অবসর শব্দটা উচ্চারণের সাথে সাথে সাথে একটা আরামের আমেজ ও অনুভব এসে চিন্তার দারাজে ধাক্কা মারে; একটা আহ্লাদি ভাব জমে দানাদার হয়ে ওঠে। কিন্তু এই যুগে অবসর শব্দটা ‘কনক্রিট’ হিসেবে পাওয়া বেশ কঠিন; হয়তো-বা ‘অ্যাবস্ট্র্যাক্ট’ হিসেবেও পাওয়া সম্ভব নয়। সহজে অবসর মেলা বেশ ভার। গতি আর জড়তার সেই দার্শনিক ভিত্তি আমাদের জানায়, গতিই যেন ভর করেছে এই যুগের পুরোটায়। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস চতুরঙ্গে ভারতীয় সমাজব্যবস্থার ভাববাদী আর বস্তুবাদী রূপের যে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিলেন, তাঁর এই উপন্যাসের চরিত্রের মাধ্যমে, হিসেব-নিকেশ মিলিয়েছিলেন প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের আর্থ-উৎপাদন কাঠামোকে ভিত্তি করে — সেই বিষয় এখন অনেকটাই পাশ্চাত্য অভিমুখে ধাবমান। কারণ রবীন্দ্রনাথের যুগে যে দ্বৈত আর্থ-উৎপাদন-কাঠামো বিদ্যমান ছিল — এখন তা বলতে গেলে প্রায় ভ্যানিশ হয়ে গেছে এই ভূমিতে।
‘বঙ্গ’, ‘বাংলা’, ‘পূর্ব-বাংলা’, ‘বাংলাদেশ’ — এই নামগুলোর ক্রমাগত পরিবর্তন-বয়স হাজার বছর ছাড়িয়ে গেছে, ইতিহাস এমনটাই সাক্ষ্য দিচ্ছে। ফলে এই নামের ক্রমায়ত পরিবর্তন কেবল নামের মধ্যেই আবদ্ধ থাকেনি; এই পরিবর্তন এই ভূমির অন্যান্য বিষয়কেও সমূলে পরিবর্তন করেছে। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ণিত ‘চণ্ডীমণ্ডপভিত্তিক’ সমাজে বাবাদের যে অবসরের ফুরসত ছিল, সেই ফুরসত এখন আর মেলে না, মেলা আদতে সম্ভব নয়। সারাদিন গাল-গপ্পো করেও কাটানো সম্ভব নয়। কারণটার একটা গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনা রবীন্দ্রনাথ যেমন দিয়েছিলেন তাঁর ‘কালান্তর’ প্রবন্ধের শুরুতে; তার আর একটা প্র্যাক্টিক্যাল বর্ণনা তারাশঙ্করও দিয়েছিলেন তাঁর গণদেবতা আর পঞ্চগ্রামে।
কিন্তু সেই সময় থেকে বর্তমান সময়ের বয়সের পার্থক্য প্রায় একশ’ বছর হতে চলেছে। মানুষ চাঁদে গেছে; মঙ্গলে যাবে যাবে করছে। থ্রি নট থ্রি বন্দুক এখন হাইড্রোজেন বোমার পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। আর আন্তঃদেশিয় ব্যালাস্টিক মিসাইল জানান দিচ্ছে : গতি জিনিসটা কেমন — তা ধ্বংসের বেলায় যেমন কার্যকর, তেমনি কার্যকর সৃষ্টির ক্ষেত্রেও। ফলে প্র্যাক্টিক্যালি ব্যাপারটার হিসেব বেলায় বেলায় বেশ সময় পার করে ফেলেছে। তাই বাবাদের অবসরের সেই চণ্ডীমণ্ডপীয় ধারণা-অবস্থান কোনোটাই এখন আর বিদ্যমান নয়। খুঁজে পাওয়া হবে দুষ্কর। এর পিছনে কী কী বিষয় কাজ করেছে? কাজ করেছে সমাজের দ্রুত পরিবর্তন; সভ্যতার এক দ্রুত ধাবমান ঘৌড়দৌড়।
