে পেতে রাখা মোড়াটায় বেশ আয়েশ করে মহারাজার মতো ঘাড় টান করে বসে।তারপর কঁক কঁক করে পেখম ধরে দশ বারোটা বাচ্চাসহ এগিয়ে আসা মুরগিটাকে শখের লাঠি দিয়ে বাড়ি দিলে ওটা আমাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসে।
(চলবে)
শৈশবে বিষ্ণুপুরে ঘটে যাওয়া অনেক কাহিনি স্মরণে এসে গেল।