ফাহমিদুল হক — ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক, গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও গল্পকার। যোগাযোগ নামক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। সমকালীন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ চিন্তকদের একজন তিনি। আমরা আলাপ করেছি তাঁর সঙ্গে। এই সময়ের বাংলাদেশকে চিনে নেবার জন্য এই আলাপ অত্যন্ত জরুরি। আজ থাকছে তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের শেষ কিস্তি।
সহজিয়া : যদি বলি, টিভি হারিয়ে যাবে সিনেমা হলও হারিয়ে যাবে অচিরেই। বাংলাদেশে তো হারিয়ে গেছেই। কারণ ঘরে বসেই পছন্দসই মুভি দেখা যাচ্ছে। যেমন করে ঘরে ঢুকে যাচ্ছে পছন্দসই হোটেলের খাবার, বিখ্যাত ব্র্যান্ডের জুতো-জামা। ঘরের একটি দেয়ালই হয়ে উঠতে পারে বিশাল পর্দা সাজানো সিনেমার পর্দা বা টিভির পর্দা। ভালো একটা স্ক্রিন হলে, ভালো একটা মনিটর হলেই চলবে। আশি-নব্বইয়ের দশকে ভিসিপি, ভিসিআর ছিল, এরপর সিডি-ডিভিডি এলো এবং হারিয়ে গেলো। টিভির ভবিষ্যত নিয়ে অনেকের এই শঙ্কিত ভাবনাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ফাহমিদুল : সাধারণত নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাবে পরিবর্তন ঘটে। তবে কিছু কিছু প্রযুক্তির প্রভাব হয় ক্ষণস্থায়ী। যেমন ইন্টারনেটের আগে ভিডিওটেক্সট ও টেলিটেক্সট প্রযুক্তি এসেছিল, কিন্তু সেটার কথা ভুলে গেছে মানুষ। কিছু কিছু প্রযুক্তির প্রভাব হয় দীর্ঘস্থায়ী, কিছু প্রযুক্তির প্রভাব বেশ নাটকীয় হয়। সংবাদপত্র একাই দাপট দেখিয়েছে কয়েক শতক। কিন্তু রেডিওর দাপট কমে আসতে কয়েক দশক লেগেছে মাত্র। বিশের বা তিরিশের দশকে রেডিওর যে দাপট ছিল ষাটের দশকের মধ্যেই টিভির আবির্ভাবে তা কমে আসে। তবে দাপট কমলেও প্রত্যেকেই নানান রূপে টিকে আছে। টিভির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকতে চলচ্চিত্র তার গরিমা বাড়ানোর জন্য কত কিছু করেছে – সিনেমাস্কোপ, ডলবি সাউন্ড, ডিজিটাল সাউন্ড, থ্রিডি ইত্যাদি। ক্যামেরা দিয়ে এখনও চলচ্চিত্র নির্মিত হয় কিন্তু তার পরিবেশনের নতুন নতুন ধরন তৈরী হয়েছে। এগুলো প্রত্যেকটিই পরীক্ষিত মাধ্যম – কেউ টেক্সটকে, কেউ অডিওকে, কেউ ভিজুয়ালকে রেপ্রিজেন্টে করে। ফলে এগুলো থাকবে, কিন্তু এগুলো উৎপাদন ও পরিবেশনে পরিবর্তন আসছে বা আসবে। আগেই বলেছি সময়টা এখন কনভার্জেন্সের এবং কন্টেন্টের রূপ হবে মাল্টিমিডিয়ার। কোনো একটি বিশেষ মাধ্যমের জন্য হাহাকার বা বিরহানুভূতি খুব বেশি কাজে আসবে না এক্ষেত্রে। আরেকটি কথা বলার বিষয়, একসময় উন্নত দেশ থেকে আমাদের দেশে প্রযুক্তির স্থানান্তর হতো খুব বিলম্বে, কিন্তু এখন দ্রুত হয়। আর আমাদের দেশে এক প্রযুক্তি বর্জন করে নতুন কিছুকে গ্রহণের প্রবণতা প্রযুক্তির স্রষ্টা-দেশের চাইতে বেশি বা দ্রুত হয়ে থাকে। আমেরিকায় এখনও ডিভিডি মোটামুটি নিয়মিত বিক্রি হয়, ভিএইচএস ক্যাসেট পুরনো জিনিসের দোকান থেকে আমি নিজেই সংগ্রহ করেছি, এমনকি বইয়ের দোকান খুঁজে পেয়েছি, যেখানে লংপ্লে বিক্রি হচ্ছে।
সহজিয়া : বাংলাদেশে গণমাধ্যম অধ্যয়ন ও গবেষণা বিশেষ কোনো তাত্ত্বিক অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে? যেমন ধরা যাক, ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল, স্টুয়ার্ট হলের সাংস্কৃতিক অধ্যয়নকেন্দ্রিক ভাবনা কিংবা চমস্কির প্রচারণা মডেল — এ ধরনের কোনো নতুন ঘরানা তৈরি করতে পেরেছে? কারণ অনেক অনেক অ্যাকাডেমিক ও নন-অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্র আছে গণমাধ্যম বিষয়ক চর্চার। সাম্প্রতিক গণমাধ্যম অধ্যয়নে চিন্তার অভিনবত্ব কী?
