দুর্গাপূজা ও দুর্গোৎসব : ইতিহাসের পাতা খুলে

ভারতীয় উপমহাদেশের একটি প্রাচীন সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য মাতৃদেবীর বন্দনা। এর আছে দীর্ঘ ঐতিহাসিক উৎস। সিন্ধু সভ্যতায় মাতৃকাদেবীর পূজা দেখা যায়। তবে একথা কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না যে, সিন্ধু সভ্যতার ধারাবাহিকতায় দুর্গাপূজার উদ্ভব। তবে এটা ঠিক যে, বিভিন্ন প্রাচীন প্রতীক, উপকরণ ও উপাদান যুক্ত হয়েছে নতুন আয়োজনের সঙ্গে। মাতৃদেবী হিসেবে দুর্গা হয়ে উঠেছেন পরম পূজ্য। তাঁকে ঘিরে গড়ে উঠেছে পূজা ও উৎসব; এর একদিকে রয়েছে ধর্মীয় কৃত্যের ভাগ, অন্য দিকে ছড়িয়ে আছে সামাজিক সম্মিলিত আনন্দ উদযাপনের ভাগ।

 

দুর্গাপূজা ও উৎসবকেন্দ্রিক নানা ধরনের গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। তিথি ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন, দুর্গা কী করে বাঙালির জাতীয়তাবাদী বাসনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে; দুর্গা একই সঙ্গে ভালো মেয়ে, ভালো মায়ের পারিবারিক প্রতিমূর্তি, আবার অসুরবিনাশী শক্তি। শুভ ও অশুভ শক্তির লড়াইয়ে দুর্গা অদম্য ইতিবাচক শক্তির উৎস।

 

কুনাল চক্রবর্তী দেখিয়েছেন ষষ্ঠ শতক থেকেই অবৈদিক উপাদানসমূহ ব্রাহ্মণ্যবাদী চিন্তায় প্রবেশ করছিল। তার আগে মহাভারত বা হরিবংশে দুর্গা হচ্ছেন নির্ভীক কুমারী, যিনি বিন্ধ্যা বা হিমালয়ের গুহায় বাস করেন, শিকার করেন। তাঁর সঙ্গী ভূতপ্রেত, জন্তুজানোয়ার এবং পরিধান করেন ময়ূরের পাখা। তাঁর খাদ্য-তালিকায় আছে মাংস ও মদ। দুর্গা যুদ্ধপ্রিয় এবং দানব বিধ্বংসী। দুর্গাকে দেখা যাচ্ছে অবৈদিক দেবী হিসেবে। পরবর্তী সময়ে ‍দুর্গা হয়ে ওঠেন জননী; সঙ্গে দুই কন্যা লক্ষ্মী ও সরস্বতী, দুই পুত্র কার্তিক ও গণেশ।

উনিশ শতকের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে সংবাদপত্রে দুর্গাকেন্দ্রিক আয়োজনকে ঘিরে ‘পূজা’ ও ‘উৎসব’ শব্দ দুটি ব্যবহৃত হচ্ছে। পূজা ধরন পারিবারিক, আবার বারোয়ারি – এখন যেটিকে বলা হয় ‘সার্বজনীন পূজা।’ পারিবারিক পূজাগুলোর আর্থিক উৎস পরিবার ও পরিবারের সদস্যবৃন্দের ব্যক্তিগত তহবিল। কিন্তু সার্বজনীন বা বারোয়ারি পূজার তহবিল গঠিত হয় সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায় ও অঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণি, পেশার মানুষের অংশগ্রহণে। এমনকি অন্য ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ও নানাভাবে সহায়তা দান করে এসেছেন এবং সহায়তা করে থাকেন। পারিবারিক পূজায় মূর্তির গঠন আকার আয়তনে ছোট হতে পারে। কিন্তু সার্বজনীন পূজায় মূর্তির গঠন তহবিল ও সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে। দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয় স্থায়ী মন্দিরে, গৃহস্থ বাড়িতে এবং অস্থায়ী প্রাঙ্গণে।

