একদিকে বাংলা সাহিত্যর প্রতি তীব্র অনুরাগ আর অন্য দিকে ভ্রমণের তীব্র নেশা এই দুই এর মেলবন্ধন যেখানে ঘটে সেই ভ্রমণপিয়াসী সাহিত্যানুরাগীদের বিচরণের জন্য তিনশ বছরের এই পুরনো শহরের বিকল্প যেন আর কিছুই হতে পারে না। হ্যাঁ, আমি কলকাতা শহরের কথাই বলছি। কবিগুরুর শহর, জীবনানন্দের শহর, শীর্ষেন্দু, সুনীল, সমরেশের শহর এই কলকাতা। তাই, এই শহরে ভ্রমণের ক্ষেত্রে কেমন যেন এক অদ্ভুত নস্টালজিয়া কাজ করে যা কলকাতার প্রতি মুগ্ধতার মাত্রা যেন বাড়িয়ে তোলে আরো কয়েক গুণ। থাক, লিখতে বসেছি ভ্রমণ কাহিনি , আবেগ অনুভূতির কথা না হয় অন্যখানে হবে। তবে প্রথমেই বলে রাখি অন্য ভ্রমণ কাহিনির থেকে এই লেখা টা একটু অন্য রকম ই হবে; কেননা কলকাতায় আমার যাওয়া হয়েছিল আমার জীবনের এমন একটা মুহুর্তে যেখানে জীবনে প্রথম বারের মতন সপরিবারে কোথাও দেশের বাইরে যাই। তাহলে বলা যায় এইটা আসলে মনে রাখার মত একটি ঘটনা।
যাত্রাপর্ব
২০১৮ সাল। জানুয়ারির বাইশ তারিখ কলকাতায় যাওয়ার জন্য টিকিট কাটি। খুব এক্সসাইডমেন্টের ছিল ব্যাপারখানা। স্বাভাবিক অবস্থা থেকে অস্বাভাবিক স্তরে ছিলাম। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে সকাল ৮:১৫ মিনিটে । তারপর তল্পিতল্পা নিয়ে উঠে পড়লাম ট্রেনে দাদাদের দেশের উদ্দেশ্যে। জীবনে প্রথম বারের মত ট্রেন এর দেশের বাইরে ভ্রমণ। এখনও ভাবলে ব্যাপারখানা বেশ চমৎকার লাগে। ’
হোটেল ব্যবস্থা
কলকাতা পৌঁছানোর পর থাকার ব্যবস্থা বা হোটেল নির্বাচন নিয়ে সবার উদ্বেগ থাকে। আপনি হয়ত স্বাভাবিকভাবেই মনে করবেন, নিউমার্কেটের আশেপাশে যে হোটেলগুলো আছে, তার একটাতে উঠে পড়ি। প্রথম দিকে আমিও তাই করেছি। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হলো, নিউমার্কেটের আশেপাশে না থেকে একটু ভেতরের দিকে হোটেল নির্বাচন করা। কারণ নিউমার্কেটের আশেপাশে মানে মার্কুইস বা সাদ্দার স্ট্রিট বা এর কাছাকাছি হোটেলগুলোতে অসম্ভব চাপ থাকে সারা বছর৷ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হোটেল বুকিঙের ক্ষেত্রে ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়। তাই আমার মতে, নিউমার্কেটের থেকে কিছুটা দূরে থাকুন।
একই পয়সায় অনেক ভাল হোটেল পাবেন। আগোডাতে বা বুকিং ডট কমে একটু খুঁজে দেখতে পারেন৷ অনেক ভাল হোটেল কাছাকাছি দামে পেয়ে যাবেন। সাদ্দার স্ট্রিটে (অনেকে সদর স্ট্রিটও বলেন) ‘গোল্ডেন এপেল’ কিংবা পার্ক স্ট্রিটের পার্ক হোটেলে থাকতে পারেন। একটি তিন অথবা চার তারকা হোটেলে থাকা আপনার পুরো ভ্রমণটাকে অনেক আরামদায়ক করে দিতে পারে। রাফি আহমেদ কিদওয়ায়ি রোডেও অনেকগুলো ভাল ভাল হোটেল আছে। এইসব এলাকার সুবিধে হচ্ছে ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে শান্তিতে থাকতে পারবেন। পার্ক হোটেল থেকে রাসেল স্ট্রিটের মোড়ে হেঁটে যেতে দু’মিনিট। এরপর টানা রিকশা বা অটোতে চেপে যান না আপনার নিউমার্কেট।
যাতায়াত
