শুরু হলো নতুন ধারাবাহিক — বায়োগ্রাফিক্যাল ফিকশন বা আত্মজৈবনিক কথাসাহিত্য — যখন ফুটিল কমল। লেখার পরিণতি কী দাঁড়াবে লেখক নিজেই তা ভালো বলতে পারবেন। জাহিদুর রহিম চমৎকার গদ্যে উপহার দিয়েছেন জীবন ও দর্শনের মৌলিক প্রশ্ন ও উত্তর।
এক
“আমার ভেতরে সমুদ্র — আমার চারিদিকে চিরন্তন সমুদ্র। কোন সমুদ্র?
সে কথা আমি স্পষ্ট করে বলতে পারবো না ” — আরি মিশো
রাত কাটে ভোর হয়। প্রতিদিন ভোর হয়। বুঝি বা না বুঝি তন্দ্রা ঘেরা চোখ মেলে দেই। দৃষ্টির সীমানায় নোনা দেয়ালে খসে পরা কিছু এলানো কুসুম। যেদিকে তাকাই দেখি সাবলীল এক পতিত মোহনীয় কাঁদার পাঁক। উল্টে পাল্টে নাড়া চাড়া করি সময় — টিকটিকির খসে পড়া রক্তহীন বিকৃত লেজের মত ফ্যাকাসে সময় । ইচ্ছে হয় শুয়ে থাকি আরও — ইচ্ছে হয় ভেসে যাই আলস্যের ভাসানো জোয়ারে। দূর থেকে ভেসে আসে রূপকথার বাঁশি, হারানো বিষাদের অবসাদ । শুনি রুপালি মাছির মৃদু গুঞ্জন। সমস্ত শরীর জুড়ে গভীর কুয়ো থেকে তুলে আনা জলের শীতলতা। আবার গড়িয়ে দেই গা। খাট থেকে পড়ে যায় বালিশ। চারপাশের শব্দগুলো থেমে থেমে ভয়ে ভয়ে কাছে আসে। রাত কাটে ভোর হয় । মনে পড়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় দিবারাত্রির কাব্যে আনন্দকে বলে হেরম্বের সেই কথা, ‘আলসেমিকে আমি প্রায় তোমার সমান ভালোবাসি আনন্দ।’
কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে, ‘নিজের সম্পর্কে আপনার জানা সবচেয়ে ভালো গুণ কী, যার কারণে নিজেকে শ্রদ্ধা করতে পারেন — তাহলে আমি বেশ মুশকিলে পড়ি। এমন কোন গুণ কি আছে? আমি মানে তো যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ — দিনের শেষে একটা শূন্য। এর মাঝেও কি আছে আলাদা কিছু?
ভেবে দেখেছি এর একটাই উত্তর হতে পারে, ‘আলস্য’। আমি জানি শুনে আপনারা হাসবেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি খুব সিরিয়াসভাবেই কথাটা বলছি। আমি তো আলস্যকে পেশা হিসেবে বলতে পারিনা, যেহেতু শুধু এই অলস থাকার জন্য এই সমাজে আপনারা কাউকে কোন জব দিবেন না, অথচ আমি অলস কোন মানুষকে নৈতিক দিক দিয়ে খারাপ হতে দেখিনি। আসলে প্রকৃতই যারা অলস তাঁরা অনৈতিকতার হ্যাঁপাও সামলাতে যান না। তাঁরা নিখাদ অলস কেবল।
আমি এও দেখেছি যারা অলস হয়, তাঁরা বেশ ভোজনরসিক, সংসার অন্তঃপ্রাণ ও মায়াবী হয়। এই সব গুণ যেগুলোকে আপনারা ‘গুণ’ বলতে চান না, আর এই সব মানুষ আপনারা যারা প্রতিনিয়ত এক উদ্দেশ্যহীন ব্যস্ততার অন্তরালে জীবনের বেশির ভাগ কাল শেষ করেন আর চল্লিশের পরে সেই আলস্য ভরা জীবনে জীবনের শুভ ও মঙ্গলের প্রতি চেয়ে থিতু হন। তাই অন্তত অলস হওয়ার কারণেই আমাকে আপনাদের শ্রদ্ধা করতে হবে, না হলে নিজেরাই ভুগবেন, যখন এই অন্তহীন আলস্য নিয়ে, আমার নাদুস নুদুস শরীর, কৌতূহলী চোখ, আর বুক ভরা তৃষ্ণা নিয়ে মরে যাব, আপনারাই বলবেন, ‘লোকটি কি দারুণ ছিল। খুব বেশি ধান্দা করেনি জীবনে। অথচ ধান্দা করার মতো মেধা ছিল’।
এই যে মেধা ছিল অথচ ধান্দা করিনি, এর পেছনে আসল কারণ তো আলস্যই। এতোটুকু শোনার পর আপনাদের ভেতর যুক্তিবোধের আশ্রয়ে গড়ে ওঠা মনের দৌড় ঝাপ শুরু হবে জানি। কিন্তু আমিও পাল্টা যুক্তি দিতে পারি। এই আপানারাই তো শুনিয়েছেন মানুষ আপন স্বার্থ বোঝেনা বলেই অপকর্ম করে। আপনারা আপনাদের মানবিকতা আর শিক্ষার পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় এ কথা লিখে রেখেছেন যে, ‘জেনে শুনে মানুষ আপনার স্বার্থের বিরুদ্ধে কিছু করে না। কারণ এতেই তাঁর সুবিধা।’ আপনাদের এই সব কথা উল্টে যেতে পারে ব্যক্তি বা ইতিহাস যেকোন বিচারে। ব্যক্তির সুবিধার জন্য যখন আমি অলস হব তখন আপানাদের মধ্যে মানবতাবাদী পরিসংখ্যানবিদেরা হাঁকিয়ে উঠবেন। আপনাদের সামনে চলে আসবে পৃথিবীতে মানুষের এই রমরমা সভ্যতা গায়ে জমানো কিছু অলংকার কিছু শব্দ, প্রগতি, উন্নতি, স্বাধীনতা, আধুনিকতা ইত্যাদি। কিন্তু আপনাদের লেখা আপনাদের এই সভ্যতার বাকে বাঁকে কিছু মানুষ এই সব শব্দের সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। যেমন আমি তুললাম, ধরেন ওই ‘স্বার্থ’ আর ‘সুবিধার’ সংজ্ঞার্থ জানতে। এর নির্ভুল কোন সংজ্ঞার্থ কি আছে আদৌ?
