ফাহমিদুল হক — ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক, গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও গল্পকার। যোগাযোগ নামক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। সমকালীন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ চিন্তকদের একজন তিনি। আমরা আলাপ করেছি তাঁর সঙ্গে। এই সময়ের বাংলাদেশকে চিনে নেবার জন্য এই আলাপ অত্যন্ত জরুরি। আজ থাকছে তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের প্রথম কিস্তি।
সহজিয়া : আপনি এখন যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। ইউনিভার্সিটি অফ নটরডেমে ভিজিটিং রিসার্চ প্রফেসর হিসেবে কাজ করছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার কাজ মূলত কী?
ফাহমিদুল হক : আমি ’ভিজিটিং রিসার্চ প্রফেসর’ হিসেবে এখানে আছি ফিল্ম টেলিভিশন অ্যান্ড থিয়েটার বিভাগে, ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে। আমি এখানে মূলত গবেষণা করি, পাশাপাশি ক্লাসও নেই। গত ’বসন্ত ২০২০’ সিমেস্টারে ক্লাস নিয়েছি ‘অপশ্চিমা চলচ্চিত্র’ (এশীয়, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকা) নিয়ে। সামনের ’বসন্ত ২০২১’ সিমেস্টারে ক্লাস নিবো এশীয় চলচ্চিত্র নিয়ে। এখানকার শিক্ষকরা আমেরিকান ও ইউরোপীয় চলচ্চিত্র বিষয়ে ভালো জানেন, কিন্তু এশীয় বা অন্য মহাদেশের চলচ্চিত্রের বিশেষজ্ঞ তেমন নেই। সেই স্থান খানিকটা আমি পূরণ করছি।
তবে আমার গবেষণার বিষয়গুলো বাংলাদেশকেন্দ্রিক এবং গবেষণাই আমার মূল কাজ এখানে। আমার পিএইচডি অভিসন্দর্ভকেন্দ্রিক একটি কাজ করছিলাম এক পুস্তক-প্রকল্প আকারে, ঢাকায় থেকে আমি সেটা শেষ করতে পারছিলাম না। অন্যান্য ছোট-মাঝারি গবেষণাপ্রবন্ধ বা বই প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু এই বড় প্রকল্পটির জন্য যে সময় ও বিচ্ছিন্নতা প্রয়োজন ছিল, ঢাকায় তা দুর্লভ ছিল। এখানে আমি সেটা শেষ করার অবকাশ পেলাম। সব ঠিক থাকলে দুয়েক বছরের মধ্যে এটি ব্রিস্টল-শিকাগোকেন্দ্রিক ইন্টেলেক্ট বুক থেকে প্রকাশিত হবার কথা। আবার ধরা যাক, ঢাকায় থাকতেই আমি ছোট দুটো বই নিয়ে কাজ করছিলাম – সিনেমা অব বাংলাদেশ: আ ব্রিফ হিস্ট্রি এবং চলচ্চিত্র তত্ত্ব ও গবেষণা। এই বই দুটোও কিন্তু এখানে এসেই শেষ করলাম। প্রথমটি প্রকাশিত হয়েছে এবং দ্বিতীয়টি প্রকাশক রিভিউয়ারের কাছে দিয়েছেন।
আমি এখানে একটা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রবিষয়ক উৎসব ও আলোচনার অনুষ্ঠান আয়োজন করে ফেলেছিলাম। বাংলাদেশের তিনজন স্বনামধন্য পরিচালকের এখানে আসারও কথা ছিল। ২০২০ সালের এপ্রিলে এটা অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল। কিন্তু কোভিড মহামারীর কারণে তা বাতিল হয়ে যায়। আবার রোহিঙ্গাবিষয়ক এক ডকুমেন্টারিকে ঘিরে এখানে প্রদর্শন ও আলোচনার আয়োজন প্রায় করে ফেলেছিলাম, ভিসাসংক্রান্ত জটিলতায় তা বাতিল হয়ে যায়।
’শরৎ ২০১৯’ সিমেস্টারের মতো ‘শরৎ ২০২০’ সিমেস্টারও আমার জন্য ছিল গবেষণা-সিমেস্টার। বর্তমান ‘শরৎ ২০২০’-এ আমি তিনটা ছোট ছোট গবেষণা-প্রকল্প নিয়ে কাজ করছি। এরমধ্যে একটা হলো কর্তৃত্ববাদের সময়ে চলচ্চিত্রকাররা কীভাবে নানান চাপ মোকাবেলা করছেন, যা ইতোমধ্যে একটি প্যালগ্রাভ-ম্যাকমিলানে প্রকাশিতব্য পুস্তক-অধ্যায় হিসেবে জমা দেয়া হয়েছে।
সহজিয়া : আপনি ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স মালয়েশিয়াতে ফিল্ম স্টাডিজে পিএইচডি করেছেন। গবেষণার বিষয় কী ছিল? আপনার গবেষণা-জিজ্ঞাসা, তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ এবং প্রস্তাবনা বিষয়ে যদি বলতেন….
ফাহমিদুল : বাংলাদেশের স্বাধীন চলচ্চিত্রে জাতীয় আত্মপরিচয় কী রকমভাবে পরিবেশিত হয়েছে তা পরীক্ষা করেছি আমার পিএইডি গবেষণায়। আমি মূলত তানভীর মোকাম্মেল, তারেক মাসুদ, মোরশেদুল ইসলাম ও আবু সাইয়ীদের চারটি চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করেছি। জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত আর্নেস্ট গেলনার, বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন, স্টুয়ার্ট হল, হোমি ভাবা প্রমুখের তত্ত্বগুলো এখানে আমি ব্যবহার করেছি। আর আমি দেখতে চেয়েছি বাঙালি মুসলামনের আত্মপরিচয়ের তিন ধরন আছে : বাঙালিত্ব, মুসলমানিত্ব আর লোকধর্ম। আমি যখন বই করছি, চার চলচ্চিত্র হয়ে যাচ্ছে ১০ চলচ্চিত্র আর চতুর্থ আরেকটি আত্মপরিচয়ের ধরন যুক্ত হচ্ছে – রূপান্তর। এই রূপান্তরের ব্যাপারটা সাম্প্রতিক – নয়াউদারবাদী বিশ্বায়ন ও জিহাদি ইসলামের বিশ্বায়নের কারণে বাংলাদেশ ভেতরে ভেতরে বদলে যাচ্ছে। এই ব্যাপারগুলো চলচ্চিত্রকাররা কীভাবে রেপ্রিজেন্ট করছেন, তা আমি দেখতে চেয়েছি।
সহজিয়া : এ-ধরনের বিষয় বেছে নেয়ার পেছনে কারণ কী? ব্যক্তিগত পছন্দ?