ফাহমিদুল : না না, তার সুযোগ নেই। আমাদের একাডিময়াগুলো এত বেশি পশ্চাৎপদ যে গণমাধ্যম অধ্যয়নের মূল বিষয়গুলো বুঝতে বুঝতে অনেক দেরী হয়ে যায়, ততেদিনে পশ্চিমা একাডিমায় আরো অনেক এগিয়ে যায়। একেবারে অরিজিনাল চিন্তা করেছেন যারা, যেমন আমাদের দেশে লালন ফকির, তারা একাডিময়ার বাইরের। একাডেমিয়া আমাদের সারা দুনিয়ার মৌলিক চিন্তাগুলোই এভেইলএবল করতে অক্ষম, বা খানিকটা তা করতে পারলেও একাডেমিক পরিবেশ উপহার দিতে অক্ষম। আর সমাজেও কিন্তু জ্ঞানের চাহিদা নাই। মোহাম্মদ আজম বলেন, আমাদের সমাজ জ্ঞানভিত্তিক সমাজ না। ফলে সমাজ থেকে দাবিই নাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। ঢাকায় আমাদের বিভাগে অধ্যাপক আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের কথা বলতেন, কিন্তু তিনি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু প্রডিউস করেন নি। রাজশাহীতে নিউটন ভাই বা আমরা চমস্কি চর্চা করলাম, বাংলাদেশের কনটেক্সটে কিছু লেখার চেষ্টা করলাম। মামুন ম্যানুফেকচারিং কনসেন্ট অনুবাদ করলো। আমি স্টুয়ার্ট হল অনুবাদ করলাম। এগুলো হয়তো কাজের কাজ, কিন্তু মৌলিক কাজ না। আমরা হয়তো প্রথমবারের মতো ধারাবাহিকভাবে যোগাযোগের পলিটিকাল ইকোনমি ও কালচারাল স্টাডিজের তত্ত্বগুলো অনুবাদ বা পর্যালোচনাই করিনি, বাংলাদেশের কনেটেক্সটে গবেষণাও করেছি। কিন্তু সেগুলো মৌলিক কাজ হয় নি। একধরনের পশ্চিমের ধারণাগুলোকে আমাদের দেশে ট্রান্সলেশন বা ট্রানলিটারেশন করেছি। আমরা কোনো ঘরানা তৈরি করি নি, যাকে নতুন ধারণা হিসেবে বর্ণনা করা যায়। ঢাকা বা বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর খুব ফাঁপা ও সারাৎসারহীন – আমি নিজেকে দিয়েই এটা বুঝি। যে পরিমাণ কম কন্ট্রিবিউট করে যে-পরিমাণ অ্যাপ্রিসিয়েশন আমি পেয়েছি, তাতেই বোঝা যায় এখানকার বুদ্ধিবৃত্তির বহর কতটুকু!
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এখন নতুন গবেষণা ও তত্ত্বচর্চা হচ্ছে অনেকখানিই নিউ মিডিয়াকে ঘিরে।
সহজিয়া : আপনি স্টুয়ার্ট হলের ‘‘রেপ্রিজেন্টেশন’’ অংশটি অনুবাদ করেছেন। গণমাধ্যম বোঝার ক্ষেত্রে হল কেন গুরুত্বপূর্ণ? বাংলাদেশে মিডিয়া অধ্যয়নের ক্ষেত্রে প্রয়াত এই পণ্ডিত কতোটা প্রভাব ফেলেছেন?