প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষেরা তাদের অবসর-যাপনের চিত্র এঁকে গেছে তাদের বসতি হিসেবে ব্যবহৃত প্রাগৈতিহাসিক গুহায়। কী নিখুঁত অবসরের চিত্ররে বাবা, কোনো কাজই নেই যেন, নির্লিপ্ত সময়ের একশেষ! এই সময়ের মানুষের বেলায় তা কেবল দেখা; আর দেখে দেখে কল্পনায় বিভোর হওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর দেখিনে। ফলে সে সময় বাবারা যে ধরনের অবসর-যাপন করতে সমর্থ হয়েছিল, সেটা এখন প্রাগৈতিহাসিক আমলের বিষয়ই কেবল। তাছাড়া আর কিছু নয়। সেই ‘সভ্যতা’ নামক এক আজিব চিজের দেখা না মেলাতে সেই সময় মানুষের জীবন যেমন সহজ-সরল ছিল, তেমনি সম্ভব ছিল সহজ-সরল জীবন-যাপন করা, এখন আর তা নেই।
তবে সেই যুগের আবেদন এতো বেশি ছিল যে, স্বয়ং কার্ল মার্ক্স পর্যন্ত তা দ্বারা প্রভাবিত ও প্রলোভিত হয়েছিলেন। মার্ক্সের স্বপ্নের সাম্যবাদী রাষ্ট্রের স্ট্র্যাকচারের গড়ন আর গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এই যুগ। কিন্তু সেই ‘প্রিমিটিভ এইজের’ সমাজ আর নেই। যখন যূথবদ্ধতায় শিকার, আর শিকারকার্য শেষ করে ঘরে ফিরে অবসর যাপন সম্ভব ছিল, তা আর এই যুগে সম্ভব নয়। এরপর কৃষিসমাজ [মানব-সভ্যতার প্রথম পর্যায়] এলো, সেই সমাজে মায়েরা খাটুনি বেশিই খেটেছে, পুরুষরাও বসে ছিল না। নজরুলের বাণী এক্ষেত্রে কার্যকারি ভূমিকা রাখতে পারে : “বিশ্বে যা-কিছু মাহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”। নজরুলের এই সক্রিয় এবং কার্যকারি ভাগাভাগির ব্যাপারটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা যে-ই যেভাবে দেখেন না কেন ব্যাপারটা।
কৃষিযুগে বাবারা যে অবসর-সময় কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় পেতো, তা এখন পাওয়া আর সম্ভব নয়। কারণ তখন ফসল বুনে দিয়ে বসে থাকাই ছিল মূল কাজ, আর সব নিয়ন্ত্রণ করতো প্রকৃতি; মানে সেই সময়ের কৃষির প্রকৃত হাল-হকিকত তেমনটাই জানাচ্ছে। কিন্তু এখন আবার যদি গ্রামের দিকে তাকানো হয়, গ্রামে যে কৃষি-ব্যবস্থা চালু আছে, তা অনেকাংশেই ‘হাইব্রিড কৃষি-ব্যবস্থা’। যদি বলা হয় প্রাণ-প্রকৃতির ক্ষেত্রে তা ক্ষতিকর ভীষণ — সেক্ষেত্রেও একথা মান্য। কারণ তো আছেই। ধরুন প্রাচীন ও মধ্যযুগে, এমনকি ‘আধুনিক’ আমলের প্রথম একশ’ বছরে, বাংলাদেশে যে ধরনের ‘প্রকৃতি-নির্ভর কৃষি-ব্যবস্থা’ বিদ্যমান ছিল, সেই কৃষি-ব্যবস্থা কিন্তু হাইব্রিড নয়। ফলে ফসল বুনে দাও। তারপর দিব্যি বসে গুড়্ গুড়্ রব তুলে হুক্কায় টান দাও, আরাম করো, তাশ-পাশায় মজে যাও। কিন্তু এখন তা আর সম্ভব নয়। কৃষি-ব্যবস্থার পরিচর্যায় নিয়োজিত ‘সাম্প্রতিক ছদ্মবেশি সামন্ত-কাঠামো’ আর কৃষির ওপর নির্ভরশীল বাবারাও কিন্তু অবসর খুঁজে পাচ্ছে না। কারণ পূর্বে [হাইব্রিড-পূর্ব যুগে] যে বেগুন-চারা রোপণের পর মাসে একবার পরিচর্যা করতে হতো বেগুনক্ষেতে — সেই বেগুন-চারায় বর্তমানে — পরিবেশের ক্রমায়ত দূষণে, প্রাকৃতিক অবস্থার বদলে দিনে কেবল বিষ-প্রয়োগই করতে হয় তিন-চারবার, নিয়ম করে করে। আরো নানা বিষয় তো আছেই। ফলে সামন্ত-সমাজের সেই বাবাদের অবসরের মতো এখনকার কৃষির ওপর নির্ভরশীল বাবাদের আর সেই অবসরের ফুরসত কই; আসলে নেই!
