ধারাবাহিক এই উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে সমকালীন জীবনের টুকরো টুকরো ছবি। শহর-মফস্বল-সম্পর্ক — বীজ উপন্যাসের পটভূমি। এই সময়ের একজন তরুণীর চোখে দেখা পৃথিবীটা নিশ্চিতভাবেই ভাবনা-জাগানিয়া।
৫
বৃষ্টি হচ্ছে নাকি! ফ্যানের শব্দে প্রায়ই মনে হয়, বৃষ্টি হচ্ছে। এখন আর বৃষ্টির শব্দ টের পাই না। শহরের বৃষ্টি, আসলে বৃষ্টি না। যখন আমরা টঙ্গী থাকতাম। তখন টের পাওয়া যেত বৃষ্টি। সে কী বৃষ্টি! বাবার কলেজের কাছাকাছি ভাড়া একটা বাসায় থাকতাম আমরা। খুব যে কাছাকাছি ছিলো, তা-ও নয়। এখন মনে হচ্ছে, বেশ দূরেই ছিলো বাসাটা। ভ্যান্ডায়। এলাকার নামটা ইন্টারেস্টিং। ভ্যান্ডা। লোকাল নাম। সেই বাসায় ছিলো টিনের চাল। ইশ! কী ঝুম বৃষ্টি হতো! কান খাড়া করে প্রতিটি ফোঁটা শুনতে চাইতাম আমি। চোখ বুজে আসতো ঘুমে। আহ্! ঘুম যে কত আরামের হতে পারে! সুখ বলতে সেই সময়গুলোর কথাই কেবল মনে আসে আমার। কী নিশ্চিন্তে ঘুমাতাম তখন। ছোটোবেলাটাই মজার। সবকিছুই কত আনন্দের ছিলো।
আমাদের পুরোনো বাসাটায় মেহেদী গাছ ছিল একটা। দাদি বলে মেন্দি। আমরাও বলি মেন্দি। হাতে গোল করে মেন্দি দিতাম আমরা। শেরপুর যাওয়ার সময় দাদি ব্যাগ ভরে নিয়ে যেতো। দাদি দিতো চুলে। মাথা ঠা-া থাকে। চুলের গোড়াও নাকি শক্ত হয়। মেন্দি পায়ে লাগানো যাবে না। সতর্ক করতেন দাদি। পায়ে লাগলে গুনা। ভুল করে একটি পাতাও যদি পায়ে লাগতো। তৎক্ষণাৎ তুলে সেলাম করতাম। দাদি বলতো, ‘আঙ্গরে নবিজি দাঁড়িতে মেন্দি দিত। মেন্দি তা-ই পায়ও দিউন যায় না। পাও ছুঁয়াইলেও গুনা।’
টানা একটা ঝনঝন আওয়াজ। হচ্ছে তো হচ্ছেই। থামার কোনো নাম নেই। কানে তালা লেগে যাচ্ছে। অসহ্য! আমি কি পাশ ফিরে শুইলাম! বালিশে কান রেখে এক-পাশ হয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে কানের পেশিগুলো কি ব্যথা হয়ে গেছে! এক মুহূর্তের জন্য কি ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো! তবু চোখ খোলার শক্তি ছিলো না আমার! শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে কোথাও। অবিরাম। বাড়ি সুদ্ধা মানুষ কান্নাকাটি করছে। কি-জানি বলাবলি করে লোকজন। কিছু বোঝা যায় না। খুব উৎকণ্ঠা হচ্ছে আমার। দাদি মারা গেছে! বিছানার চাদর দিয়ে মেঝেতে কারো লাশ ঢাকা। কাঁদতেছি আমি। সুর করে করে কোরান পড়ছে কেউ। অনেক দূর থেকে আসছে সুরটা। যেন আমাদের বাড়িতে নয়। অন্য কোনো বাড়ি থেকে। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। ‘ইশ! কী আরামের বৃষ্টি গো! মানুষের নাভিশ্বাস উইঠ্যা গেছিল। বড় বরকতের বৃষ্টি এটা।’ না, বৃষ্টি না। আমাদের ভাড়া বাসাটায় বিয়ে হচ্ছে আমার। দাদিকে ইয়াং দেখাচ্ছে। মার মতো লাগছে। অফিসের ইয়াকুব স্যার আর গণি স্যার। উনারা আমার দুই চাচা। ‘ভাস্তির বিয়া। আমরা কী দিমু। আঙ্গর আছেই কী। আর দিমুই কী। আমরা খালি দুআ করবার পামু আল্লার কাছে।’ বাবার মন খারাপ। বাবা ভেঙে পড়েছে। অনেক কষ্ট করেও যেন টেকাতে পারছে না বিয়েটা। কেউ বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না আমাকে। মাকে দেখছি না কোথাও। আমার খুব রাগ হচ্ছে। মা কোথায়, বাবা কীভাবে এতকিছু সামলাবে। মা রান্না করছে। চাচারা বালতিতে করে ডাল নিয়ে যাচ্ছে। বাড়ি ভরতি মানুষ। দাদা তদারকি করছে সব। বাচ্চাদের চিৎকার চেঁচামেচি। সবাই ব্যস্ত। হাসিখুশি। উঠানে সুন্দর রোদ। একটা উৎসবমুখর পরিবেশ। ‘ভাগ্য লাগে। এমন ভাগ্য কয়জনের আছে। নিজের জেফথ নিজেই তদারকি করতাছে।’ মার কাছে যেতে-না-যেতেই দেখলাম মা না, দাদি। ‘তুমি কই! তোমারে আমি খুঁজি।’ দাদি মিটিমিটি হাসে।
প্লাস্টিকের একটা লাল চেয়ারে শোভন বসে আছে। ক্ষেপে আছে সে। এত মানুষের মধ্যে তাকে দেখেও না-দেখার ভান করলাম। আরও ক্ষেপে গেলো সে। ‘সবাই আমাদের কথা জানে। চলো।’ ফিসফিস করছে শোভন। কিছু না-বলে তার সঙ্গে আমি হাঁটা দিলাম। চারপাশটা কেমন শুনশান। ভয় লাগছে। আমি তার হাত চেপে ধরলাম। সে চেপে ধরলো আমাকে। তার হাত ঠাণ্ডা। সে মরে গেছে! আমার কাছে সে গোপন করছে কিছু। মানুষ মরে গেলে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। দীর্ঘক্ষণ সে আমাকে চুমু খেল। দম বন্ধ হয়ে এল আমার। তবু ভালো লাগল। সবকিছু ভালো লাগল। ‘ঘুমাতে খুব ভালো লাগছে, শোভন।’ আমার ব্রেসিয়ারের ভেতর একটা বরফের হাত। আমি হাসলাম। বরফের হাত সারা শরীরে ঠাণ্ডা ছড়িয়ে দিচ্ছে। নরম সাদা বরফের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছি আমি। চারপাশে শুধু থরে থরে সাজানো বরফ। খুব ঠাণ্ডা লাগছে আমার। আমি কাঁপছি। আমি হাসছি। খিলখিল করে হাসছি। ফিসফিস করে কথা বলছে শোভন। ভালুকের মত হামাগুড়ি দিতে বলছে আমাকে।
বাতাসে জমে যাচ্ছে তার কথাগুলো। অথচ তার জিভ কী গরম! সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। তবু ভালো লাগছে আমার। আরও ভালো লাগছে আমার। ‘এই বরফগুলো কার, শোভন? কী সুন্দর! বরফ খুব ভালো।’ যেন প্রশ্নের উত্তর না-জানলেও আমার চলবে। সব তছনছ করে দিচ্ছে শোভন। সারা শরীর তছনছ করে দিচ্ছে শোভন। আমার সারা শরীর তছনছ করে দিচ্ছে শোভন। কথা বলতে পারছি না আমি। আমি ফিসফিস করছি। বললাম, ‘আইসক্রিমের বিল আজ আমি দিব। আমি দিব। আমি দিব। আমি দিব। নয়তো খাবো না।’ চাটতে শুরু করল শোভন। বাচ্চাদের মত। তার তর সইছে না। আমার খুব হাসি পায়। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছি আমি। শোভন ক্ষেপে যায়। শোভন। শোভন। শোভন নাছোড়বান্দা। আইসক্রিম। আইসক্রিম। আইসক্রিম আমার সারা শরীরে। আইসক্রিম আমার সারা শরীরে বইয়ে দিচ্ছে এক উন্মাদ স্রোত। শোভন হাঁপায়। শোভন ফিসফিস করে। অনেক ক্লান্তি। অনেক ঘুম। ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছি আমি। গলে যাচ্ছি। এখন শোভন নেই। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাকে। সব অপরিচিত লোক। এদের কাউকে আমি চিনি না। আমি শোভনকে খুঁজছি। আমি থেমে থেমে কাঁদছি। কেউ দেখতে পাচ্ছে না আমাকে। আমি হাঁটছি সবার আড়ালের পথ দিয়ে। আমি নগ্ন। আমার শরীরে একটা সুতাও নেই। একটা সাপ আমার পিছু নিয়েছে। আমি দৌড়াচ্ছি, দৌড়াচ্ছি। এত যে দৌড়াচ্ছি পথ আর শেষ হয় না।
খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখে চমকে গিয়ে ঘুম ভাঙলো আমার। বুকটা এখনও ধড়ফড় করছে। শ্বাস পড়ছে বড় বড়। এইতো আমি। এইতো অতি পরিচিত আমার বিছানা। প্রচণ্ড ব্যথা করছে তলপেটটা। বুঝতে পারছি, ব্লিডিং হয়েছে প্রচুর। প্রশ্রাবও পেয়েছে খুব। চোখের কোণাটা কেমন চড়চড় করছে। স্বপ্নে কান্নাটান্না করেছি নাকি। খুব ভয়ের কিছু স্বপ্নে দেখেছি। বিছানা থেকে খুব আস্তে আস্তে উঠলাম। বিছানায় না আবার পড়েটড়ে যায়।
স্বপ্নে নাকি আমি হাসি। কান্নাকাটি করি। দাদির বক্তব্য এটা। স্বপ্নে নাকি কতোকিছু বলি। শেরপুর থেকে দাদি যখন টঙ্গী আসতো তখন দাদির সঙ্গে ঘুমাতাম আমি। দাদির কথা অস্বীকার করতাম। না, কখনোই না। এ হতেই পারে না। এটা অসম্ভব। স্বপ্নে কথা বলা, কান্নাকাটি করা, হাসাহাসি বিশ্রী ব্যাপার। খুবই আনস্মার্ট। না হতেই পারে না। আরেকটা বিষয়, নাক ডাকা। উফ! অসহ্য!
স্বপ্নে দেখলাম দাদি মারা গেছে। শোভনকেও দেখলাম মনে হয়। কোথাও যেন গেছি দু’জনে। পরে আর খুঁজে পাচ্ছি না তাকে। মানুষ যা ভাবে, তা-ই স্বপ্নে দেখে। সারাক্ষণ তো এসব নিয়েই ভাবি। এখন মনে পড়ছে, আমাদের পুরোনো বাসাটাও মনে হয় দেখলাম।
চোখের কোনায় পানি শুকিয়ে আস্তরণ পড়েছে একটা। ব্রাশট্রাশ করে ফেললাম। সোয়া ছয়টার মত বাজে। এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম, ছয়টা পঁয়তাল্লিশ। এখন আর ঘুমানো উচিত হবে না। বেশ ভালো ঘুম হয়েছে। চোখেমুখে পানি দেওয়ার পর এখন বেশ লাগছে। শাড়ি পরবো নাকি। মন সায় দিল না। আচ্ছা, আরেকদিন পরবো।
সকালেই উঠে পড়ে দাদি। নামায পড়ে। তসবি হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। মুক্ত আকাশ দেখে অভ্যস্ত মানুষ দাদি। শহরে তার ভালো লাগার কথা না। ছেলের জন্যই টিকে আছে। ছেলে সঙ্গে আছে মানে সব ঠিক।
‘তোমারে স্বপ্নে দেকলাম।’
‘স্বপ্নের কতা কউন লাগে না। তাইলে স্বপ্ন ফলে না।’
স্বপ্নের আবার ফলাফলির কী আছে। এসব পুরানা আমলের কথা। মানুষ স্বপ্ন দেখে তার অচেতন মনের কারসাজিতে। আর না ফললে না ফলুক। আমি নিশ্চয়ই চাই না দাদি মারা যাক। হ্যাঁ, দাদিকে নিয়ে একটা দুশ্চিন্তা হয়তো আমার অচেতন মনে রয়ে গেছে। তাই এই স্বপ্ন দেখেছি। দাদাকেও তো দেখলাম।
‘খালি তুমারেই না, দাদারেও দেকছি।’ – দাদার কথা শুনে তার অন্যমনষ্কতা কাটল – ‘খাইছো তুমি?’