ফাহমিদুল : রেপ্রিজেন্টেশন নিয়ে বাংলা ভাষায় প্রথম দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন রেহনুমা আহমেদ, সাইফুল হক অমির কাউন্টার ফটো পত্রিকায়। সেখানে তিনি স্টুয়ার্ট হলের রেপ্রিজেন্টেশন ধারণাকে বিস্তৃতভাবেই আলোচনা করেছিলেন। এরপর যোগাযোগের অন্যতম সম্পাদক আ-আল মামুন আমাকে বলেন যে আপনি হলের টেক্সট অনুবাদ করেন। আমি সেই কষ্টকর কাজটা করি যা আমাদের রেপ্রিজেন্টেশন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ওই সংখ্যাটি ঢাকার বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে সাড়া ফেলে এবং আমাদের পত্রিকার পরিচিতি বৃদ্ধি পায়। এর কয়েক বছর পরে আমি অনুবাদটিকে বই আকারে বের করার উদ্যোগ নেই। অনুবাদটি বই করার আগে দ্বিতীয় দফায় ব্যাপকভাবে পরিমার্জনা করি বা বলা যায় অনুবাদের উৎকর্ষ বৃদ্ধির চেষ্টা করি। কারণ অনুবাদটি নিয়ে অনেক লিখিত বা অলিখিত মন্তব্য ও সমালোচনা আমি পেয়েছিলাম।
পত্রিকার অনুবাদের পর থেকেই দেখেছি, রেপ্রিজেন্টেশন নিয়ে প্রচুর কাজ হয়েছে, বিশেষত একাডেমিয়ায়। আমার নিজের পিএইচডির কাজটিই স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্রে জাতীয়তাবাদের রেপ্রিজেন্টেশন নিয়ে। অনুবাদ আর পিএইচডি গবেষণা পাশাপাশিই চলেছিল। পরে দেখা গেছে শিক্ষার্থীরা প্রচুর থিসিস প্রস্তাব দিচ্ছে, শিরোনামে রয়েছে ‘রেপ্রিজেন্টেশন’ শব্দটি। সহকর্মী গীতি আরা নাসরীন একবার বলেছিলেন, “কী এক অনুবাদ করলে, স্টুডেন্টরা এর বাইরে ভাবতেই পারছে না।’’ আমারও মনে হয়েছে অনেকে বুঝে এবং অনেকে না বুঝে এই ধারায় কাজ করতে চাচ্ছে। বলা যায়, এই প্রয়াত পণ্ডিত বাংলাদেশের মিডিয়া অধ্যয়নে খানিকটা প্রভাব রেখেছেন।
স্টুয়ার্ট হল বা রেপ্রিজেন্টেশন কেবল প্রচলিত অর্থে গণমাধ্যম নয়, যেকোনো মাধ্যমকে বুঝতেই বেশ কার্যকর। আমরা আশপাশে যা দেখি তা বাস্তবতার হুবহু প্রতিরূপ বা প্রেজেন্টেশন নয়, একে পরিবেশনের সময় রি-প্রেজেন্ট করা হয়। অনেক সময় তা ইচ্ছাকৃত থাকে, যা বোঝাও যায়। অনেকসময় তা নির্মাণ আকারে থাকে, যা সহজে বোঝা যায় না। এসব তত্ত্বায়ন করতে গিয়েই হল, সস্যুর বা বার্থ বা পার্সের কাঠামোবাদী ভাষাতত্ত্ব বা ফুকোর উত্তর-কাঠামোবাদী ডিসকোর্সের ধারণাকে ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে তার নিজস্ব রেপ্রিজেন্টেশনের ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। ফলে মিডিয়া বা সংস্কৃতি অধ্যয়নে রেপ্রিজেন্টেশন অনেক কার্য়কর।
সহজিয়া : সাম্প্রতিক গণমাধ্যম অধ্যয়নের ক্ষেত্রে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের প্রাসঙ্গিকতা কেমন মনে হয় আপনার কাছে? বিশেষ করে ‘‘কালচার ইন্ডাস্ট্রি’’র ধারণাটি এখনও প্রাসঙ্গিক নয় কি?
ফাহমিদুল : কালচার ইন্ডাস্ট্রি ধারণাটি দিয়েছিলেন জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের অ্যাডর্নো ও হর্কহেইমার। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে মিডিয়ার ব্যাপক প্রসার দেখে তাদের ধারণাটি পোক্ত হয়। চলচ্চিত্র বা টেলিভিশন কারখানা হলো একেকটি সংস্কৃতি কারখানা এবং এগুলো প্রতিনিয়ত গণসংস্কৃতি বা ম্যাস কালচার উৎপাদন করে যায়। এর ভোক্তা সাধারনণ জনগণ সস্তা বিনোদনে বুঁদ হয়ে থাকে, সমাজের প্রকৃত সমস্যাগুলো থেকে এভাবে দূরে রাখা সম্ভব হয় এবং জনগণের যূথবদ্ধভাবে সমাজ পরিবর্তনের লড়াই এভাবে আরো দূরে সরে যায়। পুঁজিবাদী শ্রেণি নিজেদের স্বার্থেই বা বিপ্লবকে দূরে সরিয়ে দিতেই সংস্কৃতি কারখানার মাধ্যমে গণসংস্কৃতি চালু করেছে।
এই বাস্তবতা একইরকম আছে, ফলে সংস্কৃতি কারখানার ধারণা এখনও প্রাসঙ্গিক এবং মিডিয়া সংস্কৃতি বোঝার জন্য সহায়ক। তবে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলেরই ওয়াল্টার বেঞ্জামিন বা ব্রিটিশ কালচারাল স্টাডিজের উইলিয়ামস-হগার্ট-হলরা বিষয়টা একটু ভিন্নভাবে দেখেন। উভয় দলই মার্কসিস্ট, কিন্তু প্রথম দল বেইজ ধরে কথা বলছেন, আর পরের দল সুপারস্ট্রাকচার নিয়ে। বেঞ্জামিন বলছেন মিডিয়ার কারিগরি পুনরুৎপাদনের মধ্য দিয়ে আসলে শিল্পকলার মহিমা বা অরা হারিয়ে যায়। হাই কালচারের আধিপত্য তাতে কমে। শিল্পকলার প্রতিলিপি বা পুনরুৎপাদিত কপি সাধারণ্যের হাতে পৌঁছে যায়, এতে শিল্পকলার গণতন্ত্রায়ন হয়। আবার কালচারাল স্টাডিজের পণ্ডিতেরা কাজ করেন মূলত জনসংস্কৃতি বা পপুলার কালচার নিয়ে, যা অ্যাডর্নোদের কাছে ছিল ম্যাস কালচার বা গণসংস্কৃতি। তারাও বলছেন, হাই কালচারের দাপটের বিপরীতে পপুলার কালচার হয় সাধারণ্যের আত্মপরিচয় খোঁজার ক্ষেত্র। জনপ্রিয় গান বা চলচ্চিত্র হয় তাদের জন্য সাংস্কৃতিক আশ্রয়।
সহজিয়া : সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিষয়বস্তুর দিক থেকে অনেক ক্ষেত্রেই কাছাকাছি ধরনের। কারণ উভয় জ্ঞানশাখা লোকপ্রিয়, অতিপ্রচারিত বিষয় ও মাধ্যম নিয়ে কাজ করে। কোন বিন্দুতে এসে দুটিকে আলাদা করবেন?