আবার পুঁজিবাদি রাষ্ট্রেও বাবাদের অবস্থাও তেমন সুখকর নয়। এই সমাজব্যবস্থায় বাবারা সকালে বের হয়ে ফিরে আসে রাতে। হয়তো-বা তার সন্তান কোনোদিন প্রশ্ন করে বসবে, “মা ঐ যে লোকটা, যে প্রতিদিন সকালে বের হয়, আর রাতে ফিরে আসে, উনি কে?” প্রশ্ন কিন্তু অবান্তর নয়! কারণ সন্তান বা পরিবারের সাথে সময় কাটানোর অবসর আদতেই বাবাদের নেই। ধরুন এক ব্যাংকার বাবার কথা, তার জীবন-ছক কেমন হতে পারে? সকালে ঘুম ভাঙে, দৌড় লাগায়, নাস্তাটাও অফিসে করে, দুপুরের খাবারও হয়তো অফিসে; মিটিং-সিটিং সেরে ফিরে আসে গভীর রাত্রে। এই ক্লান্তিকর দিন শেষে অবসর যাপনের সুযোগ আসলে কই? থাকে কি? সম্ভব কি? না। ছুটির দিনে? তাও কাটে কর্মব্যস্ততায়। তাই সবশেষে ঘুম তার চোখে ফিরে আসে হয়তো-বা মৃত্যুর মতো। আনন্দ-অবসরের সুযোগ স্বপ্নাতীত ব্যাপারই বটে এইসময়!
সমাজে কে কোন্ কাজ করবে — তা সমাজের দীর্ঘদিনের ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। ফলে বর্তমানে যে ব্যবস্থা ও অবস্থা বিদ্যমান — তা যে আজীবন থাকবে তাও সত্য নয়। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থা এখনো দুনিয়ার বিভিন্ন পুরোনো ট্রাইবাল কমিউন-এ দেখা যায়। এই বিষয়টা এখনো বাংলাদেশের বিভিন্ন সমাজ-ব্যবস্থায়ও বিদ্যমান। ফলে সেখানে পুরুষদের ঘরের কাজ-কর্মই সামলাতে হয়, বাচ্চা-কাচ্চাও পালতে হয়। এবং অবসরে তারা কিন্তু দিব্যি গুড়গুড়ি হুক্কা নিয়ে বসে যায়। এমনকি সেই হুক্কায় মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের প্রধান নারীও গুরুর ভূমিকা নিয়ে টান দেয়। এবং এ অঞ্চলে [আদিবাসী অঞ্চল] ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের চিত্রও সেই কথা বলে যে, এখানে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ রয়েছে। ফলে এই মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা যদি আবার সভ্যতার নানান বিবর্তনের মাধ্যমে ফিরে আসে দুনিয়ায় — তাহলে তো কোনো কিছুই করার থাকবে না। ফলে তখন যদি ঘরের কাজ-কর্ম পুরুষের করতে হয়, তবে তো তাকে তা করতে হবে। সোশ্যাল হেজেমনি তো আর ছেড়ে কথা কয় না; ফলে পুরুষ সেটা করতে বাধ্য হবে। তাই বলতেই হচ্ছে, কর্তৃত্ব কেবল একদিনেই নির্মিত হয় না। দীর্ঘদিনের নানান বিষয়ের সক্রিয় প্রভাব নির্দিষ্ট সামাজিক কর্তৃত্ব নির্মাণে কার্যকারি ভূমিকা পালন করে।
