২০২০ সালে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন লুইজ এলিজাবেথ গ্ল্যুক। গ্ল্যুকের লেখায় নোবেল দাতা গোষ্ঠী পেয়েছেন : “unmistakable poetic voice that with austere beauty makes individual existence universal.” আমরা উদ্যোগ নিয়েছি গ্ল্যুকের কবিতার ধারাবাহিক উপস্থাপনার। কয়েক কিস্তিতে বেশ কিছু কবিতার অনুবাদ প্রকাশ করার পরিকল্পনা রেখেছি। আজ থাকছে মুম রহমানের অনুবাদে ৫টি কবিতা।
সর্সি’র ক্ষমতা
আমি তো কখনোই কাউকে শূকর বানাইনি
কিছু মানুষই শূকর; আমি কেবল তাদের
শূকরের মতো দেখতে করেছি।
আমি তোমাদের এই দুনিয়া নিয়ে অসুস্থ
এখানে বাইরের ছদ্মবেশ ভেতরকে ঢেকে রাখে। তোমাদের পুরুষেরা
আদতে খারাপ ছিলো না :
উচ্ছৃঙ্খল জীবন
তাদের এমন করেছে। শূকরের মতো,
আমার যত্নে
এবং আমার নারীদের যত্নে, তারা
মধুর হয়ে উঠেছিলো।
তারপর আমি জাদুমন্ত্র উল্টে দিয়েছি, তোমাকে দেখিয়েছি আমার ভালোত্ব
ঠিক যেমন দেখিয়েছি ক্ষমতা। আমি দেখেছিলাম
আমরা এখানে সুখি হতে পারতাম,
যেমন নারী পুরুষরা হয় আর কি
যখন তাদের চাহিদাগুলো সরল। এক নিশ্বাসে,
আমি আগেই দেখেছি তোমার প্রস্থান,
তোমার লোকেরা আমার সহযোগিতায় নির্ভয়ে গিয়েছে
ক্রন্দনরত আর ক্রুব্ধ সমুদ্রে। তুমি মনে করো
সামান্য কান্না আমাকে মর্মাহত করে? বন্ধু আমার,
প্রত্যেক জাদুকরই
হৃদয়ে বাস্তববাদী; কেউ দেখতে পায় না নির্যাস যে কিনা
সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হয়। আমি যদি নেহাত তোমাকে ধরে রাখতে চাইতাম
আমি তোমাকে বন্দী করে রাখতে পারতাম।
* সর্সি : হোমারের অডেসি মহাকাব্যের ছোট্ট একটি চরিত্র। অডিসিয়াম তার অভিযান কালে আয়েয়া দ্বীপে যায়, এই দ্বীপেই তার বসবাস। ট্রোজান যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে অডেসিয়াস এখানে এলে সর্সি তার জাদুবলে অডেসিয়াসের লোকদের শূকরে পরিণত করে। উল্লেখ দেবতা হেলিয়াস ও দেবী হেকাটের কন্যা সর্সি হলেন গ্রিক পুরাণে জাদুমন্ত্রের দেবী। তিনি মানুষকে নানা পশু বানিয়ে ফেলতেন। নানা রকম বিষ, সুরা তৈরি করতে পারতেন, তার ছিলো যাদুর কাঠি। যাহোক অডেসিয়াস একবছর সর্সি’র সঙ্গে থাকেন, তাদের একটি সন্তান হয় এবং শেষ পর্যন্ত সর্সিকে অনুরোধ করে তার বাহিনীকে শূকর থেকে মানুষের রূপান্তর করাতে রাজি করতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সুন্দরী, ক্ষমতাবান এই নারী অডেসিয়াসের প্রেমমুগ্ধ ছিলেন। গ্রিক এমনকি রোমান পুরাণে সর্সি জাদুকরী, কামোত্তেজক, ঈর্ষাপরায়ণ এবং ক্ষমতাবান এক নারী। ওভিদের মেটামরফোসিসেও এই নারীর কথা আছে। লুইজ গ্ল্যুকের একাধিক কবিতায় এই নারীকে পাওয়া যায়।
সর্সি’র যন্ত্রণা
আমি তিক্ততার সাথে অনুতাপ করি
তোমাকে ভালোবাসার বছরগুলিকে
তোমার উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতি উভয়কেই, অনুতাপ করি
সেই সব আইন আর অনুশাসনকে
যা নিষেধ করে আমাকে তোমার কাছে রাখতে, সেই সমুদ্র
কাচের চাদর, সূর্য-স্নাত
গ্রিক জাহাজের শোভা : কেমন
করে আমি ক্ষমতা কাজে দেবে যদি
আমার কোন ইচ্ছাই না থাকে
তোমাকে রূপান্তরিত করার :
যেমন তুমি আমার শরীরকে ভালোবেসে ছিলে
যেমন তুমি খুঁজে পেয়েছিলো তাদের
কামনা আমাদের সকল উপহারেরও
চেয়েও অধিক, সেই অনন্য মুহূর্তে,
সম্মান ও আশার উপর,
বিশ্বস্ততার উপর, সেই বন্ধনের নামে যা
আমি প্রত্যাখান করি
তোমার স্ত্রীর জন্য তোমার অনুভূতি
যেমন তোমাকে দিয়েছি
