“মৃত” ভাষার সজীব বয়ান

লাতিন ভাষার কথা — আমাদের সুপরিচিত অনুবাদক জি এইচ হাবীবের নতুন অনুবাদকর্ম। বইটি হাতে নিয়েই আমরা এক ধরনের ভালো লাগায় আক্রান্ত হই, কেননা সাম্প্রতিক অতীতে এতোটা সুমুদ্রিত, পরিপাটি বই আমাদের অভিজ্ঞতায় আসেনি। ‘অনুবাদকের কথা’-শীর্ষক গদ্যে আমরা জানতে পারি, ভুবনখ্যাত  সুইডিশ ভাষাবিদ তরে ইয়নসনের Latin: Kulturen, historien, språket বইটির মেরেতে ড্যামসগার্ড সোরেনসেন ও নাইজেল ভিনসেন্টকৃত ইংরেজি এডাপ্টেশন পড়ে তাঁর ভালো লাগার কথা। আমাদের আলোচ্য বইটি সেই এডাপ্টেশন A Natural History of Latin-এর প্রথম দুটি পর্বের অনুবাদ। পর্ব দুটির নাম ‘Latin and the Romans এবং ‘Latin and Europe’; বাংলায়, ‘লাতিন ও রোমকরা’ এবং ‘লাতিন ও ইউরোপ’।

 

অনুবাদক আশংকা করেছেন, লাতিনের ব্যাকরণ ও শব্দভান্ডার সম্পর্কে খুব বেশি লোক আগ্রহী হবেন না। এই কারণেই তিনি A Natural Hisotory of Latin-এর বাকি তিন পর্ব ‘About the Grammar’, ‘Basic Vocabulary’, ‘Common Phrases and Expressions’ তিনি অনুবাদ করেননি। আমাদের কাছেও আশংকাটি অমূলক মনে হয় না। কেননা, লাতিন সম্পর্কে বিজ্ঞ মহলেরই ধারণা যে, এটি একটি ‘মৃত ভাষা’। ফলে এই ভাষার শুলুকসন্ধানে সাধারণ্যে আগ্রহ না থাকাটাই স্বাভাবিক। তবু অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য তিনি আরেকটি বই থেকে কিছু শব্দবন্ধ উচ্চারণ, অর্থ, টীকাসহ অনুবাদ করে দিয়েছেন।

 

অনুবাদকের জবানিতেই আমরা জানতে পারি, পঞ্চম পর্ব ‘Phrases And Expressions’-এর সাথে ইউজিন এরলিখের Amo, Amas, Amat and More বইটির সাদৃশ্য আছে। সে বই থেকে কিছু শব্দবন্ধ ‘প্রচলিত লাতিন শব্দবন্ধ’ শিরোনামে ”লাতিন ভাষার কথা”-য়  গ্রন্থিত হয়েছে।

 

এট্রুসকান বর্ণমালা জন্মেছিল ইতালিতে, গ্রিক অক্ষর থেকে। ইউবীয় গ্রিকরা ( Euboean Greeks) পশ্চিমাঞ্চলের ভাষাটিকে ইতালিতে নিয়ে আসেন। এই অক্ষরের সর্বপ্রাচীন নিদর্শন খ্রিস্টের জন্মের ছয়শো বছর আগের। বেশিরভাগ লিপি ডানদিক থেকে বাম দিকে প্রসারিত, কিন্তু কিছু জায়গায় বাম দিক থেকে ডান দিকে গিয়ে আবার পরবর্তী লাইনেই ডানদিক থেকে বামদিকে। এই পদ্ধতিটাকে বলা হয় Boustrophedon। এ ভাষায় এমনকি সংগীতের স্বরলিপির সন্ধান মিলেছে। এই ভাষাটি এট্রুরিয়ার (তাসকানি ও আমব্রিয়া অঞ্চলের ) অধিবাসীরা খ্রিস্টের জন্মের ১০০ বছর পর অব্দি ব্যবহার করেছেন। পুরোহিত আর পণ্ডিতেরা আরো কিছুকাল এ ভাষার প্রেমে মশগুল ছিলেন। সম্রাট ক্লডিয়াস এট্রুসকানদের ইতিহাস বিশ খণ্ডে রচনা করেন যার হদিশ আর মেলে না। আল্পস অঞ্চলে একসময় ব্যবহৃত হতো ‘রায়েটিক’ এবং লেমনস দ্বীপপুঞ্জে ‘লেমনিয়ান’। এই ভাষাদ্বয়ের সাথে এট্রুসকানের সম্পর্ক রয়েছে। উত্তর-পশ্চিম ইতালির ‘কামুনিক’ ভাষার সাথেও লাতিনের সম্পর্ক রয়েছে বলে অধিকাংশ ভাষাবিজ্ঞানীর মত।