 

গবেষকরা দুর্গাপূজার দুটো ভাগ করেছেন; একটি বাংলা অঞ্চল ঘরানার, অন্যটি বাংলা অঞ্চল-বহির্ভূত ঘরানার। বাংলা-বহির্ভূত দুর্গাপূজা অনেক বেশি স্মার্ত ব্রাহ্মণদের দেবীপূজা নির্ভর; এটির আরেক নাম বৈদিক পূজা। কিন্তু বাংলা অঞ্চলের পূজায় যুক্ত আছে বৈদিক, পৌরাণিক ও তান্ত্রিক উপাদান।

 

বাংলা অঞ্চলে দুর্গাপূজার সূত্রপাতের ইতিহাস নিয়ে মতভেদ আছে। তবে কলকাতার একটি পারিবারিক উৎসের কথা বলা হয়, যারা ১৪১১ সালে পূজা করেছেন। সে মূর্তিতে দেখা যাচ্ছে দেবী সিংহবাহিনী, কিন্তু তাঁর সঙ্গে সন্তানেরা নেই। যেমনটা দেখতে পাওয়া যায় এখনকার দুর্গা মূর্তিতে। দূর্গাপূজার আরেকটি উৎসের কথা বলা হয়; সেটি বাংলাদেশের রাজশাহীর তাহেবপুর অঞ্চলের জমিদার কামসনারায়ণে উদ্যোগে আয়োজিত পূজা। এর কালপর্ব ধরা হয় ১৫৮৩। দূর্গাপূজার আরেকটি ইতিহাস জড়িয়ে আছে  সতের শতকের জমিদার লক্ষ্মীকান্তের সঙ্গে। তিনি বেহালা গ্রামে একটি আট চালা প্রতিষ্ঠিত করেন। এখানে প্রথম ১৬১০ সালে হৈমন্তিক পূজা অনুষ্ঠিত হয় বলে তথ্য পাওয়া যায়।

 

বানারসে দুর্গা অনুষ্ঠিত হবার পেছনে আছে বাঙালি ব্রাহ্মণ ও জমিদারদের প্রভাব। আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রভূমি হিসেবে বানারসে বাঙালি পুরোহিতরা স্থায়ীভাবে আবাস গেঁড়েছেন। রানি ভবানীর মতো সম্পদশালী জমিদাররাও ঠাঁই নিয়েছেন বানারসে। আর তাই দুর্গা পূজার সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রভাবও তৈরি হয়েছে বানারসে।

সূত্র : মিটমিউজিয়াম

১৭৫৭ সালে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এবং শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ আশ্বিনী দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। এই উদযাপন ছিল তাদের শক্তি ও দম্ভের একটি প্রকাশ; ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে তাঁদের সংহতি ও সহাবস্থানের রূপ। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকেই প্রধানত বারোয়ারি পূজার উদ্যোক্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। উনিশ শতকে স্থানীয় বাঙালি বেনিয়াদের দুর্গা পূজাকে নিয়ে আসেন জনপরিসরে। সে সময় দুর্গাকে সাজানো হত নিখাদ স্বর্ণ ও দামি পাথর দিয়ে। ঠাকুর পরিবারের প্রতিমাকে সাজানো হয় সম্পূর্ণ স্বর্ণ দিয়ে। মল্লিক পরিবারের পূজাতেও প্রচুর অর্থ ব্যয় হত। দুর্গোৎসব চলত ১৫ দিনেরও অধিক সময়ব্যাপী।

 

