অ্যাডলফ হিটলারের মাইন ক্যাম্পের ইংরেজি অনুবাদকালে কতোগুলো শব্দ নিয়ে অনুবাদকেরা ধন্ধে পড়ে যান। অনুবাদের জন্য যথার্থ শব্দ তাঁরা খুঁজে পাচ্ছিলেন না । শব্দ দুটির একটি হলো ‘Volk’, আরেকটি ‘Weltanshchauung’ । অথচ এই শব্দ দুটির ঠিকঠাক ভাষান্তর জরুরি, কেননা শব্দ দুটি হিটলারের চিন্তাসমগ্রের বড়ো চিহ্নস্বরূপ । Volk শব্দের কেউ অনুবাদ করেছেন ‘folk’, কেউ ‘race’ । বাংলায় কী বলা যেতে পারে ‘জাতীয় জনগোষ্ঠী’, যা আদতে হিটলারের তত্ত্ব মোতাবেক মাস পিপল বা সাধারণ জনগোষ্ঠী থেকে অর্থগত বা তত্ত্বগত পার্থক্যসূচকতাই প্রকাশ করে। ওয়েলট্যানশাং হলো আরেকটি ভাষান্তর-অসম্ভব শব্দ । ইংরেজি অনুবাদকেরা এ শব্দের অনুবাদ করেছেন ‘view of life’ । এই শব্দের আন্তর ভাষ্যেই হিটলারের সঙ্গে মুসোলিনির তত্ত্বগত বা অভিপ্রায়গত সামীপ্য বোঝা যায়।
মুসোলিনির আগে রাজনৈতিক শব্দভান্ডারে ‘ফ্যাসিবাদ’ বলে কোনো শব্দ বা প্রত্যয় ছিল না। তাঁর মতাদর্শিক কর্মসূচির আভ্যন্তর দর্শন কালে ‘ফ্যাসিবাদ’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে । মতাদর্শগত ঐক্যে ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক পার্টি’র মুখপাত্র হিটলারও এই কাতারে সামিল । হিটলারের ওয়েলট্যানশাং আদতে ফ্যাসিবাদ মতাদর্শেরই ওকালতি করছে ।
বেনিতো মুসোলিনি মূলত তাঁর মতাদর্শের প্রচার শুরু করেন পত্রিকায় লিখে, পত্রিকার নাম ছিল ‘ইতালির জনগণ’ । একের পর এক নিবন্ধ লিখে, বিস্তর সংলাপের মাধ্যমে প্রচার করতে থাকেন তার মতাদর্শ । এ মতাদর্শের প্রধান ভিত হলো এক myth, ‘রোমান সাম্রাজ্যে’র myth বা ‘কল্পাদর্শ’, ‘‘we have created our myth.The myth is faith, it is passion.It is not necessary that it shall be a reality.It is reality by the fact that it is a good, a hope, a faith.Our myth is the nation, our myth in the greatness of the nation.’’ (১৯২২ সালে মুসোলিনির রাখা বক্তৃতা থেকে উদ্ধৃত)। একইভাবে হিটলারও প্র্রচার করতেন বিশুদ্ধ রক্তের মিথ, তথা আর্য জাতির কল্পাদর্শ। প্রাচীন ভারতের কল্পাদর্শের প্রোপাগান্ডায় পুরো ভারত এখন দাঙ্গা-উন্মুখ । এটা এক আশ্চর্য সমাপতন নয় । বরং চারিত্রের এমন মেলবন্ধনই নিশ্চিত করে তাদের ফ্যাসিস্ত হয়ে ওঠার ঝোঁক। এ মিথ-প্রোপাগান্ডাই রূপ নেয় আগ্রাসী জাতীয়তাবাদে। এ ফ্যাসিবাদেরই আরেক রূপ সাম্রাজ্যবাদ ।
মুসোলিনি ক্ষমতায় আসেন ১৯২২ সালে, মুসোলিনি-সংক্রামে, ফ্যাসিবাদপীড়িত ইতালির কেটেছে ১৯৪৩ সাল অব্দি। তিনি যে সংগঠন গড়ে তোলেন, তার নাম দেওয়া হয় Fasci di combattiment বা যোদ্ধাদের জোট; fasci শব্দের অর্থ জোট, মূলত তা বোঝায় কতোগুলো কুঠারের শক্ত বাঁধনি যা প্রাচীন রোমান শাসকের প্রতীক। মুসোলিনির অনুসারীদের বলা হতো ‘ফ্যাসিস্ত’ ।
হিটলারও মিথ, নেতা, ‘বীরত্বব্যঞ্জক ইচ্ছা’র (heroic will) সরণি ধরে জর্মানিতে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন । প্রথম মহাযুদ্ধের পরে হিটলারের রাজনৈতিক দল পরিচিত হয়ে ওঠে ‘ন্যাশনাল সোশালিস্ট জর্মান ওয়ার্কাস’ পার্টি’, সংক্ষেপে ‘নাৎসি’ নামে । হিটলার ও মুসোলিনি উভয়েরই মত, ইতিহাসের কর্তব্য-আদি বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সম্পাদিত হয় নি, বরং তা হয়েছে বীরত্বব্যঞ্জক ইচ্ছার দ্বারা । তারা ছিলেন বীরপূজারি । এই বীর হয়ে ওঠার বাসনাকে অনেকে বলেছেন নিৎশের ‘অতিমানব’ (overman) তত্ত্ব থেকে এসেছে ।
ফ্যাসিস্তরা মূলত অ-যুক্তিবাদকে উদযাপন করে, এ তত্ত্বে নিরুৎসাহিত করা হয়ে যুক্তির পারম্পর্যকে । হালের পোস্ট-মর্ডানিজমের যুক্তিহীনতাকে প্রশ্রয় বা নিৎশের প্রাধান্য দেখতে পেয়ে, এ তত্ত্বকেও অনেকে ফ্যাসিবাদের অন্য রূপ বলতে চেয়েছেন ।
হিটলার মনে করতেন, পৃথিবীর ইতিহাস অল্পসংখ্যক ব্যক্তিদের রচিত হয়; তবে এই অল্পসংখ্যক ব্যক্তিরা বহুসংখ্যক ব্যক্তির ইচ্ছা বা সংকল্পকে তুলে ধরে । হিটলারের বর্ণিত এ অল্পসংখ্যক ব্যক্তি এলিট শ্রেণিভুক্ত । তাদেরই একজন নেতা হয়ে ওঠেন । রাষ্ট্রের অধিকর্তা হয়ে ওঠেন সে নেতা এবং তার এলিট শ্রেণি । জনগণ সেখানে অচ্ছুৎ, অপর; যেন তাদর কাজ একটাই নেতা এবং এলিট শ্রেণির প্রভূত কল্যাণ । এ রাষ্ট্রের ক্রম হয়ে ওঠে নেতা-এলিট শ্রেণি-জনগণ। এলিটদের প্রধান হবেন নেতা, তিনি সমস্ত কাজ সম্পাদনা করবেন, কাজের সব কৃতিত্ব তাঁরই, তাঁর কোনো কাজ নিয়েই প্রশ্ন বা আপত্তি তোলা যাবে না। নেতার সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক থাকে রহস্যাবৃত, যুক্তি-গর্হিত। এ রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠী প্রেরণার বশে নেতাকে অনুসরণ করে থাকে; যে প্রেরণার কোনো বৌদ্ধিক আধার থাকে না ।
হিটলার তার মাইন ক্যাম্প গ্রন্থে বিস্তর পৃষ্ঠা ব্যয় করেছেন নেতার প্রোপাগান্ডা বিষয়ে, তার সাংগাঠনিক তৎপরতা নিয়ে । তার মতে, নেতাকে তাত্ত্বিক বা পণ্ডিত হতে হবে না, তিনি হবেন ফলিত মনোবিজ্ঞানে পারদর্শী এবং একজন সংগঠক। প্রোপাগান্ডার ক্ষেত্রে কোন কৌশলকেই বাদ দেন নি। তাঁর মত, প্রোপাগান্ডাকে ছড়িয়ে দিতে হবে ‘শিশুর প্রথম পাঠ থেকে প্রতিদিনের সংবাদে, থিয়েটার থেকে চিত্রকলা প্রদর্শনীতে, প্রত্যেক বুলেটিন ও বিলবোর্ডে’ (‘মাইন ক্যাম্প’) । কৌশল হিসেবে উল্লেখ করেছেন, লিখিত যুক্তির পরিবর্তে ভাষণদানের কার্যকরতা, আলোর প্রভাব, আবহাওয়া, প্রতীক ও জনতার তাৎপর্য ।
চিন্তার একনায়কত্বকে সবল করতে ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রে সদা উপেক্ষিত ছিল চিন্তার বহুমুখিনতা। তাই ঘোষণা দিয়ে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল ২৫ হাজার বই । সেখানে লোক জমায়েত হয়েছিল ৪০ হাজার। বাজেয়াপ্ত বইয়ের মধ্যে ছিল সিগমুন্ড ফ্রয়েড, এরিখ মারিয়া রেমার্ক, ফ্রান্স কাফকার সমগ্র রচনা ।
মিথের অতিপ্রচারই, আর এ প্রচারে একটা জনগোষ্ঠীকে অপর করে তোলা, তাদের নির্বিচারে হত্যা, তাদের রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, বিরোধী মত মাত্রই অপাঙক্তেয়, দলনযোগ্য, এই তো চলেছে ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রে। তা ইতালিতেও হয়েছে, জর্মান দেশেও হয়েছে, চিলিতে হয়েছে, ভারতে হয়েছে, হচ্ছে । প্রত্যেক ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্র মূলত স্বভাবে পৌত্তলিক হয়ে ওঠে । নেতাকে বিগ্রহ করে প্রশস্তিবাক্যের ফুলঝুরি আদতে পৌত্তলিকতারই অন্তর্প্রকাশ ।
একটি ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্র তার টিকে থাকার জন্যই দেশজুড়ে ‘যুদ্ধাবস্থা’ জারি রাখে । গ্রামসি দেখিয়েছেন, ফ্যাসিবাদী শাসক কাজ করেন প্রবলতম রাষ্ট্রিক হেজিমনি নিয়ে, তাই রাষ্ট্রকে বুঝতে জনগণ বরাবরই প্রতারিত হয় । একটা ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্র মূলত গড়েই ওঠে, টিকে থাকে, দীর্ঘজীবী হয় মিথ বা কল্পাদর্শ ও প্রোপাগান্ডাকে ভিত্তি করে । ফ্যাসিবাদ যুক্তিহীনতাকেই প্রতিষ্ঠা করতে চা্য় । চায় প্রশস্তি, স্তাবক পরিবৃত দেশ । জনতা মাত্রই সেখানে অপর, গণতন্ত্র তার প্রবল প্রতিপক্ষ । জনতাকে অক্রিয় করে রাখা, অথবা তাদের ক্রীড়নক বানিয়ে রাখাই ফ্যাসিবাদী সংঘের যে কোন কর্মসূচির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ।