পাখি-জীবনও জীবন

সাত সকালে ঘুঘুর উচ্চকিত ডাকে প্লাবিত হচ্ছে বগাডুবি বিলের নিস্তরঙ্গ জলাভূমি। বর্ষা শেষ হয়ে গেছে। তবু বৃষ্টির দাপটে জেরবার জনজীবন। পাহাড়ী ঢলে ভোগাই, মালিঝি, মহারশির শরীর ফুলে ফেঁপে উঠছে। কোথায় কোথায় ভাঙছে পাড়। প্লাবিত হচ্ছে কৃষিজমি, সড়ক কিংবা বসত বাড়ি। বগাডুবিতে পানি দম ধরে আছে।

 

ছোট নৌকায় কেউ কেউ উদোম গাঁয়ে ছুঁড়ছে জাল– ঝাঁকাভরা রুপালি পুঁটি ট্যাঙরার ছটপট ছটপট দাপাদাপি দেখতে ভালোই লাগে। বিষ আর বরফে নিস্তেজ মাছ আমরা কেজি দরে বাজার থেকে কিনলেও  মরা নরম মাছে মাছিও বসে না। মাছের বাজার মানেই তো কালোকালো ছোটছোট মাছির ভনভন। বিষের প্রকোপে মাছের বাজার থেকে মাছি উধাও। আহা কী সুন্দর রুপালি মাছের দাপাদাপি!

 

জলের ভেতর উঁকি দেয়া নানা জাতের উদ্ভিদের মাথা উঁচিয়ে শুষে নিচ্ছে সকালের রোদ আর  বিছানো সবুজ পাতা মেলে দিয়ে ফুটে আছে সাদা সাদা শাপলা; অন্য কোথাও আবার গোলাপি রঙের পাপড়ি মেলানো শাপলা জলে ভাসছে আপন মনে।

 

এখানেই নেমে পড়লাম আমরা। আমরা মানে শেরপুর বার্ড কনজারভেশন সোসাইটির টিম। আমি এ দলের অনুগামী মাত্র। পাখি চিনি বই পড়ে। চোখ মেলে দেখে বুঝি নি এশুধু চড়ুই না — এটি পাতিচড়ুই; দোচালা টিনের চালের টু’য়ে খড়ের গাদার ঘরের চড়ুই। “যে চড়ুই বাঞ্জা– ডিম পাড়ে না সে আর গেরস্থের ঘুলঘুলিতে থাকে না– আশ্রয় নেয় পাশের কোন ছোট গাছের পাতায় ছায়ায়।” বললেন শহীদুজ্জামান।

ছোট কিচিরমিচির অস্থির পাখিটি কে না চেনে? আমিও চিনি। কিন্তু যেমন করে শহীদ বলল তেমন করে তো দেখিনি আমার এই পড়শি পাখিকে। “মানে বাঞ্জা পাতিচড়ুই সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী”— যোগ করলেন আব্দুর কাদির আর সুজয় মালাকার।  আমি আমোদিত হলাম। রমতা সাধু আর বহতা জলের মতো পাতিচড়ুই সংসার মায়া পেছনে রেখে  কেবলই  উড়ে বেড়ানো গাছে গাছে। কোথাও তার বন্ধন নেই। বৈরাগ্য সাধনার  পথে পথে পাতিচড়ুই রমতা সাধু বহতা জল।

 

একটু পাখির মতো  আওয়াজ কিংবা উড়ন্ত পাখির ডানা ঝাপটানোর ছায়া দেখে  সুজয় মালাকারেরা সচকিত হয়ে খুঁজতে থাকে কোন ডালে বসল কিংবা শূন্যে পাক খেতে খেতে উড়ছে অথবা ইলেকট্রিক পুলের তারে পুচ্ছ ঝুলিয়ে বসতে না বসতে রেডি  একেক জনের ইয়া বড় বড় ক্যামরা।

 

একই সাথে হাটছে চলছি ফিরছি — আমি দেখছি গাছপালা ছুটন্ত গাড়ি অথবা কাজের জন্য বেড়িয়ে যাওয়া প্রান্তিক মানুষ  আর টিম এসবিসি — ‘এই যে পাখি বলে’ চট করে চোখে গুঁজে বায়নোকুলার ‘গলার দিকটা হালকা  ধূসর পিঠ আর ভ্রুরেখা নেই’ বলছে সুজয় মালাকার, অন্যদিকে তাক করে ফেলেছে আব্দুর কাদের শহিদুজ্জামান অথবা অপূর্ব নন্দীর ক্যামেরা।

 