‘তর বাপ উডুক। পরে খামুনি। তুই যা, খা গা। পরে আবার তাড়াহুড়া লাগাবি।’
‘তর দাদারে নিয়া কী দেকলি?’
‘এহন জিগাও ক্যা? না, কওয়া যাবো না।’ – আমি একটা দুষ্টামির হাসি দিলাম – ‘আচ্ছা যাও, পরে কমুনি।’
কিন্তু দাদাকে নিয়ে কী দেখেছি, সত্যিই আমার মনে নেই।
বাসায় থাকলেই যত ভয়। ভয় যত ফেসবুকে। বাইরে বেরোলে সব স্বাভাবিক। কত মানুষ। মাঝে মাঝে অচেনা মানুষগুলোকে দেখতে আমার খুব ভালো লাগে! ভয় লাগে নির্জনতা। ঢাকা আমার প্রিয় শহর। শত সমস্যার পরও ঢাকা আমার প্রিয়। বাবা চায় না আমি ঢাকা ছাড়ি। এই জন্যই বোধ হয় পাত্র জুটাতে তার দেরি হচ্ছে। এই ফালতু চাকরিটা করতে দেওয়ারও একমাত্র কারণ, ঢাকা।
চাকরিটা ভালো না, ঠিক আছে। বেশি পরিশ্রম হয়ে যায়। কিন্তু আমার জন্য এটা খুবই জরুরি ছিলো। খুবই সঠিক সময়ে চাকরিটা আমি পেয়েছি। সারাদিনের এই ব্যস্ততাটা আমার জন্য মহৌষধ। মানুষগুলোর সঙ্গও আমি বেশ উপভোগ করি। অন্তত একটা সার্কেল সেখানে গড়ে ওঠেছে। যাদের নিয়ে আমি ভাবি। আমার ভাবনা ব্যস্ত থাকে। মোজাম্মেল, শান্তা আপু, জেসমিন দি’ এদের প্রতি আমি ঋণী। বাসায় একদিন তাদেরকে দাওয়াত দিবো। আমার সব কলিগদের। বিভাস দা’ তবু ঠিক আছে। কিন্তু মাজহার ভাই একেবারে যাচ্ছে তাই। উনাকে আসলে বাসায় ডাকা চলে না। মোজাম্মেলের কথাতেই না, উনার অ্যাটিচ্যুডে আসলেই সমস্যা আছে। আমি নিজেই খেয়াল করেছি। মেয়েদের দিকে উনার তাকানোর ভঙ্গি সুবিধার না। শান্তা আপু আর জেসমিন দি’র দিকে উনার তাকানোতে স্পষ্ট সমস্যা আছে। উনার চোখ সমবসময় মেয়েদের বুক-পেট হাতড়ে বেড়ায়। এমনিতে মানুষ খারাপ না। কিন্তু কথাবার্তায় কমনসেন্সের ঘাটতি আছে। মাস-দুয়েকের মধ্যেই পাটোয়ারীর ধাতানি খেয়েছে কয়েকবার।
মোজাম্মেল আমাকে মাজহার ভাইয়ের ব্যাপারে সাবধান করেছে আগেই। শান্তা আপুর বিষয়ে নাকি উল্টাপাল্টা কথা জিজ্ঞাসা করত। পাত্তা পায়নি। এখন নাকি আর আজেবাজে কিছু বলে না। তাছাড়া কথাবার্তা বলতে বলতে একটা সম্পর্ক আসলে দাঁড়িয়েই যায়। এখন আর বলবেই বা কোন মুখে।