আরেকটা ব্যাপার, স্মরণ করা যেতে পারে মহীনের ঘোড়াগুলি ব্যান্ডের সেই বিখ্যাত গান : “পৃথিবীটা নাকি ছোটো হতে হতে/স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে…/ড্রয়িংরুমে রাখা বোকা বাক্সে বন্দি।” আসলে গৌতম রায়দের সেই যুগের — গ্লোবালাইজেশনের প্রাইমাল যুগ — চেয়েও আজকের পৃথিবী ছোটো হয়ে গেছে। মানুষের আর তেমন কোনো অবসরের প্রক্রিয়াগত অভিজ্ঞতা অর্জনের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আবার সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে সংসার ভাঙার প্রবণতা বাড়ছে হু হু করে। তাই সেই ভাঙা সংসারের হাল ধরা, বিশেষ করে বাচ্চা-কাচ্চা পালনের দায়িত্ব, পুরুষের জন্য নিত্যনৈমিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে — তা শ্রমজীবী থেকে হালের ফিল্ম-স্টারদের দিকেই নজর দিলেই স্পষ্ট হয়। কারণ এই ভাঙন-পরবর্তী সময়ে পরিবারের প্রতি নজর দেওয়ার ব্যাপারটা অনেকাংশেই পুরুষের ওপর গিয়েই বর্তায়; নারীর ওপর বর্তায় না, তা বলছি না, তাও বর্তায়। আর এক্ষেত্রে পুরুষের তেমন কিছুই করার থাকে না। মেনে নিতে হয়, এবং সন্তানের দায়িত্ব নিয়ে তাকে গড়ে-পিটে বড়ো করে তোলার দায়িত্বও কাঁধে তুলে নিতে হয়। ফলে এই ভাঙনের যুগে পারবারিক ভাঙনের ফলে উদ্ভূত সমস্যায় পড়ে বাবারা যে একেবারেই অবসরের মধ্যে সময় পার করতে পারে, তা কিন্তু নয়। কারণ বহু। একটা উদাহরণ : মাকে খুঁজতে বাধ্য হয় বাবার মধ্যেÑ সেটা তো বাবাকে নির্লিপ্ত আর আয়েশি থাকতে দেয় না মোটেও।
তাছাড়া আধুনিকতার এই তুঙ্গ পর্যায়ে মেট্রোপলিটনের আলো-ছায়ায় বাবাদেরকে অনেককেই নিজের কাজ নিজে করে খেতে হয়। এই ধরুন চাকরির সুবাদে অনেক বাবাদের অবস্থান করতে হয় স্ত্রীর চাকরিক্ষেত্র কিংবা পরিবার থেকে বহু দূরে। কিন্তু আধুনিক যুগে কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা তো তাদের কর্মচারিদের নিয়ে তেমন ভাবিত নয়। ফলে খাদ্য ও বাসস্থানের সংস্থান এবং সেগুলো দেখভাল করে বাবাদের অবসর-যাপনের ফুরসত আদতে কোথায়? তার দেখা কি আদতে সম্ভব হয়? এমন প্রশ্ন রয়েই যায় শেষমেশ।
মজার ব্যাপার হলো বারবার অভিযোগ তোলা হয় এই বলে যে, মায়েদের কাজের কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। তাদের কর্মের কোনো মূল্য নেই। মায়েদের জীবনে কোনো অবসর নেই। কিন্তু এইরকম প্রশ্ন যদি বাবাদের ক্ষেত্রেও তোলা হয় — তাহলে কীভাবে এই উত্তর দেওয়া যেতে পারে? আদতে সমস্যাটা হচ্ছে এইখানে। সামন্ত-সমাজে নারী-পুরুষের দ্বৈত কর্ম-অবস্থানে আর্থ-উৎপাদন কাঠামো গড়ে উঠেছিল। সেখানে ভাগেযোগে কাজ যেমন চলেছে, তেমনি অবসরও মিলেছে। তার পরবর্তীতে — বর্তমানের এই অবস্থানে — নারী কিংবা পুরুষ, কারোরই তেমন অবসর মেলে না, মেলা সম্ভবও নয়। যদিও মেলে তা সাময়িক, পিস্টন আর গুলি চলে আসতে যতোটা সময় নেয়, এই আরকি।
