অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফি অত্যন্ত উঁচু মাপের মানুষ। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে। তাঁর অনেক উক্তি বা কথা প্রবাদের মতো। তার কয়েক টুকরো কথা।
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের নির্ভীক ক্রিকেটার যাঁর নাম ক্রিকেটপ্রেমী জনতা আজীবন মনে রাখবে। মাশরাফি বিন মর্তুজা যার ক্রিকেটীয় পরিসংখ্যানের চেয়ে ক্রিকেট অধিনায়কত্বের মূলমন্ত্র বেশি কথা বলে। নেতৃত্বে মাশরাফি মানেই যেন ওডিআই ক্রিকেটে আরেকটি নতুন বিজয়ী সৃষ্টি। সকল ক্রিকেটীয় গুণ তার মধ্যে থাকলেও নেতৃত্ব দানের ক্ষেত্রে তার যাদুকরী শক্তি আছে, যা অন্যদের থেকে একটু আলাদা।
বাংলার ক্রিকেটকে ভালোবেসে এগারোটি সেলাই নিয়ে খেলেছেন দীর্ঘ সময়। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সেরা বোলিং স্তম্ভ ও একদিনের আন্তর্জাতিকে দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি একজন ডানহাতি ব্যাটসম্যান। তার বোলিংয়ের ধরন ডানহাতি পেস বোলার। বাংলাদেশ জাতীয় দল ছাড়াও তিনি এশিয়ান একাদশের একদিনের আন্তর্জাতিক দলে খেলেছেন। ২০০৭ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে অবিস্মরণীয় জয়ে মর্তুজা ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ৩৮ রানে ৪ উইকেট দখল করেন।
বিশ্বকাপের প্রস্তুতি খেলায় নিউজিল্যান্ডের সাথে বিজয়েও মাশরাফির ভূমিকা রয়েছে। মাশরাফি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ গতির বোলার এবং সমর্থকদের কাছে “নড়াইল এক্সপ্রেস” নামে পরিচিত। মাশরাফি একজন মারকুটে ব্যাটসম্যান। ভারতের বিপক্ষে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় একদিনের আন্তর্জাতিক খেলায় তিনি পরপর চার বলে ছক্কা পেটান। সেই ওভার থেকে তিনি ২৬ রান সংগ্রহ করেন যা কোন বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানের জন্য এক ওভারে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। ১৪ বছরের ক্যারিয়ারে ১১ বার চোটের কারণে দলের বাইরে যেতে হয়েছে মাশরাফিকে। চোটই তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল ২০১১ সালের দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ। চোটের কারণে অপারেশন টেবিলে তাকে যেতে হয়েছে সাতবার। এসব ক্রিকেটের পরিসংখ্যান নিয়ে আজ কথা না বলে ম্যাশের কিছু উক্তি যা ক্রিকেটের শক্তি ছাড়াও তাকে অন্য উচ্চতায় নিয়েছে; দেখা যাক মাশরাফির কথার শক্তি :
১. আমি জানি না, আমি কতদিন এইদলের সাথে আমার খেলা চালিয়ে যেতে পারবো। তবে আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি—যখন আমি বুঝতে পারবো আমার দক্ষতা এবং ইচ্ছাশক্তি কমে আসছে, তখন আমি নিজে থেকেই সরে যাবো।
২. আমি বলি, এই যারা ক্রিকেটে দেশপ্রেম দেশপ্রেম বলে চিৎকার করে, এরা সবাই যদি একদিন রাস্তায় কলার খোসা ফেলা বন্ধ করত, একটা দিন রাস্তায় থুতু না ফেলত বা একটা দিন ট্রাফিক আইন মানত, দেশ বদলে যেত। এই এনার্জি ক্রিকেটের পেছনে ব্যয় না করে নিজের কাজটা যদি সততার সঙ্গে একটা দিনও সবাই মানে, সেটাই হয় দেশপ্রেম দেখানো।
৩. আমি ক্রিকেটার, একটা জীবন কি বাঁচাতে পারি? একজন ডাক্তার পারেন। কই, দেশের সবচেয়ে ভালো ডাক্তারের নামে কেউ তো একটা হাততালি দেয় না! তাদের নিয়ে মিথ তৈরি করুন, তারা আরও পাঁচজনের জীবন বাঁচাবেন। তারাই তারকা। তারকা হলেন লেবাররা, দেশ গড়ে ফেলছেন। ক্রিকেট দিয়ে আমরা কি বানাতে পারছি? একটা ইটও কি ক্রিকেট দিয়ে বানানো যায়? একটা ধান জন্মায় ক্রিকেট মাঠে? যারা ইট দিয়ে দালান বানায়, কারখানায় ওটা-ওটা বানায় বা ক্ষেতে ধান জন্মায়, তারকা হলেন তারা।