ফাহমিদুল : আমি তো মিডিয়া ও চলচ্চিত্র দুই ক্ষেত্রেই গবেষণা করি, বিশ্লেষণ করি। যদিও বিষয়দুটো পরস্পরসম্পর্কিত, কিন্তু তাদের আলাদা করাও সম্ভব। ধীরে ধীরে চলচ্চিত্রে আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে আমি চলচ্চিত্রকে পিএইচডির এলাকা হিসেবে চূড়ান্ত করি। আর আমি অবশ্যই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়েই কাজ করতে চেয়েছি। আর স্বাধীন চলচ্চিত্রচর্চা একটা মজবুত ভিত্তি পেয়ে গেছে ওই সময়ে (আমি পিএইচডি শুরু করেছি ২০০৬ সালে)। আর এসব চলচ্চিত্রকার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক চলচ্চিত্র বারবার নির্মাণ করেছেন। তাই ভাবলাম তাদের ছবিতে জাতীয়তাবাদের পরিবেশনার ধরন কেমন, তা পরীক্ষা করে দেখি।
সহজিয়া : বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এবং মালয়েশিয়ার বিদ্যাচর্চায় কী ধরনের পার্থক্য আপনার চোখে পড়েছে? আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?
ফাহমিদুল : যে তিনটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা থেকে বলা যায় যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চমানের, মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মাঝারি মানের এবং বাংলাদেশেরগুলো নিম্নমানের। এটা অবশ্য গড় বিবেচনায় বললাম, কিন্তু মোটামুটি এই সত্যি। বিশ্ববিদ্যালয়সংক্রান্ত বিভিন্ন বৈশ্বিক র্যাংকিং তারই সাক্ষ্য বহন করে। তবে যুক্তরাষ্ট্রেও সাধারণ মানের বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, কিন্তু পৃথিবীসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেকগুলো তো যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত। জ্ঞানই যে ক্ষমতা বা শক্তি তা তারা জানে, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রে অনেক। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ছোট ছোট শহর গড়েই উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে। সারা বিশ্বের সব মেধাকে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাতেই শুষে নেয়। যুক্তরাষ্ট্রকে একটা বিশ্ববিদ্যালয়-রাষ্ট্র বললেও অত্যুক্তি হবে না। মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভালো করার চেষ্টা লক্ষ্যণীয়, কিন্তু বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভালো করার চেষ্টা দেখা যায় না। বরং যতটুকু ঐতিহ্য ছিল তাও নষ্ট হচ্ছে ধীরে ধীরে। বাংলাদেশে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নেই বলে জ্ঞানকে শক্তি হিসেবে দেখার প্রবণতা নেই। বরং শাসকশ্রেণি জ্ঞানকে ভয় পায়, হীরক রাজার মতোই জনগণের শিক্ষাগ্রহণক ভাবে, “এরা যত বেশি জানে, তত কম মানে।’’ জনবাহুল্যের কারণে মানুষের শরীরকে ঘিরে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সাজিয়েছে শাসকশ্রেণি, তা দিয়ে রেমিট্যান্স আসে বা সেলাইকারখানায় তাকে নিম্নবেতনে কাজে লাগানো যায়, বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনার জন্য। মানুষের মগজের বিকাশ শাসকশ্রেণি চায় না, তারা প্রশ্নহীন আনুগত্য চায়।
তবে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আন্ডারগ্র্যাড প্রোগ্রাম একেবারে খারাপ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আসলে কলেজের মতো কাজ করে, ক্লাসরুম টিচিংই প্রধান কাজ এখানে। গবেষণা বা পোস্টগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম খুবই দুর্বল। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই বলতে পারবে না, গত ১০ বছরে আমার এই ১০টা বিশ্বমানের পিএইচডি অভিসন্দর্ভ আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা তহবিল সৃষ্টি করা হয়েছে, সেই তহবিল নিজস্ব পিএইচডি প্রোগ্রামকে শক্তিশালী না করে, শিক্ষকদের বিদেশে পিএইচডি করার জন্য দেয়া হচ্ছে। অথচ বিদেশের এক পিএইচডির অর্থ দিয়ে দেশে ১০জনকে তহবিল দেয়া যেত। দেশের টাকা খরচ করে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং বাড়াচ্ছে আমারদের গবেষকরা। সেই টাকা দেশে ব্যবহৃত হলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং বাড়তো। আমাদের পিএইচডি দুর্বল কারণ এখানে যৎসামান্য বৃত্তি দেয়া হয়। গবেষক পিএইচডি করে, অন্য কিছু করার পাশাপাশি। তার পূর্ণ মনোযোগ এখানে থাকে না। পূর্ণ বৃত্তি ও পোস্ট-গ্র্যাজুয়েটদের আবাসনের ব্যবস্থা করা গেলে, দেশের পাশাপাশি বিদেশ থেকেও গবেষকরা আসতো।
সহজিয়া : অনেকেরই ধারণা, কেউ কেউ এমন মন্তব্যও করেন, যা কিছু চিন্তাভাবনা হয়েছে এবং হচ্ছে, তা মূলত পশ্চিমেই হয়েছে এবং হচ্ছে। পৃথিবীর অপর প্রান্তগুলো নতুন বা অভিনব বা গ্রাউন্ডব্রেকিং কোনো চিন্তা দিতে পারছেনা। বরং পশ্চিমী চিন্তার পুনরুৎপাদন ও পুনঃব্যাখ্যা ছাড়া কিছু করতে পারছে না। এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?
ফাহমিদুল : গবেষণার ও চিন্তার জন্য একটা সংস্কৃতি, একটা পরিবেশ দরকার হয়। চিন্তার পরিবেশ মানে নিছক নির্জনতা নয় – অবকাঠামো, বৃত্তির অর্থ, ব্যবহারোপযোগী গ্রন্থাগার এবং সর্বোপরি সমাজে চিন্তা ও জ্ঞানের চাহিদা ও সমাজের মানুষের দিক থেকে অ্যাপ্রিসিয়েশন প্রয়োজন। লালন ফকিরসহ অনেক সাধক অবশ্যই এদেশে মৌলিক চিন্তা করেছেন। কিন্তু আধুনিক জ্ঞানভিত্তিক সমাজে চিন্তার সৃজনে অবশ্যই বিদ্যায়তিনক চর্চার ঐতিহ্য থাকা দরকার। ভারতে সাব-অল্টার্ন স্টাডিজের পণ্ডিতেরা দেশে বসেই অনেক কাজ করেছেন। তবে তাদের অনেকেই আবার বিদেশে গিয়ে কাজ করার ডাক পেয়েছেন, এবং এভাবে যাওয়া-আসার মধ্য দিয়ে তাদের কাজ আরো সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু দেখবেন ভারতের বিদ্যায়তনে বিদ্যাচর্চার একটা পরিবেশ কিন্তু রয়েছে। এছাড়া সমাজে ওই বিদ্যার কিছু চাহিদা বা উপযোগিতাও রয়েছে। অপশ্চিমা দেশের পণ্ডিতদের অনেক অবদান জ্ঞানজগতে অবশ্যই রয়েছে, তবে তারা তাদের কাজগুলো করার বা চিন্তা ও তত্ত্ব প্রণয়নের পরিবেশ তারা পেয়েছেন পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও পশ্চিমা সমাজে গিয়ে। কখনো তারা পশ্চিমা চিন্তা দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে একাজ করেছেন, কখনো বা সেই সমাজে থেকে পশ্চিমা আধিপত্যের সমালোচনা করেছেন। ফ্রানৎস ফানোঁ বা এডওয়ার্ড সাইদের কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। পশ্চিমা সমাজের সেটুকু সহ্য করার শক্তি রয়েছে বলেই তারা আজও আধিপত্য বজায় রাখতে পারছে।
আমি বা আমার মতো কয়েকজন এতদিন মিডিয়া স্টাডিজের পশ্চিমা ক্রিটিকাল চিন্তাগুলোই পুনরুৎপাদন করেছি, বাংলাদেশে, বাংলা ভাষায়। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ বা হেজিমনির ক্রিটিক করার তীব্র বোধ বা ইচ্ছে আমাদের থাকতেই পারে, কিন্তু তার ভাষা আমাদের জানা নেই। চমস্কি বা তার মতো পণ্ডিতরাই আমাদের সেই ভাষা-ভোকাবুলারি, আর্গুমেন্টের ধরন ও প্রয়োজনীয় তত্ত্ব সরবরাহ করেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বা সমাজ সেরকম ‘পরিবেশ’ দেয় নি, যেখান থেকে চমস্কি তৈরি হবেন। উপনিবেশিত হলে একটা সমাজ নিঃস্ব হয়ে যায়, উপনিবেশের ইতিহাসও এক্ষেত্রে স্মরণ করা দরকার। বাংলায় লুণ্ঠিত সম্পদ দিয়ে ইয়র্কশায়ারে শিল্পবিপ্লব হয়েছে। ইউরোপীয় রেনেসাঁর ইতিহাসও আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, পুরো ব্যপারটা বিচার করার ক্ষেত্রে।
সহজিয়া : বাংলাদেশে গণমাধ্যম অধ্যয়ন বেশ পুরনো একটি বিষয়। বর্তমান বাংলাদেশের অনেক নতুন, পুরনো, পাবলিক, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়টি পড়ানো হয়ে থাকে। এই বিদ্যার চাহিদা হঠাৎ বেড়ে গেল কেন? আপনার ভাবনা কী?
ফাহমিদুল : গণমাধ্যম অধ্যয়ন পুরনো বিষয় নয়। এটা একেবারেই ২০০০ সাল-পরবর্তী একটা বিষয়। সালটা বললাম কেবল একটা ল্যান্ডমার্ক হিসেবে, ২০০০ সালে এসংক্রান্ত বিশেষ কিছু ঘটেছে এমন নয়। এর আগে আলী রীয়াজ কিছু কাজ করেছেন, তবে তিনি পরে পুরোদস্তুর রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বনে যান। অধ্যাপক গোলাম রহমান কিছু কাজ করেছেন, কিন্তু বাংলায় না-লেখার কারণে একাডেমিয়ার বাইরে তেমন কোনো প্রভাব পড়ে নি। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার পাঠদান শুরু হয়েছে ১৯৬৪ সালে, অনার্স প্রোগ্রাম চালু হয়েছে ১৯৭৮ সালে, কিন্তু গবেষণা প্রায় ছিলই না, অধ্যয়ন হয়েছে যৎসামান্য, বিচ্ছিন্নভাবে। মূলত ঢাকার বাইরে নতুন নতুন বিভাগ চালু হয়েছে, সেসবসহ ঢাকাতেও নিয়মিত গণমাধ্যম অধ্যয়ন শুরু হয় নতুন শতকের গোড়া থেকেই। এটা হয়েছে অপেক্ষাকৃত নতুন ও তরুণ গবেষক-বিশ্লেষকদের অবদানে।
এই বিদ্যার চাহিদা বেড়েছে হঠাৎ করে ২০০০ সাল পরবর্তী সময়ে, মিডিয়া-কারখানার বিকাশের সূত্রে। মিডিয়া-বুমের কারণে হঠাৎ এই কারখানায় জনবলের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে, বিভাগগুলো একারণেই আবির্ভূত হয়েছে। আমাদের লেখাতেই আমরা বলেছি এই মিডিয়া বুম-ও হয়েছে নয়া উদারবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রয়োজনে। আর এই কারখানা ইতোমধ্যে সংকটের আবর্তে পতিত হবার কারণে কিছু কিছু বিভাগও সংকটে পড়ে গেছে, বিশেষত কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ।
সহজিয়া : মোটা দাগে, গণমাধ্যম অধ্যয়নের দুটি দিক নজরে পড়ে; এক : এর টেকনিক্যাল দিক, যা নির্মাণ, সম্পাদনা ও সম্প্রচার ইত্যাদি কলাকৌশলগত বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত, দুই. গণমাধ্যমের সমাজতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক অধ্যয়নের দিক। আবার কেউ কেউ মিডিয়া অধ্যয়নের ক্ষেত্রে পলিটিক্যাল ইকনোমি বা রাজনৈতিক অর্থনীতির তত্ত্বগত দিকও বিবেচনায় রাখেন। আপনার গবেষণা ও আগ্রহ দেখে মনে হয়, আপনি সমাজতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক অধ্যয়নের ব্যাপারে আগ্রহী। কেন?
ফাহমিদুল : আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা যে চাকরি-বাকরি পান, তা তারা পান ওই টেকনিকাল কলাকৌশল পাঠ করেছেন, সেজন্য। গণমাধ্যমের ক্রিটিকাল পাঠ তাদের চাকরি নিশ্চিত করে না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ তো কেবল সাংবাদিকতার হ্যান্ডস-অন ট্রেনিং দেয়া নয়, সাংবাদিকতা ও মিডিয়াকে অধ্যয়নের দিকটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এরই সূত্রে সংস্কৃতিকে অধ্যয়ন, এরই সূত্রে সমাজে সাংস্কৃতিক মাধ্যমগুলোর ভূমিকা কী, তার পাঠ। অধ্যয়ন-পাঠ-গবেষণায় তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের যে প্রশিক্ষণ তা সাংবাদিকতায়ও কাজে লাগে, অন্য যেকোনো পেশাতেও কাজে লাগে।
আমার প্রথম দিকের কাজগুলো রাজনৈতিক অর্থনীতি ধারায় করেছি। পরে সাংস্কৃতিক অধ্যয়নে আগ্রহী হয়েছি। আমাদের ‘যোগাযোগ’ পত্রিকার পথরেখাও সেভাবেই অঙ্কিত হয়েছে। আপনি দেখবেন পলিটিকাল ইকোনমি ও কালচারাল স্টাডিজে ধারায় যারা কাজ করেছেন তাদের দুই বর্গই মার্কসবাদ প্রভাবিত। তবে মোটা দাগে বলা যায়, পলিটিকাল ইকোনমিস্টরা বেইজ নিয়ে কাজ করেন আর কালচারাল স্টাডিজের অনুসারীরা সুপারস্ট্রাকচার ধরে কাজ করেছেন। রাজনৈতিক অর্থনীতি ধারায় মিডিয়ার পুঁজি, মালিকানা, ভোক্তা সংস্কৃতি নির্মাণে মিডিয়ার ভূমিকা এসব নিয়ে আমি প্রচুর লিখেছি, যোগাযোগ পত্রিকার সহ-লেখকরা প্রচুর লিখেছেন। আমার অসম্মতি উৎপাদন (২০১১) বইটি এক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্বমূলক। পরে আবার সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন ধারায় কাজ করেছি। স্টুয়ার্ট হলের রেপ্রিজেন্টেশন (২০১৫) ধারণার অনুবাদ করেছি। আর যোগাযোগ-এর রেপ্রিজেন্টেশন ও জনসংস্কৃতি সংখ্যা সম্পাদনা করেছি। আর প্রচুর লিখেছি চলচ্চিত্র নিয়ে – শিল্পসম্মত ও জনপ্রিয় ধারার চলচ্চিত্র নিয়ে। আমার পিএইচডি থিসিসও চলচ্চিত্র সংক্রান্ত – বাংলাদেশের স্বাধীনধারার চলচ্চিত্রে জাতীয় আত্মপরিচয় কীভাবে পরিবেশিত হয় তা দেখার চেষ্টা করেছি। এই ধারাতেই কো-অথরড বই করেছি তারেক মাসুদ জাতীয়তাবাদ ও চলচ্চিত্র (২০১৪)। চলচ্চিত্র সমালোচনা (২০১৩) ও চলচ্চিত্র পাঠ (২০১৭) নামেও বই প্রকাশ করেছি। নিউ মিডিয়া ধারায়ও কয়েকটি গবেষণা করেছি, সম্পাদনা করেছি যোগাযোগ-এর নিউ মিডিয়া সংখ্যা।
আমাদের দেশে নব্বই দশকের শুরু থেকেই নিও-লিবারেল মার্কেট ইকোনমি চালু হয়ে যায়। বিদেশি পণ্য আমদানি করে এদেশে অবাধে বিক্রি করা শুরু হয়ে যায়। তবে বিক্রিবাটা তো এমনিতেই হবে না, সাধারণ ক্রেতাদের ভোক্তায় উন্নীত করতে হবে। পণ্য বিক্রির জন্য ভোক্তামনষ্ক জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। এই ভোক্তাসংস্কৃতি কৃত্রিমভাবে তৈরি করতে হবে। এই দায়িত্ব দেয়া হয় মিডিয়াকে। নব্বই দশকের শেষ থেকে মিডিয়া সেই দায়িত্ব পালন করে আসছে। আমি যখন রাজশাহীতে ছিলাম, তখন সেলিম রেজা নিউটন ও আ-আল মামুনসহ আরো অনেকে মিলে এগুলো নিয়ে ভাবা ও বিশ্লেষণ শুরু করি। এভাবে আমরা পলিটিকাল ইকোনমি ধারায় কাজ করতে থাকি।
এখন পলিটিকাল ইকোনমির একটা ‘রিডাকশনিস্ট‘ দিক থাকে, যে সবকিছুকে অর্থনীতি, পুঁজি ও শ্রেণি দিয়ে বিচার করতে চায়। তাই আমরা শ্রেণির পাশাপাশি জেন্ডার, সংস্কৃতি, ইতিহাস ইত্যাদির আলোকে মিডিয়াকে বোঝার চেষ্টা শুরু করি। অন্যদিকে চলচ্চিত্র মাধ্যমটি শৈশব থেকেই আমাকে খুব টানতো। এর শিল্প ও দর্শনের দিকটিও আমাকে আকৃষ্ট করতো। এক মাধ্যমে সব শিল্পমাধ্যম জড়ো হয়ে এক ইনটেন্স শিল্পের জগত তৈরি করে। আমি এর অমোঘ আকর্ষণ এড়াতে পারিনি কখনোই। চলচ্চিত্রের তত্ত্বের জগতও অনেক জটিল। মিডিয়া স্টাডিজের চেয়ে ফিল্ম স্টাডিজ আমার কাছে বেশি কমপ্লেক্স মনে হয়, একারণে আরও আকর্ষণীয় লাগে। জাকির হোসেন রাজু কিংবা গীতি আরা নাসরীনের সাহচর্য়ও চলচ্চিত্র গবেষণায় আমাকে আরও আগ্রহী করে তুলেছে। এভাবেই আমার কাজগুলো হয়ে উঠেছে। বলতে চাই, আমি একা একা কাজ করিনি, কমরেডশিপের মধ্য দিয়ে আমাদের কাজগুলো বেড়ে উঠেছে। আমার কো-অথরড বেশ কয়েকটি বই আছে। আবার যোগাযোগ পত্রিকা ছিল আমাদের যৌথ একাডেমিক কর্মসূচির একটা প্রকাশ।
সহজিয়া : একটা প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খায়, গণমাধ্যম সম্পর্কিত সমাজতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক অধ্যয়নের প্রভাব চলমান বা বিদ্যমান গণমাধ্যমসমূহে তাত্ত্বিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে কি? অর্থাৎ বলতে চাইছি যে, যাঁরা গণমাধ্যম বিদ্যা অধ্যয়নের সূত্রে রেডিও-টিভি-সংবাদপত্র কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে কাজ করছেন, তাঁরা কি সমাজতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা সম্পর্কে তত্ত্বগতভাবে সচেতন থেকে কাজ করছেন? এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
ফাহমিদুল : তেমন হচ্ছে বলা যাবে না। কারণ ওইসব তত্ত্ব এবং জার্নালিস্টিক স্কিল একরকম পরস্পর-আলাদা হয়ে আছে। রিপোর্টিং-এডিটিং যারা পড়ান, তারা এসব তত্ত্বকথায় বেশি আগ্রহী হন না সাধারণত। আবার বিভাগ থেকে শিখে যারা সংবাদ কারখানায় কাজ করেন, তারা দেখেন তত্ত্ব ও কাজের ক্ষেত্র বেশ আলাদা। একসময় তো কারখানায় বলা হতো, বিভাগে যা পড়েছো, তা আগে ভুলতে হবে। সেই পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টেছে, কারণ এখন অনেক নিউজ ম্যানেজার সাংবাদিকতার ডিগ্রিধারী। আমরা আশা করি বিভাগে যে এথিকাল জার্নালিজম বা নৈতিকতা মেনে সাংবাদিকতার ওপর জোর দেয়া হয়, তা যেন শিক্ষার্থীরা অনুসরণ করে। এটুকুর বেশি আমরা আশা করি না, পরিস্থিতি সার্বিকভাবে বিচার করে। তার কিছুটা ফল আমরা দেখিও। দেখবেন, যারা ভালো রিপোর্টের জন্য পুরস্কার পাচ্ছেন, তাদের বড় অংশ সাংবাদিকতায় পড়াশোনা করা। তবে মালিকের ইচ্ছে, সংবাদমাধ্যমের রাজনীতিসংশ্লিষ্টতা, মিডিয়সংশ্লিষ্ট আইনকানুন (যেমন আজকের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) ইত্যাদি কাজের সুযোগকে সীমিত করে ফেলে।
সহজিয়া : এমন একটি প্রশ্ন অনেকেই করে থাকেন, গণমাধ্যমের পক্ষে আদতে ‘‘গণ’’মুখী হওয়া সম্ভব কিনা? কারণ গণমাধ্যমসমূহ পরিচালিত হয় ব্যাপক পুঁজির মালিক দ্বারা। এমনকি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমও ‘‘গণ’’ নয়। তাহলে ‘‘গণমত’’, ‘‘গণচিন্তা’’ কোথায় প্রকাশিত ও প্রচারিত হবে? এক সময় অধ্যাপক ও গবেষক আলী রিয়াজ একটি বই লিখেছিলেন, গণবিচ্ছিন্ন গণমাধ্যম। গণামাধ্যমের গণবিচ্ছিন্নতা বিষয়ে আপনার ভাবনা জানতে চাইছি।
ফাহমিদুল : গণমাধ্যম তো এখন প্রচারমাধ্যম। রাজনৈতিক অর্থনীতির আলোচনায় ওপরে বলেছি, কোন কনটেক্সটে এগুলো প্রচারমাধ্যমে পরিণত হলো। গণমাধ্যমে পণ্যের প্রচার করা হয়, রাজনৈতিক ও ব্যবসায় এলিটদের খবরই এসব প্রচারমাধ্যম দখল করে রাখে। আর থাকে কিছু চটুল বিনোদনের খবর। আজকালকার মিডিয়া পাঠক-দর্শকের মন জাগাতে নয়, মন যোগাতে কন্টেন্ট সাজায়। নিউটন ভাই বলতেন, বড়লোকদের ড্রয়িংরুমে দেশ-সমাজ নিয়ে যেরকম হা-হুতাশ শোনা যায়, মিডিয়ায় তারই প্রতিফলন দেখা যায়। একসময় সরকারি চাপের চাইতে মালিকানা ও বিজ্ঞাপনদাতাদের চাপ বড় ছিল। একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে, কর্তৃত্ববাদী শাসনের সময়ে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সময়ে, গণমাধ্যম আরও গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তার গণবিচ্ছিন্নতা অনেকক্ষেত্রে চাপে পড়ে নয়, স্বেচ্ছানির্বাচিত। টেলিভিশনগুলোর লাইসেন্স দেয়া হয়েছে সরকারঘনিষ্ঠ লোকজনকেই, ফলে সরকারের স্বার্থরক্ষায় তারা উৎসাহী। ভিন্ন যেকোনো ভাবনার বিকাশ দেখা গেলে, বা স্বতন্ত্র অথচ রাজনৈতিক চিন্তা বা সক্রিয়তাকে বা আন্দোলনকে দেখা গেলে, তাকে ভিলিফাই করতে, তাকে কালিমালিপ্ত করতে বেশিরভাগ গণমাধ্যমের উৎসাহ দেখা যায়। তাই এখন তারা পাঠক-দর্শকের মন যোগাতেও ব্যর্থ। তাইতো মেইনস্ট্রিম বা পেশাদার গণমাধ্যম তীব্র আস্থার সংকটের মধ্যে পড়ে গেছে। অডিয়েন্স এখন সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশি সময় কাটায়, তথ্যের ক্ষুধা সেখান থেকেই মেটাতে চায়। ২০০০ সাল থেকে মিডিয়া কারখানা দ্রুত বর্ধিত হয়েছে, ২০২০ নাগাদ এসে এই কারখানাকে শ্বেতহস্তীর মতো দেখাচ্ছে।
সহজিয়া : ইউটিউব, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, পিন্টারেস্ট, ব্যক্তিগত ব্লগ ইত্যাদি ‘‘বিকল্প গণমাধ্যম’’ হিসেবে কাজ করছে — এমন কথা বলা যায় কি? কারণ ইন্টারনেটের ওপরও নানামাত্রিক নজরদারি খবরদারি চলে? সেই খবরদারি যতো না পুঁজির, ততো বেশি রাজনৈতিক ভাবাদর্শের। আপনি কী বলবেন?
