লেখালেখির উঠান : নতুন পত্রিকার গন্ধ

লেখালেখির উঠান ।। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির কাগজ ।। বর্ষ ২ সংখ্যা ২ ।। ফেব্রুয়ারি ২০২০

 

হাতে পেলাম নতুন ছোটকাগজ লেখালেখির উঠান। নতুন লেখা, নতুন কালির গন্ধ লেগে থাকা কাগজটি উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে খানিকটা স্মৃতিকাতর হতে হলো : ছোটকাগজ টিকে আছে! আশি-নব্বই দশকের আন্দোলনগুলো কি ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে গেছে? সেই নস্টলাজিয়ায় উঁকি দিয়ে লাভ নেই। কারণ নতুন গণমাধ্যম-ব্যবস্থা আমাদের দাঁড় করিয়েছে অ-মুদ্রণের জগতে।

 

কিন্তু লেখালেখির উঠান  দুই দুুনিয়ার মধ্যবর্তী সাঁকো। আমরা একে পাই অনলাইনে, আবার পাই অফলাইনে। দুই মাধ্যমে সমান তৎপর এই পত্রিকা। অসাধারণ একটি প্রকাশনা প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প, বাংলাদেশের বিভিন্ন ভাষার কবিতা, বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার কবিতা, অনুগল্প, সাক্ষাৎকার, স্মৃতিচারণ, অনুবাদ গল্প, চলচ্চিত্র, ভ্রমণসাহিত্য, সংগীত গ্রন্থালোচনা — বিচিত্র সম্ভারে সজ্জিত।

 

লেখার বিষয়বস্তুগুলো চিন্তাজাগানিয়া। প্রায় প্রতিটি প্রবন্ধে নতুন চিন্তাসূত্রের বীজ নিহিত। হোক তা ‘আক্রান্ত জীবনানন্দ’, ‘মুনীর নিয়াজি’, ‘রবীন্দ্রনাট্যের রাজাগণ’, ‘ট্রটস্কি ও ফ্রিদা কাহলো’। বিশেষভাবে বলতে হয় মুনীর নিয়াজি ও রবীন্দ্রনাটক বিষয়ক প্রবন্ধ দুটির কথা। জাভেদ হুসেনের জবানিতে আমাদের দেশে স্বল্পপরিচিত মুনীর নিয়াজিকে চেনা গেলো। আলতাফ পারভেজ হাজির করেছেন ট্রটস্কি ও ফ্রিদা কাহলোর সম্পর্কের একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা।

 

রবীন্দ্রনাটক প্রসঙ্গে হুমায়ূন আজম রেওয়াজের বক্তব্য নতুন করে ভাববার কিছু জায়গা প্রস্তুত করে দিল। কারণ তিনি রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি করা রাজাদের একটি রাজনৈতিক পাঠ হাজির করেছেন। প্রকৃতপক্ষে প্রবন্ধটি বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। তাঁর বেশ কিছু প্রশ্ন ও প্রস্তাবনা রবীন্দ্রসাহিত্য পাঠের নতুন সম্ভবনার কথা বলে। যেমন তিনি বলেছেন, ‘প্রশ্ন হল, রাবীন্দ্রিকতা কি একটি মতবাদ হয়ে উঠেছে? নাকি আমরা করি রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাবনাকে মতবাদ ঠাওরে রাজা-উজির মারছি? কিংবা মতবাদ এবং প্রস্তাবনাসমূহকে গুলিয়ে ফেলছি?’ রেওয়াজ বলছেন, আইডিয়া/ কনসেপ্ট/ হাইপোথিসিস/ প্রিন্সিপাল/ ল/ থিয়োরি ইত্যাদি অবস্থানে ‘রবীন্দ্রনাথের কোন প্রস্তাবটি কোন স্তরে’ তা বিবেচনায় আানা উচিত।

 

তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ এই যে, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ, রাজনৈতিক ভাবনা, সমাজ ও উন্নয়ন তত্ত্ব আলোচনার জন্য সমালোচকরা রাশিয়ার চিঠি, গোরা, চার অধ্যায়, কালান্তর প্রভৃতি লেখাকে আমলে নিলেও রক্তকরবী, মুক্তধারা, রাজা, রথের রশিকে তেমন একটা গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেন না। তাই এ প্রশ্নও তুলেছেন, ‘‘নাট্যকার রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্ম কি অরাজনৈতিকতার তত্ত্ববাহী।’’ মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটকের রাজাদের প্রসঙ্গে রেওয়াজ অনেকগুলো প্রশ্ন ও প্রস্তাবনা পেশ করেছেন। তাঁর মতে রবীন্দ্রনাথের রাজারা রাজধর্ম বজায় রাখলেও ‘রাষ্ট্রনীতিবর্জিত’, ‘রাজাগণ এখানে ব্যক্তিসত্তার উপরে উঠার সুযোগ পেয়েছেন খুব কম।’, ‘রাষ্ট্রের বিস্তৃত কাঠামোর প্রতিনিধি তারা নন বরং অংশ মাত্র।’

 

কিন্তু বিপরীত প্রশ্নও তোলা যায়, রবীন্দ্রনাথ কি রাষ্ট্রকে সমাজের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন? রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রনীতি, রাষ্ট্রপরিচালনা — রাষ্ট্রবিষয়ক এই ধারণাগুলোকে ভাবনার কেন্দ্রে রেখে রবীন্দ্রনাথ নাটক লিখেছেন? ‘রামরাজ্য’ বা ‘ইউটোপিয়া’ হিসেবে ‘শ্রীমণ্ডিত’ কিন্তু ‘বাস্তবিক নয়’ — রেওয়াজের এ সিদ্ধান্ত আদতে সকল ধরনের আইডিয়া, হাইপোথিসিসকেই ‘কেবলই’ ইউটোপিয়া হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলার ঝুঁকি তৈরি করে।

 

ধরা যাক, মার্কসবাদী রাষ্ট্রের সর্বশেষ স্তরের সাম্যবাদী রাষ্ট্র কি আমরা দেখেছি? এটি কি পরীক্ষিত বাস্তবতা? শ্রীনিকেতন-শান্তিনিকেতন তৈরি করায় সমস্যা কোথায়? শ্রীনিকেতন কি ইউটোপিয়া? নাকি বাস্তব? নাকি শ্রীনিকেতন পরিচালনা এবং শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রপরবর্তী অনুশীলনে সমস্যা? যদি সমস্যা থেকেই থাকে, তাহলে তার দায় কি রবীন্দ্রনাথের? যাই হোক, একটি ভিন্ন কণ্ঠস্বরের লেখার জন্য রেওয়াজকে সাধুবাদ জানাই।

 

ফেসবুকীয় স্ট্যাটাসশাসিত লিখনকর্মে নতুন চিন্তার লেখা যখন দুর্লভ হয়ে উঠেছে তখন রেওয়াজের লেখাপাঠ দারুণ আনন্দের বিষয়। নিজের লেখাটিকে তিনি বলেছেন ‘প্রস্তাবনা তৈরির প্রস্তাবনা।’ প্রত্যাশা করি, তিনি ভবিষ্যতে প্রস্তাবনার একটি পূর্ণাঙ্গ অবয়ব আমাদের সামনে হাজির করবেন। এতে করে রবীন্দ্রনাটকের ভিন্নতর ব্যাখ্যার দরোজা উন্মোচিত হবে বলেই ধারণা করি।

 

লেখালেখির উঠানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাংলাদেশের বিভিন্ন ভাষার কবিতা; এ অংশে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের উর্দু, মারমা, চাকমা,  মান্দি কবিতা। সম্পাদকের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। কারণ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বহুভাষিক অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেয় এই আয়োজন। শামীম জামানভি, অং মারমা, মৃত্তিকা চাকমা, সুদীপ্ত চাকমা মিকাডো, শাওন রিছিলের কবিতা বাংলা ভাষীদের চমকিত করবে। ‘সম্পাদকের কথায়’ সম্পাদক এ বিষয়ক বক্তব্যও জুড়ে দিয়েছেন।

 

এছাড়া অন্য দেশের অনুবাদ কবিতার তালিকায় আছে হূবনাথ পাণ্ডেয়, ইউনুস এমরে, মিখাইল লেরমেন্তফ, মাওলানা রুমি, ইয়েটস, বদর শাকির আস সাইয়াব, তাও তে চিং প্রমুখের কবিতা। মূল হিন্দি থেকে অজিত দাশ অনুবাদ করেছেন সমকালীন হিন্দি কবিতা। পড়শি ভাষা ও দেশের সাহিত্য না জানার মতো সাহিত্যিক মূর্খতা আর হয়ই না। অজিতের চমৎকার অনুবাদগুলো সেদিক থেকে অভাবিত সংযোজন। সামগ্রিকভাবেই লেখালেখির উঠানের অনুবাদ শাখাটি সমৃদ্ধ — যা আমাদের নিয়ে যায় বহুভাষিক ও বহুসাংস্কৃতিক পরিসরে।

 

লেখালেখির উঠান সুচিন্তিত সম্পাদনার ফসল। এর পেছনে জড়িয়ে আছে বেশ বুদ্ধিবৃত্তিক একটি সম্পাদনা পর্ষদ। প্রত্যক্ষভাবে সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত আছেন মাজহার জীবন ও অজিত দাশ। দুজনকে অভিনন্দন জানাই। লেখা সংগ্রহ ও সম্পাদনার মর্মদেশে চিন্তা, বুদ্ধিবৃত্তি ও সুবিবেচনা যুক্ত না থাকলে কোনো একটি পত্রিকা সংকলন হয় মাত্র, পত্রিকা থেকে কোনো চিন্তা বা ভাবাদর্শ উৎপন্ন হয় না। লেখালেখির উঠান চিন্তা ও বুদ্ধির মাপকাঠিতে অনেক উঁচুতে অবস্থান করছে। প্রত্যাশা করি, অব্যাহতভাবে প্রসারিত হবে উঠানের দিগন্ত।

1 COMMENT

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here