আঠার শতকের শেষ দিকে ও উনিশ শতকে দুর্গা পূজা হয়ে হয়ে ওঠে নাগরিক পরিচিতির অংশ। পূজার সঙ্গে যুক্ত হয় যাত্রাপালা, নাচ, গান এবং সংগীতের নানা ধরন। পূজায় বায়না দিয়ে নিয়ে আসা হতো বিখ্যাত বাইজিদের। পূজার উৎসবের অংশ ছিল খেউর, যাত্রা, আখড়াই। তিথি ভট্টাচার্যের মতে, পূজার উৎসবমুখর পরিবেশনাগুলো নতুন নাগরিক রুচি তৈরিতে সহায়তা করেছে। তিনি আরও দেখিয়েছেন দুর্গা পূজার সঙ্গে গড়ে উঠেছে হিন্দু জাতিত্ববোধের সম্পর্ক।

 

১২৭৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়েছ বেহারিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন দুর্গোৎসব নামক নাটক; এ নাটকে দুর্গা পূজা আয়োজনের গুরুত্ব উপস্থাপিত হয়েছে। পূজা অনুষ্ঠিত হওয়া, না-হওয়া বিষয়ক তর্ক করতে দেখা যায় চরিত্রগুলোকে। ব্রাহ্ম ও সনাতন হিন্দুর পূজা বিষয়ক তর্ক-বিতর্ক উঠে এসেছে এই নাটকে।

 

স্বদেশী আন্দোলনের সময় প্রকাশিত হয়েছিল ভারতের সার্বজনীন দুর্গোৎসব (১৯০৭) নামের বটতলার পুথি। জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দুর্গাপূজাকে দেখা হয়েছে এ বইয়ে। বিশ শতকের প্রেক্ষাপটে দুর্গাকে ঘিরে লেখা হয়েছে গান, নাটক। মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত লিখেছিলেন দেবী দুর্গা নামক নাটক। নাটকটির ভূমিকায় লেখা হয়েছে, ‘‘মেধস্ মুনির উপদেশে, সুরথ রাজ্য-কামনায় এবং সমাধি মুক্তি-কামনায় শ্রীদুর্গা পূজা করেছিলেন। ফলে, সুরথ পেলেন রাজ্য ও সমাধি পেলেন বাঞ্ছিত মুক্তি। সেই থেকে বসন্তকালে দেবী পূজার প্রচলন হ’ল। — এই পৌরাণিক আখ্যায়িকা অবলম্বনে দেবী দুর্গা রচিত হয়েছে।’’ এ নাটকের গানগুলো লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এ নাটকেই লেখা হয়েছে :

শক্তিরূপা মা আমার –

মরি মরি, একি মূর্ত্তি ভয়াল সুন্দর!

অতসী কাঞ্চণবর্ণ, পৃষ্ঠদেশে দোলে

শ্রাবণ জলদ সম কুঞ্চিত কুন্তল,

ত্রিনয়নে বহ্নি দ্যুতি, ওষ্ঠে মৃদু হাস,

দশকরে ধৃত চক্র, খড়্গ, ধনু, পাশ!

জাগিবি রে অভয়া, নিষ্পেষিত ভারতের

রক্ত-সিক্ত হৃদি-পদ্মদলে!

 

আজকের দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসবের সঙ্গে ঔপনিবেশিক ইতিহাস বা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। আজকের বাংলাদেশে দুর্গাপূজা মূলত ধর্মীয় কৃত্য ও উৎসব। আদতে প্রতিটি ধর্মীয় উৎসবের কমপক্ষে দুটি দিক থাকে; প্রথমত : ধর্মবিশ্বাস থেকে উঠে আসা বিভিন্ন প্রতীকনির্ভর কৃত্য, দ্বিতীয়ত, উৎসব বা আনন্দ আয়োজন — যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে খাদ্য, আড্ডা, আলাপ এবং পারস্পরিক সহাবস্থান। সংশ্লিষ্ট কৃত্যে ধর্মবিশ্বাসবশত অংশগ্রহণের ইচ্ছে থেকে অপর ধর্ম বা সম্প্রদায়ের মানুষ অপর সম্প্রদায়ের উৎসবে অংশ নেয় না — এটিই বাস্তবতা।

 

সূত্র

Tithi Bhattacharya,The Journal of Asian Studies, Volume 66, Issue 04, November 2007, pp 919 ­-962

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here