 

টাইবার নদীর ধারে ছোটো শহর রোম, শান্ত ও পরিপাটি। প্রায় দুইশো বছর ধরে রোমানরা যেখানেই গেছে সেখানকার লিপি সংগ্রহ করে এনেছে। মোটামুটিভাবে এট্রুসকান ভাষার ধ্বনিগত ও রৈখিক নিয়ম মেনেই লাতিন বিকশিত হয়েছে। লেখার দিক বলা বাহুল্য, একই। এই ব্যাপারটা লক্ষিত হয় খ্রিস্টের জন্মের ছয়শো বছর আগে। পরে স্বাভাবিকভাবেই লাতিন ভাষার দাবিতে এট্রুসকান পাল্টাতে শুরু করে। ধীরে ধীরে লাতিন অক্ষর, ভাষা ও লিপি স্থায়ী রূপ পায়।

 

লাতিন ভাষার কথা পড়তে গেলে আমরা মুখোমুখি হবো প্রায় তিন হাজার বছর আগের একটি ভাষার উৎপত্তি ও বিবর্তনের ইতিহাসে। একটি ভাষা কী করে অনেকটা অঞ্চলব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ও বিকশিত হয় সেই ইতিহাসটাই এই বইতে আলোচিত হয়েছে। ভাষাটি সম্পর্কে মনে রাখার মতো অজস্র গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের উল্লেখ আছে গ্রন্থটিতে, সেই তথ্য-সমুদ্র থেকে একগণ্ডূষ নীচে দেয়া হলো :

 

এক। লাতিন ভাষায় the বা indefinite article-এর তুল্যমূল্য কিছু নেই। (পৃ.। ১৬) দুই। লাতিন শব্দে স্বরাঘাত পড়ে, সবসময়, শেষ থেকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় দল বা সিলেবলে। (পৃ.। ১৯ ) তিন। ইংরেজি শব্দ people এসেছে লাতিন populus থেকে, ফরাসি peuple হয়ে। (পৃ.। ২২) চার। মজার বিষয় হলো, অনেক স্কটিশ উপভাষার আধুনিক উচ্চারণ লাতিনের উচ্চারণের কাছাকাছি, কারণ সীমান্তের দক্ষিণের উপভাষাগুলোর মতো সেগুলো একই ‘স্বরবর্ণ পরিবর্তনের’ (vowel change) মধ্যে দিয়ে যায়নি। (পৃ. ২৫) পাঁচ। সংরক্ষিত হয়েছে এমন সবচাইতে পুরনো লাতিন সাহিত্য বলতে আমরা প্লতাস নামের এক ভদ্রলোকের বেশ কিছু নাটককেই বুঝি। (পৃ.। ৩৯) ছয়। মিশরীয়রা প্যাপিরাসে লেখার কৌশল আবিষ্কার করে, এবং ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে তা গোটা ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। (পৃ.। ৪৯)

 

এইভাবে পুরো বইটিই তুলে দেয়ার লোভ আপাতত সংবরণ করতে হচ্ছে। প্রথম দুটি পর্ব ছোটো ছোটো উপ-শিরোনামে বিভক্ত। প্রথম পর্বে উপশিরোনামের সংখ্যা পঁচিশ এবং দ্বিতীয় পর্বে বাইশ। প্রথম পর্বে, ছোটো ছোটো উপ-শিরোনামে জানা যাবে লাতিন ভাষার প্রাথমিক পরিচয়। তারপর রোমের আদিকালের ইতিহাস হয়ে লাতিন কীভাবে লাতিন হলো, ইতিহাসের ভাষা হিসেবে লাতিনের ভূমিকা কী , রোমকরা জাতি হিসেবে কেমন ছিলো এবং গ্রিসের সাথে রোমের সম্পর্ক কেমন ছিলো, বক্তৃতা-রাজনীতি – বিচারের ভাষা, ইতিহাসের ভাষা হিসেবে লাতিনের ভূমিকা, এসব কথা।

 

পাঠক প্রায় তিন হাজার বছরের ইতিহাসে মানসভ্রমণ করতে করতে দেখবেন কেমন করে লাতিন অতি ধীরে সমগ্র ইউরোপের ভাষা হয়ে উঠল । জ্ঞান-বিজ্ঞান, দৈনন্দিন জীবনের ভাষা, আইন ও আইনের ভাষা, লাতিন কবিতা ও কবি তথা সাহিত্যিকদের সম্পর্কে জানার পাশাপাশি ধর্ম হিসেবে খ্রিস্ট ধর্মের উৎপত্তির ইতিহাস মনোযোগী পাঠকের করতলগত হয়ে যাবে।

 