ফাহমিদুল : একটু আগেই বলেছি গণমাধ্যমের রাজনৈতিক অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন উভয়েই মার্কসপ্রভাবিত (গণমাধ্যম অধ্যয়নের আরও অন্য শাখা আছে, সেগুলো সব মার্কসপ্রভাবিতও নয়), তবে তাদের অনুসন্ধানের পদ্ধতি আলাদা। উভয়েরই লক্ষ্য সত্য অনুসন্ধান, মাধ্যম ও অডিয়েন্সের সম্পর্ক বা সুনির্দিষ্টভাবে বললে ক্ষমতাসম্পর্ককে বুঝতে চায়। তবে একদল একেবারে ভিত্তিমূলে অনুসন্ধান করে, মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের মালিকানার ধরন, পুঁজিবাদী শ্রেণির সঙ্গে সম্পর্ক এবং কনেন্টে তার প্রভাব ইত্যাদি বুঝতে চায়। আর সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন উপরিকাঠামোর আধেয় নিয়ে বিশ্লেষণ করে – কন্টেন্টকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তার চিহ্নগুলো, তার ফ্রেমিং, তার ডিসকোর্স, তার মনঃসমীক্ষণ ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে। রাজনৈতিক-অর্থনীতি অনেক বেশি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধ্যয়নে তাত্ত্বিক মনোভঙ্গিটি বেশি প্রকাশিত। সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন কাজ করে ’সস্তা জনপ্রিয় সংস্কৃতি’ নিয়ে, কিন্তু তাত্ত্বিকতার কারণে তাকে বেশি জটিল মনে হতে পারে।
সহজিয়া : সিনেমা নিয়ে আপনার বেশ কিছু কাজ আছে। উচ্চতর গবেষণাও সিনেমা নিয়ে। গণমাধ্যমের অন্য শাখাগুলো থেকে ফিল্ম বেছে নেয়ার কারণ কী?
ফাহমিদুল : শৈশব থেকেই চলচ্চিত্র আমাকে খুব টানতো। চলচ্চিত্রের রূপালি পর্দায় চরিত্রের মিথস্ক্রিয়া বা ঘটনার বিন্যাস আমাকে মোহাচ্ছন্ন করে ফেলতো। জনপ্রিয় চলচ্চিত্র দেখতে দেখতে আমি ঢাকায় এসে দেশবিদেশের শিল্পসম্মত চলচ্চিত্রের সন্ধান পাই। ফলে চলচ্চিত্রের শিল্পের দিকটি আমার কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। একেকটি ভালো চলচ্চিত্র আমাকে কয়েকদিন পর্য়ন্ত আচ্ছন্ন করে রাখতো। কিন্তু চলচ্চিত্র নিয়ে উচ্চশিক্ষা আমার মাথায় ঠিকঠাক আসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেবারও কয়েক বছর পরে। ছাত্রজীবনে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ‘চলচ্চিত্র চক্র’ বলে এক পাঠচক্রে যোগ দিয়ে আমি বিশ্বের নানান মাস্টার ফিল্মমেকারের শিল্পসম্মত চলচ্চিত্রের সঙ্গে পরিচিত হই, বেশ কিছু ক্লাসিক ছবি দেখার সুযোগ পাই এবং চলচ্চিত্র নিয়ে সিরিয়াস হয়ে উঠি। ১৯৯৩-৯৪ সালের সেই পাঠচক্রে আমাদের কোঅর্ডিনেটর বা শিক্ষক ছিলেন জাকির হোসেন রাজু । তিনি আমার বিভাগেরই ছাত্র ছিলেন, তিনবছর সিনিয়র ছিলেন। কিন্তু বিভাগে তাকে আমি তেমন দেখিনি। ছাত্রজীবনেই তিনি ‘মিছিলের মুখ’ বলে একটি প্রামাণ্যচিত্র (নব্বইয়ের গণঅভূত্থানভিত্তিক) নিয়ে দেশবিদেশ ঘুরে আসেন। চট্টগ্রামে এক বছর ও রাজশাহীতে চার বছর শিক্ষকতাশেষে ঢাকায় ২০০২ সালে জয়েন করার পরে এক পর্য়ায়ে