আপনারা এখন মাথা খারাপ বলে আমার চিন্তাগুলোকে খারিজ করে দিতে উদ্যত। দয়া করে শেষ পর্যন্ত শুনুন। আমিতো সুবিধা বা স্বার্থ যাই বলুন এসব দেখি আমার আলস্যের মাঝেই। কারণ এই আলস্যই আমাকে আত্মার মুখোমুখি দাঁড় করায়। আমি নিজেকে চিনতে পারি। কিন্তু এই নিজেকে চেনা আর আমার এই আলস্যের স্তুতি আজ মানুষের তৈরি নকল সভ্যতা আর আপনাদের সাজানো সুশৃঙ্খল জীবনবোধের বিরুদ্ধে আঘাত। মানুষের আত্মপরিচয় ভেঙেচুরে তছনছ করে দিবে এই তিলে তিলে গড়ে তোলা সভ্যতার ভিত, মানবতার কল্যাণের নামে মানবপ্রেমীরা যা তৈরি করেছেন। মানুষকে সৎ মানুষ ও ভালো মানুষ করে তোলার আহ্বান জানিয়ে এরপর পুঁজির বিকাশের প্রয়োজনের জন্য ‘পুঁজির সকল সুবিধা ও স্বার্থ’ মানুষের আপন সুবিধা ও স্বার্থ বলে চেনানো সকল ন্যায়শাস্ত্রের বুলির কোন কানা কড়ি মূল্য নেই এই আমার এবং আমার মতো অলস যারা তাঁদের কাছে। সভ্যতা গড়ে তোলে আপনারা যারা অলস নন — তাঁরা গেয়েছেন সভ্যতার জয়গান, বলেছেন, সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে মানুষের মন নরম হয়েছে, মানুষের রক্ততৃষ্ণা কমেছে এবং স্বাভাবিকভাবে মানুষ যুদ্ধের অনুপযুক্ত হয়েছে।
আপনারা যদি সত্যবাদী হন আর যুক্তান্ধ (যুক্তিবাদে অন্ধ) না হয়ে যান, তবে আজ আপনার চারপাশে একজন তাকিয়ে দেখুন! বৃষ্টি ধারার মতো রক্ত ঝরছে সারা দুনিয়ায়, আর সেটা আনন্দের সঙ্গে, যেন এক শ্যাম্পেন উৎসব হচ্ছে। প্রাচীন কালের জনপদগুলো, আপনারা যাদের অসভ্য ও বর্বর বলেন, তাঁরা হত্যা করতো এক ন্যায়বোধ থেকে। বেশির ভাগ সময় সেটা ছিল ব্যক্তি অপরাধকেন্দ্রিক। আর আজ এই সভ্যতার রসে রূপে গড়ে ওঠা আপনাদের সূক্ষ্ম রুচিতে আনন্দের ঢেউ তুলে হত্যা হচ্ছে পুঁজির বিকাশের স্বার্থে, সম্পদ চুরির সুবিধার জন্য। এরপরেও আপনারা বলেন, মানুষ মানবিক হয়েছে আর হত্যা জঘন্য।
আমি জানি আমি যত কথাই বলি, বিজ্ঞান আর যুক্তির যাবতীয় ত্রুটি আপনাদের চোখ এড়িয়েই যাবে। আপনারা আশা করে থাকবেন একদিন এমন কিছু হবে, মানুষ পালটে যাবে, পরিপূর্ণ রোবট হয়ে ন্যায়-অন্যায়ের ঊর্ধ্বে উঠে যাবে। একেবারে এক সুবর্ণ সুদিন আসবে। নতুন রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক একটা কাঠামো গড়ে উঠবে। মানুষের সকল বিভ্রম আর স্বচ্যুতির সমাধান দিবে বিজ্ঞান আর যুক্তি। মানুষ গড়ে তুলবে আধুনিকতা ও যুক্তির সাত মহলা বাড়ি। সেই বাড়ির মানুষগুলো হবে চূড়ান্ত প্রকরণের যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানপূজক।