তবে ‘পুরুষতন্ত্রের’ নামে সমাজে যে ধরনের কর্মকাণ্ড দেখা যায়, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। নারী-নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণের মতো কর্মকাণ্ডকে স্বীকৃতি দেওয়া বর্বরতারই নামান্তর। তাই সাধু সাবধান : নারীবাদী চিন্তায় নয়, মানুষ হিসেবে প্রাপ্যতার হিসেবে নারীকে সকল বিষয়ে সমান অধিকার দেওয়া একেবারেই যৌক্তিক; এটা নারী বা পুরুষ বলে নয়, মানুষ হিসেবেই প্রাপ্য। তা না হলে সামষ্টিক উন্নয়ন অনেকাংশেই বাধাগ্রস্থ হয়ে পড়বে। তাই আর একটু বলতে হয়, নজরুলের কথার সাথে সুর মিলিয়ে : “পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রাদাহ,/কামিনী এনেছে যামিনী-শান্তি, সমীরণ, বারিবাহ।” (‘নারী’, সাম্যবাদী)
শেষ করবো জীবনানন্দ দাশের কবিতা দিয়ে; যে কবিতা ‘পিস্টন’ আর ‘গুলিকে’ প্রতিনিধিত্ব করেছে। ‘দ্য গ্রেট জীবনানন্দ দাশ’ আসলেই গ্রেট — তাঁর কবিতার চিন্তা আর পারিপার্শ্বিক চিন্তাকে এক করে ফেলার মাধ্যমে। নিচে যে কবিতাটি উদ্ধৃত হবে, সে কবিতায় জীবনানন্দ দাশ দেখিয়েছেন যে, কীভাবে মানুষ ‘আধুনিকতায়’ নির্মিত তীব্র গতিতে পৃথিবী নামক ছোট এক গ্রহের কোথাও শান্তি পায় না। এক গতিশীল পিস্টন এবং ধ্বংসাত্মক গুলি তাড়া করে ফেরে সর্বদা মানুষকে। আসলে মানুষের বিশ্রাম বা অবসর নেই, সম্ভব নয় এই যন্ত্র-যুগে; ‘যন্ত্র-যুগের ক্ল্যাইম্যাক্স পর্বও’ বলা যেতে পারে এই সময়কেÑআর এরই সাথে সাথে সোশ্যাল মিডিয়া তো আছেই। এই সোশ্যাল মিডিয়া কী কাজ-কারবার সম্পাদন করে, তা আগেই বলা হয়েছে। জীবনানন্দ দাশ প্রায় ৮০ বছর আগে যে কবিতা লিখে গিয়েছিলেন, সেই কবিতায় স্পষ্ট হয়েছে যে ‘বনহংস-বনহংসী’ — কারো মাফ নেই, এই পিস্টন আর গুলিভরা সভ্যতায়। জীবনানন্দীয় কাব্য-ভাষায় ‘নীরালা নীড়ের’ অবসর ব্যাপারটা তো হাস্যকর ঠেকবে এখনকার মানুষের কাছে। উদ্ধৃত করছি ক’ লাইন। পাঠকের সুবিধে হবে খানিক। যদিও ‘প্রকৃতি-প্রতীকায়ন’ জটিল করেছে এই কবিতাকে; কিন্তু আগের ফিরিস্তি একে সরল করেই দিবে, আশা রাখতে দোষ কোথায়।
আমি যদি হতাম বনহংস,
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে
ছিপছিপে শরের ভিতর
এক নিরালা নীড়ে;
[‘আমি যদি হতাম’, বনলতা সেন]