ফাহমিদুল : বিকল্প গণমাধ্যম ধারণাটা কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ, এর একটা আদর্শ বা বলা যায় রাজনৈতিক আদর্শ আছে। সামাজিক মাধ্যমগুলো মূলধারার যোগাযোগ মাধ্যমের সমান্তরাল অর্থে বিকল্প, কিন্তু আদর্শগতভাবে বিকল্প নয়। দে আর অল্টারনেটিভ টু মেইনস্ট্রিম, নট অল্টারনেটিভ ইটসেল্ফ। এসব মাধ্যমে মেইনস্ট্রিম ভাবনারই প্রতিফলন দেখা যায়। কিছু অল্টারনেটিভ ও প্রগ্রেসিভ আদর্শের পাশাপাশি খুবই পশ্চাৎপদ আদর্শও ব্যাপক মাত্রায় এখানে উপস্থিত।
বিকল্প মাধ্যম সমাজের আধিপত্যশীল রাজনৈতিক এলিট, বিজনেস এলিটদের বিপরীতধর্মী আদর্শ নিয়ে কাজ করার কথা। কিন্তু বাস্তব জগতের সব বড় খেলোয়াড়ই ভার্চুয়াল জগতে উপস্থিত। বা তারাই সামাজিক মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে। সামাজিক মাধ্যম নিয়ে কাজ করেন ক্রিস্টিয়ান ফুকস। তিনি বলেন, ২০০০ সাল নাগাদ বিশ্বঅর্থনীতিতে যে ‘ডটকম ক্রাশ’ হয়, সেই সংকটকে মোকাবেলা করতেই ওয়েব ২.০ বা সামাজিক মাধ্যমের জন্ম হয়েছে।
তবে সামাজিক মাধ্যমে সনাতনী যোগাযোগ প্রক্রিয়া পাল্টে গেছে, এখন সোর্সের পাশাপাশি রিসিভারও শক্তিশালী। আগে সাধারণ মানুষ ছিল টেলিভিশন-সংবাদপত্রের অক্রিয় ভোক্তা বা কনজিউমার এখন তারা প্রজিউমার বা ভোক্তোৎপাদক। এক ধরনের আনুভূমিক যোগাযোগের মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে একটা প্রতি-ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। ফলে আরব বসন্তে সরকার পড়ে গেছে। এখন এধরনের অভিজ্ঞতার পর সরকারগুলো সতর্ক হয়ে এমন সব মেশিন কিনেছে যে এক গোয়েন্দা অফিসে বসে সারা দেশের মানুষ কোথায় কী সরকারবিরোধী লিখছে জেনে যাচ্ছে। জনগণের করের টাকায় ডিভাইস কিনে জনগণকেই নজরদারি করা হচ্ছে। প্রথমে মনে হচ্ছিল সাধারণ জনগণ লাভবান হয়েছে সামাজিক মাধ্যম থেকে। কিন্তু এখন মনে হয় জনগণ ক্ষতিগ্রস্তই হয়েছে, সরকার যেমন তাকে সহজেই নজরে রাখতে পারছে, খুব কম জনবল নিয়োগ করে। তেমনি ব্যবসায় শ্রেণিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তার পণ্যের ভোক্তাকে সহজেই খুঁজে পাচ্ছে, বিজ্ঞাপন নিয়ে হাজির হতে পারছে সরাসরি তার কাছে। আসলে ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহারকারীদের প্রফাইলিং করে এবং ব্যবসায়ীদের কাছে সেই ডেটাবেজ বিক্রি করে। সেটার ভিত্তিতে ব্যবসায়ীরা তার পণ্য নিয়ে হাজির হয়ে যাচ্ছে ব্যবহারকারীর কাছে। ডালাস স্মাইদের ‘অডিয়েন্স কমোডিটি’ ধারণাটি এক্ষেত্রে স্মর্তব্য। অডিয়েন্স আসলে দফায় দফায় বিক্রি হচ্ছে ক্ষমতাবানদের কাছে। আবার অন্য দিকে ফেসবুক বা গুগলের মতো কর্পোরেশন নিজেরা কিছু প্রস্তুত করে না। ‘ইউজার জেনারেটেড কন্টেন্ট’ই হলো তার বার্গেনিংয়ের অস্ত্র – গুগল যা আমাদের খুঁজে দেয়, তার একটাও তার নিজের নয়। ফেসবুকে সারাক্ষণ মানুষ কন্টেন্ট প্রডিউস করছে। ফেসবুক এই বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষকে দেখিয়েই বিজ্ঞাপনদাতাদের আকৃষ্ট করে। আমরা হলাম ফেসবুকের ‘আনপেইড লেবার‘।
এরকম বিবিধ কারণে ইন্টারনেটের সামাজিক মাধ্যমকে বিকল্প মাধ্যম বলা যাবে না।
সহজিয়া : যোগাযোগ পত্রিকার ২০১৬ সালের জুলাই সংখ্যাটি ছিল ‘‘টেলিভিশন’’ নিয়ে। টেলিভিশন যন্ত্রটি থাকবে কি? আপনার কী মনে হয়? ইদানিং ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখা যায়, ‘‘লাইভ টিভি তৈরি করুন মাত্র তিন হাজার টাকায়।’’ ইউটিউবে প্রদর্শিত হচ্ছে নিজের বা নিজেদের তৈরি করা কনটেন্ট। আবার নিউজ পোর্টালও তৈরি করা যাচ্ছে স্বল্প টাকায়। এটা কি গণমাধ্যমের এক ধরনের ‘‘গণমুখিনতা’’?