তার সঙ্গে বিশ্রাম করতে, আমি প্রত্যাখান করি তোমাকে
ঘুমাও আবার তুমি
যদি আমি নাই বা পাই তোমাকে।
রাত্রির গান
উপরে দেখো লণ্ঠনের আলো।
তুমি কি দেখোনি? অন্ধকারের নিস্তব্ধতাখানি
স্বর্গের আতঙ্ক।
আমরা আলাদা ছিলাম অতি দীর্ঘ, অতি বেদনাদায়ক বিচ্ছিন্নতা।
কেমন করে তুমি স্বপ্ন ধারণ করো,
এ দেখা পরিত্যাগ করো? আমি মনে করি তুমি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখো।
তোমার মুখ মৃদু প্রত্যাশায় পরিপূর্ণ।
তোমাকে আমার জাগানো প্রয়োজন, তোমাকে মনে করিয়ে দেয়া প্রয়োজন যে কোথাও কোন ভবিষ্যত নেই।
সেই কারণেই আমরা স্বাধীন। আর এখন আমার মাঝের অনেক দুর্বলতা কেটে গেছে একেবারে, তাই আমি বাধ্য নই
চোখ বন্ধ করতে, ফিরে যেতে, সংশোধিত হতে —
সৈকত শান্ত; সমুদ্র পরিস্কার করে তার বাহুল্যপূর্ণ জীবন,
অস্বচ্ছ, পাথুরে। গুচ্ছে গুচ্ছে, উদ্ভিজ সমারোহে,
সমুদ্রপাখিরা ঘুমায় জাহাজ-ঘাটে। টার্নেস*, ঘাতক —
তুমি ক্লান্ত; আমি দেখতে পাচ্ছি।
আমরা দুজনেই ক্লান্ত, আমরা এক বিরাট নাটক সমাপ্ত করেছি।
এমনকি আমাদের হাত শীতল, সেগুলো যেন আগুনের ইন্ধনকাঠি।
আমাদের পোশাক বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে বালুতে, অদ্ভূতভাবে
অনেকটাই,
তারা কখনোই ছাইয়ে পরিণত হয়নি।
তোমাকে আমার বলতে হবে আমি কী শিখেছি, যা জানি এখন
স্বপ্নবাজদের কী হয়েছে।
তারা এটা অনুভব করে না যখন তারা বদলায়। একদিন
তারা জেগে ওঠে। তারা সাজগোজ করে। তারা বৃদ্ধ হয়ে যায়।
আজ রাতে আমি ভীত নই।
বিপ্লব অনুভব করতে। কেমন করে তুমি ঘুমাতে চাইবে
যখন কামনা তোমাকে সেই শান্তি দেয়?
আজ রাতে তুমি আমার মতোই, সৌভাগ্যবানদের একজন।
তুমি যা চাও তাই তুমি পাবে। তুমি পাবে তোমার বিস্মরণ।
* টার্নেস অনেকটা সীগালের মতোই পাখি। তবে আকারে ছোট। এরা মাছ শিকার করে। সৈকতের কাছাকাছিই থাকে।
প্রজাপতি
দেখো, একটা প্রজাপতি। তুমি কি কোন আকাঙ্ক্ষা বুনেছো?
তুমি প্রজাপতি দেখলে একটা আকাঙ্ক্ষা করো না।
তুমি তো তা করো। তুমি কি এবার একটা করেছো?
হ্যাঁ।
এটা গণনা হয় না।
আকাঙ্ক্ষা
মনে আছে সেই সময় যখন তুমি আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলে?
আমি অনেক আকাঙ্ক্ষা বুনেছি।
যখন আমি তোমাকে মিথ্যা বলেছিলাম
প্রজাপতি সম্পর্কে। আমি সব সময়ই ভাবতাম
তুমি কিসের আকাঙ্ক্ষা করেছো।
তোমার কি মনে হয় আমি কীসের আকাঙ্ক্ষা করেছিলাম?
আমি জানি না। হয়তো আমি ফিরে আসবো,
হয়তো কোনভাবে শেষ পর্যন্ত আমরা একত্র হবো।
আমি সেই আকাঙ্ক্ষাই করেছিলাম যা সব সময় আকাঙ্ক্ষা করি।
আমি আরেকটা কবিতার আকাঙ্ক্ষা করেছিলাম।
সন্তগণ
আমাদের পরিবারে, দুইজন সন্ত ছিলেন,
আমার খালাম্মা আর দাদিমা।
কিন্তু তাদের জীবন ছিলো আলাদা।
আমার দাদিমা ছিলেন প্রশান্ত, এমনকি শেষ মুহূর্তেও।
তিনি এমন লোক যেন শান্ত জলে হাঁটছেন;
কোন কারণে
স্বয়ং সমুদ্রও পারেনি তাকে আঘাত করতে।
যখন আমার খালাম্মা সেই একই পথে গেছেন,
ঢেউয়েরা তার উপর আছড়ে পড়েছে, তারা তাকে আক্রমণ করেছে
যেমন করে নিয়তির সাড়া দেয়
সত্যিকারের আধ্যাত্মিক প্রকৃতির উপর।
আমার দাদিমা ছিলেন সর্তক, রক্ষণশীল :
সে কারণেই তিনি ভোগান্তি এড়িয়ে গেছেন।
আমার খালাম্মা কিচ্ছু এড়িয়ে যাননি;
প্রত্যেকবার সমুদ্র পশ্চাদপসরণ করেছে, তিনি ভালোবাসেন এমন কাউকে নিয়ে গেছে দুরে।
তবুও তিনি সমুদ্রকে
অশুভ বলে জ্ঞান করেন না। তার কাছে এটা যেমন আছে তেমনই:
যখন সে মাটিকে স্পর্শ করে, সে অবশ্যই হিংস্র হয়ে ওঠে।