দ্বিতীয় পর্বে রোমের পরে বাকি ইউরোপে লাতিনের ভূমিকা, লাতিনসহ অন্যান্য রোমানভাষাসমূহের বিবরণ জানা যাবে। বৃটেনে লাতিনের প্রভাব, বিদ্যালয়ে লাতিন চর্চার বিবরণ এমনকি বাচন ও বানান সম্পর্কে তো বটেই সেই সময়ের সন্ত ও ধর্মদ্রোহী, ঐতিহ্যের অভিভাবক (কোন কালেই না এঁরা ছিলেন!) সম্পর্কে জানতে জানতে গ্রন্থের গভীরগামী পাঠক জেনে ফেলবেন পদার্থবিদ, রসায়নবিদ এবং চিকিৎসকদের ভাষা সম্পর্কে। খুব মজা করে লেখা হয়েছে কিমিয়া, ডাকিনীবিদ্যা ও হ্যারি পটারের সম্পর্ক।

 

দ্বিতীয় পর্বের একেবারে শেষে ‘ লাতিন ও জার্মান’, ‘লাতিন ও ফরাসী’, ‘ লাতিন ও ইংরেজি’ এবং ‘লাতিন ও আমরা’- এই চারটি উপ-শিরোনামে সংক্ষেপে লাতিনের সাথে জার্মান, ফরাসি ও ইংরেজদের সম্পর্ক আলোচনা করা হয়েছে। এখানে ‘লাতিন ও আমরা’ থেকে একটি অংশ তুলে দিলে “লাতিন ভাষার কথা”-র মূল লেখক ও অনুবাদকের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আরো পরিষ্কার হওয়া যাবে, ‘লাতিন তিনটি সুনির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করেছে বা ক’রে চলেছে। প্রাচীন যুগে তা ছিলো রোমকদের মাতৃভাষা ; দুই বা তিন শতক আগে পর্যন্ত সেটি ছিলো ইউরোপের আন্তর্জাতিক ভাষা; এবং এটাই সেই ভাষা যেখান থেকে আধুনিক সব ইউরোপীয় ভাষা সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃতঋণ শব্দ নিয়েছে। তার মানে, লাতিন সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান রাখার তিনটি ভালো কারণ রয়েছে এবং আশা করা যায়, এই বইটিতে এই তিনটি ক্ষেত্র সম্পর্কে কিছুটা কাজের তথ্য পাওয়া যাবে। আপনাদের কেউ কেউ হয়তো এমনকি আরো খানিকটা এগিয়ে গিয়ে সত্যি সত্যিই ভাষাটি শিখে ফেলার মতো অনুপ্রেরণা পেয়ে যেতে পারেন। প্রচুর সময় আর প্রচেষ্টার দরকার তাতে, কিন্তু সেটি ফলদায়ক হতে পারে। ( পৃ.। ২৪৯)।

 

বইটিতে পণ্ডিতি মারপ্যাঁচ নেই একেবারেই। কবি উৎপলকুমার বসু বন্ধু সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লেখা এক চিঠিতে লিখেছিলেন,  ‘পাণ্ডিত্য থেকে দূরে থাকুন।’ উক্তিটি মজার ছলে করা হলেও এই বইটির ক্ষেত্রেও খাটে । পাঠকবান্ধব ভাষায় রচিত মূল বইয়ের লাতিন ভাষার কথা নামক অনুবাদ সাম্প্রতিক বাংলা অনুবাদের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এইজন্যে যে খটোমটো ভাষার অজুহাতে আমরা, সাধারণ পাঠকেরা, লাতিন ভাষা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকি। কিন্তু, প্রায় তিন সহস্রাব্দ ধরে পৃথিবীর ভাষার ইতিহাসে যে-ভাষাটি নিজস্ব গুরুত্বের প্রমাণ রেখে যাচ্ছে সে ভাষার অর্থাৎ লাতিনের প্রতি আমপাঠককে মনোযোগী করে তুলবার যাবতীয় আয়োজনই প্রায় নির্ভুলভাবে ছাপা এই গ্রন্থে সম্পন্ন করা হয়েছে।

 

এবার, পাঠক, বাকি কাজ আপনার হাতে। আসুন, বইটি নিয়ে কোনো এক নির্জন অবসরে বসে পড়া যাক। আপাতত, এই আলোচক পড়বার সময়টি বিফলে না যাওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে বিদায় নিচ্ছে এখান থেকে, তার আগে অনুবাদক জি এইচ হাবীবকে কিছু বিমুগ্ধ করতালি এবং সেই সাথে, বিষয়ানুগ প্রচ্ছদের জন্য শিল্পী নির্ঝর নৈঃশব্দ্য এবং এই বাণিজ্যপরাহত প্রয়াসের জন্য প্রকাশক প্রকৃতি-পরিচয়কে অভিবাদন জানানো জরুরি!

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here