ফাহমিদুল: ইউটিউব-এর ’টিউব’ অংশটি নেয়া হয়েছে টেলিভিশনের ‘পিকচার টিউব’ ধারণা থেকে। আদি সিআরটি টেলিভিশনের মূল বিষয়ই ছিল পিকচার টিউব। সনাতনী সম্প্রচার-টেলিভিশনের নানান বিকল্প তৈরি হচ্ছে, এবং তা মূলত ইন্টারনেটকেন্দ্রিক। ওয়েব টিভি-র ধারণা এভাবেই এসেছে। আবার টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র ফিকশনের একটা সম্মিলিত রূপ দেখা যাচ্ছে ওটিটি (ওভার দ্য টপ) প্ল্যাটফর্মগুলোয়। নেটফ্লিক্সে টিভি সিরিজের মতো ওয়েব সিরিজ আছে, আবার তারা চলচ্চিত্রও প্রযোজনা করছে, যা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেতেও পারে, নাও পেতে পারে।
আমরা ২০১৬ সালে টেলিভিশন সংখ্যা প্রকাশ করি, কিন্তু তার কাজ হয়েছে ২০১৩ থেকে। ওই সময়টায় বাংলাদেশে টেলিভিশন কারখানা এক উৎকর্ষের মধ্যে অবস্থান করছিল। নতুন শতকের গোড়াতেই টেলিভিশন বুম হয় দেশে, এবং তা ২০১৫ নাগাদ সবচেয়ে প্রভাবশালী মিডিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আমি মনে করি ২০১০ নাগাদ মুদ্রণ সংবাদপত্রের গুরুত্বকে ছাপিয়ে যায় টেলিভিশন নিউজ। তবে ২০২০ নাগাদ তা পড়তির দিকে। টেলিভিশন ফিকশন বা নাটক অবশ্য ২০১০-এর আগেই তার মূল্য হারিয়েছে। অন্যান্য দেশে কিন্তু টেলিভিশন এখনও গুরুত্বসহই বিরাজ করছে। আমাদের দেশে বিশেষ করে টেলিভিশনগুলো, বেশিমাত্রায় সরকার অনুগত, তাই তারা নিজেরাই দর্শকপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেছে, বেশ দ্রুত। টেলিভিশনের লাইসেন্সপ্রক্রিয়াতেই এই গলদ ছিল, কেবলমাত্র সরকারঘনিষ্ঠ লোককেই লাইসেন্স দেয়া হয়।
তবে পরিবর্তিত সময়ে আমরা টেলিভিশন সেটে আজকাল ইন্টারনেটনির্ভর ওটিটির অনুষ্ঠান দেখি, আবার ল্যাপটপে বা মোবাইল ফোনে সম্প্রচার টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখি। সময়টাই এখন সম্মিলন বা কনভার্জেন্সের। সম্প্রচার টেলিভিশন যে রাজত্ব করেছে পঞ্চাশের দশক থেকে বাকী শতক, নতুন শতকে তার একক আধিপত্য থাকছে না। তবে টেলিভিশন ধারণাটি থাকছেই, সেটা ওয়েব টিভি হোক আর ফেসবুকে জুম বা স্ট্রিমইয়ার্ডের লাইভ হোক।
সহজিয়া : অ্যাকাডেমিক বা নন-অ্যাকাডেমিক — কোনো পরিসর থেকে ন্যূনতম দক্ষ না হয়ে অনেকে নিউজ পোর্টাল চালু করেছেন, করছেন। ইউটিউবে চ্যানেল খোলার মাধ্যমে বিভিন্ন সংবাদ বা তথ্য পরিবেশন করছেন। এখানে যেমন তথ্য প্রচারের স্বাধীনতা থাকছে, তেমনি উদ্দেশ্যমূলক তথ্যবিকৃতির সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে। তথ্যকে স্বেচ্ছাচারীভাবে পরিবেশনের সুযোগ থাকছে। এক্ষেত্রে ‘‘বিকল্প গণমাধ্যম’’ গণ হতে গিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে না? পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে না? সংবাদ ও গুজবের পার্থক্য করতে না পারার দায় কার ওপর বর্তাবে? প্রকাশক ও ভোক্তা? গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ হিসেবে এই বিষয়গুলোকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
ফাহমিদুল : বিকল্প গণমাধ্যমের আলাপ আমি আগেই করেছি। মূলধারার বিকল্প হয়ে, মূলধারার মতো করে বা তারও ইনফেরিওর কন্টেন্ট নির্মাণ করে যারা, তাদের বিকল্প গণমাধ্যম বলা যায় না। নিশ্চয়ই অল্প কিছু সাইট বা ফেসবুক প্রফাইল বা ব্লগ বিকল্প গণমাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু ইন্টারনেটে বা সামাজিক মাধ্যমে সনাতনী বড় খেলোয়াড়রা যেমন আছে, তেমনি মিডিয়ার গণতন্ত্রায়ণের সুযোগ নিয়ে অনেক অপরিপক্ব, অপরিণামদর্শী, পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণার লোকজনও হাজির আছে। ফ্যাক্টনির্ভর সংবাদ আর ভুয়া সংবাদের পার্থক্য করাই মুশকিল হচ্ছে। বিশেষত নতুন ও অনলাইন সংস্কৃতিতে অনভ্যস্ত লোকজনের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ এটা। নিউ মিডিয়া লিটারেসি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এই লিটারেসির অভাবেই কিন্তু রামুর মতো ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে। রামুর মডেলে নাসিরনগর, রংপুরসহ নানান জায়গায় সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে। সংখ্যালঘু কারো ওয়ালে গিয়ে কোরান/রসুলের অবমাননার পোস্ট করে এটা তার নামে চালিয়ে দিয়ে এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপরে হামলা করার ঘটনা ঘটেছে, ইউজারের প্রাইভেসি সেটিং দুর্বল থাকার কারণে। নিজ নিজ প্রাইভেসি সেটিং ঠিক করে নেয়া বা স্ট্রং পাসওয়ার্ড দেয়া কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া লিটারেসির অংশ। আবার ওই জ্ঞানটাও সাধারণ মানুষের থাকা দরকার যে অন্যের ওয়ালে জিনিস জুড়ে দিয়ে তাকে তার নামে প্রচার করা একটা হীন ষড়যন্ত্র!