৪. আহ! একটা নাভিশ্বাস ওঠা জীবন। তৃতীয় ম্যাচ শেষে আমি হঠাৎ করে অনুভব করি ঈদ চলে এসেছে এবং আমি আমার চমৎকার নিজের শহরটিতে ঈদ করতে যাচ্ছি। আমাদের প্রত্যেকেরই নিজের একটি স্বস্তির জায়গা আছে। কিছুলোক হয়তো বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে জায়গাটি আমার নিজের বাড়ি। এটি আমাকে নতুন করে পুরোনো শক্তিতে উজ্জীবিত করে।
৫. রান না করলে মরবি না। ব্যাটিং কর। এটা জীবন না, খেলা।
৬. তামিম যখন ব্রোকেন ফিঙ্গার নিয়ে নেমেছিল তখনই আমি এশিয়া কাপ জিতে নিয়েছি।
৭. ক্রিকেটাররা নন, চিকিৎসক-শ্রমিক-কৃষকরাই হচ্ছেন প্রকৃত তারকা।
৮. পা দুটো বেইমানি করলেও ঘাড়ের রগ বাঁকা করে চ্যালেঞ্জ করবো নিজেকেই। শুধু একটা বল করতে চাই বাংলাদেশের হয়ে।
৯. আমি মাশরাফিও যদি পারফর্ম না করি, তাহলে সরে যেতে হবে। দেশের হয়ে খেলতে নামলে, দেশের পতাকাকে প্রতিনিধিত্ব করলে জবাবদিহিতা থাকতেই হবে। ১৬ কোটি মানুষ খেলা দেখছে, ১৬ কোটি মানুষেরই জাজমেন্ট আছে। সেটাকে মূল্য দিতে হবেই।
১০. আজ কিছু কথা পরিষ্কার করে বলি। আমরা সবাইকে বিনোদন দেই।
১১. আমরা প্রকৃত অর্থে বীর নই। আমাদের সত্যিকার বীর হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা। আমরা দেশের জন্য কোন কিছু বিসর্জন দিই নি, মুক্তিযোদ্ধারা দিয়েছেন। আমাকে ভূল বুঝবেননা—ক্রিকেট কিন্তু জীবনের সবকিছু নয়। আমরা শুধুমাত্র চেষ্টা করি আমাদের দেশের মানুষকে খুশী করতে।
১২. আমি আপনাকে এখন বলতে পারি তামিম একদিন ১০,০০০ রান করবে, সাকিব করবে ১০,০০০ রান, সাথে থাকবে ৪০০ উইকেট, মুস্তাফিজের থাকবে ৪০০ উইকেট এবং সৌম্যের ১০,০০০ রান। বাংলাদেশ সামনের দশ বছরে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক আন্তর্জাতিক মানের প্লেয়ার বের করবে, যদি না টাকার মোহযুক্ত টি টুয়েন্টি লিগগুলো সবাইকে আচ্ছন্ন না করে।
১৩. আমি সবাইকে অনুরোধ করবো খুব বেশি উত্তেজিত না হতে। আমাদের উচিৎ আমাদের প্রতিপক্ষকে সম্মান করা। একইসাথে আমাদের পরাজয়গুলোকে খুব রূঢ়ভাবে না নেওয়া। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র ধৈর্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি যে দলটি এখন উন্নতি করছে দুই বা তিন বছর পরে এই দলটি পেশাদারিত্বের পরিচয় দিবে।
১৪. রবাংলাদেশের হয়ে টানা ১০০ ম্যাচ জিতলেও, তার পরের ম্যাচের জন্য জেতার তাগিদ একই থাকবে. তৃতীয় ম্যাচে তাই ছাড় দেয়ার প্রশ্নই উঠে না।
১৫. দেশের তুলনায় ক্রিকেট অতি ক্ষুদ্র একটা ব্যাপার। একটা দেশের অনেক ছোট ছোট মাধ্যমের একটা হতে পারে খেলাধুলা; তার একটা অংশ ক্রিকেট। ক্রিকেট কখনও দেশপ্রেমের প্রতীক হতে পারে না। সোজা কথায় খেলাধুলা হলো বিনোদন।
১৬. আমার ২০০ উইকেট নিয়ে আমি যদি আরো ১০০ টি ম্যাচ খেলতে পারতাম তাহলে আমি আরও গুরুত্বপূর্ণ বোলার হতে পারতাম। সম্ভবত আমাকে নিয়ে সবাই অনেক গর্বিত হত যদি আমি ৩০০ অথবা ৩৫০ উইকেট শিকারী কোন বোলার হতাম। আমি বিশ্বাস করি আমার দীর্ঘ সময় ধরে খেলার সামর্থ আছে, কিন্তু যদিও আমি বাংলাদেশের হয়ে ১৪ বছর ধরে খেলছি, তবুও আমি তিন থেকে চার বছর হারিয়েছি ইনজুরির কারণে।
১৭. কেউ যদি সত্যিকার অর্থে খেলা বোঝে তাহলে অবশ্যই তারা স্বীকার করবে গত কয়েক মাসে আমরা অসাধারণ কিছু সময় পার করেছি। এবং আমার দৃষ্টিকোণ থেকে এটি বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য অনেক বড় একটি অর্জন, বিশেষ করে ২০১৫ সালটি। আমাদের কাছে—একদিনের ক্রিকেট, গত আট মাস ছিলো একটি স্বপ্নের মত, আমরাই এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছি।
১৮. রকিবুল ভাই ব্যাটে জয় বাংলা লিখে খেলতে নেমেছিলেন, অনেক বড় কাজ। তার চেয়েও বড় কাজ, বাবার বন্দুক নিয়ে ফ্রন্টে চলে গিয়েছিলেন। শহীদ জুয়েল ক্রিকেট রেখে ক্র্যাক প্লাটুনে যোগ দিয়েছিলেন। এটাই হলো বীরত্ব। ফাস্ট বোলিং সামলানার মধ্যে রোমান্টিসিজম আছে, ডিউটি আছে। বীরত্ব নেই।