দেখলাম সেই রাজু ভাইই অস্ট্রেলিয়ায় পিএইডি করছেন ফিল্ম স্টাডিজে (তিনি আইইউবির শিক্ষক ছিলেন, এখনও আছেন)। তখনও রাজশাহীর মিডিয়া-অ্যাক্টিভিজম আমার মাথায় – প্রচুর বাংলায় লিখতে হবে, পত্রিকা করতে হবে, এদেশের মানুষের সামনে মিডিয়ার সব জারিজুরি ফাঁস করে দিতে হবে। প্রথম আলো-ডেইলি স্টার তখন প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা, একুশে টিভির পাশাপাশি এনটিভি-চ্যানেল আই-এটিএন প্রতিষ্ঠিত চ্যানেল। আমরা তখন পুরোদস্তুর রাজনৈতিক-অর্থনীতি নিয়ে কাজ করছি।
তবে ছোট ছোট দুই বাচ্চা হয়ে গেছে তখন। প্রভাষকের নিম্নবেতনে চার সদস্যের পরিবার চালাতে পারছিলাম না। ঢাকায় টেকাই দায় হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম পিএইচডির মাধ্যমেই একটা পরিবর্তন আনতে হবে জীবনে। এই সূত্রে ঢাকা ছাড়াই ঠিক হবে, সঙ্গে একটা ডিগ্রিও হবে। আমি ভাবলাম, পিএইচডির জন্য মানুষ বছরের পর বছর প্রস্তুতি নেয়, টোয়েফল-জিআরই দেয়, আর অন্য কিছু করে না। মানে আমাদের মতো করে প্রমোশনের পয়েন্ট দেয় না, এমন বিষয়ে তো অন্যরা লেখেন না। আমি তো টোয়েফল-জিআরইর পথে হাঁটিনি। আমি ছোট দেশে বড় ডিগ্রি করার নীতি গ্রহণ করলাম। সরাসরি পিএইচডি রিসার্চ করবো, বড় দেশে গিয়ে প্রথমে মাস্টার্স করা আমাকে পোষাবে না। বা ওইসব জিআরই ইত্যাদি দেয়া আমাকে পোষাবে না। বন্ধু-সহকর্মী শামীম রেজা বললো মালয়েশিয়ার কথা। আমার সুপারভাইজারের নামও তার কাছেই পাওয়া। আর গবেষণার এলাকা নির্ধারণ করে ফেলেছি রাজু ভাইয়ের পথ অনুসরণ করে। এভাবেই ফিল্ম স্টাডিজে পিএইচডির জন্য মালয়েশিয়ায় যাওয়া। বলার ব্যাপার হলো, আমি যখন পেনাংয়ে, তখন রাজু ভাইও কুয়লালামপুরে ছিলেন কিছুকাল। কুয়লালামপুরে তার সঙ্গে দেখাও হয়। তার কাছ থেকে আমি আমার থিসিসের জন্য ভালো দিকনির্দেশনাও পেয়েছি। খুব সুচিন্তিতভাবে ফিল্ম স্টাডিজে পিএইচডির সিদ্ধান্ত নিয়েছি এমন নয়, তবে ফিল্ম নিয়ে যত পড়তে থাকলাম, জানতে থাকলাম, তত আগ্রহ বাড়তে থাকলো। আজ বলতে পারি মিডিয়া স্টাডিজের চেয়ে ফিল্ম স্টাডিজ কেবল আকর্ষণীয়ই নয়, একটু জটিল বা কঠিনও। শিল্পের সব মাধ্যম সম্পর্কে বা সমাজতাত্ত্বিক বেসিক থিয়রি সম্পর্কে সহজাত আগ্রহ ও কিছু জানাশোনা না থাকলে এদিকে না আসাই ভালো। যেকোনো ভালো ছাত্র মিডিয়া স্টাডিজে পড়তে সক্ষম হবে, কিন্তু সব ভালো ছাত্রই ফিল্ম স্টাডিজ আয়ত্তে আনতে পারবে না। তার থাকতে হবে শিল্পসাহিত্যের প্রতি একধরনের ভালবাসা ও মায়া।
সহজিয়া : তারেক মাসুদ ও জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করেছেন। ভারতীয় হিন্দি সিনেমায় জাতীয়তাবাদ প্রত্যক্ষ মতাদর্শ আকারে যতোটা প্রবলভাবে উপস্থাপিত হয়, বাংলাদেশি সিনেমায় জাতীয়তাবাদ কি ততোটাই প্রাবল্য নিয়ে হাজির হয়? নাকি কিছু দৃশ্যায়ন, কিছু সংলাপ, কিছু গান ইত্যাদি জাতীয়তাবাদের টুকরো চিহ্ন হিসেবে হাজির হয়?
ফাহমিদুল : ভারতে তো বলিউড জাতীয় চলচ্চিত্রের প্রতিনিধি, ফলে সেখানে জাতীয়তাবাদের চিত্রায়ণও নিয়মিত। কাশ্মীর প্রশ্নে কিংবা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অনাবাসী ভারতীয়দের কাহিনিতে কিংবা পিরিয়ড ফিল্মে জাতীয়তাবাদ পরিবেশিত হয়। আমাদের দেশে মূলধারার চলচ্চিত্র বহুদিন ধরেই সংকটে নিপতিত এবং তার জাতীয়তাবাদকে ঠিকঠাক পরিবেশন করার মতো মেধার ঘাটতি আছে। পরিবর্তে দেশে বা বিশ্বমঞ্চে স্বাধীনধারার চলচ্চিত্রগুলোই বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে। আবার স্বাধীনধারার চলচ্চিত্রকাররা বিশেষত মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে জাতীয়তাবাদের পরিবেশনায় বেশ উৎসাহী। তাদের মধ্যে তারেক মাসুদের জাতীয়তাবাদের পরিবেশনা নিয়ে আমরা আমাদের বইতে বিস্তৃত কাজ করেছি। সেখানে আমরা দেখেছি যে এই নির্মাতার জাতীয়তাবাদ পরিবেশনে বিবর্তন রয়েছে। মুক্তির গান যদি মুক্তিযুদ্ধের প্রাধান্যশীল ডিসকোর্সের বয়ান থাকে তবে মুক্তির কথা, মাটির ময়না ও নরসুন্দর-এ ক্রমশ অপ্রাধান্যশীল, অপ্রচলিত ও অশ্রুত ডিসকোর্সকে অনুসন্ধান করেছেন তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ। মুক্তিযুদ্ধ যে জনযুদ্ধ ছিল তা মুক্তির কথায় এসেছে, যেখানে কৃষক, নারী কিংবা আদিবাসীদের অংশগ্রহণের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
সহজিয়া : সিনেমা অফ বাংলাদেশ : আ ব্রিফ হিস্ট্রি আপনার নতুন বই। অভিনন্দন জানাচ্ছি নতুন বই প্রকাশ উপলক্ষে। বইটি বেশ সুন্দর হয়েছে দেখতে। আশা করি পড়তেও খারাপ লাগবে না। এখনও পড়া হয় নি। এ বইয়ে আপনার মূল প্রস্তাবনা কী? কী করতে চেয়েছেন বইটিতে?
ফাহমিদুল : আমাদের চলচ্চিত্রের উল্লেখযোগ্য ইতিহাস লিখেছেন আলমগীর কবির ইংরেজিতে ১৯৭৯ সালে এবং অনুপম হায়াৎ বাংলায়, ১৯৮৭ সালে। এছাড়া জাকির হোসেন রাজু লিখেছেন ২০১৫ সালে। আলমগীর কবিরের বইটি বেরিয়েছে বাংলা একাডেমী থেকে, অনুপম হায়াতের বইটি এফডিসি থেকে এবং জাকির হোসেন রাজুর বইটি বিশ্বখ্যাত রাটলেজ থেকে। কবির আর হায়াতের বই দুটি অনেক পুরনো। রাজুর বইটি তাত্ত্বিকভাবে ভারী এবং দামী বই বলে দেশে দুষ্প্রাপ্য। আমি চেয়েছি সাম্প্রতিক তথ্যসহ ইংরেজিতে এমন একটা বই করতে, যা আকারে ছোট ও হ্যান্ডি হবে, এবং দেশে ও বিদেশে সহজলভ্য হবে। গুলশানের এক ডিনার সন্ধ্যায় উপস্থিত ছিলাম আমি, সামিয়া জামান, বেলায়াত হোসেন মামুন ও নোমান রবিন। সেই সভায় সামিয়া জামান জানান, সংগঠক হিসেবে তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে যান, কিন্তু বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে কোনো প্রকাশনা তিনি বিদেশিদের দেখাতে বা দিতে পারেন না। তেমন কোনো বই নাই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের। ডিনার থেকে ফেরার পথে আমার মনে হয়, এধরনের বই আমি করতে পারি। কারণ কিছু কাজ ইতোমধ্যে করাই আছে। চিন্তাসূত্র এই ঘটনা হলেও, আমি মনে করি বাংলাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা করছেন বা নানান ওয়ার্কশপে চলচ্চিত্র শিখতে চাইছেন, বা যারা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সম্পর্কে এক জায়গায় সব ঐতিহাসিক তথ্য জানতে চান, তাদের জন্যও বইটি অনেক উপকারী হবে।
সহজিয়া : ইতিহাস নির্মাণের তো নানা রকম ধারা আছে। বাংলাদেশে যেকোনো ইতিহাস প্রধানত জাতীয়তাবাদী ধারায় রচিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাস লিখতে গিয়ে আপনি ইতিহাসের কোন ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন?