আবার পেশাদার সংবাদ আর ভুয়া সংবাদ চিহ্নিত করতে পারাও মিডিয়া লিটারেসির অংশ। এক্ষেত্রে চেনা পদ্ধতি হলো পোর্টালের ব্র্যান্ডকে গুরুত্ব দেয়া। নামী ও চেনা/পেশাদার সংবাদ প্রতিষ্ঠানের পরিবেশিত সংবাদ ছাড়া চোখের সামনে কিছু চলে আসলেই তা সহজে বিশ্বাস করা উচিত নয়। আবার ইউজারদেরও দেখামাত্র শেয়ার করা চাঞ্চল্যকর বিষয় দেখামাত্রই চঞ্চল হয়ে ওঠা যাবে না। একটু সময় নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা উচিত বা শেয়ার করা উচিত। ইউজারদের এক্ষেত্রে ধীরে ধীরে স্মার্ট হয়ে উঠতে হবে। এজন্যই এসব ক্ষেত্রে পরামর্শ হলো, ”থিঙ্ক বিফোর ইউ ক্লিক”।
তবে মাধ্যমের এই গণতন্ত্রায়ণকে আমি ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই। আগে কেবল প্রশিক্ষিত সাংবাদিকরাই সংবাদ সংগ্রহ করতো ও পরিবেশন করতো। কিন্তু এখন নাগরিক সাংবাদিকরাও কাঁচা বা raw সংবাদ পরিবেশন করছে। এতে খুব কম বিষয়ই আনহার্ড বা আনএক্সপ্লোরড থাকছে। অনেক সময় মেইনস্ট্রিম মিডিয়া সমাজের অন্যান্য ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর সঙ্গে মিথোজীবীমূলক সম্পর্কের কারণে অনেক কিছুই পরিবেশন করতো না, বা ‘কিল‘ করে দিত। নাগরিক সাংবাদিকদের কারণে সেসব বিষয়ও সামনে চলে আসছে। তবে চ্যালেঞ্জ থেকেই যাচ্ছে। ভুয়া সংবাদের ছড়াছড়ি, ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো আইন থেকে মামলার ঝুঁকি থাকায় অনেকে অনেক সাধারণ জিনিসও পরিবেশন করছে না, বা করতে ভয় পাচ্ছে। আমাদের কর্তৃত্ববাদী সরকার পেশাদার সাংবাদিকতাকে আজকাল এতটাই নিয়ন্ত্রণ করে যে, গুজব ও ফেইক নিউজ এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতাও পেয়ে যাচ্ছে। পেশাদার সাংবাদিকতা যত স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে, গুজব ও ভুয়া সংবাদের বিকাশ তত কম হবে।
সহজিয়া : এখন প্রায় সব টিভিচ্যানেলেরই ইউটিউব চ্যানেল আছে। গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব দৈনিক পত্রিকা ইউটিউবের সঙ্গে সম্পর্কিত। তারা সংবাদ ও অনুষ্ঠান প্রচার করছে। এই অন্তঃমাধ্যম-সম্পর্ক — প্রিন্ট-অডিও-ভিজ্যুয়াল — পরস্পরনির্ভর সম্পর্ককে কীভাবে দেখছেন? এটি কি ‘‘নিউমিডিয়া’’ ধারণার ফল?
ফাহমিদুল : এবিষয়ে একটু আগেই আলাপ করেছি। সম্মিলনই হলো এখনকার মিডিয়ার বাস্তবতা। নিউ মিডিয়া হলো কনভার্জেন্ট মিডিয়া। আর টেক্সট, আলোকচিত্র, শব্দ সবকিছুর সম্মিলনে যে মাল্টিমিডিয়া, সেটাই হলো আজকের বা ভবিষ্যতের বাস্তবতা। এই ‘ভবিষ্যৎ’ আবার পরিবর্তনশীল। আপনি বড়জোর ৫ বা ১০ বছর অব্দি কল্পনা করতে পারেন, এতই দ্রুত পরিবর্তনশীল নিউ মিডিয়ার জগত।
তো আপনাকে ধরতে হবে ইন্টারন্টে সংযোগ থাকা স্মার্ট মোবাইল ফোন হলো কনভার্জেন্সের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ যেখানে নিউ ইয়র্ক টাইমসে টেক্সটের পাশাপাশি/সঙ্গে ভিডিও থাকবে আর বিবিসিতে ভিডিও রিপোর্টের পাশাপাশি/সঙ্গে টেক্সট ছাপা হবে। একইসঙ্গে তাদের ফেসবুক পেইজ থাকবে এবং ইউটিউব চ্যানেল থাকবে। এই বাস্তবতায় যারা নিজেদের বদলে নিতে পেরেছে তারা টিকে আছে, মুদ্রণ মাধ্যমের অনেকেই ঝরে গেছে।