দশটা ক্রস করলে, সেটা লেট। পাটোয়ারী নিশ্চিত ডেকে পাঠাবে, আর শান্টিং দেবে। পৌনে দশটা বাজলে, সেটাও লেট। পাটোয়ারী ডাকবে না অবশ্য। তবে পরপর কয়েকদিন পৌনে দশটা বাজলে, পাটোয়ারী হুট করে একদিন ডাকবে। তিরস্কার দণ্ড। অজুহাত গ্রান্টেড। সাড়ে নয়টা বেটার টাইম। অফিসে ঢুকেই কাজে লেগে পড়তে হয় না। গল্পগুজব করে একটু চিয়ার-আপ হওয়া যায়। অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ছাড়া, নয়টা পঁয়তাল্লিশের মধ্যেই সবাই চলে আসে। দশটায় যে যার ডেস্কে চলে যায়।
অফিসে ঢুকে প্রতিদিন যে কমন দৃশ্যটা দেখি তা হল, বিভাস দা’ আর জেসমিন দি’ দুজনে বসে গল্প করছে। কোনোদিন হয়তো শান্তা আপুও থাকে সেই দলে। বা ইমরান। কোনোদিন বা মোজাম্মেল। কেন জানি, আমি গিয়ে বসি না। বসতে ইচ্ছাও করেনি কোনোদিন। এসব ক্ষেত্রে আমি সরাসরি ডেস্কে গিয়েই বসে থাকি। মোজাম্মেল থাকলে, ও-ই এগিয়ে আসে, তখন টুকটাক কথাবার্তা হয়। উনারা ডাকলে অবশ্য যেতাম। কিন্তু ডাকবেনই বা কেন। অবশ্য দেখামাত্র জেসমিন দি’ই আগেভাগে খোঁজ নেয়। কুশল জিজ্ঞাসা করে।
‘কিরে দিয়া! কী অবস্থা তোর! বাসার সবাই ভালো!’
সাদা জমিনে ছোপ ছোপ ফুলে ভরা একটা শাড়ি পরে এসেছে জেসমিন দি’। মুখে কিউট একটা হাসি ঝুলিয়ে রেখে কুশল জিজ্ঞাসা করলো আমার।
আমি বললাম, ‘এই তো চলছে। খারাপ না। ভালোই। তোমাদের কী অবস্থা!’
‘এই তো রে ভালো! এই তোদের বাসাটা উত্তরার দিকে না? এরমধ্যে যাবো একদিন উত্তরায়। গিয়ে তোকে ফোন দেবো।’
‘আচ্ছা দিয়ো।’, এই বলতে বলতে উনাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। কেন গেলাম জানি না। আমার আসলে ঐদিকে যাওয়ার কথা না। আমার যাওয়ার কথা ডেস্কে। ‘একটা চেয়ার টেনে বস।’ নিজেকে অপ্রস্তুত লাগছিল আমার। ‘আপনাদের কি ডিস্টার্ব করলাম?’, একপ্রকার মুখ ফসকে বলেই ফেললাম। জেসমিন দি’ বললো, ‘আরে না। তোর যে কথা। কী রাজ্যের জরুরি আলাপ করছি আমরা!’
