২০২০ সালে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন লুইজ এলিজাবেথ গ্ল্যুক। বাংলাদেশে তাঁকে নিয়ে প্রায় ঢোলশহরত যোগে শোরগোল আর মাতম শুরু হয়ে গেছে। সাম্প্রতিক আলাপ ও প্রলাপে মনে হচ্ছে এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাবার কথা ছিল পাশের বাড়ির পরিচিতি কোনো কাকু বা কাকির কিংবা কোনো বয়স্ক দাদুর; ষড়যন্ত্র করে গ্ল্যুককে পুরস্কার দেয়া হয়েছে। আদতে অবিতর্কিত পুরস্কারপ্রাপ্তের তালিকা খুব বেশি দীর্ঘ নয়। বাংলাদেশের বিখ্যাত একাডেমির কুখ্যাত কাণ্ডকারখানা সকলের জানা। অতএব… পৃথিবীখ্যাত অনেকেই এখনও পুরস্কার পান নি; যেমন : মিলান কুন্ডেরা। অনেকেই না পেয়ে লোকান্তরিত হবেন। অনেকে পেয়েও সাহিত্যিক দুনিয়া থেকে লোকান্তরিত হয়েছেন; প্রভাব হারিয়েছেন সাহিত্যের বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে। আমাদের স্বদেশী রবিঠাকুরের লেখাপত্র নিয়েই সন্দেহ দেখা দিয়েছিল ডব্লু বি ইয়েটসের মনে।
এমন অনেক বাঙালি লেখক আছেন সম্ভবত দুই-একটি বইয়ের জন্যই নোবেল পেতে পারতেন; কিন্তু পান নি। যেমন : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা সতীনাথ ভাদুড়ী। আদার ব্যাপারি হয়ে আমরা সেসব বিষয়ের তদন্তে যেতে পারব না। আপাতত নোবেল দাতাগোষ্ঠীর ভাষ্য শুনে নেই, গ্ল্যুকের লেখায় তাঁরা কী পেয়েছেন : “unmistakable poetic voice that with austere beauty makes individual existence universal.” ফ্ল্যাপ পড়া পণ্ডিত (FPP) আর না পড়ে পণ্ডিত (NPP) — দুটিই খুব বিপদজনক। আমরা তাই উদ্যোগ নিয়েছি গ্ল্যুকের কবিতার ধারাবাহিক উপস্থাপনার। কয়েক কিস্তিতে বেশ কিছু কবিতার অনুবাদ প্রকাশ করার পরিকল্পনা রেখেছি। এবারে থাকছে সায়মা মনিকার অনুবাদে ৬টি কবিতা।
কবি-পরিচিতি
১৯৯৩ সালে পুলিৎজার পুরস্কার আর ২০০৩- ২০০৪ সালে পোয়েট লরিয়েট সম্মান পেয়েই সবার পরিচিত হয়ে ওঠেন লুইজ এলিজাবেথ গ্ল্যুক। তাঁর কবিতার উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো শুধু বৌদ্ধিক দিকই নয় বরং কিছু চিত্র, রূপকল্প প্রভৃতি কেমন করে যেন খুব নিভৃতেই মনে জায়গা করে নেয়। তিনি যখন মানুষের জীবন নিয়ে কবিতায় চিত্রকল্প ব্যবহার করছেন, আমি ভাবছি, এটা কি ফুলের জীবন নিয়ে বলছেন! আর তাঁর পৌরাণিক কাহিনির অসামান্য ব্যবহার বিভিন্ন কবিতায় মুগ্ধ তো করেই, পাশাপাশি সেই সব পৌরাণিক চরিত্রকে নতুন করে পরিচয় করিয়েও দেয়। তাঁর সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বেশ মনোগ্রাহী। তাঁর ব্যক্তিজীবন ভীষণভাবে ব্যক্ত হয়েছ তাঁর কবিতায়। তাই কবিতাগুলো আমাদের হয়ে ওঠে খুব সহজে।
কানাগলি
আমি বললাম, “শোন, দেবদূত, আমাকে এই ক্ষুদ্রতা থেকে আলাদা করো।”
বিচ্ছিন্ন করো ঘৃণা থেকে, এই অবিচলিত আহার তালিকার গালাগাল থেকে,
যা আসলে খাদ্যশস্য, ভদকা আর টমেটোর
রসে সমন্বিত।
তুমি যে প্রেমের বীজ বপন করেছো
এই সব স্বস্তা অলংকারের মাধ্যমে।
সেখানে থেকে যাওয়াটা
থাকতে না চাওয়ার তীব্র বাসনা উদ্রেককারী।
আমি তার রক্তশূন্যতার প্রবণতায়
চার মাস যাবত খাবার তৈরি করলাম।
এবং এই দুশ্চরিত্রদের সাথে