ফাহমিদুল : জাকির হোসেন রাজু তার বইতে একটা ব্যাখ্যামূলক পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। কত সালে কি হলো, কোন ছবি মুক্তি পেল বা আলোচিত ছবিগুলো নিয়ে বর্ণনা – এধরনের পদ্ধতি এড়িয়ে তিনি দেখিয়েছেন ওই ছবি ওই সময়ে কেন হলো বা হবার পরে কেন গ্রহণযোগ্যতা পেল? অর্থাৎ বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি ঐতিহাসিক ঘটনাকে ব্যাখ্যা করেছেন। আমি তার পদ্ধতিই অনুসরণ করেছি, বইতে তা উল্লেখও আছে। অবশ্য বহু ঘটনাকে সংক্ষেপে বর্ণনা করতে গিয়ে সবসময় তা পারাও যায় নি।
সহজিয়া : ভবিষ্যতের গণমাধ্যম অধ্যয়ন নিয়ে আপনি কোন ধরনের সম্ভাবনার কথা ভাবছেন? বিশেষ করে, করোনা-পরবর্তী বাস্তবতায় মুদ্রণকেন্দ্রিক গণমাধ্যমের দশা কী হতে পারে? এরইমধ্যে অনেক পত্রিকার বিক্রি সংখ্যা অনেক বেশি নিচের দিকে নেমে গেছে। অবশ্য উল্টো খরবও শুনেছি যে, বই বিক্রি বেড়ে গেছে। আপনার কি মনে হয়, করোনা-পরবর্তী ভবিষ্যতের বাস্তবতায় মুদ্রণ নয়, ভার্চুয়াল প্রচার, প্রকাশনা ও বিপণন ইত্যাদির সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য তৈরি হবে?
ফাহমিদুল : আমি তো দেখি আমাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যেতে হবে। দেশের যা পরিস্থিতি! আর মাধ্যমের বিবর্তন, বিশেষত নয়া মাধ্যমের আবির্ভাবে পুরো মাধ্যমপরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে, সেটা মনিটর করতে হবে। ভবিষ্যতে মুদ্রণের ক্ষেত্রে যেটা হবে, কুটির শিল্প ধাঁচের মিডিয়া ও প্রকাশনা আর তেমন দেখা যাবে না। যারা পেশাদার, যাদের বড় পুঁজি থাকবে তারা মুদ্রণ ও প্রকাশনা অব্যাহত রাখবেন। তবে তারাও ডিজিটাল ডিসেমিনেশন বা বিপণন এড়াতে পারবেন না। অবশ্যই ভার্চুয়াল কারবার আরও বাড়বে। তবে শখের বশে বা ছোট পুঁজি নিয়ে প্রিন্ট মিডিয়া করা বা বই প্রকাশ করার চর্চা অব্যাহত রাখা খুব কঠিন হয়ে যাবে। অবশ্যই ছাপাখানার কালির মাদকতা উবে যাবে না, তার একটা চাহিদা ও উপযোগিতা থাকছেই। কিন্তু সেটা পেশাদারের কাজ হবে। মুদ্রণের বিক্রি ও বিপণন অবশ্যই ভার্চুয়ালি বাড়তে থাকবে।
সহজিয়া : আপনি গল্প লেখেনে। তিনটি বই বেরিয়েছে। গণমাধ্যম বিষয়ক কাজের অভিজ্ঞতা গল্প লিখতে কোনোভাবে সহায়তা করেছে আপনাকে?