বিভাস দা’ সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকালো। তার চোখগুলো কেমন গভীর। ঘন। কালো। হঠাৎ দেখলে যে-কেউ মনে করবে, চোখে কাজল দিয়েছেন। কেমন ভয় ভয় লাগে। একটু গু-ামার্কা। কিন্তু সুন্দর। বিষয়টা এর আগে কখনো খেয়াল হয়নি। আমার চোখের দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করলো, ‘আপনার কী মনে হয়?’ মুখে প্রচ্ছন্ন একটা হাসি। উনার মুখে যেটা সবসময়েই থাকে। বিল্ট-ইন।
জেসমিন দি’ একবার আমার দিকে তাকায়। আরেকবার তাকান বিভাস দা’র দিকে। আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। বুঝতে পারছি না, কী বলব! হাসলাম। বললাম, ‘আমার উদ্দেশ্য আসলে ডিস্টার্ব করা নয়।’ বিভাস দা’র সমস্ত মুখম-লে আগের হাসিটাই আরেকটু প্রস্ফূটিত হল। নাটকীয় ঢঙে বললেন, ‘সো, ইউ আর অলওয়েজ ওয়েলকামড হেয়ার।’ সবকিছু মিলিয়ে সুন্দর একটা পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল। যদিও ভেতরে ভেতরে হয়তো যথেষ্ট হাঁপিয়ে গিয়েছিলাম আমি। সামান্য এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমার যেন মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম হয়ে গেছে। নতুন কারো সঙ্গে পরিচিত হতে, কথা শুরু করতে আমার খুব অস্বস্তি হয়। অবশ্য একবার আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেলে পরে আর সমস্যা হয় না। তখন যা ইচ্ছা গল্প করতে পারি। এমনকি অন্য অনেকের মত আমার ওয়ার্ড সেনসিটিভিটিও খুব একটা নেই।
ঘড়িতে নয়টা পঁচিশ বাজছে। সাধারণত পঁয়ত্রিশ-চল্লিশের দিকে মোজাম্মেল চলে আসে। ইমরান ঢুকলো। ঢুকেই এদিকে চলে আসলো সোজা। নিজেই একটা চেয়ার টেনে বসে গেল চুপচাপ। দৃষ্টি বিনিময় হল বিভাস দা’র সঙ্গে।
‘রুবাইয়াৎ ই ওমর খৈয়ামটা আবারো পড়ছি। স্টুডেন্ট অবস্থায় এত ভালো করে পড়া হয়নি। দারুণ অনুবাদ করেছে নজরুল। এত দারুণভাবে তালটা বজায় রেখেছে। কী বলবো! মনে হয় মূল ফার্সিতেই পড়ছি। এক-কথায় দারুণ।’, খুবই উৎফুল্ল ভাব নিয়ে আগের কথার জের টানল জেসমিন দি’।
আমার একটু খারাপই লাগছে। বিভাস দা’কে নিয়ে এভাবে নেগেটিভলি চিন্তা করাটা ঠিক হয়নি। উনি একটু চুপচাপ। এই তো। আরেকজনের নামে নিন্দা-টিন্দা করেন না। এ তো আরও ভালো। এতে খারাপ তো কিছু নেই। খুবই স্বাভাবিক স্বরে সাধারণ কথাবার্তার ঢঙ্গে যোগ করলেন বিভাস দা’, ‘সবাই নজরুলের এই অনুবাদটার প্রশংসা করে। কিন্তু তাঁর অনুবাদে ওমর খৈয়ামকেই আমি পাই না। প্রতিটি কবিতা কেমন নজরুলময়। খৈয়ামকে মনে হয় ভাসা ভাসা জগতের কবি। আমি বরং ইংরেজিতে পড়েই খৈয়ামকে কিছুটা ফিল করতে পারি। ফিলোসফিটা টের পাই।’
ঢুকেই শান্তা আপু হইচই ফেলে দিলেন। উনার কাজই এটা। একটা চেক শাড়ি পড়ে এসেছেন আজ। খুবই সুন্দর লাগছে। একইসঙ্গে মোজাম্মেল আর মাজহার ভাই ঢুকল। এরমধ্যেই আলোচনার বিষয় গেছে বদলে। সবার সঙ্গে হাই-হ্যালো করছেন। বিভাস দা’কে কেমন গডফাদার গডফাদার লাগে। কালো। চুপচাপ একজন মানুষ। অবশ্য এত কালো নন। গড়পড়তা কালো আরকি। জেসমিন দি’র মত নন। কালো বলেই উনার ফেইসে একটা ওয়েট এসেছে। ফর্সা হলে হয়তো এই লুকটা আসতো না। ওমর খৈয়ামের নাম শুনেছি, কখনো পড়িনি। পড়াশোনা করার অভ্যাসটা খুবই ভালো অভ্যাস। যারা পড়াশোনা করে তাদের আমার খুব পছন্দ হয়। শোভনও পড়াশোনা করতো খুব। তার পড়াশোনা অবশ্য ডিপার্টমেন্টাল আর চাকরি-বাকরি রিলেটেড। কবিতা-টবিতা নিয়ে মাথাব্যথা তার কোনোদিন ছিলো না।