এরপর কোনো একদিন এই আমার মনের মতো কারো অলস মনের কোন প্রতিক্রিয়াশীল অংশ বের হয়ে প্রশ্ন করবে জীবনের কি তবে কোন সমস্যা নাই? সমস্যাবিহীন জীবন নিয়ে এই ঘেঁয়ে ছকে কাটা ঘরে থাকার চেয়ে চলো আমাদের সেই সব বোকা-সোকা দিনে ফিরে যাই, যখন মানুষ চলত আপন খেয়াল খুশিতেই। সেই আপন খেয়াল খুশির জন্য আর সব সুবিধার ধারণা সে অস্বীকার করেছে। এখন আপনারাই বলুন সেই দিন এই সব অলস মনের কথাগুলো কতটা অচেনা আর অদ্ভুত লাগবে আপনাদের কাছে। আপনাদের সভ্য মন কি চিনবে এই শব্দগুলোকে? আমার মতো অলস মানুষেরা চিরদিন চেয়েছে পছন্দের অবাধ স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতার মূল্য আর পরিণাম নিয়ে আপনারা ভাবুন, আমরা ভাবতেও বাধ্য নই।
আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি, আপনাদের নিজেদের পছন্দ বলে কি কিছু সত্যি আছে? আকাঙ্ক্ষা বলে কিছু আছে? আছে সেই ইচ্ছের স্বাধীনতা? ইচ্ছে, স্বাধীনতা আর আকাঙ্ক্ষা ছাড়া মানুষ তো যন্ত্রের চেয়ে বেশি কিছু না। কিছুই না।
আমি আজ এ কথা বুঝে গিয়েছি যে, যুক্তি যুক্তির চেয়ে বেশি কিছু না, আর বিজ্ঞান বিজ্ঞানের চেয়ে বেশি কিছু না। এ দুটি খেলা করে মানুষের সাজানো বাস্তবে। বাস্তবের সীমানা ক্ষমতা আর সাফল্য দিয়ে ঘেরা। কিন্তু ইচ্ছে আর আকাঙ্ক্ষা কাজ করে মানুষের জীবনের আবেগ, কল্পনা আর বাস্তবের সবটা জুড়ে। ইচ্ছের স্বাধীনতা মানুষকে ক্ষমতা আর সাফল্যের বাইরে নিজের অবস্থান চিহ্নিত করতে সাহায্য করে, যদি তাই মানুষের আকাঙ্ক্ষা হয়।
আমাদের জীবন যতই তুচ্ছ হোক, মূল্যহীন হোক সেটাই কিন্তু আমাদের জীবন। আপনারা বলবেন এতো জানি, কিন্তু আসলে কী বলতে চাইছেন। আমি কেবল বলতে চাই, সেই জীবনে নিজের লাভজনক বা সুবিধার দিক বেঁছে নেবার স্বাধীনতা যেমন আছে মানুষের, তেমনি আছে অসুবিধা ও অলাভজনক জীবন বেচে নেবার স্বাধীনতা, সেই লাভ আর সুবিধা যেটা আপনারা বিচার করেন আপনাদের ক্ষমতা আর সাফল্য দিয়ে গড়া বাস্তবের নিরিখে।
কিন্তু একটা মুশকিলও আছে। আমি জানি আছে। সেটা আমার পছন্দের আর যুক্তির মধ্যে সংঘাত। এই সংঘাত আমার প্রতিদিনের জীবনকে দুর্বিষহ করে দিচ্ছে, কারণ আমি সামাজিক জীব। আমি না চাইলেও কতগুলো সম্পর্কের সুতোয় দুলছে আমার ইচ্ছে আর অনিচ্ছার মাঝের ভূমি। আর এই দুলুনির কারণেই আমি আমার সাথে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করে যাচ্ছি।
আমার এই প্রতারণা এ কথা আমাকে বুঝিয়েছে যে, প্রকৃতির মাঝে মানুষ হিসেবে আমি একমাত্র অকৃতজ্ঞ প্রাণী। আমি যদি কৃতজ্ঞ প্রাণী হতাম তবে সে যুক্তি আর বাস্তবতার সীমানাতেও শান্তির শ্বাস ফেলে চলতে পারতাম। ঘৃণা আর ভালোবাসার নিরন্তর দ্বন্দ্ব আমাকে সারাক্ষণ পোড়াত না। আর এই যন্ত্রণার ক্ষতে এই কথাই পরিস্কার লেখা আছে যে, আমি যন্ত্র না, অনন্ত আশীর্বাদের অন্তহীন সুখের রেণু ঝর্না ধারার মতো যতই আমার উপরে ঝরুক, আমার ইচ্ছের লক্ষে পৌঁছানোর জন্য আমি আমার জীবনে যে অভিশাপের ছায়া বয়ে চলি, যুক্তি আর গণিতের ছকে ফেলে তাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না।