ফাহমিদুল : প্রথমে আমি ফিকশন রাইটারই হতে চেয়েছি। আমার গল্পগ্রন্থ তিনটি – সে ও তার ছায়া (১৯৯৭), এ শহর আমার নয় (২০০৫) ও শিপ্রার শহরে কয়েকজন এজেন্ট (২০১২)। আর একটা কিশোর উপন্যাস রয়েছে – বেড়ালের দেশে ইঁদুর হয়ে (২০০৯)। ক্যাডেট কলেজের প্রেক্ষাপটে, এটি রূপকাশ্রয়ী এক রাজনৈতিক নভেলা।
এরপর একাডিময়ায় যোগ দেবার পরে প্রবন্ধ ও গবেষণায় মনোযোগী হই। ফিকশন লিখে খুব বেশি নামডাকও হচ্ছিল না। আসলে প্রথম পর্যায়ে নিজের নাম চাউর হবার লোভ ছিল, খ্যাতির মোহ ছিল। পরে অবশ্য সেটা চলে যায়। আর বিবেচনা করে দেখলাম, ফিকশন রাইটার অনেক আছেন, অনেকে আমার চেয়ে ভালো লেখেন। বরং প্রবন্ধ ও গবেষণায়, বিশেষত আমার ডিসিপ্লিনে অনেক অবদান রাখার সুযোগ আছে। ২০০০-২০০২ সময়পর্বে রাজশাহীর গ্রুপটায় অন্তর্ভুক্ত হতে পেরে আমার জীবনের অনেক কিছু পাল্টে গেছে। বিশেষত একাডেমিক ও রাজনৈতিক চিন্তা ও তৎপরতার জায়গায় অনেক পরিবর্তন আসে। তখনও ফিকশন সমানতালে চলছিল বটে, কিন্তু পরে গবেষণা-প্রবন্ধই বড় হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক চিন্তা ও একাডেমিক লেখালেখি এক বিন্দুতে এসে মিলিত হয়।
আমি একাডেমিয়ায় যোগ দেবার আগে সাংবাদিকতা করেছি, পরে মিডিয়া নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি অব্যাহত থেকেছে। আমার অনেক সাংবাদিক বন্ধু আছেন এবং মিডিয়া হাউসে আমার সবসময়ই যাতায়াত ছিল। ফলে সাংবাদিক চরিত্রকে আমার জানা। তাই কিছু কিছু গল্পে সাংবাদিকরা চরিত্র আকারে এসেছে। কিন্তু খুব বেশি এসেছে এমন বলা যাবে না। অন্যদিকে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতার তত্ত্বগুলো ফিকশনে কিছুমাত্রায় প্রতিফলিত হয়েছে।
সহজিয়া : লেখালেখি ও গবেষণা নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
ফাহমিদুল : ১৯৯৭ সালে একাডেমিয়ায় যোগ দেবার পর থেকে আমি বাংলা ভাষায় সমাজবিদ্যা চর্চাই করে গেছি। কেবল নিজে চর্চা করিনি, অন্যদের জন্য প্লাটফর্মও উন্মুক্ত করেছি। প্রচুর সম্পাদনা করেছি, কেবল যোগাযোগ পত্রিকা নয়, বইয়ের পাশাপাশি বিভাগের ছোট ছোট পুস্তিকা ও বড় সংকলনও সম্পাদনা করেছি। যে-শিক্ষার্থীর থিসিস গাইড করেছি, ভালো কাজ হলে, সেটাকে পুনরায় গাইড করে রিভাইজ করিয়ে নিয়ে প্রকাশ করেছি।
আমি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করতে পারি না। আমার মোটামুটি পাঁচসালা পরিকল্পনা থাকে। আগামী ৫ বছর আমি বাংলা কাজ কম করবো এবং ইংরেজি কাজ বেশি করবো। আন্তর্জাতিক প্রকাশনাই হবে বেশি। যোগাযোগ পত্রিকায় বিরতি দিয়েছি, বাংলায় সম্পাদনার কাজও আর করবো না। আমার পিএইচডির কাজকে বড় করে একটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি করেছি, এটি বাইরের একটি প্রকাশনা থেকে বেরুনোর কথা, আগেই বলেছি। কিছু বুক চ্যাপ্টার ও জার্নাল আর্টিকেল বেরুবে বাইরে থেকে। সব ঠিক থাকলে বাংলাদেশের মিডিয়ার ইতিহাস নিয়ে ইংরেজিতে একটা বই হতে পারে। এগুলো সব আগামী ৫ বছরের পরিকল্পনা। তবে একটা বাংলা বইয়ের পাণ্ডুলিপি ঢাকার এক নামী প্রকাশকের কাছে জমা দেয়া আছে, শিরোনাম চলচ্চিত্র: তত্ত্ব ও গবেষণা, এটার কথাও ওপরে এক জায়গা বলেছি। এসব কাজের রিভিউয়ার কমেন্টস আসবে, সেগুলো রিভাইজ করার পেছনেও অনেক সময় যাবে। আগামী বছর আমার বয়স ৫০ হবে। আরো ২০ বছর বেঁচে থাকার ইচ্ছা। যদি বেঁচে থাকি, কাজ করতে থাকবো। এভাবে কাজ করতে করতে একদিন মরে যাবো। আমি মৃত্যুকে নিয়ে কখনো ভাবিনি আগে, করোনাকালে তাও ভাবতে হয়েছে। মৃত্যু জীবনেরই অংশ।
আমি ভাল-মন্দ, গুরুত্বপূর্ণ-গুরুত্বহীন – সারাক্ষণ নানান কাজে জড়িয়ে থাকি। তবে আজকাল আমি অবসরও উপভোগ করি, আমার শরীরও বিশ্রাম চায়।। কিন্তু আমার অখণ্ড অবসর যেন কখনো না আসে!
১৫ অক্টোবর ২০২০
মিশাওয়াকা, ইন্ডিয়ানা, যুক্তরাষ্ট্র
ফাহমিদুল হক স্যার, গ্রেট।
আমি স্যারের একজন একলব্য ছাত্র।
সাক্ষাতকারটি পড়ে সত্যিকার অর্থে উপকৃত হলাম, সমৃদ্ধ হলো ভাণ্ডার। ফাহমিদুল হক স্যারের জন্য অফুরান ভালোবাসা।
সহজিয়া’কে সাধুবাদ জানাই।