কবিতা বলতে আমার কাছে ঐ রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কবিতা। তবে নজরুলই আমার বেশি প্রিয়। কেন প্রিয়, তা ভাবিনি। তাঁর কবিতা যে খুব পড়েছি, তা-ও নয়। বাসায় সঞ্চিতা বইটা ছিলো। মাঝে মাঝে পড়তাম। নজরুল মুসলমান এই একটা বিষয়ও তাঁকে ভালো লাগার পেছনে কাজ করতে পারে। তবে এটাও ঠিক, আমি গোঁড়া টাইপের না। আমার অনেক হিন্দু বান্ধবীও আছে, যাদের আমি খুব পছন্দ করি। আর তারাও আমাকে পছন্দ করে। ভার্সিটিতে ওঠার পর কবিতা-টবিতা আর পড়া হতো না। ডিপার্টমেন্টের পড়া পড়েই তখন কূল পাওয়া যেতো না, আর কবিতা। তাছাড়া কবিতা আমার কাছে কঠিন লাগে।
এইসবই তাদের আলাপের বিষয় থাকে। শুনতে ভালোই লাগছিলো। খাওয়ার সময়ও আজ সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। ইমরানকে খুব উত্তেজিত মনে হলো। ইমরানের কথাবার্তা আমার খুব বিরক্ত লাগে। সবসময় সে নেগেটিভ। সবসময় তার কথার বিষয় থাকে দেশ, রাজনীতি, ভার্সিটি, ভার্সিটির টিচার এইসব। আরে বাবা সবকিছুর মধ্যে এত রাজনীতি টানার কী আছে! ভার্সিটির টিচারদের সে একদম সহ্য করতে পারে না। সব মূর্খেরা নাকি দলে দলে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হচ্ছে। সুযোগ পেলেই দেশের প্রসঙ্গ আনবে। আর দেশের কথা উঠলেই সরকারের একশো একটা দোষ খুঁজে বের করবে সে। দোষ সে বের করবেই। তার কাজই হচ্ছে সরকারের দোষ বের করা। আর কথায় কথায় মার্কস-লেনিন কপচানো। মার্কস-লেনিনের বই তো কমবেশি আমরাও পড়েছি। তাই বলে তো সবকিছুকে তার মত নেগেটিভভাবে দেখি না। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র এসব আমরাও পড়েছি। জানলেই যে কপচাতে হবে, তা তো নয়। বিভাস দা’কে একপ্রকার অ্যাটাক করেই কথা বলছিলো ইমরান। যথারীতি বিভাস দা’ তার মতো করে হাসছিলো।
বাথরুমে ঢুকেই আমার চোখ টিকটিকিটাকে খুঁজে বের করে। তাকে তার যথাস্থানেই দেখা গেলো। বাথরুমের স্ট্রাকচারটা এমন যে, কমোডে বসলে সোজা অপর পাশের দেয়ালে চোখ উঁচু করে তাকালেই ভেন্টিলেটরটা। সেখান থেকে বড় বড় চোখে টিকটিকিটা তাকিয়ে থাকে। আরেকজনের সামনে কাপড় খুলতে আমাদের ঠিকই লজ্জা লাগে, কিন্তু এই যে টিকটিকিটা হা করে তাকিয়ে আছে, এ-নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। বাথরুমটা অপরিচ্ছন্ন নয়। তারপরও গা কেমন ঘিনঘিন করে। বলা উচিত টয়লেট। এখানে নিশ্চই আমরা গোসল করি না।
ফেরার পথে মোজাম্মেলকে বেশ ফেড-আপ মনে হলো। দিনে সে দশবার চাকরি ছাড়ে। পড়াশোনা হচ্ছে না তার। পড়ার একদম সময় পায় না। এসব নিয়ে কথা বলছিলো। সামনের বিসিএস নিয়ে সে সিরিয়াস হতে চায়। কিন্তু পারছে না। এর জন্য দায়ী পাটোয়ারী। বিসিএস দিয়ে সে যদি কখনো পুলিশ বা অ্যাডমিনে যেতে পারে পাটোয়ারীকে সে একচোট দেখে নিবে। যদিও তার ফার্স্ট চয়েস অ্যাডমিন। কিন্তু তার টার্গেট হল পুলিশ। ‘জলীর ফ্যামিলি নাকি অ্যাম্বিশাস। ফ্যামিলিতে সে একাই। বাবা-মা দু’জনেই ক্যাডার। দু’জনেই এডুকেশনে। তাই এডুকেশন ক্যাডারের ছেলেও নাকি অ্যাকসেপ্ট করবে না। শুরুতে মোজাম্মেল অবশ্য জানতো না যে, জলীই বাবামায়ের একমাত্র সন্তান। ভালো লাগতো। কথাবার্তা বলতো। এভাবেই রিলেশন হয়ে গেল।
: আচ্ছা মোজাম্মেল, আমি একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, তুমি আবার কিছু মনে করবে না তো?