মানসম্পন্ন সহাবস্থান করলাম। কিন্তু ও আমার প্রিয়, যদি এখন আমি তোমার হাত
তোমার চুল স্বপ্নে দেখি
তবে তা হলো সেই জ্বলজ্বলে কানাগলি।
আমি মনে করি তা যেন দাবার মতো।
মনের বিরুদ্ধে মন।
সকাল নয়টায় স্বগতোক্তি
এই ক্যান্টাবাইলে আসা
নয় তুচ্ছ কোন বিষয়।
তার জ্বরের সাথে
বাস করা শুরু
সেই ষোল বছর আগে।
আর এই ষোল বছর যাবত
অপেক্ষায় শুধু বসে থাকা
সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।
হাসি ছিল মুখে।
জানো, স্বপ্ন ছিল
হয় মরণ হোক
অথবা ও আবার
আমারই প্রেমে পড়ুক।
অন্য কারোর পায়ের
মোজার মতন ঘুরে দাঁড়াক।
ভেবেছি সে আছে।
ভেবেছি তার অনুপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে।
আর আজ সে একটা ডিমপোচের মতন
মৃত চোখে তাকিয়ে থাকলো।
তার টোস্টটিও অস্পৃশ্য হয়েই আছে।
*কেন্টাবাইল : এক ধরনের সংগীত যা যন্ত্রানুসঙ্গের সাহায্যে মানুষের কন্ঠস্বর নকল করতে ব্যবহার করা হয়।
লাল পপি
একটা মন আর অনুভূতি
থাকাই কেবল
যথেষ্ট তো নয়:
ওহ, আমার তো তা
আছে তবে,
তা আমায়
কেবলই শাসন করে।
স্বর্গে আমার
আছেন স্রষ্টা
যিনি অরুণ
আলোকচ্ছটায়
নিজেকে করেন উদ্ভাসিত
তাতে হ্রদয়ে
আমার অনল
যেমনি অনল
জ্বলজ্বল
তাঁর উপস্থিতি।
হ্রদয় ধারণ করার মতন
গৌরব আর আছে কোথা?
ও ভাইয়েরা বোনেরা,
তোমরাও ছিলে কি
আমারই মতন,
অনেক আগে
যখন তোমরাও
ছিলে মানুষ?
নিজেকে কখনও
দিয়েছো কি অনুমতি
শুধু একবার মুক্ত হবার,
যে আর কখনোই হবেনা মুক্ত?
কেননা আমি তাই বলছি
যা করছো তোমরা।
আর আমিই বলছি
কেননা আমিও এখন বদ্ধ।
একটি উপকথা
দুইজন নারী এলো
এক দাবি নিয়ে
জ্ঞাননিষ্ঠ এক
রাজার পদতলে।
নারী দু’জন
অথচ শিশু
মাত্র একজন।
রাজা নিলেন বুঝে
কেউ একজন তো
নিশ্চয়ই করছে মিথ্যাচার।
এবারে তিনি
যা বললেন, তা হলো
শিশুটিকে করা হোক
দ্বিখণ্ডিত ;
তবে কাউকেই
যেতে হবেনা আর
শূন্য হাতে।
সে তরবারি হাতে
হলেন উদ্যত।
ঠিক তখন
দুই নারীর একজন
স্বত্বত্যাগ করলেন:
এটাই ছিল ইশারা
এ অধ্যায়ের।
ধরো,
দেখলে তুমি তোমার মাকে
দুই কন্যার মাঝে
দ্বিখণ্ডিত হতে:
তখন তাকে বাঁচাতে
আর নিজেকে ধসাতে
তুমি কী করতে পারো–
তিনি তখন নেবেন চিনে
কে ছিল সত্যি
যে মায়ের দ্বিখণ্ডিত
হওয়ার বেদনা
পারেনি নিতে মেনে।
“ইথাকা”
প্রেমিকের বেঁচে থাকাটাই
মুখ্য নয়। সে তো প্রেমিকার
মনেই বেঁচে থাকে। সে তার প্রেমিকার
প্রেমের একাগ্রতার সুরে
অবিরাম সাদা কাফনের মতো
আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েই থাকে।
সে তো দুজন মানুষ ছিল।
সে একাধারে দেহ এবং স্বর ছিল, সহজ
চৌম্বকাবিষ্ট একজন জীবন্ত মানুষের, এবং তারপর
স্বপ্ন আর ছবি উদঘাটিত হতে লাগলো
যা সেই নারীর প্রেমেই আকৃতি পায়,
আক্ষরিকতায় বিশ্বাসী হলভর্তি করে
বসে থাকা মানুষের সামনে।
তুমি যে দুঃখ করো
প্রবঞ্চক সমুদ্র তাকে
চিরতরে নিয়ে যেতে
চেষ্টা করছে,
কেবল প্রথম মানুষটাকেই
নিতে পেরেছে,
যে আদতে আমার স্বামী ছিল, তোমার অবশ্যই
এই মানুষগুলোর জন্য দুঃখ করা উচিত: কেননা
তারা তো জানেনা যে
তারা যা দেখছে তাই সব নয়;
তারা এও জানেনা যে যখন কেউ এভাবে
ভালোবাসে, তখন কাফনের কাপড়ও
বিয়ের গাউনে পরিণত হয়।
ভালো লাগল। ধন্যবাদ সায়মা মনিকা।