‘এসবিসি’ টিম পঁচিশের অপূর্ব নন্দী থেকে শুরু করে ষাটের দেবদাস চন্দ বাবুদের প্রাণ ও প্রকৃতির সংগঠন। “শেরপুর বার্ড কনজারভেজন সোসাইটি” বছর কয়েক গঠিত  পাখি, বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি নিয়ে একটি স্বেচ্ছসেবী সংগঠন। ডাকের পক্ষে ভারি হলে সংক্ষেপে এসবিসি।

 

“আমাদের পাখি” সুজয়দের মুখপত্র। প্রকাশিত হয়েছে দ্বিতীয় সংখ্যা। কাজটি যৌথতার ফসল। সাংবাৎসরিক নানা তৎপরতার ভেতর দিয়ে চলছে প্রাণ ও প্রকৃতি নিয়ে সামাজিক আন্দোলন। প্রচ্ছদ পাখির নাম ‘পাতিকেস্ট্রল’। আমার আর আপনার পড়শি। অথচ দেখুন কী অবাক কাণ্ড সাত রাজার সাত রাজ্যের খবরাখবর নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠলেও আমি আমার পড়শিকে চিনি না। দুচোখ মেলে দেখিনি কোথায় তাহার বসত।

 

আমার সাথে পাখির সম্পর্ক নেই। পাখি চিনি না। গজনি, মধুটিলা, লাউচাপড়া, বাবলাকোনা, হারিয়াকোনা, ও ব্রহ্মপুত্র চরে শতশত পাখির বসত — কারো সাথে আমার মোলাকাত নাই। পিঞ্জিরা বন্দি করে কোন কোন পড়শিকে চিনি জানি। ছোলা খুদকুঁড়ো দিয়ে পুষি। বারান্দার রেলিঙে খাঁচা বন্দি পড়শি ডাকে, না কান্দে বুঝি না। ইতিউতি চায়। প্রিয় নাম ধরে ডাকে। আমোদিত হই। আমার লোভী চোখ চকচক করে। আহা!

 

এই তো  আমাদের পাখি প্রীতি!! নয়া নয়া সড়ক হবে — গাছ কাটো; বাড়ির উঠানে হাই রাইজিং হবে সুতরাং দাদার আমলে লাগানো আম কাঁঠাল লিচু গেরস্থালি গাছ কাটো। ইকোপার্ক হবে, শিশুদের দোলনা হবে, বাবুদের পিকনিক হবে, শতশত গাড়ি দাঁড়াবে কোথায় —গাছ কাটো। ভবন উঠবে? জলাশয় ভরে ফেলো। পুকুর ভরে ফেলো। পাখি আমাদের নিয়ে আমাদের আদ্যিখেতা আছে, কিন্তু সপ্রাণ কোন সম্পর্ক নেই।

 

পড়শি আমার উদ্বাস্তু। রিফিউজি। অনেক পড়শি বিপন্ন। তবে গুগোলে আছে। কী বলো? আমার সন্তানকে কী গুগোলেই পাখি দেখাতে হবে!!পড়শির ঘাড়ে হাটুগেঁড়ে বসেছি আমিও। এশুধু জর্জ ফ্লয়েডই বলছে না।  I can’t breathe পাখিও বলে। পাখিও বলছে অবিরত I can’t breathe.শুধু পড়শির ভাষা বুঝি না। আমার উচ্চকিত  শব্দের দাপটে তার ভাষা প্রান্তিকেরর  প্রান্তিক। মানুষের মাপ কাঠিতে মাপতে মাপতে সত্যি ভুলে গেছি Bird lives matters. প্রকৃতির সাথে ভেদ বিভেদে জড়িয়ে ভেবেছি সে বুঝি অপর— আমি নই। উন্নয়নের সূচকে হারিয়ে ফেলছি নদী পাহাড় বৃক্ষ আর পাখিদের বসতের কথা। সব জায়গায় চাই মানুষের প্রতিষ্ঠা।পাখি জীবনও জীবন।

 