: না না, বলো, মনে করার কী আছে!
: জলী কি এই রিলেশানের ব্যাপারে সিরিয়াস?
: সিরিয়াস, বলতে আসলে কী বোঝাচ্ছো?
: সিরিয়াস বলতে, সে কি তোমাকে বিয়ে করতে চায়? বিয়ে করার জন্যই তোমরা সম্পর্ক করছো, বিষয়টা কি এমন?
: এটা আমি কীভাবে বলবো, বলো?
: কেন, তুমি তাকে কখনো জিজ্ঞাসা করোনি?
: এসব বিষয় কি জিজ্ঞাসা করে জানা যায়!
তাই তো। কিছু বিষয় আসলে প্রতিশ্রুতির ধার ধারে না। না জানা যায় জিজ্ঞাসায় বা অবজার্ভেশনে। প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ক্ষেত্রে শোভনের তো কোনো কার্পণ্যই ছিলো না। অথচ আজ তার কী পরিণতি!
‘তুমি একদিন বলেছিলে। আমার মনে আছে। এখনকার সময়ে অ্যাফেয়ার মানেই ফিজিক্যাল রিলেশান। তা সম্পর্কের মেয়াদ এক সপ্তাহের হোক, আর যাই হোক। তোমাদের মধ্যে কি, মানে এই ধরনের কোনো সম্পর্ক আছে?’ মোজাম্মেল চুপ হয়ে গেল। সবসময় সে খুব ঠাট্টার মুডে থাকে। তাকে এরকম চিন্তিত অবস্থায় কমই দেখা যায়। বললো, ‘আমাদের রিলেশান প্রায় একবছর হতে চললো। আর বিষয়টাকে এত রেখে ঢেকে বলার কিছু নেই। বেশ কয়েকবারই আমাদের মধ্যে সেক্সুয়াল ডিলিংস হয়েছে।’
অনেকক্ষণ আমরা কিছু বললাম না। চুপচাপ হাঁটছিলাম। মনের মধ্যে আমার কেমন একটা অস্বস্তি কাজ করছিল। সরাসরি এমন একটা প্রশ্ন মোজাম্মেলকে হয়তো না-করলেও চলতো। ‘দ্যাখো মোজাম্মেল! শুধুমাত্র কৌতূহলবশত আমি প্রশ্নটা তোমাকে করিনি। আমার ধারণা, একজন মেয়ে যখন তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ফিজিক্যাল রিলেশানে যায়, তখন সে আসলে তাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে বলেই যায়। সুতরাং মেয়েটা তখন সহজে চাইবে না যে তার অ্যাফেয়ারটা ভেঙে যাক।’ মোজাম্মেল জোরেশোরে হেসে ওঠল। ‘তুমি দেখি বেশ ইন্টারেস্টিং।’ — সে যোগ করল — ‘তোমার প্রশ্ন নিয়ে আমি মোটেও বিচলিত না। তোমার তো আমাকে চেনার কথা। আর তুমি কেমন তা তো আমি জানি।’