অনেকেই একটা সমস্যার কথা বলেন কলকাতায়। সেটা হলো অত্যধিক ট্যাক্সি ভাড়া। আর অপরদিকে ট্রাম বা বাসের রুট আমাদের জানা নেই। এজন্য সবচেয়ে সহজ সমাধান হচ্ছে উবার। এখানকার উবার চালকেরা কাজের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের পরিচয় দেয়। চাইলেই পাওয়া যায় যেকোনো জায়গায়, যেকোনো সময়। এসি উবারের ভাড়া হলুদ নন-এসি এম্বাসেডরের থেকেও কম। এছাড়া কলকাতার মেট্রো দারুণ একটা জিনিস। অনেক দূরে যেতে পারবেন স্বল্প খরচ আর অল্প সময়ে।
নতুন ভ্রমণকারীরা কারেন্সি ভাঙানোর জন্য অনেক সময় বিপাকে পড়ে যায়। অনেক জায়গা আছে, তবে সাদ্দার স্ট্রিটের দোকানগুলোই সম্ভবত সবচেয়ে ভাল রেট দেয়। ডলার এবং বাংলাদেশি টাকা- দুটোই ভাঙ্গাতে পারবেন।
ভ্রমণ পর্ব
দু’শ বছরের পুরনো জব চার্নকের শহরের প্রতিটি অলিতেগলিতে ইতিহাস আক্ষরিক অর্থেই লেপটে আছে। আর এখানেই কোলকাতার মূল আকর্ষণ। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে এমন কয়েকটা জায়গায় যেতে পারেন। যেমন :মার্বেল প্যালেস, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, পার্ক স্ট্রিটে কুইন্স ম্যানসন, কলেজস্ট্রিট, কফি হাউজ, হাওড়া ব্রিজ, এসপ্ল্যানেড। আমি বেলুড়, দিঘা, ডায়মন্ড হার্বার, শান্তিনিকেতন — এসব জায়গায় যাইনি। কালীঘাটেও নয়। তবে ইচ্ছে আছে সামনের দিনগুলোতে যাব। এছাড়া আরও আছে অসংখ্য রোড, স্ট্রিট আর লেনের ছড়াছড়ি।
ইতিহাস আর গল্প সাহিত্যের অসংখ্য চরিত্রের স্মৃতিচারণ করা যায় কলকাতা শহরের অলিতে গলিতে। হ্যারিসন রোডে ব্যোমকেশ আর অজিত থাকত। মট লেনে তারানাথ তান্ত্রিক। কলেজস্ট্রিট তো শিক্ষার তীর্থ। কী নেই এখানে? প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত কলেজ, হিন্দু কলেজ, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ। এই এক জায়গাতেই আপনি সবই পাবেন। যখন হেঁটে যাবেন দু’ধারে বইয়ের দোকানগুলোকে রেখে, মনে হবে আপনি ইতিহাসে অধ্যায় পেরুচ্ছেন। আরও আছে বড়বাজার, বউবাজার, ইত্যাদি।
এছাড়া আছে বিখ্যাত পার্ক স্ট্রিট, যার সরকারি নাম ‘মাদার টেরিজা সরণি’। কিন্তু পার্ক স্ট্রিট নামেই এর বেশি পরিচয়। পার্ক স্ট্রিট সেমিট্রি হলো বিশ্বের প্রাচীনতম নন-চার্চ সেমিট্রিগুলির একটি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সম্ভবত এটিই ছিল ইউরোপ ও আমেরিকার বাইরে বিশ্বের বৃহত্তম খ্রিস্টান কবরখানা। তখন এর নাম ছিল ‘বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড’। পরে নাম দেয়া হয় পার্ক স্ট্রিট। এই পার্ক স্ট্রিট নামটা এসেছে সতের শতকের ইংরেজ চীফ জাস্টিস স্যার এলিজাহ’র ডিয়ার পার্ক ছিল এখানে। সেখান থেকেই পার্ক স্ট্রিট।
বাচ্চাদের ঘুরাঘুরির জন্য সবচেয়ে মোক্ষম জায়গা হচ্ছে সাইন্স সিটি। সারাদিন না-হোক, তিন-চার ঘণ্টা তো অনায়াসেই কেটে যাবে। কেবল কারে চড়ে একটার পর একটা বিল্ডিং ঘুরে দেখানো যায় বাচ্চাদের। এছাড়া যেতে পারেন বিড়লা প্ল্যানেটরেইয়ামে। সবকিছু ফোনে ঠিক করার পরেও গিয়ে দেখি রুম নেই, এবং চাহিদা বেশি হওয়ায় আপনি চাইলেও সহজেই আরেকটা মানসম্মত হোটেল খুঁজে পাবেন না।
সন্ধ্যার আগেই একটা ট্যাক্সি ডেকে চলে যেতে পারেন মিলেনিয়াম পার্ক। গঙার ধারে এই জায়গাটা থেকে আপনি হাওড়া ব্রিজ দেখতে পাবেন। এত সুন্দর একটা জায়গা, যা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। এরপর আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামবে।