উচ্চাকাঙ্ক্ষী নির্মাতাদের প্রতি
জাপানের কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা আকিরা কুরোশাওয়ার (১৯১০-১৯৯৮) কাছে এক সাক্ষাৎকারপ্রার্থী জাপানের উৎসাহী নির্মাতাদের পক্ষ থেকে উপদেশ পেতে চাইলে কুরোশাওয়া যা বলেন, তারই অনুবাদ এটি। শুধু জাপান নয়, সারা পৃথিবীর সকল তরুণ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী চলচ্চিত্র নির্মাতাসহ চলচ্চিত্র উৎসাহী সকলের কাজে আসবে এই বিশ্বাস থেকে এই অনুবাদের প্রয়াস। অনুবাদ করেছেন সৌরভ চৌধুরী।
উচ্চাকাঙ্ক্ষী নির্মাতারা প্রায়ই আমার কাছে আসে। তাদের যে বিষয়টিতে আমি বেশ বেগ পাই তা হলো, তারা বলে “সিনেমা বানাতে বেশ বড় অংকের টাকা লাগে।”
সত্যিকার অর্থেই.. নির্মাতা হয়ে ওঠা খুবই কঠিন!
তোমাকে নানা জিনিস থেকে অভিজ্ঞতা নিতে হবে, শিখতে হবে আর এইটা এত সহজে হয়ে ওঠে না। তবে, সত্যিই যদি তুমি সিনেমা বানাইতে চাও তবে চিত্রনাট্য লেখো। তোমাদের প্রত্যেকের হাতে কলমে চিত্রনাট্য লেখা দরকার। এই কাজটা করে তুমি সিনেমার গঠন বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে শিখতে পারবা এবং জানতে পারবা সিনেমা আসলে কী জিনিস!… এইসব আমি তাদের বলি। কিন্তু তারা লেখে না। তারা লেখার কাজটাকে খুবই কঠিন মনে করে। এবং সত্যি বলতে, তাই-ই। স্ক্রিপ্ট লেখা একটা কঠিন কাজ। বালজাক (ফরাসি লেখক, চিত্রনাট্যকার, ১৭৯৯-১৮৫০) ঔপন্যাসিকসহ অন্যান্য লেখকদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, লেখার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এবং অপরিহার্য জিনিস হলো, লেখার মতো একটা ম্যাড়ম্যাড়ে কাজের মুখোমুখি হওয়ার ধৈর্য… প্রতিবারে অন্তত একটি করে শব্দ টানা লিখে যাওয়া। এই কাজটা সব লেখকের জন্যেই দরকার। আপনি যদি বালজাকের কাজের কলেবর খতিয়ে দেখেন, দেখবেন, এটা এক কথায় বিস্ময়কর; আমাদের এক জীবনে পড়ে শেষ করা সম্ভব না! তিনি কীভাবে লিখতেন জানেন? ব্যাপারটা কিন্তু খুবই ইন্টারেস্টিং! তাঁর মনে যাই আসতো, তাই তিনি টানা লিখে যেতেন এবং তৎক্ষণাৎ সেটা প্রিন্ট করতে পাঠিয়ে দিতেন। বড়জোর পাতাখানেক প্রিন্টেড কাগজ হতো। কাগজগুলো হাতে পাওয়ার পর যতক্ষণ না তার আসল লেখায় কিয়দাংশ বাকি থাকতো ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি মার্জিনে সংশোধন করে যেতেন।
তারপর তিনি সেই সংশোধিত লেখাটাই প্রকাশককে দিতেন। এইটা কাজের একটা ভালো উপায়। যদিও প্রকাশকের জন্য ব্যাপারটা কঠিন হতে পারে। তিনি (বালজাক) যে এত এত লেখা তৈরি করতে পেরেছেন, তা এই পদ্ধতির জন্য। এভাবে কাজ এগিয়ে নেয়া যেতে পারে। তবে সবচাইতে জরুরি জিনিস হইলো টানা অন্তত একটা করে শব্দ, ততক্ষণ পর্যন্ত লিখে যাওয়ার ধৈর্য্য অর্জন করা, যতক্ষণ না পূর্ণাঙ্গ লেখাটা দাঁড়ায়। অনেকেরই এই ধৈর্য্যের ঘাটতি আছে। যদি তুমি (উৎসাহী নির্মাতা) এতে একবার অভ্যস্ত হয়ে পড়ো, তবে নির্ঝঞ্ঝাটভাবে লিখে যেতে পারবে। চিত্রনাট্য লিখতে তোমার দরকার হবে কেবল কাগজ আর কলম।
লেখার কাজে যখন আমি আর নারুস (মিকিও নারুস, জাপানি চলচ্চিত্র নির্মাতা, ১৯০৫-১৯৬৯) কোনো সরাইখানায় থাকতাম। আমি প্রায়ই তার ঘরে যেতাম। দেখতাম তার টেবিলে কাগজ আর কলম। যে সব লেখা তার সব চাইতে চমকপ্রদ পাণ্ডুলিপি হয়ে ওঠে, মানে সে তখন যা লিখছিল, তা নিয়ে কথা বলতাম। এইটা বেশ মজার ঘটনা… সে কি লেখতেছে — আমি তা দেখতে চাইলে সে শুধু হালকা হাসতো। নারুস আসলে কিছু কিছু চরিত্র সম্পর্কে লিখতো। যারা, একটা ঘরে, কিছু একটা করছে। কেবলই কিছু করছে। কেবলই কিছু একটা। সুনির্দিষ্ট কিছু নয়। নারুসের ক্ষেত্রে সেইসব বর্ণনাই যথেষ্ট ছিল কারণ, তিনি নির্মাণের জন্য তৈরি ছিলেন। তার সুনির্দিষ্ট হওয়ার দরকার ছিল না । তার এই ‘কিছু একটা’র ধারণাটা ছিল বেশ মজার।
কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে লেখার এই ক্লান্তিকর কাজটিকেই তোমার প্রকৃতি বানিয়ে তুলতে হবে। যদি একবার লিখতে বসো এবং ধীরস্থিরভাবে সারাদিন লিখে যাও, তোমার খুব কষ্ট হলেও তুমি নিদেনপক্ষে ২/৩ পাতা লেখা তৈরি করতে পারবে। আর এভাবে চালিয়ে গেলে অবশেষে তুমি শ’খানেক পাতার লেখা তৈরি করতে পারবে। আমার মনে হয় আজকালকার ছেলেমেয়েরা এই কৌশল জানে না। তারা শুরু করে এবং তৎক্ষণাৎ শীর্ষে পৌঁছতে চায়। যদি তুমি মাউন্টেনে চড়তে চাও, তবে সবার আগে তোমাকে বলা হবে চূড়ার দিকে তাকিও না। তবে, যে পথ দিয়ে তুমি উপরে উঠছো তাতে দৃষ্টি রাখো। তোমাকে ধৈর্য সহকারে কেবলই একটার পর একটা পদক্ষেপ নিতে হবে। যদি তুমি চূড়ায় তাকিয়ে থাকো তবে হতাশ হয়ে পড়বে। আমার মনে হয় লেখার বেলায়ও এটা সত্যি।
কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে লেখার এই ক্লান্তিকর কাজটিকেই তোমার প্রকৃতি বানিয়ে তুলতে হবে। যদি একবার লিখতে বসো এবং ধীরস্থিরভাবে সারাদিন লিখে যাও, তোমার খুব কষ্ট হলেও তুমি নিদেনপক্ষে ২/৩ পাতা লেখা তৈরি করতে পারবে। আর এভাবে চালিয়ে গেলে অবশেষে তুমি শ’খানেক পাতার লেখা তৈরি করতে পারবে। আমার মনে হয় আজকালকার ছেলেমেয়েরা এই কৌশল জানে না। তারা শুরু করে এবং তৎক্ষণাৎ শীর্ষে পৌঁছতে চায়। যদি তুমি মাউন্টেনে চড়তে চাও, তবে সবার আগে তোমাকে বলা হবে চূড়ার দিকে তাকিও না। তবে, যে পথ দিয়ে তুমি উপরে উঠছো তাতে দৃষ্টি রাখো। তোমাকে ধৈর্য সহকারে কেবলই একটার পর একটা পদক্ষেপ নিতে হবে। যদি তুমি চূড়ায় তাকিয়ে থাকো তবে হতাশ হয়ে পড়বে। আমার মনে হয় লেখার বেলায়ও এটা সত্যি।
লেখার এই কাজটাতে তোমাকে অভ্যস্ত হতে হবে। কাজটাকে কষ্টকর না ভেবে এটাকে রুটিন মনে করে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, তবে, অধিকাংশই মাঝপথে হাল ছেড়ে দেয়। আমি আমার সহকারীদের বলি, তারা যদি একবার হাল ছেড়ে দেয় তবে এইরকম হতেই থাকবে। কারণ সেটাই অভ্যাসে পরিণত হয়। এবং তারা কাজকে কঠিন লাগামাত্র হাল ছেড়ে দিতে চাইবে। আমি তাদের নিয়ত লিখে যেতে বলি, যতক্ষণ পর্যন্ত তা কোনো এরকম শেষে না পৌঁছায়। ‘শেষ’ তা যেরকমই হোক-না-কেন। আমি বলি… হাল ছেড়ো না, এমনকি মাঝপথে — তা যদি বিস্তর কঠিনও হয়ে পড়ে। কিন্তু যখনই তাদের এইসব কঠিন মনে হয়, তারা হাত গুটিয়ে নেয়। তাছাড়া… আজকালকার ছেলেমেয়েরা বইপত্র পড়েনা। আমার মনে হয় না, তাদের কেউই রাশিয়ান সাহিত্য সম্পের্কে বিস্তর জানা শোনা রাখে। তাদের অন্তত কিছু নির্দিষ্ট পরিমাণ পড়ালেখা জরুরি। তোমার ভেতর থেকে যদি কোনো কিছুর পুনরাবৃত্তি না ঘটে তবে তুমি কিছুই সৃষ্টি করতে পারবে না। তাই আমি প্রায়ই বলি, ‘স্মৃতি থেকে সৃষ্টি হয়’।
স্মৃতি বা অভিজ্ঞতাই তোমার সৃজনকর্মের উৎস। শূন্য থেকে তুমি কিছুই সৃষ্টি করতে পারো না। তোমাকে পড়তে হয়, জানতে হয় বা স্বীয় অভিজ্ঞতা লব্ধ স্মৃতিকে কাজে লাগাতে হয়। তোমার ভেতর যদি কিছু না থাকে তবে, তুমি কিছুই সৃষ্টি করতে পারবে না। তাই সবসময় নানা রকম পঠন-পাঠন জরুরি। সাম্প্রতিক উপন্যাসগুলোও এর আওতায় পরে । আমার আরও মনে হয় তোমাদের ধ্রুপদী সাহিত্য পড়া দরকার।
অনুবাদের জন্য ধন্যবাদ। বিশ্বজ্ঞান এভাবেই বাংলায় প্রযেশ করুক।