আমি বোকার মতো এদিক ওদিকে খুঁজি কোথায় পাখি — এতো বগাডুবি বিল। শরতে কিছুটা জল থাকলেও হেমন্তের পর প্যাকপ্যাক বিলের কর্দমাক্ত উদলা শরীর হাঁ হয়ে থাকে আকাশের দিকে চেয়ে। বগাডুবি বিল পেরিয়ে উত্তর পশ্চিমে দিকে গজারমারি বিল, হাগড়াডোবা বিল, ব্যাঙমারি বিল, ধৌলিবিলসহ ছোট ছোট জলাভুমি আরো উত্তরে আর পশ্চিমে সীমান্তঘেঁষা গজনী, মধুটিলা ইকোপার্ক হয়ে ধানশাইল, শয়তান বাজার  লাউচাপড়া, দিঘলাকোনা হারিয়াকোনা, বাবলাকোনা আর পূর্বে মরিয়মনগর, বারোমারি হয়ে পানিহাটি পর্যন্ত পাহাড়ি বন, বাগান, বাদা, ঝোপ, মরাগাছের খোঁড়ল আর পাহাড়ি ছড়া শেরপুর অঞ্চলের পাখিদের আবাসের বিস্তার।

 

শীতের শেষে জলাভূমি শুকিয়েই জেগে ওঠে হলুদে হলুদে সয়লাব — বিস্তৃণ মাঠে সর্ষে ক্ষেত নেচে ওঠে দুলে ওঠে বাতাস আর রোদের ভেতর। আর গজারমারি বিলে সবুজে সবুজে প্রসারিত কোয়াশ ক্ষেত। প্রান্তিক কৃষকের চোখেমুখে একটু সুস্থির নিশ্বাস। এই সময়ে ঝাঁকে ঝাঁকে যেমন আবাসিক পাখি আসে তেমনি পরিযায়ী পাখির ওড়াওড়িতে পূনর্জন্ম ঘটে এই জলাভুমির। বললেন শহীদুজ্জামান।

 

সব জলাশয় শুকিয়ে যায় না। পায়ের পাতা ভেজানো কালোজলে বেড়ে ওঠে জলজ উদ্ভিদ, ফলমূল, সরীসৃপ কেঁচো, গুল্ম ও পিচ্ছিল শেওলা – এগুলোই পরিযায়ী পাখির খাদ্য। অতিথি পাখির বাড়িতে তখন তুষারে ঢাকা সাদা সাদা আরো সাদার শীতার্ত মাঠ — ঠিক এই সময়েই পরিযায়ী পাখি এই নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল পরিযায়ন করে  “ডায়াগোনালী ভাবে নয় — লম্বভাবে পরিযায়ন করে” শ্যামলারঙের বাংলাদেশে চলে আসে — এই সব কোয়াশ ক্ষেতে সর্ষে ক্ষেতে।

 

ঝিনাইগাতি সড়কের পাশেই বগাডুবি বিল। পায়েহাটা বাতরে নয়াবর্ষার জলে ফিনফিনিয়ে উঠেছে কোথায় ঢেঁকিশাক ঢোলমালিক আর বুকসমান  ছনকাশ আর উচণ্ডী। বর্ষার পরে বেড়ে ওঠে উচণ্ডী। শহীদুজ্জামান ‘ছোটছোট বেগুনি রঙের ফুল ফুটে ‘ বলে হাতে নিয়ে দেখালেন। মেয়েদের নাকফুলের মতো ছোট ছড়ানো বেগুনির নিচে সবুজ তোড়ায় ফুটে আছে থোকা থোকা উচণ্ডী ফুল। আর বাতর ছেয়ে আছে তিতবেগুন ফল আর কমলা রঙের অতসী ফুল রোদের তাপে কাৎ হয়ে আছে। ক’দিন গেলেই শুকিয়ে ঝুল থাকবে বাচ্চাদের তাগির মাথায় বেঁধে দেয়া ঘন্টার মতো। তখন কমলা রঙের অতসী শুকিয়ে  ঝনঝন ঝুনঝুন পায়েলের যখন বাজে।

 

পাড় উচু করে কৃত্রিম পুকুর। বড়বড় নিকানো জাল বাঁশের চার কোনায় গিট্টি খেয়ে বেঢপ পেট নিয়ে ঝুলে আছে।  তার ওপাশে বিলের তল্লাট। তল্লাটের পর নীলাকাশে মিশেছে মাটির সাথে। এখানে সাদা স্লিম বক ওড়ে ওড়ে মাছেরও লাগিয়া পরাণ করে হায় হায়। বিলের বাইরে আর পা রাখে না বক।ঘুরে ঘুরে উড়ে উড়ে সেই বিলের জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে প্রতিক্ষা।দুইপায়ে স্থীর ভাস্কর্যের মতো কানি বকের প্রতিক্ষা আর প্রতীক্ষা। নটে গাছটি মুড়ালেও বকের প্রতীক্ষা  আর ফুরাই না।

 

আমি তো ওই এক বকই চিনি। বইয়ে দেখা বক।  মাছ শরীর বকের ঠোঁটে এফোঁড় ওফোঁড় করে দাঁড়িয়ে থাকা সফল বক। সুজয় দেখিয়ে দিতে না পাড়লেও পটাপট বলে ফেলল গোটা সাতের বকের প্রজাতি। নোটবুকে  দেশি-বক ধুপনি-বক, গো-বক, বড়-বগা, মাঝলা বগা, ছোট বগা লিখলেও কী দিয়ে যে বকদের চিনব সেটি সুজয় না বললেও বুঝতে পারলাম বক ও বগা আলাদা। আবার নাকি বগলাও আছে। আমার বুঝি পাখিপাঠ শিকেয় উঠল।

 

১৯৩ প্রকার পাখির বাস এই শেরপুর অঞ্চলে। পাহাড় বনে যেমন আছে তেমনি ব্রহ্মপুত্র বিধৌত এলাকাও পাখির বসত। মাথা ঘাড় গলা বুক লেজ লেজের দৈর্ঘ ঠোঁট ও ভ্রুরেখা দেখে দেখে পাখি চেনা আমার কম্ম নয়। ডাক্তার চোখমেপে আরো একজোড়া চোখ নিলে কী হবে আব্দুর কাদির, সুজয় দূরে থাক — অপূর্ব নন্দী যার কিনা শরীরে এখনো হল হোস্টেলের শিক্ষার্থীর গন্ধ লেপ্টে আছে সেও দেখছি দূর আর উঁচু ডালে বসা অথবা মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখির আদল রঙ দৈর্ঘ দেখে পটাপট বলে দিচ্ছে পাখির নামধাম গোষ্ঠী পরিচয়ের বিষয় আশয়।

 

শুধু কী তাই ওদের দেখে পাখিরা পুচ্ছতুলে ঝুঁটি ঝাঁকিয়ে অথবা খোঁড়লে বসে মুখ উঁচিয়ে পোজ দেয় আর পটাপট ওরা  ক্লিক ক্লিক….। কাছাকাছি পাশাপাশি পাখি যদি আমার সামনে আসত তবে না হয় গলা ঘাড় বুক পেট ছেনে ছুনে দেখে শুনে বলা যেতো  এটি টিয়া পাখি — শুধু টিয়া না মদনা টিয়া কিংবা সবুজ টিয়া; দাঁড় করিয়ে ছবি তোলা যেতো  নিদেনপক্ষে সেলফি তোলা যেতো!

 

সেটি আর হলো না। কিন্তু পাখি তো আর আমাকে চিনল না। চিনল এসবিসি টিমকে। পূর্বজন্মে নিশ্চয় এরা পাখিদের ভাই বেরাদার ছিল। পাখিদেরও সমাজ আছে কেউ আবার খয়রা পাপিয়া, পাতি পাপিয়া, ছোট-নথ জিরিয়া, মেটেমাথা টিটি পরিযায়ী। কেউ আপনার আমার উঠানে ঘুরঘুর করা বক, তিলাঘুঘু, লাল রাজ ঘুঘু, হলদে পা হরিয়ালের মতো আবাসিক পাখি আরো আছেপাতি পাপিয়া পন্থ পরিযায়ী পাখি  আবার টইটই করে বেড়ানো টো টো কোম্পানির ম্যানাজার ভেগাবণ্ড পাখরা চুটকি লাটুয়া ভবঘুরে পাখি। বুঝেন ঠেলা। বই দেখে দেখে শুধু পাখি দেখা নয় চোখ মেলে পাখি দেখা — শুধু কী তাই মন দিয়ে পাখিমন বুঝতে পারলেই পাখি চেনা যায়! পাখি কাছে আসে।

 

এই ভবঘুরে টিমের খপ্পরে পড়ে আমার কী অবস্থা দেখুন! ভরঘুরের সঙ্গী বানানো  ষড়যন্ত্র এরা আমার মাথায় ইনস্টল করে দিয়েছে। শিগগিরই একটি ডিএসএলার প্রয়োজন।  অপূর্ব ভাট্টাচার্য  টেনেটুনে হিসেব কষে দেখালেন আপতত আশি হাজার টাকার মতো খচ্চা করলে একটি হিল্লে হতে পার। নইলে পাখি সমাজে ঢোকার বদলে আমি বহিরাগত — অনুপ্রবেশকারী । বার্ড ওয়াচার নই।

1 COMMENT

  1. খুব ভালো লাগলো পাখিদের কথা পড়ে।পাখি জীবন সত্যিই রোমাঞ্চকর।লেখক বন্ধুর অনন্য সুন্দর উপস্থাপনা।একরাশ মুগ্ধতা ও ধন্যবাদ ।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here